প্রেমবিভ্রাট
০৪
তানভীর তুহিন
তুহিন দীপ্তির প্রশ্নে নিদারুণ নিস্তব্ধতায় তলিয়ে গেল। আসলেই কী এটা কোন কারণের কাতারে পড়ে? কিন্তু এটাই যে আমার কাছে মস্তবড় কারণ। এই কারণের জন্যই তো আমি কাউকে জড়াতে চাইনি নিজের জীবনের সাথে। তুহিন গভীর ভাবে ভাবছে কথাগুলো দীপ্তিকে জানানোর প্রয়োজন আছে কী-না তা নিয়ে। দীপ্তি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। অপেক্ষা করছে উত্তরের। যদিও উত্তরটা দীপ্তির জানা। বিয়ের আগেই তুহিনের বাবা-মা সবটা বলেছিল দীপ্তিকে। সবটা জেনেই দীপ্তি বিয়ে করেছে তুহিনকে। কারণ দীপ্তি প্রচুর টান অনুভব করতো তুহিনের প্রতি। সেই টানের বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়াচ্ছিল দীপ্তির জন্য। তাই যখন আসাদ সাহেব দীপ্তির বাড়িতে তুহিন আর দীপ্তির বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় তখনই দীপ্তি রাজি হয়ে যায়। তুহিন দীপ্তিকে বিয়ের দিনই দেখেছিল এটা সত্যি। কিন্তু দীপ্তি তুহিনকে সেই কলেজ জীবন থেকে চেনে। যখন তুহিন বার্সেলোনা ছিল তখন থেকে। তুহিনের সব পছন্দ অপছন্দ মুখস্ত থেকে কণ্ঠস্থ থেকে ঠোটস্থ দীপ্তির। সবই জানে দীপ্তি। একদম সব। তুহিনের বিয়ে না করার কারণটা তো দীপ্তির মুখস্ত। কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে এই কারণ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
তুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস বিয়োগ করল। ” নীলিমা! ওর নাম নীলিমা ছিল। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় আমার সহপাঠী ছিল। অসম্ভব সুন্দরি ছিলো। একদম স্বর্গের অপ্সরা সমতুল্য। ওর লম্বাচুলের সেই মাতাল করা ঘ্রান, গলা আর বুকের ঠিক মাঝখানের একটু উপরে একটা ছোট তিল যা পাগল করে দিতে পারতো যেকোনো পুরুষকে। পাগল করে দিতে পারতো কেন বলছি? ওর জন্য সবাই পাগল ছিল। কলেজের জুনিয়র, সিনিয়র, ক্লাসমেট সবাই লাইন মারতো ও-কে। আমিও বাদ যাইনি। আমার কপাল চওড়া হওয়ায় ও আমার সাথে রিলেশনশিপে যায়। সেই দিনটা! যেদিন হাটুকাপা অবস্থায় বলেছিলাম ও-কে, নীল আমি তোমায় অনেক পছন্দ করি। আসলে পছন্দ করি না। আমি না তোমায় ভালোবাসি। খুবই অগোছালো ভাবে বলেছিলাম সবটা। বুকটা যেন কেঁপে দেহ থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাচ্ছিলোল। মুখটা অজানা এক কারণে শুকিয়ে গিয়েছিল সেদিন। চেহারাটাও হয়তো চুপসে গিয়েছিল সেদিন। খুবই অপ্রস্তুত আর আনকমফার্টেবল বোধ করছিলাম সেদিন। কিন্তু আমার সব অপ্রস্তুত বোধকে ঠুনকো করে দিয়ে সেদিন কিছু না বলে সোজা এসে আমায় জড়িয়ে ধরেছিল নীল। আমার জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার স্পর্ষ অনুভব করেছিলাম সেদিন। মনে হচ্ছিলো যেন হৃদস্পন্দনের এই তীব্র গতির কবলে পড়ে হয়ত অজ্ঞান হয়ে যাব। কিন্তু না সেদিন অজ্ঞান হইনি। আমিও জড়িয়ে ধরেছিলাম ওকে। আহ! কী মুহুর্ত ছিলো। মনে হচ্ছিল সবটা যেন থেমে গেছে। এই বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ড ক্রিয়া সাধন ভুলে গেছে। শুধু চলছে আমার বুকের হৃদস্পন্দন, নিঃশ্বাস আর নীলের সেই লম্বা চুলগুলো। চুলগুলো এসে আমার মুখে আছড়ে পড়ছিল আর আমি মাতাল হচ্ছিলাম নীলের চুলের সেই মাতালকরা ঘ্রাণে। আসলেই মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মজনু হয়ে গিয়েছিলাম নীলের প্রেমে। পাগলের মতো ভালোবাসতাম মেয়েটাকে। ভেবেছিলাম আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। কোন দুঃখ নেই। নীলকে নিয়ে এভাবেই সারাজীবন সুখে থেকে তারপর ওর সাথেই মরে যাব। কিন্তু নীল তার আগেই আমায় মেরে ফেলেছিল। আমায় ছেড়ে অন্য একটা সিনিয়র এর সাথে রিলেশনশিপে গিয়েছিল। সেদিন কলেজের মাঠে কাঁদতে কাঁদতে ওর কাছে কারণ জানতে চেয়েছিলাম ও খুব স্বাভাবিকভাবে বলেছিল, তোমার সাথে আমার আর ঠিক যাচ্ছে না। রিলেশনশিপ ওয়ার্কআউট হচ্ছে না। ” কলেজের মাঠের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম আমি। ভিক্ষুকের মতো অনুনয় করছিলাম নীলের কাছে যে তুমি যা বলবে তাই করবো। দয়া করে এভাবে মাঝপথে ছেড়ে দিও না আমায়। কিন্তু ও শোনেনি। একদমই তোয়াক্কা করেনি আমায়। মূল্য দেয়নি আমার শুভ্র-স্বচ্ছ অনুভুতি গুলোর। ও আমায় এড়িয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলো। আমি বারবার ওর হাত ধরে ও-কে আটকাতে চাচ্ছিলাম। আর সেই অপরাধে ওর সিনিয়র প্রেমিক এসে বেধর মেরেছিলো আমায়। নিজের পুরো পৃথিবীটাই যেনো উল্টে গিয়েছিলো নীল আমায় ছেড়ে দেবার পর। প্রচণ্ড বিরহে ভুগতাম। প্রচুর কাঁদতাম। বুক ফেটে যেত কষ্টে। তখন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটা আমায় সাহায্য করেছিল। আমার বাবা! আমার জীবনের সুপারহিরো। পুরোপুরিভাবে সাপোর্ট করেছিলো আমায়। সবভাবে আমার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল বাবা। আমি উকিল হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবা ডাক্তারি পড়াতে চেয়েছিলো আমায়। কারন উনি নিজেও একজন ডাক্তার ছিলো। ওনার স্বিদ্ধান্তটাকে অসম্মান করতে পারিনি তাই ডাক্তারি পড়তে বার্সেলোনা চলে যাই। বার্সেলোনা যাবার পরে পরিবার ছাড়া, কারো ভালোবাসা ছাড়া নিজেকে একদম একা অনুভব হতো। একাকিত্ব যেন গলা চেপে ধরেছিলো আমার। অনেক কান্না করেছি। কেউ ছিলোনা কান্না থামানোর জন্য। আস্তে আস্তে হেরে যাই একাকিত্বের কাছে। আমি পুরোপুরি ভাবে ধবংস হয়ে যেতাম, অস্তিত্বহীন হয়ে যেতাম, যদি না আমার বাবা আমায় সাপোর্ট করতো। আমার অনেক চেনা পরিচিত মানুষ এই ভালোবাসা নামক বস্তুটার কাছে বাজেভাবে হেরে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব দেখার পরে সিদ্ধান্ত নেই যে জীবনে আর কাউকে ভালোবাসব না। আমি এক প্রকার নারী বিদ্বেষী, বিবাহ বিদ্বেষী হয়ে গেছি। ভালোবাসা শব্দটার প্রতি সৃষ্টি হয়েছে এক বিরুপ আর তিক্ত মনোভাব। বিশ্বাস উঠে গেছে এই ভালোবাসা নামক মরিচিকার উপর থেকে। কোনো মেয়েকেই ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না আমি। সবাইকে ঠিক নীলের মতই মনে হয়। ভয় হয় খুব। কাকে ভালোবাসবো? যদি সেও নীলের মতো মাঝপথে ছেড়ে চলে যায়? কিন্তু দেশে আসার ছয় মাস পড়েই বাবা তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। কারণ বাবার মতে, ভালোবাসা ছাড়া বাঁচা যায় না। বাঁচতে হলে মন প্রয়োজন আর মন জীবিত রাখতে হলে ভালোবাসা খুব, খুব প্রয়োজন। তবুও আমি অসম্মতি জানাই বিয়েতে। কারণ আমি চাচ্ছিলাম না সেই অসহনীয় ব্যাথাটা দেবার সুযোগ আর কাউকে দিতে। আমি চাচ্ছিলাম না কেউ আমার স্বাধিন জীবনটায় গেড়ে বসুক। সেজন্যই বিয়েতে মত ছিলো না আমার। ”
দীপ্তি এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে তুহিনের কথা শুনছিলো। ইশ মানুষটা কী সুন্দরভাবে রুপের প্রশংসা করতে পারে। এভাবে কী কোনোদিন আমার রুপের প্রশংসা করবেন উনি? হয়তো আমার রুপ চোখেই পড়েনি ওনার। পড়লে তো মুগ্ধনয়নে দেখতো আমায়। কিন্তু সেভাবে তো তাকায়নি এক মুহুর্তের জন্যও। নিরবে একধ্যানে এসব ভাবছিলো দীপ্তি। তুহিনের প্রশ্নে ধ্যানভঙ্গ হলো দীপ্তির। ” কী ভাবছ? ”
দীপ্তি জবাব না দিয়ে তুহিনকে পালটা প্রশ্ন করল, ” আচ্ছা আপনি একবারও গালমন্দ, নিন্দা বা অপমান করেননি নীলিমার। কেন করেননি? এখনো কী ওনাকে ভালোবাসেন? ”
তুহিন কিঞ্চিৎ হাসল। ” না ও-কে ভালোবাসি না। তবে ঘৃনাও করি না ঠিক। বাকি রইলো গালমন্দ করার কথা। তা বোকারা করে। আমরা চাইলেই কী আমাদের প্রথম প্রেম কে ভুলতে পারি? কখনই পারি না। হ্যা প্রথম প্রেমের প্রতি ভালোবাসাটা সরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু প্রথম প্রেমটা একেবারে ভুলে যাওয়া যায় না। কোনোভাবেই যায় না। আমিও ভুলিনি নীলকে। ভুলতেও পারবো না কোনোদিন। তবে ওকে ভালোবাসি না। কারন ও আসলে ভালোবাসার মুল্যই জানে না। আর যারা ভালোবাসার মুল্য জানে না তারা ভালোবাসার যোগ্যই না। ”
দীপ্তি প্রত্যাশিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল, ” আমায় কী কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবেন না? ”
দীপ্তির প্রশ্নে নিরবতার অতলে তলিয়ে যায় তুহিন। দীপ্তিও প্রশ্ন করে থেমে গেছে। তার বুকের ধুকপুকানি, ফুসফুসের শ্বাসক্রিয়া থেমে গেছে। তারমধ্যে কাজ করছে চরম উত্তেজনা আর উৎকন্ঠা। খানিক ভেবে তুহিন বলল, ” হয়তো আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলবো। ভালোবাসাটা প্রকৃতির দান। সময়ের সাথে সাথে হয়তো আমিও তোমায় ভালোবেসে ফেলবো। হয়তো নীলকে যতটা বাসতাম তার থেকেও বেশি বাসবো। সবটা সময় আর বিধাতার হাতে। ”
ঠিক এই কথাটাই যেন শুনতে চাচ্ছিলো দীপ্তি। তুহিনের কথায় মনের ভেতরে এক হিমেল হাওয়া বয়ে গেছে দীপ্তির। এই অনুভূতি দীপ্তির চিরঅচেনা। এর আগে কখনো এভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেনি দীপ্তি। আজ যেন একটু বেশিই হালকা লাগছে তার।
তুহিন দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করল, ” তোমার জীবনে কেউ ছিলো না? ”
– ” না আমি কাউকে আসতে দেইনি। ”
তুহিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। ” আসতে দাওনি মানে.. কেন? আসতে দাওনি? ”
– ” যেদিন আপনি আমায় ভালোবাসতে শুরু করবেন, যেদিন আমায় ভালোবাসি বলবেন। সেদিন বলব। তার আগে না। ”
দীপ্তির কথায় হেসে ফেলল তুহিন। ” আর যদি কখনো ভালোই না বাসি? ”
আচানক তাপে ছ্যাঁত করে উঠল দীপ্তির বুকটা। নিজেকে স্বাভাবিক করল দীপ্তি। দীপ্তি বলল,” ওই যে বললেন সময়। তার হাতেই নাহয় ছেড়ে দিলাম। আর যদি কোনোদিন ভালো নাই বাসতে পারেন তাহলে নাহয় ওই প্রশ্নের উত্তরটা অপ্রকাশিতই থাকবে। ”
তুহিন ফের হাসে। ” আচ্ছা বুঝব কী করে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি? আমার ভালোবাসার অনুভুতিবোধে মরিচা ধরে গেছে বোধহয়। তাই অনুভুতি বুঝতে কিছু নিদৃষ্ট লক্ষন বিস্তারিতর প্রয়োজন। ”
– ” আমি কীভাবে জানবো? আমি কী এর আগে প্রেম করেছি নাকি? আপনি করছেন, আপনি জানেন। ” থেমে যায় দীপ্তি। সে প্রেম করেনি? সে তো তুহিনের প্রেমে পাগল। সে কীভাবে বুঝেছিলো? দীপ্তি কিছুক্ষন নিজের অনুভুতি বিশ্লেষন করল। ” যেদিন আপনার ভেতরে আমায় হারানোর ভয় জন্মাবে সেদিন মনে করবেন আপনি আমায় ভালোবাসেন। ”
– ” আচ্ছা কোনোদিন এমন ভয় পেলে জানাব। ”
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ❤️
” Tanvir’s Writings “