#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৭০||
#রহস্যের_উন্মোচন
১১৪.
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই আহনাফের ঘুমটা ভেঙে গেলো। চেয়ার থেকে মাথা তুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে লাইব্রেরিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার পাশের চেয়ারে তূর্য মাথা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে সামনের সোফা থেকে একটা কুশন এনে তূর্যের মাথার নিচে দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে লাইব্রেরি থেকে বের হলো। সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে তখনই মাওশিয়াতের চেঁচামেচি শুনে থমকে গেলো। অরুণিকার রুম থেকেই চেঁচামেচির শব্দটা আসছে। আহনাফ সেদিকে যেতেই আরাফ আর ইভানও নিজেদের রুম থেকে বের হলো। তারা মাওশিয়াতকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই অরুণিকার রুমে ঢুকে তিনজনই স্তব্ধ হয়ে গেলো। মাওশিয়াত শতাব্দীকে মেঝে থেকে উঠানোর চেষ্টা করছে। আর ঘরে কোথাও অরুণিকা নেই। আহনাফ পুরো ঘরে অরুণিকাকে না পেয়ে অন্য ঘরে তাকে খুঁজতে গেলো। এদিকে ইভান আর মাওশিয়াত শতাব্দীকে উঠিয়ে হুইলচেয়ারে বসালো। শতাব্দীর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। তার চোখেমুখে ভীতি। সে নিজের সব শক্তি দিয়ে কন্ঠ থেকে শব্দ বের করার চেষ্টা করতে চাইছিলো। কিন্তু একটা শব্দও বের করতে না পেরে, সে কেঁদে দিলো। শতাব্দীর ছটফটানো দেখেই সবাই বুঝলো ভালো কিছু হয় নি। আরাফ বারান্দায় গিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলো, বারান্দায় অরুণিকার পায়ের স্যান্ডেলটা পড়ে আছে। স্যান্ডেলটা হাতে নিয়ে সে রুমে এসে দেখলো, অন্য স্যান্ডেলটি ঘরের ভেতরে। আরাফ শতাব্দীর সামনে বসে বলল,
“শতাব্দী, রাতে কি কেউ ঘরে এসেছিল?”
শতাব্দী চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললো। আরাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “অরু কোথায়?”
শতাব্দী বারান্দার দিকে তাকালো। ইভান বারান্দায় এসে ভালোভাবে আশেপাশে তাকালো। তারপর রুমে ঢুকতেই আহনাফ অরুণিকার ঘরে এসে বলল,
“অরু কোথাও নেই।”
তাহমিদ, তূর্য আর ইমনও ততোক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তাহমিদ নিচে নেমে বাইরে পাহারারত পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলো, অরুণিকাকে দেখেছে কিনা। কিন্তু তারা কাউকে ঘরের আশেপাশে আসতেও দেখে নি, যেতেও দেখে নি। তারা সবাই চিন্তিত হয়ে বসার ঘরে পায়চারি করছে। মাওশিয়াত শতাব্দীর হাত ধরে একপাশে বসে আছে। হঠাৎ আরাফের ফোনে একটা কল এলো। আরাফ নম্বর না দেখেই কল রিসিভ করে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“হ্যালো, হ্যালো, অরু?”
ওপাশ থেকে অট্টহাসির শব্দ ভেসে এলো। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আরবান মামা?”
আরবান নামটা শুনেই ইমন আরাফের কাছ থেকে ফোন টেনে নিয়ে কলটা লাউডস্পিকারে রাখলো।
আরবান তালুকদার বললেন,
“হ্যাঁ, আমি আরবান তালুকদার। তোমার মামা।”
ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অরু কোথায়?”
আরবান তালুকদার আবার হেসে উঠলেন। আর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন,
“বাব্বাহ, আমাদের ছোট্ট সোনামণির জন্য তোমাদের কতো চিন্তা! জেনে বেশ ভালোই লাগছে। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী বেঁচে থাকলে নেহাত বলতেন, আমার মেয়ে ভাগ্য নিয়ে এসেছে। সৌভাগ্যবতী অরুণিকা।”
তূর্য চেঁচিয়ে বললো,
“কথা না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলুন, অরুণিকা কোথায়?”
“অরুণিকা চৌধুরী, ওরফে তোমার টুইংকেল তার ছোট্ট জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন সে আল্লাহকে স্মরণ করছে। খুব শীঘ্রই সে তার বাবা-মার কাছে চলে যাবে।”
আহনাফ এই কথা শুনে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাগের মাথায় সামনে থাকা ছোট টেবিলটিতে সজোরে লাথি মারলো। ইমনের হাত থেকে ফোন টেনে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“অরুর যদি কিছু হয়, আমি তোকে খুন করবো।”
আরবান তালুকদার হেসে বললেন,
“আগে তো তোমার ছোট্ট বউকে বাঁচাও। তারপর এমন ভারী ভারী বাক্য শুনবো। এখন তেমন একটা মজা পাচ্ছি না। মজা তো তখন হবে, যখন তোমরা ছ’জন কুকুরের মতো দৌঁড়াবে, আর ওদিকে আমাদের ছোট্ট সোনামণি বিড়ালের মতো মিউ মিউ….”
আহনাফ আরবান তালুকদারের পুরো কথা শুনলো না। রাগের মাথায় ফোনটা মেঝেতে আছাড় মারলো। আরাফ আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ফোন ফেলে দিলি কেন? অরু কোথায় আছে, এটা তো জানতেই পারলাম না।”
আহনাফ আরাফের কলার ধরে বলল,
“তোর রুমের পাশেই অরুর রুম ছিল। তুই একটুও বুঝতে পারিস নি? তোর তো কোনো মাথা ব্যথায় নেই।”
তূর্য আহনাফকে একপাশে টেনে আনলো। আরাফ স্তব্ধ হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন আরাফের কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলল,
“ওর মাথা ঠিক নেই। অরুণিকার চিন্তায় উল্টাপাল্টা বকছে।”
আরাফ ইমনকে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আমার চেয়ে বেশি ওর চিন্তা হচ্ছে? অরু আমার প্রাণ। ও আমার বাচ্চা। আমি বাবার মতো ওকে বড় করেছি। আমি শরীর আর মনের সব শক্তি খরচ করে ওকে এতো বড় করে তুলেছি। তুই কি বুঝবি আমার মাথা ব্যথা?”
ইভান চেঁচিয়ে বলল,
“তোরা চুপ করবি এখন? এভাবে ঝগড়া করে কি কোনো লাভ হবে?”
এবার তাহমিদ বলল,
“কেউ বারান্দা টপকে অরুণিকার ঘরে এসে ওকে নিয়ে গেলো, আর বাইরের পাহারারত পুলিশ কর্মকর্তাগুলো কি সারারাত ঘাস কেটেছিল?”
এদিকে ইমান ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকার মায়াভরা ছবি দেখেই যেন তার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। হঠাৎ তার সহকর্মী ছাদে এসে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“ইমান, তোমার জন্য খারাপ সংবাদ আছে। অরুণিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
ইমান কথাটি শুনেই চমকে উঠলো। সে সাথে সাথেই আরাফকে ফোন করলো। কিন্তু আরাফের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। সে এরপর ইমনকে ফোন করলো। ইমন পুরো ঘটনাটি ইমানকে বলতেই ইমান সব বুঝে গেলো। ইমান ইমনের কল কেটে আরেকটা নম্বর ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই ইমান চেঁচিয়ে বলল,
“কি করতে চাইছো তুমি, বাবা? অরুর কিছু হলে আমি তোমাদের কাউকে ছাড়বো না।”
ওপাশ থেকে শীতল কণ্ঠে ইমানের বাবা বললেন,
“এটাই হওয়ার ছিল, ইমান। মেয়েটা তো তোমার চেয়ে বেশি অন্য কাউকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাহলে ওর বাঁচা-মরায় তোমার কিইবা আসে যায়?”
“আমি ওকে ভালোবাসি। তাই আমার আসে যায়।”
“ও তোমাকে ভালোবাসে না। আর তোমার ওই মেয়ের নাম মাথা থেকে মুছে ফেলা উচিত।”
ইমান রাগী কন্ঠে বললো,
“অনেক করে ফেলেছো। এবার আর না। আমি সবাইকে তোমাদের কথা জানিয়ে দেবো। তোমরা কারা কারা জড়িত আছো, সবাইকে ধরিয়ে দেবো।”
ওপাশের লোকটি হালকা হাসলেন। তারপর বললেন,
“রক্তের সম্পর্ক সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তুমি পারবে না, বাবা। আমি তোমাকে কতো কষ্ট করে বড় করেছি। তুমি তোমার বাবার ক্ষতি করতে পারবে না।”
ইমান কল কেটে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবা নামটা দেখে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। পরক্ষণেই তার চোখের সামনে অরুণিকার মায়াবী মুখটা ভেসে উঠলো। সে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। তারপর আহনাফের নম্বরে কল দিলো। আহনাফ কল রিসিভ করতেই ইমান আহনাফকে কিছু বলতে না দিয়েই বলতে লাগলো,
“আমি জানি, আদিল ভাইয়াকে কে মেরেছিল। আমি জানি, আরবান তালুকদারের সাথে কে জড়িত আছে। আমি জানি রহমতুল্লাহ কার কথায় আপনাদের পরিবারের সবাইকে মেরেছিল। আমি এটাও জানি আজ কি হবে। আর অরুণিকা কোথায় থাকতে পারে। আমি সব জানি।”
আহনাফ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমান তাকে সবকিছুই সংক্ষেপে বললো। আহনাফ বলল,
“আমি কাল রাতেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তুমি যে তার ছেলে, এটা ভাবতেও পারি নি। এখন অরুকে কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাই বলো?”
“তাদের অনেক দিনের পরিকল্পনা ছিল মুরাদপুরে একটা হামলা করাবে। এই হামলার মূল উদ্দেশ্য সাহিল মির্জাকে মেরে ফেলা। তারা ক্ষোভের বশেই অরুণিকাকে মারতে চাইছে। তারা চেয়েছিল অরুণিকার সাথে আরবান তালুকদারের বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে মৈত্রীর সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নিতে। যখন জানলো, আমি ওকে ভালোবাসি। তখন আমাকেই বাধ্য করতে লাগলো। ওদের প্ল্যান জানার পর আমি অরুণিকা থেকে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই হয়তো তোমাদের উপর ক্ষোভ থেকেই ওকে মারতে চাইছে। ওরা জানে অরুণিকার কিছু হলে তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে। আহনাফ ভাই, আমার বাবা খুনী, শাহেদ মির্জা খুনী নন। রহমতুল্লাহ তোমাদের ব্রেইন ওয়াশ করার জন্য শাহেদ মির্জার নাম নিয়েছিল। কারণ শাহেদ মির্জার সাথে রহমতুল্লাহর ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল।”
“জানি, আসল খুনী তো সেই সিকান্দার বস। আদিল ভাইয়াকে সিকান্দার বসই মেরেছিল। তূর্যের বিয়ের দিন সে-ই আদিল ভাইয়ার উপর হামলা করেছিল।”
“ভাইয়া, অরুণিকা হয়তো আরবান তালুকদারের কাছেই জিম্মি, নয়তো মুরাদপুরের আশেপাশে কোথাও তাকে আটকে রেখেছে। বোমটা কখন বার্স্ট হবে আমি জানি না। কিন্তু আজই যেকোনো সময় হতে পারে৷ আমি রাখছি, আমি আমার দিক থেকে সব চেষ্টা করবো।”
ইমান কিছুক্ষণের মধ্যেই সব তথ্য বের করে, আরবান তালুকদারের ঠিকানা আহনাফকে ই-মেইলে পাঠিয়ে দিলো। মাওশিয়াত আর শতাব্দীকে একা রেখেই ছ’জন তাদের পনেরো বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ও তাদের একমাত্র প্রাণকে বাঁচানোর জন্য বেরিয়ে পড়লো।
১১৫.
আরবান তালুকদার তন্নির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বন্দুকের ঠা ঠা শব্দ কানে আসতেই আরবান তালুকদারের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। পাশের ড্রয়ার থেকে একটা কালো কোট বের করে তা পরে নিলেন। কোট পরতে পরতে তিনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নিচে আরাফ, ইমন আর তূর্যকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। তারপর আলমারি থেকে কালো গ্লাভস বের করে পরে নিলেন। এরপর ড্রয়ার থেকে একটা কালো মুখোশ বের করলেন। সেটিও মুখে লাগিয়ে তিনি আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। নিজেকে দেখে তিনি হাসতে লাগলেন।
সেদিন সময়টা ছিল সন্ধ্যা সাতটা। মৈত্রী ম্যানশনে হঠাৎই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মহল্লায় থাকা সবাই চমকে উঠলো। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ গেলেও মৈত্রী এলাকার রাস্তার হেডলাইটগুলো কখনোই বন্ধ হয় নি। আর আজ হঠাৎ পুরো এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে গেল কেন? রহমতুল্লাহর ছেলে রুকন এসে আরবান তালুকদারের সামনে দাঁড়ালো। বাড়ির প্রধান গেইট, ভেতরের গেইট, প্রতিটি বাড়ির সামনের গেইটে ক’জন অস্ত্রধারী পাহারাদার আছে, সব তথ্য দিলো। আরবান তালুকদার পেছনে ইশারা করতেই একটা ছোট ট্রাকের পেছন থেকে ষাট জন মুখোশ আর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নেমে পড়লো। আরবান তালুকদারের হাতের ইশারায় দেরী না করেই ষাট জনই মৈত্রী ম্যানশনের প্রধান গেইট দিয়ে ঢুকেই গুলি চালাতে লাগলো। নিস্তব্ধ অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকাটি যেন মুহূর্তেই ভয়ংকর হয়ে উঠলো। আশেপাশের বাড়িগুলোর দারোয়ানরা গেইট বন্ধ করে দিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। আঠারো মিনিটের ব্যবধানে পাহারাদারদের হত্যা করে ষাট জন মুখোশধারী লোক বিভক্ত হয়ে প্রথমে ইমতিয়াজ মাহবুবের বাড়িতে ঢুকলো, তারপর হাকিম আহমেদের বাড়িতে ঢুকে সবাইকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করলো। তারপর আলীম হোসেনের বাড়ি, এরপর আশেপাশে তাদের আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে হামলা চালালো। সবার শেষে আরবান তালুকদার চৌধুরী বাড়িতে ঢুকলেন। ততোক্ষণে আনিস চৌধুরী জানালার ফাঁক দিয়ে কালো কোট পরা আরবান তালুকদারকে দেখে ফেললেন। তবে তিনি জানতেন না, এই লোক আরবান তালুকদার হবে কিনা। কারণ কয়েক মাস আগে তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য একটা বন্ধু ও আত্মীয়দের নিয়ে একটা সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছিল। আর সেখানে সবাইকে মৈত্রী গ্রুপ থেকে কালো কোট দেওয়া হয়েছিল। আর এই কোট শুধু তাদের পরিচিত বন্ধু বা আত্মীয়দেরই থাকার কথা। আর সেই সমাবেশে মুরশিদ জুবাইয়ের উপস্থিত থাকলেও তার কালো কোটটিতে ত্রুটি থাকায় সেটি সমাবেশের আয়োজকের হাতে দিয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। আনিস চৌধুরী ভাইকে এই কথা জানাতেই, জুবাইয়ের করিম চৌধুরী সাথে সাথে ফোন দিয়ে মুরশিদ জুবাইয়েরের কাছে সাহায্য চাইলেন। আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশজন অস্ত্রধারী লোক একই সাথে চৌধুরী বাড়িতে ঢুকে পড়ল। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারের সবার মুখের দিকে না তাকিয়েই তার আদরের কন্যা অরুণিকাকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। ততোক্ষণে আরবান তালুকদার পিস্তল তাক করে আরাফের বাবা আরহাম চৌধুরীর বুকে গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। অরুণিকা সাথে সাথেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মেয়েকে রান্নাঘরের কেবিনেটে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি না আসা পর্যন্ত তুমি একটা শব্দও করবে না। এখান থেকে বেরও হবে না।”
অরুণিকা ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা হেলিয়ে দিতেই তিনি কেবিনেটের দরজা বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর নিজেকে পিলারের আড়ালে রেখে বসার ঘরের টেবিলে রাখা সমাবেশে আসা মেহমানদের তালিকাটি উঠিয়ে নিলেন। কারণ এর মধ্যেই খুনীর নাম থাকবে। আর তখনই তার উপর কেউ গুলি ছুঁড়লো। পিঠে আর হাতে দুইটা গুলি লাগায় জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মাটিতে ঢলে পড়লেন। এরপর ঘরের সবাইকে মেরে ফেলার পর আরবান তালুকদারের লোকেরা এসে যখন বলল, আর কেউ বেঁচে নেই। তখন আরবান তালুকদার মুচকি হেসে বললেন,
“প্রতিটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দাও। যাতে এদের অস্তিত্বও এই বাড়িতেই মিশে যায়। কারো চিহ্নও যাতে অবশিষ্ট না থাকে।”
সেই রাতের দৃশ্যটি ভাবতে ভাবতেই আরবান তালুকদার নিজের পিস্তলে গুলি ভর্তি করতে লাগলেন, আর মনে মনে বললেন,
“সেদিন যাদের মারতে পারি নি আজ তাদের মেরে আমার রক্ত ঠান্ডা করবো।”
তূর্য ধাক্কা দিয়ে আরবান তালুকদারের রুমের দরজা খুলতেই আরবান তালুকদার তার পিস্তলের প্রথম বুলেটটি তূর্যের দিকে ছুঁড়লো। বুলেটটি সোজা তূর্যের কাঁধে এসে লাগলো। তূর্য দরজার কাছেই ধপ করে বসে পড়লো। আরাফ আর ইমন তূর্যকে এভাবে ঢলে পড়তে দেখেই তার দিকে দৌঁড়ে এলো। ততক্ষণে আরবান তালুকদারের কিছু লোক এসে ইমন আর আরাফকে মারতে লাগলো। আরাফ তূর্যের অবস্থা দেখে নিজের সব শক্তি দিয়ে লোকগুলোকে মারলো। আরবান তালুকদার তূর্যের পায়ে আরেকটা গুলি ছুঁড়লেন। তূর্য পা ধরে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। ইমন আরবানের লোকগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তূর্যকে টেনে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। আরবান তালুকদার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ইমনের দিকে পিস্তল তাক করলেন। ইমন তূর্যকে ধরে একপাশে বসে আছে। সে স্থির দৃষ্টিতে আরবান তালুকদারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনই আরাফ পেছন থেকে এসে আরবান তালুকদারের পিঠে ছুরি চালিয়ে দিলো। ঠিক যেভাবে রহমতুল্লাহ আহনাফের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছিল সেভাবেই। আরবান তালুকদার দুর্বল হয়ে পড়তেই ইমন উঠে তার হাত থেকে পিস্তলটি কেঁড়ে নিলো। আর তার মুখের মুখোশটা টেনে খুলে ফেললো। আরবান তালুকদার দেয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। আরাফ আরবান তালুকদারের পিস্তলটি হাতে নিয়ে বলল,
“অনেক হয়েছে, আর না।”
আরবান তালুকদার কাঁপা গলায় বললেন,
“তুমি আমাকে মারবে, আরাফ? তোমার মামাক মারবে?”
আরাফ গর্জন করে বলে উঠলো,
“আপনি আমার পুরো পরিবারকে খুন করেছিলেন।”
“কারণ আছে। কারণ তোমার মা। তোমার বাবা, তোমার দাদা-দাদি, তোমার পুরো পরিবার তোমার মাকে হত্যা করেছিল। তন্নি আমাকে চিঠি লিখেছিল।”
“ভুল, আপনি ভুল বুঝেছিলেন। সংসারে অনেক ঝামেলা হয়৷ মা সেই ফ্রাস্টেশন থেকেই তার ভাইকে চিঠি লিখেছিল, আর বলেছিল, তাকে একটু দেখতে আসতে। আমার জন্মের পর মা অসুস্থ হয়ে যায়। মাকে কেউ সন্তান নিতে বাধ্য করে নি। মেজো বাবার দুই দুইটা ছেলে হয়েছিল। তারপরও মা সন্তান নিতে পারছিল না। তবুও এই নিয়ে কারো কোনো আফসোস ছিলো না। এমনকি মেজ বাবা আর মেজ মা জিসান ভাইয়াকে দত্তক হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু মা নিজের ছেলে চেয়েছিলেন। নিজের ইচ্ছায়, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে মা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। কেউ তাকে মারে নি। কেউ মাকে কষ্ট দেয় নি। এটা শুধু কিছু সময়ের আক্ষেপ ছিল। আর সেই আক্ষেপ থেকে আপনি এতোগুলো মানুষকে খুন করেছেন? অরুর বাবা-মা, ভাইদের মেরেছেন, আহনাফের বাবা-মাকে মেরেছেন, ছোট আব্বার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, মৈত্রীদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুন করেছেন। সেই রাতে আশি জন লোক খুন হয়েছিল। আপনি বাড়ির কাজের লোকদেরও রেহাই দেন নি। আপনি তো মানুষ না। আপনি তো একটা পশু।”
আরবান তালুকদার হাসতে হাসতে বললেন,
“মেরেছি, বেশ করেছি। আমি নিজ হাতে তোর বাবাকে মেরেছি। তোর দাদার বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছি। তোর ছোট আব্বার ছেলে দিশানের গলাটা কেটে তোর দাদির কোলে দিয়ে এসেছি। তার তো নাতির অনেক শখ! তোকেও মেরে ফেলতাম। কিন্তু তুই ছিলি না। যখন জানলাম তুই বেঁচে আছিস, তখন ভাবলাম, তোকে পরে মারবো। আগে যারা মরেছে তাদের তো মিটিয়ে দেই। তারপর তোদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেই, আর সেই রাতেই তোর পুরো পরিবারকে আমি ধোঁয়ার সাথে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলাম।”
আরাফের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে একে একে সব গুলি ছুঁড়ে আরবান তালুকদারের বুকটা ঝাঁঝরা করে দিলো। এতেও সে শান্ত হলো না। সে আরবান তালুকদারের নিথর শরীরটা টেনে এনে মেঝে থেকে ছুরিটা হাতে নিলো। তারপর একটার পর একটা আঘাত করতে লাগলো। আরাফকে এই মুহূর্তে উন্মাদের মতো লাগছে। সে চিৎকার করে কাঁদছে। ইমন তাকে টেনে সরিয়ে আনলো আর তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শান্ত হো আরাফ। শান্ত হো। লোকটা মারা গেছে। এখন তূর্যের অবস্থা খারাপ। আমাদের ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
আরাফের হুঁশ ফিরতেই সে তূর্যের দিকে ছুটে গেলো। ইমন আর আরাফ তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিচে নামলো। আরাফ গাড়িতে উঠেই আরবান তালুকদারের ব্যাপারে সব কিছুই মুরশিদ জুবাইয়েরকে জানাল। মুরশিদ জুবাইয়ের তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,
“আমি সব ব্যবস্থা করব। আরবান তালুকদারের হত্যাকে আমি দুর্ঘটনার নাম দিয়ে দেবো। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না, আরাফ। হত্যার বদলে হত্যা। এটাই ন্যায় বিচার।”
১১৬.
প্রায় দুই ঘন্টা ধরে মুরাদপুরের অলিগলি ছুঁটছে তাহমিদ, ইভান আর আহনাফ। বোম ঠিক কোথায় রাখা হয়েছে এ নিয়েও সবাই সন্দেহে আছে। নিরাপত্তা বাহিনী এসে তাদের যন্ত্র দিয়ে পুরো জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়েছে। কিন্তু কোথাও কিছুই পাওয়া যায় নি। সবাই ব্যাপারটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত মুরাদপুরের আশেপাশের সব রাস্তা বন্ধ। এমন জায়গা বন্ধ রাখলে পুরো শহরের চলাচল খানিকটা স্থবির হয়ে যাবেই। বারোটার পর আবার সব স্বাভাবিকভাবে চলতে লাগলো। মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর কথা শুনতে আগ্রহী নয়। এলাকাটা এতো বড়ও নয় যে বোম রাখলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে আহনাফদের বিভ্রান্ত করার জন্য এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে ইমানকে বিশ্বাস করবে কি করবে না সেই দ্বন্ধে ভুগছে তিনজন। তাহমিদের পা’টা অসম্ভব ব্যথা করছে, ইভানের চোখ জ্বালা করছে, আহনাফের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। তাদের তিনজনেরই রোদের তাপে পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে৷ গলার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবুও তাদের একটু পানি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে অরুণিকাকে পেলেই যেন সব তৃষ্ণা মিটবে। এদিকে তূর্যকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে সবটা জানাতেই মাওশিয়াত তাড়াতাড়ি উপমাকে তূর্যের খবর দিলো। উপমা সব শুনে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে পৌঁছালো। সে তূর্যের জন্য কাঁদছে তো কাঁদছেই। ইমন তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত। এদিকে আরাফ পাথরের মতো বসে আছে। সে নিজের হাতে কোনো মানুষকে খুন করেছে। তাই তার নিজেকেই কেমন যেন নোংরা নোংরা লাগছে। ইমন আরাফের দিকে একনজর তাকিয়ে উপমাকে ধমক দিয়ে বলল,
“এতোদিন তো আমার বন্ধুর খবর নাও নি। এখন এসে এসব ন্যাকামো করছো কেন? চুপ করে বসে থাকো। নয়তো ধাক্কা দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেবো। আসছে বউগিরি দেখাতে!”
উপমা ইমনের কথায় নির্বাক হয়ে গেলো। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে ধপ করে হাসপাতালের বেঞ্চে বসে পড়লো। মুহূর্তেই তূর্যের শুকনো মুখটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কতোবার তার অফিসের সামনে গিয়ে তূর্য দাঁড়িয়েছিল, কতোবার তার বাড়ির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চেয়েছিল, তূর্য শুধু একটাবার সুযোগ চেয়েছিল। কিন্তু উপমা একটুও সাড়া দেয় নি। উপমা দুই হাত উঠিয়ে মনে মনে বলল,
“আল্লাহ, আমাকে একটা শেষ সুযোগ দাও। আমি তূর্যকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি ওকে আর কষ্ট দেবো না। ওকে আর দূরে সরিয়ে দেবো না। আল্লাহ, প্লিজ ওকে সুস্থ করে ফিরিয়ে দাও। প্লিজ আল্লাহ। তূর্য সুস্থ হলে আমি টানা ত্রিশটা রোজা রাখবো। এতোদিন যতো টাকা জমিয়েছি সব দান করে দেবো। তূর্যকে সুস্থ করে দাও, আল্লাহ।”
এদিকে ‘টুইংকেল হাউজ’ এর বাড়ির দরজার সামনে চার-পাঁচজন মুখোশধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাওশিয়াত দরজার পীপহোল দিয়ে লোকগুলোকে দেখে ঘাবড়ে গেলো। সে শতাব্দীকে নিয়ে বসার ঘরে চলে এলো। বসার ঘরের পাশেই, একটা রুম আছে, তারা সেখানে চলে গেলো। শতাব্দীকে হুইলচেয়ার থেকে নামিয়ে এক কোণায় বসিয়ে জিনিসপত্র দিয়ে তাকে ঢেকে দিলো। তারপর সে নিজেও একটা কেবিনেটে ঢুকে বসে রইলো। মাওশিয়াত সন্তানসম্ভবা। এর মধ্যে সে লোকগুলোর সাথে মারপিট করতে পারবে না। যদিও সে জুডো বিদ্যায় পারদর্শী। কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের সন্তানের জন্য কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সে ইমনকেও জানাতে চাচ্ছে না, যদি ইমন এখানে এসে কোনো বিপদে পড়ে? হঠাৎ বাইরে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেলো। এর কিছুক্ষণ পর বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠলো। মাওশিয়াত ধীরে ধীরে ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভারটা উঠাতেই রিয়াজুর রহমানের কন্ঠ শুনে থমকে গেলো। রিয়াজুর রহমান বললেন, “হ্যালো, হ্যালো।”
মাওশিয়াত কাঁপা কন্ঠে বলল, “হ্যালো।”
“কে বলছেন? মিসেস ইমন মাহবুব?”
“জ্বি।”
“আমি রিয়াজুর রহমান। আপনাদের বাসার বাইরে কিছু হামলাকারী ছিল। ওদের গ্রেফতার করা হয়েছে। দরজা খুলুন। আমি আর শাহবাজ খান বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”
মাওশিয়াত সাহস নিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই দেখলো কিছু পুলিশ সদস্যকে সাথে নিয়েই শাহবাজ খান আর রিয়াজুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন। তারা ভেতরে ঢুকে শতাব্দীকে বের করে আনলো। বাড়ির গেইটে ভালোভাবে তালা লাগিয়ে মাওশিয়াত ইমনকে বলল সে শতাব্দীকে নিয়ে রিয়াজুর রহমানের বাড়িতে যাচ্ছে। ইমন অনুমতি দিতেই সে চলে গেলো। রিয়াজুর রহমানের বাসায় এসেই মাওশিয়াত বলল,
“কাল রাতে মুন্সী আংকেলের পরিবাররা আপনার সাথেই এসেছিল। ওরা কোথায়?”
রিয়াজুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“ওরা আমার নতুন বাড়িতে। এটা আমার নিজের বাড়ি। ভেতরে আমার মা আছেন।”
মাওশিয়াত শতাব্দীকে নিয়ে রিয়াজুর রহমানের মায়ের ঘরে এলো। সে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে কাকে বিশ্বাস করবে, বুঝতে পারছে না। তাই রিয়াজুর রহমান তার পরিচিত এক বোনকে বাসায় আসতে বললেন। মাওশিয়াত যেহেতু সন্তানসম্ভবা তার এখন মনটা স্থির থাকা উচিত। তার বয়সী কোনো মেয়ে যদি তার আশেপাশে থাকে, তাহলে সে মানসিকভাবে শান্ত থাকবে। এদিকে সে কিছুক্ষণ পর পর ইমনের সাথে কথা বলছে। ইমন ঠিক আছে কিনা কয়েকবার করে জিজ্ঞেস করছে। একদিকে তূর্যের অপারেশন চলছে, অন্যদিকে আরাফ পাথরের মতো বসে আছে। ইমন সব ফেলে তো আর মাওশিয়াতের কাছে আসতে পারবে না। তাই সে মাওশিয়াতকে আশ্বস্ত করে বললো, সে তাড়াতাড়ি ফিরবে।
প্রায় আড়াই ঘন্টার মধ্যে ইমান শহরে পৌঁছালো। শহরে এসেই তার সহকর্মী থেকে সে সব খবর নিয়ে নিলো। ইমান বুঝতে পারলো, তার বাবা এখানে একটা চালাকি করেছে। তাই সে আহনাফকে একটা মেসেজ দিয়ে মুরাদপুরের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘুরালো।
এদিকে আহনাফ একটা বাড়ির সামনে তার বাইকটা থামালো। বাইক থেকে নেমে সে ধীর পায়ে বাড়িটিতে ঢুকলো।
রান্নাঘর থেকে পানি খেতে খেতে বেরিয়ে এলো ইশমাম মুন্সী। ইশমাম আহনাফকে দেখে চমকে উঠলো। সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহনাফ, তুমি এখানে?”
“আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। আপনার একটা সাহায্য লাগবে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। কি সাহায্য লাগবে, বলো?”
“অরুণিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কি বলতে পারবেন ও কোথায় আছে?”
ইশমাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“আমি কিভাবে বলবো?”
“সেটাই তো। কিন্তু আমার যতোদূর ধারণা আপনি না জানলেও সিকান্দার বস সব জানবে।”
ইশমাম স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই সোফার কোণা থেকে একটা পিস্তল বের করে আহনাফের সামনে ধরার আগেই আহনাফ তার বুকে সজোরে একটা লাথি মারলো। ইশমাম ছিটকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলো। আহনাফ ইমানের সহকর্মীদের ইশারায় বলল, দরজা বেঁধে দিতে। তারপর সে ইশমামের পিস্তলটি পা দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে ইশমামের সামনে বসে পড়লো। ইশমাম ভীত চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ শীতল কণ্ঠে বলল,
“আমার অরু কোথায়?”
“আমি কিভাবে জানবো, আহনাফ? তুমি আমাকে কেন মারতে চাইছো?”
“ইমান আমাকে সব বলে দিয়েছে। আদিল ভাইয়াকে তুই খুন করেছিস। নিজেকে তৈমুর হিসেবে পরিচয় দিয়েছিস। আর তোর বাবা শাহবাজ খানের পরিচয়ে এতোদিন এতো অন্যায় করেছে! আর গতকাল সিকান্দার বসের পরিচয় দিয়ে আমার কাজটা তো তুই আরো সহজ করে দিয়েছিলি৷ সিকান্দার বস নামের কেউই নেই। এটা তোর ছদ্মনাম। সাবা মির্জার সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তার নাম সিকদার শেখ। কলকাতায় আমি তার কোম্পানিতেই কাজ করতাম। ইশ! কিভাবে ফেঁসে গেলি তুই, তাই না? তুই যেই ফেইক ডাটা অনলাইনে ছেড়েছিস, ভুল করে ওখানের একটা ডাটায় তোর হ্যাকার তারিখ চেঞ্জ করতে ভুলে গিয়েছিল। আর ওই তারিখ দেখেই বুঝলাম, সিকান্দার বসের কোনো অস্তিত্বই নেই। এই নামটা তো নতুন করে অনলাইনে এসেছে। আমি আরো ভাবছি, আগে পিছে দুই বছর আগের ছবি। মধ্যের ছবিটা ওয়ান ডে এগো কিভাবে সম্ভব? বাহ, হ্যাকারও রেখেছিস, তাই না? তুই তো মাস্টারমাইন্ড। গতকাল নিজেদের উপরই মিথ্যে হামলা করে কি চমৎকার ভাবে আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করতে চেয়েছিলি। আর এদিকে আমাদের সবার ফোনের সব ডাটা নিজের কাছে রেখেছিস। যখন আমরা বুঝে গেছি, তখন আরবান তালুকদারকে আমাদের বাসায় পাঠিয়েছিস। আমাদের লাইব্রেরির সিসিটিভি ফুটেজ পর্যন্ত ডিলিট করিয়ে দিয়েছিস। ইন্টারেস্টিং।”
ইশমাম মুন্সী ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“এখানে আমার কোনো হাত নেই। আমি সব বাবার কথায় করেছিলাম। বাবারই মৈত্রীদের সাথে শত্রুতা ছিল। বাবা মৈত্রীদের খুন করিয়েছিল। আমি তো শুধু তার কথামতো কাজ করেছি। আদিল মধ্যে দিয়ে সব জেনে গিয়েছিল, তাই ওকে মেরে ফেলেছিলাম। ইমানও সব জেনে ফেলেছিল। কিন্তু বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে নি। ও অনেক ইমোশনাল ছেলে। বাবার অন্ধভক্ত। আমি তো ভাবতেই পারছি না, ও তোমাদের সব বলে দিয়েছে।”
“এখন বল, অরু কোথায়?”
ইশমাম আহনাফকে তাদের পরিকল্পনা আর অরুণিকাকে কোথায় রেখেছে সব জানালো। সব শুনে আহনাফ উঠে আসতে যাবে তখনই ইশমাম তার উপর হামলা করলো। আহনাফ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে তার কাঁধে হাত দিয়ে নিজের পিস্তল বের করে ইশমামের উপর গুলি চালিয়ে দিলো। এরপর সে ইশমামের সামনে বসে তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে রিভলভারে আরেকটা চাপ দিলো। ইশমামের কপাল ফুঁড়ে বুলেটটি সামনের দেয়ালে এসে আটকালো। আহনাফ বাঁকা হেসে বলল,
“বলেছিলাম, আমি কাউকে ছাড়বো না। এখন মিস্টার সুলতান মুন্সী, শুধু তুমি এক জীব বাকি আছো। এরপর যুদ্ধ শেষ।”
চলবে–
(বেচারা আরাফ কিভাবে পোলের মধ্যে ভোট পেলো, সেটাই ভাবছি। আপনারা আরাফকে একটুও বিশ্বাস করতে পারলেন না? হায় হায়! আর যে আসল খুনী, তাকে কেউ ভোটই দিলো না।)