অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৬৪||

0
1079

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬৪||

১০৬.
সানায়া ইভানের হাত ধরে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। এই হাতটা তার কাছে পরম বিশ্বস্তের হাত। পাহাড়ে উঠেই সানায়া হাসতে লাগলো। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”

“আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাই।”

ইভান মুগ্ধ দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যার কাছে প্রকৃতি দেখায় স্বপ্ন, সেই মেয়েটা কখনোই কৃত্রিম হতে পারে না৷ সে তো প্রকৃতির মতোই প্রাকৃতিক আর হাস্যজ্বল হবে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ইভানের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো। সানায়া ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইভান, তোমাকে হাসলেই ভালো লাগে। এভাবে মুখটা অন্ধকার করে রেখেছো কেন?”

ইভান হাসার চেষ্টা করতেই সানায়া বলল,
“বাসায় সবাইকে গম্ভীরমুখে দেখতে দেখতে আমি খুব বিরক্ত হয়ে গেছি। অন্তত তুমি আমার সামনে হাসলে আমার ভালো লাগবে।”

ইভান হেসে সানায়ার হাতটা ধরলো আর বলল,
“আই প্রমিজ, অন্তত তোমার সামনে আমি হাসবো।”

সানায়া ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইভানের স্পর্শ এতোটা গভীর যে তার ইচ্ছে করছে, এভাবেই কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেলে কোনো আপত্তি নেই।

তারা পাহাড় থেকে নামার সময় জুতার ফিতার সাথে পা আটকে সানায়া ধপ করে নিচে পড়ার আগেই ইভান তার বাহু আটকে ধরলো। সানায়া সাথে সাথে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“ইভান, আমি নিচে পড়লে মরে যাবো কিন্তু।”

ইভান সানায়ার ভীত চেহারা দেখে হেসে বলল,
“পাহাড়ের শেষ প্রান্ত এখনো তোমার দুই হাত দূরে আছে। এখান থেকে ধাক্কা দিলেও তুমি মাটিতেই পড়বে, পাহাড় থেকে নিচে পড়বে না। সো রিল্যাক্স।”

ইভান সানায়াকে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে নিচে তাকালো। দেখলো সানায়ার জুতোর ফিতে খুলে গেছে। ইভান নিজেই তার জুতোর ফিতে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এখনো ফিতে লাগানো শিখো নি!”

এদিকে সানায়া ইভানের ঘন চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। সে আজ পর্যন্ত শুনে এসেছে, মেয়েদের খোলা চুল ছেলেদের খুব আকর্ষণ করে। কিন্তু আজ সে নিজেকে দেখে ভাবছে, মাঝে মাঝে ছেলেদের চুলও মেয়েদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সানায়া হঠাৎ কি ভেবে ইভানের ঘন চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলো। ইভান মাথা তুলে ভ্রূ কুঁচকে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে সালাম করছি না যে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া দিচ্ছো।”

সানায়া হেসে বলল,
“আমার দোয়া নিয়ে রাখো। মাঝে মাঝে বন্ধুদের দোয়ায় সফলতা আসে।”

ইভান দাঁড়িয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“কেমন সফলতা আসবে?”

“এই ধরো, প্রেমে পড়বে, বা বিয়ের তারিখ ঠিক হবে।”

ইভান কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে সানায়ার দিকে ঝুঁকে বলল,
“তাহলে মনে করো তোমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে।”

এই কথা বলে ইভান পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। সানায়া ইভানের কথায় সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ইভানের পেছন পেছন এসে বলল,
“কি বললে? দোয়া কবুল হয়ে গেছে মানে? তুমি প্রেমে পড়েছো? নাকি তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? কোনটা?”

ইভান কিছু বললো না। সে হাসির রেখা মুখে টেনেই নিচে নামছে। সানায়া বিরক্তির সুরে বলল,
“বলো না, চুপ করে আছো কেন?”

ইভান সানায়ার হাত ধরে বলল,
“এতো প্রশ্ন করো কেন বলো তো? বললাম তো তোমার দোয়া কবুল হয়েছে। এখন বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো, কি হয়েছে।”

এদিকে কয়েকদিন পর অরুণিকা কলেজ থেকে বের হয়ে দেখলো তার কলেজ গেইটের সামনে ইমান দাঁড়িয়ে আছে। ইমানকে দেখেও না দেখার ভান করে অরুণিকা সামনে হেঁটে যেতে লাগলো। তখনই ইমান দৌঁড়ে তার কাছে এসে বলল,
“অরুণিকা, কেমন আছো?”

ইমান সামনে আসায় অরুণিকা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আপনি এখানে?”

“তোমার সাথে দেখা কর‍তে এসেছি।”

“কেন?”

“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”

“কথা থাকলে একদিন বাসায় আসেন। তারপর কথা হবে।”

অরুণিকা আবার হাঁটতে লাগলো। ইমান এবার তার পিছু পিছু হাঁটছে। অরুণিকা পেছন ফিরে ইমানকে দেখে বলল,
“আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন কেন?”

“চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”

অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না। আহনাফ আমাকে নিতে আসবে।”

ইমান হঠাৎ অরুণিকার অনুমতি ছাড়াই তার হাত ধরে বলল,
“মিথ্যে কথা কেন বলছো, অরু? আমি জানি আজ আহনাফ ভাইয়া আসবে না।”

ইমানকে মনে মনে পছন্দ করলেও অরুণিকার কেমন যেন ভয় লাগছে। সে কোনোভাবেই ইমানের সাথে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সে ইমানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আপনি আমার হাত ধরলেন কেন?”

“আহনাফও তো তোমার হাত ধরে। ওকে তো কখনো বারণ করো নি।”

“আহনাফ আর আপনি এক নন।”

“জানি, আমরা আলাদা। আর এটা জানি তোমার কাছে আমিই অনেক স্পেশাল।”

অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “মানে?”

ইমান মুচকি হেসে বলল,
“চলো, আমরা কোথাও বসি। তারপর সব কিছুর সমাধান হবে।”

অরুণিকা আবার এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আরাফের অভিমানী মুখ, আহনাফের রাগ, আর বাকিদের উপেক্ষা। অরুণিকা কোনোভাবেই তার কাছের মানুষগুলোকে কষ্ট দিতে চায় না। তাই সে মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না। যা বলার এখানেই বলুন। বলে এখান থেকে চলে যান।”

ইমান কিছু একটা ভেবে বলল,
“ওকে ফাইন। বলছি, শুনো।”

“হুম, শুনছি। বলুন।”

“আগে আমার দিকে তাকাও।”

অরুণিকা ইমানের দিকে তাকাতেই ইমান বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, অরু।”

অরুণিকা ইমানের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। তার মনে অজানা ভালোলাগা কাজ করছে। তবুও সে এই ভালো লাগাটি প্রকাশ না করে বিষ্ময়সূচক কন্ঠে বলল,
“এটা আপনি আমাকে কেন বলছেন?”

“তোমাকে না বলে কাকে বলবো?”

“দেখুন, আমার আপনাকে ভালো লাগে না।”

ইমান হেসে বলল, “মিথ্যে বলছো কেন, অরু?”

“আমি কেন মিথ্যে বলবো?”

“আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো। আমি এটাও জানি তুমি আমাকে ভালোবাসে। আর এও শুনেছি, তুমি আহনাফকে বিয়ে করতে চাও না।”

অরুণিকা অবাক হলো। সে মনে মনে ভাবলো,
“এই কথা ইমান কিভাবে জানলো? আমি তো ওকে কখনোই এই কথা বলি নি। আর বাড়ির বাইরে তো কেউই এই বিষয়ে কিছুই জানে না। আরাফরা তো কখনোই এই ব্যাপারে ইমানকে জানাবে না, কারণ ওরা তো এই সম্পর্কই মানছে না। আর মৌ ভাবী তো ইমানকে ভালোভাবে চেনেও না। তাহলে ইমানকে এই কথা কে বলেছে? আরবান মামা? কিন্তু উনি কেন শুধু শুধু ওকে এসব বলতে যাবেন? এটা বলে উনার কিইবা লাভ হবে?”

১০৭.

আজ শহরে বৃষ্টি নেমেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থেকে ঝাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সানায়া গাড়ি থামিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়লো। ইভান সানায়াকে আটকাতে পারলো না। শহরের নিস্তব্ধ পথ, গোধূলিবেলা আর ঝুম বৃষ্টি। একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ইভান তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছন থেকে ছাতা বের করে সানায়ার কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি কিন্তু তোমার গাড়ি নিয়েই বাসায় ফিরবে। আমি তোমাকে আর আমার গাড়িতে উঠাবো না।”

সানায়া বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বলল, “কেন?”

“আমার সিট ভিজে যাবে তাই।”

সানায়া ইভানের হাত থেকে ছাতা কেঁড়ে নিয়ে ছাতাটা বন্ধ করে দিলো। ইভান সানায়ার এমন কান্ডে খুব বিরক্ত হলো। সানায়া ছাতা নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“দেখো এটা রাস্তা, তোমার বাড়ির গার্ডেন না যে এভাবে লাফাচ্ছো!”

সানায়া হেসে বলল,
“এখন কি আমাকে গাড়িতে উঠাবে না? তুমিও তো ভিজে গেছো। আমার ক্ষেত্রে যদি এমন নিয়ম থাকে, তাহলে তোমার ক্ষেত্রে কেমন হবে?”

ইভান কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, তখনই সানায়া ইভানের হাত ধরে বলল,
“আমি যতোদূর জানি, তুমি মানুষটা প্রাকৃতিক। তাহলে এতো চমৎকার মুহূর্ত হারিয়ে ফেলতে চাও কেন?”

ইভান সানায়ার মুখে এমন কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। সানায়া ইভানের ভেজা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“কি ভাবছো?”

ইভান সানায়ার প্রশ্নে ভাবনা থেকে বেরিয়ে সানায়ার হাত ধরে তাকে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে গেলো। সানায়া ইভানের এমন কান্ডে প্রচুর অবাক হলো। সানায়া কিছু বলার আগে ইভান বলল,
“তোমার দেখছি, চমৎকার মুহূর্ত সৃষ্টি করার খুব লোভ চড়ে বসেছে। আজকাল তোমার মনটাও হয়তো নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।”

সানায়া আমতা-আমতা করে বলল,
“এমন কিছু না।”

ইভান সানায়াকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“তোমাকে আজ একটা চমৎকার মুহূর্তের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। পরিচিত হতে চাও?”

সানায়ার গলায় কথা আটকে গেছে। সে কখনো কোনো পুরুষ মানুষের এতো কাছে আসে নি। আর আজ সেই কাছে আসার অনুভূতি তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তুলছে। সানায়া ভাবছে, সে কি আজ ইভানকে বেশি পেয়ে যাচ্ছে?

অনুভূতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া ভালো। কিন্তু আজ তার অনুভূতি সীমা হারাচ্ছে। এদিকে ইভান সানায়ার মুখের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে উষ্ণ কন্ঠে বলল,
“আমি আগে কখনো বৃষ্টি সিক্ত কোনো মেয়ের দিকে তাকাই নি। আজ প্রথম দেখছি।”

সানায়া কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কেন দেখো নি?”

“সময়-সুযোগ একটাও হয় নি।”

“আজ হয়েছে?”

“তুমি সাথে থাকলে সব সুযোগ সহজে ধরা দেয়, সব সময় হাতের মুঠোয় চলে আসে।”

সানায়া লাজুক হেসে মাথা ঝুঁকালো। ইভান সানায়ার হাসি দেখেই বুঝলো, সানায়ার অনুভূতি শুধু বন্ধুত্বের মাঝে আবদ্ধ নেই, বহুদূর গড়িয়েছে। হয়তো সে প্রকাশ করার কোনো ভাষা পাচ্ছে না, হয়তো বা সাহস বা সুযোগ হচ্ছে না।

মিনিট পাঁচেক এভাবেই তারা একে-অপরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ গাড়ির হর্ণ শুনতেই ইভান সানায়াকে টেনে রাস্তার একপাশে চলে গেলো। আর কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ি তাদের অতিক্রম করে চলে গেলো। সানায়া বলল,
“এই রাস্তায় গাড়ি কম আসা-যাওয়া করে। তাই আমার এই জায়গাটা খুব প্রিয়।”

ইভান অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সানায়া তার কাছে এসে তার মুখটা নিজের দিকে ফেরাতেই ইভান সানায়ার হাতের দিকে তাকালো। সানায়া ইভানের এমন তাকানো দেখে হাত সরিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। হয়তো সে একটু বেশিই অধিকার খাটিয়ে ফেলছে। তারা তো শুধুই বন্ধু। বন্ধু হয়ে কি এতো অধিকার খাটানো উচিত? কিন্তু সানায়া তো ইভানকে শুধু বন্ধু ভাবে না। খুব কাছের মানুষ ভাবে। খুব আপন মানুষ ভাবে। তার ইচ্ছে করে সব বাঁধা ভুলে ইভানকে নিজের কাছে রেখে দিতে।

তারা এখন প্রতিদিনই দেখা করে। আর দিনশেষে ইভান যখন সানায়াকে বিদায় দেয়, সেই মুহূর্তটা সানায়ার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে তার খুব কান্না আসে। তবুও পরেরদিন তো আবার দেখা হবে, এই ভেবে আবার নিজের মনকে বুঝিয়ে নেয়।

ইভান গাড়ির পেছন থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে সিটটা প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে নিলো। তারপর সানায়াকে বসতে বললো। সানায়া মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে বসলো। ইভানও গাড়িতে উঠে বসে বলল,
“গোধূলি বেলায়, মাঝ রাস্তায়, বৃষ্টিস্নাত মুহূর্তে একটা সুদর্শন যুবকের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার অনুভূতিটা প্রতিটি যুবতীর কাছে একটা চমৎকার মুহূর্ত। আর মানুষটা যদি প্রিয় হয়, তাহলে সেই অনুভূতি মিষ্টি হাসিতে প্রকাশ পায়। কিন্তু যদি অপ্রিয় হয়, তাহলে এমন মুহূর্তে কোনো পুরুষের স্পর্শে চোখ ভারী হয়ে আসে। আর তোমার চোখ দেখে মনে হলো, তুমি খুব মজা পেয়েছো।”

ইভানের শেষ কথাটা শুনে লজ্জায় সানায়ার মুখটা লাল হয়ে গেলো। ঠান্ডার মধ্যেই সানায়ার মুখটা গরম হয়ে যাচ্ছে। ইভান সানায়ার লাজুক ভাব দেখে তার গাল টেনে ধরে বলল,
“তোমার এই হাসিটা আমার বেশি ভালো লাগে। বড় ঘরের মেয়েদের হাবভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভাব তোমার মধ্যে আছে। আর এটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে।”

সানায়া মনে মনে লাফাতে লাগলো। আজকে ইভানের সব কথায় যেন তাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিচ্ছে। আচ্ছা, ছেলেটা আজ এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে কেন? সানায়া বিড়বিড় করে বলল,
“থু থু থু, নজর না পরুক।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি করলে তুমি এটা?”

সানায়া অবাক হয়ে বলল,
“কখন, কি করলাম আবার?”

ইভান শব্দ করে হাসলো। সে আর কিছু না বলে গাড়িতে চাবি ঘুরালো।

এদিকে উপমা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ডেস্কে এসে বসলো। আজকাল রিয়াজুর রহমানের কাজকর্ম তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। সারাদিন তাকে এটা-সেটা বলে নিজের কেবিনে ডেকে নিবে, আর তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদিও সে রিয়াজুর রহমানের পারসোনাল এসিস্ট্যান্ট, তাই বলে কি এসিস্ট্যান্টকে এভাবে দেখে থাকতে হবে। ডেস্কে বসে উপমা হাঁসফাঁস করছিল তখনই রিয়াজুর রহমান তার চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। উপমা কারো উপস্থিতি পেয়ে পেছন ফিরে রিয়াজুর রহমানকে দেখে ভড়কে গেলো। রিয়াজুর রহমান দুই হাত সামনে এনে বললেন,
“রিল্যাক্স, রিল্যাক্স। এভাবে হনহনিয়ে আমার কেবিন থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণটা জানতে পারি?”

উপমা দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো,
“আপনার এভাবে তাকিয়ে থাকাটা আমার পছন্দের না।”

“পুরুষ মানুষ মেয়ে লোকের দিকে তাকাবেই। এটা স্বাভাবিক। বাট ট্রাস্ট মি, উপমা, আমি খারাপ দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকাই না। এটা ভালো দৃষ্টি। শুভ দৃষ্টি।”

উপমা রিয়াজুর রহমানের দিকে সেকেন্ড খানিক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডেস্ক থেকে বেরিয়ে চলে এলো। রিয়াজুর রহমান উপমার পিছু নিতে গেলে নিয়াজ হোসেন তার হাত ধরে আটকালো আর বলল,
“রিয়াজ, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখ। তুই বাস্কার গ্রুপের এম.ডি।”

রিয়াজুর রহমান নিয়াজ হোসেনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উপমার পিছু পিছু নেমে গেলো। উপমা নিচে নামতেই সিঁড়িতে তূর্যকে দেখে থমকে গেলো। তূর্যও উপমাকে দেখে দৌঁড়ে উপমার কাছে এসে বলল,
“উপমা, কেমন আছো তুমি? কতোদিন পর তোমায় দেখলাম। আমার ফোন ধরো না কেন তুমি? পাঁচমাস হয়ে গেছে, এখন তো অন্তত বাড়ি ফিরে আসো। আর কতো অভিমান রাখবে?”

উপমা কিছু বলার আগেই রিয়াজুর রহমান পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তূর্য রিয়াজুর রহমানকে দেখে অবাক হলো। রিয়াজুর রহমান হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“হাই, আমি রিয়াজুর রহমান, উপমার বস।”

রিয়াজুর রহমান অদ্ভুত দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়েছে, যা দেখে তূর্যের খুব সন্দেহ হলো। এদিকে উপমা তূর্যের পাশ কাটিয়ে বের হতে যাবে তখনই তূর্য তার হাত ধরে বলল,
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”

উপমা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“অন্য কোনো একদিন। আমার এখন তাড়া আছে।”

উপমা এই বলে চলে গেলো। তূর্য তার পিছু নিতে গেলে রিয়াজুর রহমান বললেন,
“আমি খুব সোজাসাপ্টা কথা বলা পছন্দ করি।”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে রিয়াজুর রহমানের দিকে তাকালো। রিয়াজুর রহমান তার সামনে এসে বললেন,
“আমি উপমাকে পছন্দ করি।”

রিয়াজের কথা শুনেই তূর্যের রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো। সে শান্ত কন্ঠে বললো,
“আপনি পাগলের প্রলাপ বকছেন, মিস্টার রিয়াজ।”

রিয়াজুর রহমান হেসে বললেন,
“অবশ্যই। আরূপার পর এই প্রথম কেউ আমার মনে স্থান করে নিয়েছে। প্রলাপ বকা তো স্বাভাবিক।”

“সি ইজ মাই ওয়াইফ, মিস্টার রিয়াজ।”

“আই নৌ, আই নৌ। বাট মনে হয় না তোমাদের সম্পর্কে আর কিছু বাকি আছে।”

তূর্য হাত মুঠো করে রিয়াজের দিকে এগিয়ে এলো। আর বলল,
“ওর দিকে নজর দিলে আমি আপনার প্রাণ নিয়ে নেবো।”

রিয়াজুর রহমান অট্টহাসি হেসে বললেন,
“আগে নিজের প্রাণ বাঁচাও, তূর্য। তোমাদের জীবন ঝুঁকিতে আছে। স্পেশালি অরুণিকার। আর মুরশিদ জুবাইয়ের আমার বন্ধু। ওর কাছ থেকে আমি সব শুনেছি, জেনেছি। কিন্তু আদিলের মৃত্যুর রহস্য একটা রহস্য হয়ে রয়ে গেলো।”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। রিয়াজ বললেন,
“আমি অনেক কিছুই জানি, যা তুমি জানো না। বরং তোমরা কেউই জানো না। আর উপমার জন্য আমি তোমাকে সেই তথ্যটা দিতে চাই।”

“কোন তথ্য?”

“আমি নিশ্চিত নই, তবুও আমার মনে হচ্ছে আরূপার মৃত্যুর সাথে তোমাদের পরিবারের খুন হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।”

“এটা আপনি কিভাবে বুঝলেন?”

“আরূপা, আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল। আমি একাই ওকে ভালোবেসেছিলাম, আর ও ভালোবাসতো একটা সাধারণ দোকানদারকে। ওর আত্মহত্যার পর তোমাদের বাড়িতে অনেক কিছুই ঘটেছিল। আর তার মধ্যে একটি হলো, সেই দোকানদারকে বাসায় এনে মারধোর করা। লোকটা তোমাদের বাড়িতেই সবার সামনে নিজের গলায় নিজেই ছুরি চালায়। আর আমার যা মনে হয়, এই পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটা, সেই দোকানদারের মৃত্যুর জের ধরেই হয়েছিল। আর সেই রাতে সবাই বাড়িতে ছিল। স্বাভাবিকভাবে সবাই বাড়িতে থাকার কথা নয়। জিসান, জিহান ওরা তো ক্যাম্প থেকে ফিরেছিল। তাহলে বুঝা উচিত, সেদিন বাড়িতেই কেউ একজন ছিল, যে এসব তথ্য বাইরে দিয়েছে। আর তোমাদের বাড়িতে যারা ছিল সবাই মারা গেছে, এটা তোমরা কিভাবে নিশ্চিত হয়েছো? তোমাদের বাড়ির গুপ্তচর তো এখনো বেঁচে আছে।”

“কে?”

“রহমতুল্লাহ।”

“মানে? উনি তো আমাদের বাড়িতে থাকতো না। ইনফ্যাক্ট উনাকে আমরা আগে কখনোই দেখি নি।”

“রহমতুল্লাহকে দেখো নি, কিন্তু রুকনকে তো দেখেছো!”

“রুকন!”

তূর্য কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও আমাদের বাড়ির দারোয়ান ছিল।”

“রহমতুল্লাহর ছেলে।”

তূর্য এই কথা শুনে অবাক হলো। রিয়াজ আবার বললেন,
“সেদিন তোমাদের বাড়ির সব দারোয়ান নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের সবার পরিবার তাদের খোঁজ নিতে আসে৷ শুধু রুকনের খোঁজ নিতে কেউ আসে নি। সবাই মনে করতো, সে অনাথ। কিন্তু সে এখনো বেঁচে আছে। আর আমি গত দু’দিন আগেই এই খবর পেয়েছি। তোমাকেই প্রথম জানালাম। আমার মনে হয় রুকনকে ধরতে পারলে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”

তূর্যের মাথাটা ঘুরছে। সব কিছুই গোলকধাঁধার মতো হয়ে গেছে। রিয়াজ তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“লিসেন ইয়াং ম্যান, আমি যা করছি উপমার জন্য। কারণ আমি শিউর, আদিল সেই লোকটাকে চিনতো, যে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। আর তাই আদিলকে মেরে ফেলা হয়েছে। আর আমার ধারণামতে এবার তাদের টার্গেটে আছে, আহনাফ।”

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here