প্রেমবিভ্রাট ১০ তানভীর তুহিন

0
637

প্রেমবিভ্রাট
১০
তানভীর তুহিন

সকালে দীপ্তির আগে তুহিনের ঘুম ভাঙল। একই কম্বলের নিচে দুজনে শোয়া। দীপ্তি একটা পা তুহিনের উপর তুলে দিয়ে, তুহিনের জ্যাকেট খামচে ধরে একদম তুহিনের পাশ ঘেষে ঘুমিয়ে আছে। বোধহয় তার হেয়ারক্লিপটা খুলে গেছে তাই চুলগুলো এলোমেলো হয়ে প্রায় ঢেকে ফেলেছে মুখটাকে। তুহিন আঙুল দিয়ে দীপ্তির চুলগুলো মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল। দীপ্তি একটু নড়ে তুহিনের দিকে আরো ঘেষে এগিয়ে এলো। তুহিন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে।
দীপ্তি যদি আমার প্রেমিকা হতো তাহলে নিশ্চয়ই এখন বড়সড় ধরনের একটা অঘটন ঘটে যেতো। দীপ্তির দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে এসব ভাবছে তুহিন। পরক্ষণেই তুহিন আবার ভাবল এটা ঠিক দীপ্তি আমার প্রেমিকা না কিন্তু দীপ্তি তো আমার বিবাহিতা স্ত্রী।

হ্যা স্ত্রী হয়েছে তো কী রাজকার্য সাধিত হয়েছে? অঘটন ঘটানোর জন্য অধিকারের প্রয়োজন হয়। সে অধিকার আছে তোর? এসব আবোলতাবোল ভেবে তুহিন খাট থেকে নেমে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল।

বাইরের প্রকৃতিটা অসম্ভব সুন্দর। চারদিকে শুধুই ঝাপসাভাবের ছড়াছড়ি। কোনটা মেঘ, কোনটা কুয়াশা বোঝা দায়। বাইরের ফুরফুরে তাজা শীতল হাওয়ায় চোখ বুঝে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিল তুহিন। হঠাৎ কেউ দরজা ধাক্কাল। তুহিন একমুহুর্তও দেরি না করে গিয়ে দরজা খুলল। কারণ দীপ্তি ঘুমোচ্ছে। দরজা ধাক্কানোর শব্দে যদি দীপ্তি উঠে গিয়ে দেখে যে তুহিন জেগে থেকেও দরজা খুলতে দেরি করেছে। তাহলে তুহিনের মাথা আর মাথার যায়গায় থাকবে না। সেটা দীপ্তি চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। তুহিন দরজা খুলতেই মাঝবয়সি একজন মহিলা একটা ট্রে দিয়ে চলে গেল। তুহিন ট্রে হাতে তুলে দরজা বন্ধ করে দিল। ট্রে তে চা, মোমো আর সাথে কাসুন্দি। দুটো প্লেটে ৬ টা, ৬ টা করে মোমো দেওয়া। দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটাতে ভেজ মোমো আরেকটাতে চিকেন মোমো দেওয়া আছে। তুহিন ট্রে টেবিলে রেখে বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হবার জন্য।

তুহিন ফ্রেশ হয়ে এসে ট্রে হাতে নিয়ে দীপ্তির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দীপ্তি গতকাল সিনেমাটিক মর্নিং দিয়ে শুরু করেছিল। আজকে সেটার পুনরাবৃত্তি করবে তুহিন।

তুহিন ট্রে হাতে, মুখে লম্বা হাসি ধরে রেখে দীপ্তিকে ডাকা শুরু করল। অন্তর্মনে অনুশীলন করে নিল জাগার পরে দীপ্তিকে কী বলবে। বারকয়েক ডাকতেই দীপ্তি গুঙিয়ে উঠল, ” কী হয়েছে? ”
– ” খাবার এনেছি, ওঠো। খেয়েদেয়ে ঘুরতে বের হবো তো নাকি? ”
– ” আরেকটু ঘুমোতে দিন। ঘুম পাচ্ছে খুব। ” গুঙিয়ে বলল দীপ্তি।

তুহিনের শিক্ষা হলো না। মুখ হাসি হাসি করে দীপ্তিকে জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল, ” দীপ্তি নয়টা বাজে, ওঠো। ঘুরতে বেরোবে না? ”

দীপ্তি এবার রেগে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। উঠে বসেই কান ফাটানো চিৎকার দিয়ে বলল, ” উফফ অসহ্য! কী হয়েছে আপনার? বললাম না আরেকটু ঘুমোতে দিন। ”

আকস্মিক চিৎকারে তুহিনের মুখের হাসি উবে গেল। সে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে। তুহিনকে দেখে মনে হচ্ছে মস্তবড় কোন চুরি বা ডাকাতি করে হাতেনাতে ধরা পড়েছে সে। তুহিনের হাতে ট্রে দেখে দীপ্তি নাটুকে মেকি গলায় বলল, ” এই ট্রে ভর্তি খাবারসব কী আপনি বানিয়েছেন? আপনি রান্না করেছেন এসব? ”

তুহিন মাথা নেড়ে না বলতেই দীপ্তি আবার হুংকারে ফেটে পড়ল, ” তাহলে আবার এতো ফিল্মি স্টাইলে ঘুম থেকে জাগানোর কী আছে? খুব রোমান্টিকতা উপচে পড়ছে তাই না? কই রাতে তো রোমান্টিক ওয়েদার ছিলো তখন তো কিছু করলেন না। এখন আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এসেছেন রোমান্টিকতা জাহির করতে? যত্তসব! ”

মেয়েটা পাগল নাকি? এত সুন্দর করে হেসে নাস্তা নিয়ে এলাম। সিরিয়ালের মতো জানু, বাবু না বলুক একটা শুকনো থ্যাংকস তো দিতে পারতো, না-কি? তা না করে সকাল সকাল উমের মুরগির মতো চেঁচামেচি করছে, নিজমনে ভাবল তুহিন।

তুহিন গতকালের ঘটনা টেনে আনল। বলল, ” তা গতকাল এত কীসের রোমান্টিক ওয়েদার ছিলো যে, তুমি আমায় একদম চুলের পানি দিয়ে প্রেমে মাতাল হয়ে যাওয়া প্রেমিকার মতো ঘুম থেকে জাগালে? ”

তুহিনের আচানক যুক্তির তোপে থতমত খেয়ে গেল দীপ্তি। আসলেই তো! এখন কী বলব? ইস চান্দুটা আমার। কী রোমান্টিক ওয়েতে খাবার নিয়ে এসেছিলো। আর আমি বলদি কিনা সক্কাল সক্কাল ঝাড়ি মেরে দিলাম। ছি! দীপ্তি, ছি! স্যেম অন ইউ। এসব ভেবে ভেবে মুখ কোঁচকাচ্ছিলো দীপ্তি। তখনই তর্কে এগিয়ে থাকার জন্য আরেকটি লাইন মনে পড়ে গেল তার। হুংকার ঝেড়ে বলল, ” আমার মুখ দিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। তাই চুলের পানি দিয়ে জাগিয়েছি। আর কে প্রেমে মাতাল হয়ে গেছে? আমি মোটেই মাতাল ফাতাল হইনি। ড্যাবড্যাবিয়ে তো আপনি তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। একদম চরিত্রহীনের মতো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলেন আমায়। আপনি কী মনে করেন আমি বুঝি না কিছু? আমি সব বুঝি। হ্যাহ..”

কোত্থেকে কোথায় চলে গেল মেয়েটা? সকাল সকাল উঠে ভাল কাজ করেও শেষে কিনা চরিত্রহীনের তকমা পেলাম। এই মেয়ে তো আমায় ইন্ডিরেক্টলি লম্পটও বলল। এবার তোর শিক্ষা হয়েছে তো তুহিন? আর যাবি আগবাড়িয়ে প্রেম দেখাতে? আগবাড়িয়ে কেন? ও আর প্রেম দেখালেও তুই পাত্তা দিবি না। এসব ভেবে ভেবে তুহিন চুপচাপ গিয়ে ট্রে টেবিলে রেখে দিল।

দীপ্তি নিজেকে অকথ্য ভাষায় মারাত্মক কিছু গালি দিতে দিতে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমে ঢুকে উঁকি মেরে তুহিনকে দেখল। তুহিন চুপচাপ মুখ কালো করে বসে আছে। বেশ মন খারাপ হয়েছে বেচারার। তুহিনের এই অসহায় দশা দেখে তুহিনের হয়ে দীপ্তি নিজেই নিজেকে আরো কিছু মারাত্মক গালাগাল দিতে দিতে বাথরুমের দরজা বন্ধ করল।

তুহিন দীপ্তির জন্য অপেক্ষা করছিল। দীপ্তি এলে খাওয়া শুরু করবে। ফের ভাবল একটু আগে যে হাজার কথা শোনাল তার জন্য কীসের ওয়েট করব? সাতপাঁচ না ভেবেই তুহিন একটা মোমোতে কাসুন্দি মাখিয়ে মুখে দিতে নিল। ব্যস! বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। ঠিক তেমনি দীপ্তি বের হয়ে দেখল তুহিন তাকে রেখেই নাস্তা সেরে ফেলছে। দীপ্তি গলা বসিয়ে অভিমানী সুর ধরল, ” বাহ! এতক্ষণ তো খুব ঢঙ হচ্ছিল নাস্তা নিয়ে। আর এখন ঢঙ ভুলে গিয়ে নিজে নিজেই খেয়ে নিচ্ছেন? ”

তুহিন পড়েছে মস্ত গ্যারাকলে। তুহিন মোমো রেখে দীপ্তির দিকে তাকাল। দীপ্তি চোখ সরিয়ে নিলো। তুহিন মোমোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে মোমোটাকে বলল, ” তোরও আমার মুখে যাবার স্বাধিনতা নেই। আমারও তোকে আমার মুখে নেবার স্বাধিনতা নেই। আমরা দুজনেই অসহায় আর পরাধীন। পড়ে থাক প্লেটে। পড়ে পড়ে মর, পঁচ। আমার পেটে তোকে যেতে হবে না। ”

তুহিন কাসুন্দিমাখানো মোমোটাকে আবার প্লেটে সাজিয়ে রেখে দিল। দীপ্তি একটু মুচকি হেসে দৌড়ে গিয়ে তুহিনের পাশে বসল। তুহিন একটা মোমোর প্লেট দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিল। দীপ্তি হাতদুটো জ্যাকেটের পকেটে গুঁজতে গুঁজতে বলল, ” আমার শীত লাগছে। আপনি খাইয়ে দিন। ”

হু! খুব আহ্লাদ তোমার, না? আমি অতটা নির্লজ্জ না যে অতগুলো কথা শোনার পরেও নিজ হাতে তোমায় খাইয়ে দেব। তুহিন নীরস গলায় বলল, ” আমি কী যন্ত্রমানব? আমারও শীত করছে। আমি তো নিজ হাতেই খাচ্ছি, নাকি? ”

আমায় অ্যাটিটিউড দেখাচ্ছ বাছা? অবশ্য তোমার যায়গায় হলে আমিও দেখাতাম, ফেয়ার এন্ড প্রেডিক্টেবল মুভ। তুহিনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজের সঙ্গে কথা বলা শেষ করল দীপ্তি। দীপ্তি পকেট থেকে হাত বের করে তুহিনের হাতে একটা মোমো ধরিয়ে দিয়ে বলল, ” কথা না বাড়িয়ে খাইয়ে দিন তো। ”

তুহিন এবার তর্ক সৃষ্টির সুযোগ পেল। সে বিদ্রুপের সঙ্গে বলল, ” তা এই যে পকেট থেকে হাত বের করে আমার হাতে মোমো ধরিয়ে দিলে; শীত করল না? ”
– ” উফ! আপনি পাড়ার ঝগড়াটে মহিলা? এত কথা প্যাঁচান কীভাবে? ”
– ” আমি খাইয়ে দিতে পারবনা। ”
– ” আমি এখন উঠে যাব কিন্তু। উঠে গেলে আপনি, আপনার বাপ, আমার বাপ কেউই সারাদিন আমায় যুদ্ধ করেও কিচ্ছু খাওয়াতে পারবেনা। ” একরোখা গলায় চটজলদি বলে শেষ করল দীপ্তি।
– ” যাও। ” তড়াক গলায় বলল তুহিন।

দীপ্তি আগুন চোখে দাঁত চেপে এক মুহূর্ত দেখল তুহিনকে। হানিমুন চুলোয় যাক, এই ব্যাটাও যাক চুলোয়, নিজমনে ভেবেই দীপ্তি খাট থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো। তুহিন দীপ্তির হাত ধরে ফেলল। তুহিনের হাত থেকে ছোটার জন্য হাত ঝটকানি দিয়ে ব্যর্থ হলো দীপ্তি। তুহিনের হাতের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে তুহিনের হাত ছাড়ার অপেক্ষা করল সে। তুহিন হাত ছাড়ল না। দীপ্তি গলা শান করে বলল, ” ছাড়ুন। ”
– ” বসো। ” আদেশ করল তুহিন।

দীপ্তি তুহিনের চোখে চোখ ধরে একগুঁয়ে গলায় বলল, ” বসব না, ছাড়ুন আমায়। ”
– ” স্যরি, এবার বসো। ” গলা নরম করে বলল তুহিন। দীপ্তি নড়ল না। ” প্লীজ বসো। ” ফের নরম গলায় অনুরোধ করল তুহিন। দীপ্তি বসল। তুহিন দীপ্তির হাত ছেড়ে দিল। দীপ্তির হাত কিঞ্চিৎ লাল হয়েছে। দীপ্তি হাতের দশা দেখে বলল, ” দানবের শক্তি। ”
– ” দানব হয়েও মুরগির সঙ্গে পারি না। ”
– ” কে মুরগি? ” কপাল কুঁচকে তুহিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল দীপ্তি। তুহিন হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দীপ্তি হুমকি ছুড়ল, ” আমি কিন্তু নেমে যাব, বলে দিচ্ছি! ” কথার সঙ্গে সঙ্গে দীপ্তির এক পা মেঝে ছুঁলো।
– ” আমি মুরগি। আমি দানব, মুরগি, হাঁস, কবুতর, ছাগল, ভেড়া সব। ” তুহিনের সরল পরাজিত গলা। তুহিনের কথা শুনে ফিক করে হাসল দীপ্তি।

তুহিন হার মানল। আর কথা না বাড়িয়ে দীপ্তিকে খাওয়ানো শুরু করল। দীপ্তিও আর অহেতুক তর্কে গেল না। সে আরাম করে মোমো খেতে থাকল।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে! ♥
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here