নীরবতা পর্ব_২৩
#নাইমা_জাহান_রিতু
রাতের খাবারের পদ দুটো থাকলেও মেসবাহর কথামতো তা বাড়িয়ে বেশ কয়েক পদের করলো উল্লাসী। খাবার শেষে মিষ্টি জাতীয় পদের জন্য করলো পায়েস। সব গুছিয়ে টেবিল সাজাতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল অনা। ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,
-“ভাইয়ার সাথে কে বসে আছে?”
-“জানি না..”
-“জানো না মানে! আচ্ছা আমিই শুনে আসছি।”
অনা ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়াতেই ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো উল্লাসী। উনার সাথে আসা মেয়েটি ধবধবে সাদা বর্ণের। শারীরিক গঠন বেশ পুরূ। মাথাভর্তি সোনালী রঙের চুল.. যা পুরো পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিমার মত বিশাল টানাটানা দুটি চোখ, দ্যুতিময় ঠোঁট.. যার কোণায় লেগে রয়েছে হাসি। থুতনিতে সামান্য ভাজ পড়ার কারণে গোলগাল মুখে মেয়েটিকে নাদুসনুদুস লাগছে।
-“আরে! এত শর্ট টাইমের মাঝে কতগুলো আইটেম করে ফেলেছো! মশাকে কী এমনেই লাকি বলি?”
ইভানার কথায় সামান্য হেসে মেসবাহ বললো,
-“আছিস তো কদিন দেশে। রোজ এসে খেয়ে খেয়ে যাবি। বুঝবি ছোট্ট মরিচের ঝাঁজ কত!”
-“হা হা.. আই ক্যান সি ইট নাও। বাই দ্য ওয়ে এটা কী?”
-“রুই মাছের ঝোল। উল্লাসী ঝাঁল কম দিয়েছো তো?”
মাথা নেড়ে মেসবাহর কথায় সম্মতি জানালো উল্লাসী। ভালো লাগছে না তার। ইভানা মেসবাহর পাশের চেয়ারে বসার পর থেকেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে মনের ভেতরটায়। ছোট খোকনের পরণের কাপড়ই যখন সুহার গায়ে দেখে তখনই সে রেগেমেগে অস্থির হয়ে পড়ে। খুব চেনে সে তার নিজের জিনিসকে। সেখানে সে তো বেশ বড়! অস্থিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে টেবিলের অপরপ্রান্তে গিয়ে মেসবাহর মুখোমুখি বসে পড়লো উল্লাসী। তার স্থানে কেনো বসেছে মেয়েটি! পুরো টেবিলজুড়ে আরও কী ফাঁকা জায়গা ছিল না?
-“উল্লাসী? লেবু নেই?”
মেসবাহর প্রশ্নের জবাবে মান ভরা গলায় উল্লাসী বললো,
-“না.. নেই।”
-“ইশ! একটু মনে করিয়ে দেবে না!”
-“মনে নেই…”
পাশ থেকে অনা বললো,
-“আম্মা তো অনেক লেবুই পাঠিয়েছিল! ওগুলো শেষ?”
-“হ্যাঁ..”
-“বলো কী! কে খেলো এত?”
-“জানি না..”
অস্বস্তি হলো উল্লাসীর। লেবু আছে.. ফ্রিজেই আছে। তবে কেনো যেনো মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হলো। তবে কাজটা কী ঠিক হলো? হবে না কেনো! অবশ্যই হয়েছে।
-“তাহলে লিমনের ওখানে কবে যাচ্ছিস?”
-“শুক্রবারে যাই.. সবাই মোটামুটি সেদিন ফ্রি আছি।”
-“ওকে। দেন এটাই কিন্তু ঠিক থাকলো। আজ তোর বউয়ের হাতের খাবার খেলাম, ফ্রাইডেতে লিমনের বউয়ের। জীবন আমার ফুরফুরা!”
হাসলো মেসবাহ। ইভানার থালায় মাংস তুলে দিতে দিতে বললো,
-“শুধু হলো না তোর হাতের খাবার খাওয়া! তবে আশা রাখছি সেটাও দ্রুত হয়ে যাবে।”
-“শীঘ্রই হবে। বিয়ে করবো সামনে। তারপর তাকে দিয়ে রান্না করিয়ে সব মশা মাছিকে ইনভাইট করবো। এসে শুধু গিলে গিলে যাবি।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেসবাহ। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিঠে একটি চাপড় দিয়ে ইভানা বললো,
-“ডন্ট লাফ মশা! এভাবে ভ্যাটকাইলে বুকে লাগে…”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। এ কেমন মেয়ে? স্বামীকে দিয়ে রান্নাবান্না করাবে! তাছাড়া মেয়েটি এভাবে উনাকে মারলো কেনো? আর উনিই বা কিছুই বললেন না কেনো? খাবারে মন দিতে পারলো না উল্লাসী। খানিকটা নড়েচড়ে বসে সে ইভানার উদ্দেশ্যে বললো,
-“আপনি উনাকে মশা কেনো বলেন?”
-“ইংল্যান্ডে থাকতে তোমার বর আমার পেছনে মশার মতো ঘুরঘুর করতো। তাই মশা ডাকি। বুঝেছো পুঁচকি?”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল উল্লাসীর। পুঁচকি কাকে বললেন উনি? তাকে? কোন দিক দিয়ে পুঁচকি সে? তার যে বিয়ে হয়ে গেছে এটা কী দেখেন না উনি? থমথমে গলায় উল্লাসী আবারও বললো,
-“আপনি উনার কী হন?”
মৃদু হেসে ইভানা বললো,
-“বেটার হাফ..”
পাশ থেকে মেসবাহ উল্লাসীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
-“ঠাট্টা রাখ। উল্লাসী ছোট মাছটা এগিয়ে দাও তো.. এটা সামান্য খেয়ে দেখ। আমার মনে হয় না, উল্লাসীর চেয়ে ভালো ছোটমাছ কেউ কখনো রাধতে পারবে!”
জ্যোতির চোখমুখ জ্বলজ্বল করছে। মেয়েকে কাছে পেয়ে কী সত্যিই সে খুশি? তাহলে সেদিন তাকে কেনো ফেলে চলে গিয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠেছে মাজহারুল। হয়তো একসময় মৌমিও এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে। তার মতো একদিন সেও উত্তরের দেখা না পেয়ে ভুলে যাবে সকল পিছুটান। যা লোক দেখানো হলেও আদৌ মন থেকে ভোলা কী সম্ভব? দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত ঘড়ির দিকে নজর দিয়ে মাজহারুল বললো,
-“এবার উঠা দরকার…”
সেকথার জবাব না দিয়ে মৌমির মুখে খাবার তুলে দিল জ্যোতি। আজ সে মাজহারুলের কাছে কিছু চাইবে। যা হয়তো বাজে, অযৌক্তিক। একজন নারী হিসেবে যা চাওয়া মোটেও শোভন নয়। তবে সে চাইবে… সময় নিয়ে নিজের মনে মনে কথা গুছিয়ে নিল জ্যোতি। তারপর ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“শুনো?”
-“হুম..”
-“আজ রাতটা আমি মৌমির সঙ্গে কাটাতে চাই। প্লিজ.. না করো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। এই প্রথম এই শেষ..”
বুকের ভেতরটা কেপে উঠলো মাজহারুলের। নিজেকে সামলে গম্ভীরমুখে সে বললো,
-“অসম্ভব..”
-“মাজহার! প্লিজ…”
-“সম্ভব নয়। ও আমাকে ছাড়া থাকবে না। রাতে উঠে আমাকে না পেলে কাঁদবে।”
-“তুমিও থাকবে আমাদের সাথে।”
-“তোমার মাথা ঠিক আছে?”
-“আছে.. আমি তোমার কাছে জীবনে অনেক কিছু চেয়েছি। কিন্তু কখনোই তুমি আমার আবদার পূরণ করতে পারো নি। আজ না হয় আমার করা শেষ আবদারটা তুমি রাখো।”
বুকের ভেতরে মুড়ে থাকা যন্ত্রণাদায়ক অতীত আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লম্বা একটি দম ছেড়ে ঘাড় নেড়ে মাজহারুল বললো,
-“এটা অসম্ভব জ্যোতি।”
-“তুমি চাইলেই সম্ভব!”
-“সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি মেসবাহকেই বা কী বলবো!”
-“বলবে কোনো এক ফ্রেন্ডের বাসায় রয়েছো!”
-“আর তোমার স্বামী?”
থেমে গেল জ্যোতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে থেমে বললো,
-“আমরা হোটেলে থাকবো। তুমি বললেই আমি পাশাপাশি দুটি রুম এখনি বুক করে ফেলবো। প্লিজ মাজহার! একটি রাত তোমার কাছে আমি ভিক্ষে চাই। আমার মেয়ের সাথে আমি অন্যায় করেছি। তবে আমি খারাপ মা নই।”
বুকের ভেতরটায় হালকা ব্যথা অনুভব করলো মাজহারুল। কেনো সে ফেলতে পারেনা জ্যোতির আবদার গুলো? আগেও এমনো হাজার আবদার করে বসেছে জ্যোতি। তখনও সেই আবদার গুলো পূরণ করতে না পারায় বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেছে। তবে সেদিনও তা বোঝেনি জ্যোতি.. আর না বোঝে আজ! মেয়েটি এত অবুঝ কেনো? গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাজহারুল। সরল গলায় বললো,
-“ঠিকাছে.. তবে এই শেষ।”
মাথার উপরের চাঁদ আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। তবুও ব্যালকনিতে জ্বলা আলোর কাছে এই আলো বড়ই ম্লান। আমাদের এই উন্নতি প্রযুক্তির কাছে জ্যোৎস্না রাত দিনকে দিন বেশ ফিকে পড়ে যাচ্ছে। লোডশেডিং ছাড়া এর সৌন্দর্য যেনো আজকাল উপভোগ করা অতি দুরূহ ব্যাপার। ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইভানা। এগিয়ে গেল সামনের দিকে। চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে উদাস গলায় বললো,
-“তুই ভালো আছিস তো?”
-“তোর কী মনে হয়?”
-“আছিস.. অনেক ভালো আছিস।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ বললো,
-“বলতে পারিস.. কখনোই ভাবিনি উল্লাসীকে নিয়ে আমিও একদিন ভাববো..”
বুকের ভেতরটায় টিপটিপ করে উঠলো ইভনার। ধীর গলায় সে বললো,
-“আমার এখন বেরুনো উচিৎ…”
-“চল..”
-“তোর যেতে হবে না। গাড়ি তো নিচে আছেই।”
উল্লাসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেসবাহর দিকে তাকালো ইভানা। ঠোঁটের কোণায় সামান্য হাসি ঝুলিয়ে দৃঢ়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“কাল তাহলে দেখা হচ্ছে?”
-“না, কাল সম্ভব না। তুই বরং পরশু আয় চেম্বারে।”
-“গ্রেট.. সি ইউ সুন।”
বেরিয়ে পড়লো ইভানা। মেসবাহ সুখে আছে। প্রচুর সুখে আছে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকতে চায় সে মেসবাহর জীবনে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসলো সে। লিমনের নাম্বারে একটি ম্যাসেজ সেন্ড করতেই ওপাশ থেকে প্রায় সাথেসাথেই কল এল লিমনের। যেনো তার একটি ম্যাসেজের আশায়ই বসে ছিল সে!
-“জ্বলন নাকি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ…!”
-“বলতেই পারিস!”
-“সেদিন মেসবাহ জেলাস ফিল করেছিলো.. আজ উল্লাসী করছে। তাহলে কী ওরা একেওপরকে খুব ভালোবাসে?”
ফোনের ওপাশের একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিমন বললো,
-“এটাও বলতে পারিস। তা কোথায় আছিস তুই?”
-“জাহান্নামে.. প্রচুর কষ্ট হচ্ছে রে..”
-“তোকে একারণেই আমি আসতে নিষেধ করেছিলাম।”
-“মাই ফাকিং মাইন্ড! আই অ্যাম টোটালি হেল্পলেস ইন দিস ম্যাটার ম্যান! ওকে.. আই কল ইউ লেটার। বাই।”
ইভানা কল কেটে দিতেই লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা অপর্নার দিকে তাকালো লিমন। একবছর হতে চললো পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছে সে মেয়েটিকে। শারীরিক মানসিক সকল দিক থেকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেও আজও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি ইভানাকে। অদ্ভুত এই ত্রিভুজ প্রেমের কোনো ভবিষ্যৎ নেই জেনেও মনের অন্তস্তল থেকে একে অপরকে ভালোবেসে যাওয়ার মাঝে যে সুখ, তা মেসবাহ অনুভব না করলেও তারা দুজনে করছে বেশ…
সকল ঘরের আলো নিভিয়ে অনাকে দেখে শোবার ঘরে এল মেসবাহ। আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় এসে বালিশে হেলান দিয়ে বসলো সে। ধরাবে না ধরাবেনা করে একটি সিগারেট ধরিয়ে ডেকে উঠলো উল্লাসীকে। তবে পাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় সে আবারও বললো,
-“ঘুমিয়েছো?”
-“উহু..”
-“এত চুপচাপ যে!”
এপর্যায়ে উঠে বসলো উল্লাসী। মেসবাহর দিকে এগিয়ে এসে কপাল কুঁচকে বললো,
-“বেটার হাফ মানে কী? বেটার মানে তো উত্তম আর হাফ মানে অর্ধেক। তাহলে অর্ধেক উত্তম.. এটি কোনো সম্পর্ক হলো?”
-“ঠাট্টা করে বলেছে। বললামই তো ও আমার ফ্রেন্ড। শুধু আমার নয় লিমনেরও। আমরা ইংল্যান্ডে যখন ছিলাম তিনজনের একইসাথে উঠাবসা ছিল। তারপর তো আমি আর লিমন দেশে চলে এলাম কিন্তু ও ওখানেই সেটেল।”
-“তাই বলে ও আপনায় মারবে কেনো?”
-“কখন মারলো?”
-“ওই যে খেতে বসে! বারবার আপনার পিঠে মারছিল!”
মৃদু হেসে মেসবাহ বললো,
-“এজন্যই কী তোমার মন খারাপ?”
-“জানি না। আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই উনার পেছনে মশার মতো ঘুরঘুর করতেন?”
-“এটাও ঠাট্টা করে বলেছে।”
একমুহূর্ত নীরব থেকে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। কটমটে গলায় বললো,
-“তাহলে আপনি ওকে আদর করলেন কেনো?”
-“আদর? কোথায়?”
-“এখন বলছেন কোথায়? অথচ উনি যাবার সময় ঠিকই উনাকে জড়িয়ে ধরলেন!”
-“আরে বাবা! এটা ফরমাল হাগ.. আদর হতে যাবে কেন?”
-“আমাকে কখনো করেছেন ওসব? আমাকে কখনোই আপনি আদর দিতে চান না! সবসময় একটু দিন না, একটু দিন না করে করে হাজারবার চাইতে হয়!”
-“বলেছিতো! বড় হলে সব দিব.. সব।”
-“বড় কেনো হতে হবে? এখন দিলে কী সমস্যা? আমাকে ছোট ছোট বলে আমার জিনিস আপনি অন্যকে দিয়ে দিচ্ছেন। তা বুঝি আমি বুঝি না?”
সিগারেট এশট্রেতে রেখে উঠে বসলো মেসবাহ। প্রশ্নসূচক চোখে উল্লাসীর দিকে চেয়ে বললো,
-“আমি তোমার জিনিস?”
-“তো? আপনি শুধুই আমার জিনিস। একটা কাজ করলে কেমন হয়? আপনার শার্টের সাথে একটি কাগজ লাগিয়ে তাতে লিখে দিব, ‘এটি শুধুই উল্লাসীর সম্পদ। অন্যেরা একদম নজর দেবেন না। নয়তো চোখ খুলে খসে পড়বে। আর জড়িয়ে ধরলে পুরো শরীরে কুষ্ঠরোগ হবে।’ ভালো হবে না?”
ঠিক কী বলবে ভেবে পেল না মেসবাহ। নির্বাক শ্রোতা বেশে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর খলখল করে হেসে উঠলো সে।
(চলবে)