অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৬৩: (১ম ভাগ)||

0
1036

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৩: (১ম ভাগ)||

১০৪.
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অরুণিকার রুমটি ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। ভাংচুরের শব্দ শুনে সবাই অরুণিকার রুমের দিকে ছুটে এলো। ঘরের অবস্থা দেখে সবাই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের সাথে লাগানো বারান্দার দরজার পেছনে চুপটি করে অরুণিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। আরাফকে দেখে সে এগুতে গিয়েই থমকে গেলো। তার সামনে আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। আরাফের কাছে যাওয়ার জন্য আহনাফকে ডিঙিয়ে যেতে হবে, আর এই মুহূর্তে আহনাফের রাগী ভাবমূর্তি দেখে তার আর সেই সাহস হচ্ছে না।

আজ অনেক বছর পর সবাই আবার আহনাফের সেই ভয়ংকর রূপটি দেখেছে। ছোটবেলা থেকেই তার বদমেজাজ। আর রেগে গেলে সে অনেক বেপরোয়া হয়ে উঠে। আর এই কয়েক বছরে সে নিজের রাগটাকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ কি এমন হলো, যার জন্য আহনাফ তার এতো বছরের নিয়ন্ত্রণটা হারিয়ে ফেলেছে? মাওশিয়াত কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই ইমন তার হাত ধরে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। আরাফ আরবান তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মামা, আপনি রুমে যান। আমরা দেখছি, কি হয়েছে!”

আরবান তালুকদার কোনো শব্দ না করেই ঘরে চলে গেলেন। আরাফ এবার ধীর পায়ে ভাঙা জিনিসগুলোকে পা দিয়ে সরিয়ে রুমে ঢুকলো। অরুণিকা আরাফকে কাছে আসতে দেখেই শব্দ করে কেঁদে দিলো। অরুণিকার কান্নার শব্দ শুনে মুহূর্তেই আহনাফের পুরো পৃথিবীটাই থমকে গেলো। তার সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ দু’টিও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে সে ধপ করে ভাঙা ফার্নিচারের উপর বসে পড়লো। মেঝেতে আয়না আর টেবিলের পেরেক গুলো ছড়িয়ে আছে। আরাফ সাথে সাথেই আহনাফকে ধরে বলল,
“এখানে বসেছিস কেন? উঠ, উঠ। চল, ঘরে চল।”

আহনাফ কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি লোভী, আমার মন-মানসিকতা খারাপ, আমি মিথ্যুক।”

“এসব কি বলছিস, আহনাফ?”

তূর্য ঘরে ঢুকে অরুণিকাকে দরজার পেছনে থেকে বের করে রুমের বাইরে নিয়ে এলো। রুম থেকে বের হয়েই অরুণিকা মাওশিয়াতকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাওশিয়াত তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। ইমন ইশারায় অরুণিকাকে অন্য রুমে নিয়ে যেতে বলল। অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার পর তাহমিদ অরুণিকার রুমের ফ্যানটা চালু করে দিলো। আরাফ আর ইভান মিলে আহনাফকে উঠিয়ে বিছানায় বসালো। তূর্য আর ইমন ভাঙা জিনিসগুলো উঠিয়ে একপাশে জড়ো করতে লাগল। ইভান রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
“এখন বল, হয়েছেটা কি!”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমার বলতে ইচ্ছে করছে না।”

তূর্য বলল,
“না বললে বুঝবো কিভাবে?”

তাহমিদ বলল,
“থাক, এখন কিছুই বলতে হবে না। তোর যাকে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে বলিস। কিন্তু মনের মধ্যে রাখিস না।”

আহনাফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। ইভান তার কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ও তোর সাথে বেয়াদবি করেছে?”

আরাফ ইভানের হাত ধরে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। সবাই আহনাফকে ঘিরে বসে আছে। সে তার অশ্রুগুলো আড়াল করার জন্য হাত দিয়ে মুখে ঢেকে রাখলো। অনেকক্ষণ পর সে বলল,
“অরু ইমানকে ভালোবাসে। ভুলটা আমারই হয়েছিল। আমি ওকে ইমানের সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলেছি। আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম, ইমান অন্য কাউকে ভালোবাসে, আর সেই মেয়েকেই বিয়ে করবে। কিন্তু সত্যটা তো ছিল, আমি এসব বিষয় নিয়ে ওর সাথে কোনো কথায় বলি নি।”

তাহমিদ বলল,
“ইমানকে ভালোবাসে এটা তোকে অরুণিকাই বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

ইমন জিজ্ঞেস করলো,
“ওদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে?”

“না, নেই। আজই প্রথম সে ইমানের সাথে একা কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। আর আজই সব সত্য জেনে ফেলেছে।”

“অদ্ভুত। আজই প্রথম কথা হলো, আবার ভালোও বাসে। এটা কেমন কথা?”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এটা অরুর কথা। ওকেই জিজ্ঞেস কর, কিভাবে ভালোবাসে! কি দেখে এতো ভালোবাসা উতলে পড়ছে যে আমাকে ও আজ লোভী, খারাপ মন-মানসিকতার লোক বলছে।”

ইভান বলল,
“যখন বলেছিল, তখন এই জিনিসপত্র না ভেঙে ওর গালে একটা চড় লাগিয়ে দিতে পারিস নি? চেয়ার-টেবিল না ভেঙে, ওর দাঁতগুলোই সব ভেঙে দিতি।”

আরাফ ইভানের দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই ইভান বলল,
“ভালো। এভাবেই তাকিয়ে থাক, আর ওকে আস্কারা দিয়ে মাথায় উঠাতে থাক। তারপর মাথায় উঠে একদিন সব চুল টেনে ছিঁড়ে দেবে।”

ইমন বলল,
“ভাই চুপ কর না। ওর এখনো এতো বোঝ-জ্ঞান হয় নি।”

এবার তূর্য আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ও তোকে এসব কেন বলেছে?”

আহনাফ বলল,
“ও ভাবছে আমি সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার জন্য ওকে বিয়ে করছি। ও আমাকে নাকি সব সম্পত্তি লিখে দেবে, তারপরও যেন আমি ওকে মুক্তি দেই। আমার নাকি মন-মানসিকতা খারাপ। তাই আমার ওর…”

এতোটুকু বলেই আহনাফ আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। সে বসা থেকে উঠে বলল,
“বাদ দে এসব।”

আহনাফ এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আহনাফকে রুম থেকে বের হতে দেখে অরুণিকা মাওশিয়াতের পেছনে আড়াল হয়ে গেলো। আহনাফ রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। এদিকে শতাব্দী লাইব্রেরী রুমে একা বসে আছে। ভাংচুরের শব্দ শুনে তাহমিদ ওকে ফেলেই চলে গেছে। বিশ মিনিট ধরে সে একা বসে ছটফট করছিল। বিশ মিনিট পর তাহমিদকে দেখেই সে শান্ত হলো। তাহমিদ শতাব্দীর হাত ধরে বলল,
“সরি, সরি। তোমাকে এতোক্ষণ একা বসিয়ে রেখেছি। সরি, শতাব্দী।”

শতাব্দী চোখের ইশারায় বোঝালো, সমস্যা নেই। তাহমিদ বলল,
“অরুণিকা আর আহনাফের মধ্যে হালকা পাতলা কথা কাটাকাটি হয়েছে। তুমি তো জানোই, ওরা টম এন্ড জেরির মতো যুদ্ধ করে। কিছুক্ষণ পর দেখবে, দু’জনই হাসাহাসি করবে।”

শতাব্দী এক দৃষ্টিতে তার মিষ্টি মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহমিদ যে তাকে মিথ্যে বলেছে, তা সে ভালো করেই জানে। কারণ শতাব্দী অরুণিকার সাথেই থাকে। আর অরুণিকা তার মনের সব কথা তার শতু আপুকে জানিয়ে দিয়েছে। অরুণিকা যে আহনাফকে ভালোবাসে না, ইমান নামের একটা ছেলেকে ভালোবাসে, এটাও শতাব্দী জানে। কেন যেন তার এই মুহূর্তে আহনাফের জন্য খারাপ লাগছে। সে নিজেও একটা সময় আহনাফের জায়গায় ছিল। হয়তো এক পাক্ষিক ভালোবাসাগুলো এমনই যন্ত্রণাদায়ক হয়। শতাব্দীও তো তার মিষ্টিমশাইকে এক তরফাই ভালোবেসে গেছে। কখনো তাহমিদ তার ভালোবাসায় সাড়া দেয় নি। যদিও শতাব্দী জানে তাহমিদ তাকে খুব ভালোবাসে।

গভীর রাত। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। শুধু ঘুম নেই আহনাফের চোখে। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে পিছু ফিরে দেখলো আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। আরাফ আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“অরু তোকে কি বলেছিল, আহু?”

আহনাফ শুকনো মুখে বললো,
“এটা শুনতে এসেছিস?”

“হ্যাঁ, কারণ আমি জানি, এটা না বললে তুই নিজেকে হালকা করতে পারবি না।”

আহনাফ হুট করে আরাফকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। অনেকক্ষণ পর সে নিজেকে শান্ত করলো আর বলল,
“এইটুকুন মেয়েটাকে কতো যত্ন নিয়ে স্পর্শ করতাম। মন খারাপ হলে ওর ছোট ছোট হাতগুলো ধরে রাখতাম, ও আমার আঙ্গুল ধরে কলকাতার অলিগলি হাঁটতো, ওর অন্ধকারে ভয় লাগলে আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়তো। মেয়েটা এখন সব ভুলে গেছে। বলছে, আমার নাকি ওকে স্পর্শ করার লোভ চড়ে বসেছে, তাই আমি ওকে বিয়ে করতে চাইছি।”

আরাফ হাত মুঠো করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে সে নিচে নেমে সোজা অরুণিকার ঘরে চলে গেলো। দেখলো অরুণিকা বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আরাফকে দেখে অরুণিকা তার পাশে এসে বলল,
“আরাফ, আমি…”

আরাফ হুট করে অরুণিকার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“তুমি এতো বড় হয়ে গেছে যে আজ আহনাফকে এতো বড় কথা বলেছ?”

অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আরাফ বলল,
“তোমার বিয়ে আহনাফের সাথে হবে, এটা আমার ডিসিশন ছিল। তুমি এখন আমাকে এতোটাই বাধ্য করেছো যে, তোমাকে জোর করেই এখন এই বিয়েতে বসাতে হবে৷ তোমার বাবা-মা, ভাই, দাদা-দাদী এদের মধ্যে কেউ যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে তোমাকে এই বিয়ে মানতেই হতো। আমাদের বংশে এর আগেও এমন হয়েছিল। দাদার বন্ধু তাহেরজানের একমাত্র মেয়ে আরূপা ইসলাম আত্মহত্যা করে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন। এখন তুমি কি ইমানের জন্য নিজেকে মেরে ফেলতে চাও?”

আরাফ নিচে পড়ে থাকা ভাঙা আয়নার একটা টুকরো অরুণিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“হাত কাঁটো।”

অরুণিকা অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ পেছন থেকে এসে অরুণিকার হাত থেকে আয়নার টুকরোটি নিয়ে আরাফকে বলল,
“পাগল হয়ে গেছিস, আরাফ?”

আরাফ বলল,
“পাগল হই নি। ওকে বল, মরতে।”

অরুণিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফ অরুণিকাকে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। তবুও এসব খারাপ চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দাও।”

আরাফ আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“বিয়ে তো হবেই। আর এই সপ্তাহেই আক্দ হবে। এখন ওর হাতে এই এক সপ্তাহ আছে। এখন ও মরে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিক।”

আহনাফ কিছু বলতে যাবে তখন আরাফ বলল,
“আমার মুখের উপর কিছু বলবি না। আমি শুধু দেখবো, ওর মনে ইমানের প্রতি ভালোবাসা কতোটুকু আছে। আমি দেখতে চাই, যেই ভালোবাসার জন্য সে তার জন্য প্রাণ দিতে পারবে এমন মানুষকে কষ্ট দিয়েছে, সেই ভালোবাসার জন্য সে নিজেকে কিভাবে ত্যাগ দিতে পারে।”

অরুণিকা পেছন থেকে এসে আরাফের হাত ধরে বলল,
“আমি ভুল করে ফেলেছি, আরাফ৷ তুমি যা বলবে, তাই হবে।”

আরাফ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“যার সাথে ভুল করেছো, তার কাছেই ক্ষমা চাও। আমি তোমাকে ততোদিন ক্ষমা করবো না, যতোদিন তুমি কবুল বলে আহনাফকে বিয়ে করবে না।”

আরাফ কথাটি বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে বলল,
“তুমি আরাফকে এসব কেন বলেছো!”

আহনাফ অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“সিমপ্যাথি নেওয়ার জন্য।”

অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “আহনাফ!”

“হ্যাঁ, তোমার তো এটাই মনে হচ্ছে এখন! স্বাভাবিক, মনে হওয়ারই কথা। আমার সম্পর্কে তোমার মনে তো খুব নেগেটিভিটি জন্মেছে। এখন তোমার সবকিছুতেই আমাকে নিচুস্তরের মানুষ মনে হবে। এন্ড লিসেন, মিস অরুণিকা চৌধুরী, আমি নিজেকে এক্সপ্লেইন করতে চাই না। তোমার আমাকে নিয়ে যা খারাপ ভাবার, ভাবো। আই ডোন্ট কেয়া’র।”

আহনাফ হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মনে মনে সে নিজেকেই বকছে। আজ তার দিনটাই খারাপ ছিল। প্রথমে রাগের মাথায় সে আহনাফকে উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছে, তাই সে দুপুর থেকেই অনুশোচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আহনাফের রাগ দেখার পর থেকে অরুণিকা তাকে সরি বলার সাহস পাচ্ছিল না। এখন আবার আরাফ তাকে চড় মেরেছে। বুদ্ধি হওয়ার পর সে এই প্রথম আরাফের চড় খেয়েছে।

অরুণিকা পুরো রাত বসে কেঁদেছে। কিন্তু কেউ তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এলো না। অন্য কোনো সময় সে অভিমান করে থাকলে, সবাই তার পেছনে ঘুরঘুর করতো। আর আজ সে একা বসে আছে। অরুণিকা মনে মনে ভাবছে,
“হয়তো আমি সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি তো ইমানকে এতোটাও ভালোবাসি না যে ওর জন্য নিজের প্রাণ দিয়ে দেবো। আমারটা তো শুধুই ভালো লাগা। কিন্তু যারা আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, আমি তাদেরকেই কষ্ট দিচ্ছি। আমি আসলেই অনেক খারাপ। আমার তো মরে যাওয়া উচিত।”

পরেরদিন বিকেলে আরাফ চেম্বার থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই রাহি তার সামনে এসে দাঁড়ালো। রাহিকে দেখে আরাফ অবাক হয়ে বলল,
“আপনি?”

রাহি অভিমানী কন্ঠে বললো,
“আমি কিন্তু তোমার সাথে রাগ করেছি।”

রাহির মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আরাফ অনেক অবাক হলো। রাহি বলল,
“ভুলে যেও না, আমরা এখন বন্ধু।”

আরাফ হেসে বলল,
“ওহ হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই তো।”

রাহি আরাফের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো। আরাফ বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“প্রথমত তুমি ভুলে গেছ, আমরা বন্ধু হয়েছি। দ্বিতীয়ত তুমি আমার আক্দে আসো নি। আবার এখন বন্ধুকে তুমি করে ডাকছো।”

আরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“প্রথমত আমি সত্যিই এই বন্ধুত্বটা সিরিয়াসলি নেই নি। দ্বিতীয়ত, সাহিল মির্জার আক্দ অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতিটা অসন্তোষজনক হতো। আর আমি সহজে কাউকে তুমি করে ডাকতে পারি না।”

আরাফের কথায় রাহি কিছুটা লজ্জা পেলো। রাহি বলল,
“জানো, আমি কেন তোমার সাথে বন্ধুত্ব কর‍তে চেয়েছি?”

“কেন?”

“কারণ তুমি অনেক ভালো। অনেক শান্ত, বিশ্বাসযোগ্য, সবার অনেক সাহায্য করো। তোমার মধ্যে কোনো অহংকার নেই।”

আরাফ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আমি মোটেও ভালো না। আমি যখন অশান্ত হই, তখন আমি সাহিল মির্জার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠি। আর আমি আমার বন্ধুদের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য। অন্যদিকে আমি একজন ডাক্তার, তাই সবাইকে শারীরিক আর মানসিকভাবে সাহায্যে করা আমার নীতি। আর অহংকর সবার মধ্যেই আছে। আমি হয়তো তা এখনো প্রকাশ করছি না।”

রাহি হেসে বলল,
“আর এই মুহূর্তে নিজের গুণগুলো লুকিয়ে তুমি আমার সামনে আরো ভালো হয়ে যাচ্ছো।”

আরাফ হাসলো। আর বলল,
“আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি এখন যাই।”

আরাফ গাড়িতে উঠতে যাবে তখনই পেছন থেকে আরাফের শার্টের কলার ধরে কেউ একজন তাকে পেছন দিকে টেনে এনে রাস্তায় ধাক্কা মারলো। আরাফ নিজেকে সামলে নিয়ে দেখলো সাহিল মির্জা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাহি সাহিলের হাত ধরে বলল,
“কি করছো তুমি, সাহিল?”

সাহিল রাহির হাত চেপে ধরে বলল,
“তুমি এখন আমার ওয়াইফ। আর আমার ওয়াইফের সাথে অন্য কারো সম্পর্ক থাকলে, আমি তাকে মুক্তি দিয়ে দেবো। এটা কিন্তু আমি তোমাকে আগেও বলেছিলাম।”

রাহি কিছু বলার আগেই সাহিল আরাফকে টেনে তুলে ধাক্কা মেরে তার লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“ওকে নিয়ে আসো।”

রাহি সাহিলকে আটকাতে যাবে তখনই সাহিল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“রাহি, এখন তুমি সাহিল মির্জার স্ত্রী। তাই নিজেকে কান্ট্রোল করো। নয়তো মিডিয়ায় শিরোনামে আসবে, সাহিল মির্জার ওয়াইফ, মৈত্রী গ্রুপের সদস্য আরাফ চৌধুরীর সাথে সম্পর্কে আছে। কেমন সম্পর্কে আছে, তা তো তুমিই ভালো জানো। আর মিডিয়া তো মাখন লাগিয়ে নিউজ তৈরি করবে। কিন্তু, যদি তোমার মাখামাখি আমার রেপুটেশনে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে, তাহলে আমি তোমাকে নয়, ওই আরাফকেই খুন করবো। মাইন্ড ইট।”

সাহিল এই কথা বলে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। এদিকে রাহি চিন্তায় পড়ে গেলো। সে কি করবে, কি করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। এখন সাহিল যদি আরাফের কোনো ক্ষতি করে বসে? রাহি কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি সানায়াকে ফোন দিয়ে সবটা জানালো। সানায়াও দেরী না করে ইভানকে ফোন করে আরাফের ব্যাপারে বললো। ইভানের তো এটা শোনার সাথে সাথেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে বাকিদের ফোন দিয়ে সানায়ার দেওয়া ঠিকানায় যেতে বলল।

আধা ঘন্টা ধরে সাহিল তার লোকেদের দিয়ে আরাফকে মেরেছে। আরাফের নাক ফেটে রক্ত পড়ছে। বেল্ট দিয়ে হাত-পায়ে এলোপাতাড়ি মারা হয়েছে তাকে। তাই এখন তার শরীর কাঁপছে। চোখের চশমটাও ভেঙে গেছে। তাই আশেপাশের সব কিছুই ঝাপসা লাগছে। মাথাটাও ভনভন করছে। তখনই আহনাফের কন্ঠ শুনে তার দেহে একটু হলেও প্রাণ ফিরলো। আরাফ ভালোভাবে কিছুই দেখছে না, শুধু হট্টগোলের শব্দ পাচ্ছে। সে মাথা তুলে ঝাপসা চোখে দেখলো অনেকগুলো মানুষ ধস্তাধস্তি করছে।

এদিকে মিনিট পাঁচেক ইমন, ইভান, তূর্য, আহনাফ আর তাহমিদ সাহিলের লোকেদের সাথে মারামারি করলো। আর সাহিল মির্জা পায়ের উপর পা তুলে তামাশা দেখছে। আহনাফ এবার সাহিলের লোকের নাক ফাটিয়ে দিয়ে সাহিলের দিকে এগিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরে বলল,
“তোর সাহস কি করে হলো, আমার ভাইকে এখানে উঠিয়ে এনেছিস!”

সাহিল অট্টহাসি হেসে মুহূর্তেই হাসি থামিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“ওপস, ভয় পেয়ে গেলাম।”

সাহিল উঠতে যাবে তখনই আহনাফ ইচ্ছেমতো সাহিলকে মারতে লাগলো। সাহিলের লোকেরা আহনাফকে আটকাতে যাবে তখনই ইভান তার পিস্তল তাক করে সাহিল মির্জার দিকে ধরলো। আর বলল,
“তোদের এম.ডিকে এক সেকেন্ডে উপরে পাঠিয়ে দেবো, যদি আরেকবার আমাদের গায়ে হাত লাগাস।”

সাহিল হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বললো। আর নিজেও আহনাফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরাফকে দেখিয়ে দিলো। সবাই আরাফকে দেখেই দৌঁড়ে গেলো। তাহমিদ আরাফকে উঠিয়ে বসালো। সামনে কয়েকটা গাড়ি থাকায়, তারা এতোক্ষণ আরাফকে খেয়াল করে নি। তারা আরাফের যেই অবস্থা করেছে, তা দেখে আহনাফের রাগ এবার সীমা ছাড়িয়ে গেলো। সে আবার এসে সাহিলের কলার ধরে বলল,
“তোকে আমি শেষ করে দেবো, সাহিল মির্জা।”

সাহিল আহনাফের হাত চেপে ধরে নিজের কলার থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তুমি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, আহনাফ চৌধুরী। কেউই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাদের পুরো পরিবার ধুলোয় মিশে গেছে। মিডিয়া বলছে, আমার বাবা এই খুনের জন্য দায়ী। কিন্তু কেউ আজ পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি কর‍তে পারে নি। উলটো আজ সে মন্ত্রীর পদে আছে। ইয়াং ম্যান, আমি যদি তোমাদের মেরেও ফেলি, আমার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ আমার হাতে অনেক পাওয়ার।”

ইভান সাহিলের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“তোর বাবাই আমাদের পরিবারকে খুন করেছে, তাই না?”

“যদি বলি, হ্যাঁ?”

“খুন করে ফেলবো তোকে!”

সাহিল মির্জা হেসে বলল,
“টাকা আমার সম্পদ, আর পলিটিক্স আমার সেইফগার্ড। আর এখন এই দুইটাই আমার হাতে আছে। তোমরা আমাকে খুন করলে, সবাই ফেঁসে যাবে। আর এর মধ্যে একা হয়ে যাবে তোমাদের অরুণিকা।”

আহনাফ আর ইভান অরুণিকার নাম শুনেই শান্ত হয়ে গেলো। সাহিল বলল,
“তোমরা একদিনের জন্য যদি জেলখানার কয়েদি হও, তাহলে তোমাদের অরুণিকা এক রাতের জন্য…”

সাহিলের মুখের ভাব দেখে পাঁচজনেরই রাগ উঠে গেলো। আরাফের মাথা ঘুরছে, তাই সে সাহিলের সব কথায় অস্পষ্ট শুনছে।

এদিকে সাহিলের কথা শুনে তূর্য চেঁচিয়ে বলল,
“তোর মুখ ছিঁড়ে দেবো আমি।”

“আগে তোমাদের বন্ধুর মুখটা ঠিক করে নাও। বেচারা, মার খেতে খেতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে। এখন হয়তো ডাক্তার সাহেবের জন্য আলাদা ডাক্তার লাগবে।”

তাহমিদ আর ইমন আরাফকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ইভান যাওয়ার আগে আরেকবার পিছু ফিরে সাহিলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“আমাদের অরুণিকাকে নিয়ে তুই বাজে কথা বলেছিস। এখন দেখ, তোর প্রাণ নিয়ে আমি কি করি!”

সাহিল ইভানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। ইভানও উত্তরে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

চলবে—-

(আগামীকাল ২য় অংশটা দেওয়া হবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here