প্রেমবিভ্রাট ২৭ তানভীর তুহিন

0
488

প্রেমবিভ্রাট
২৭
তানভীর তুহিন

প্রচন্ড মাথা গরম নিয়ে বাড়ি ঢোকে তুহিন। তার মেজাজ এখন ভাঙচুর পরিস্থিতিতে। ড্রয়িং রুমে পায়চারি করছে আসাদ সাহেব। খানিক দূরে আহত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আয়েশা এবং শায়লা বেগম। ভয়ে কাপাকাপি অবস্থা তাদের। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আসাদ সাহেবের গর্জনের শিকার হয়েছে দুজনেই। তাই ভয়ে জড়সড় হয়ে ঠাই নিয়েছে এককোনে। তুহিন হন্তদন্তভাবে গিয়ে দাঁড়ায় আসাদ সাহেবের সামনে। তুহিন যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজের রাগি সত্তাটাকে তার বাবার কাছ থেকে দূরে সড়িয়ে রাখতে, আড়াল করতে। সে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। কারন তুহিন মোটেই চায় না তার রাগের বিন্দুমাত্র রেশও তার বাবার ওপর পড়ুক। তুহিনকে দেখেই অগ্নিদৃষ্টে তাকায় আসাদ সাহেব। তুহিন মানে খুজে পায় না সে অগ্নিদৃষ্টির। তুহিন ব্যাস্তভঙ্গিতে নিজের দৃষ্টি নিচের দিকে ছুড়ে বলে, ” কীসের জন্য ডেকেছো বলো? ”
আসাদ সাহেব নিশ্চুপ অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তুহিন আবার জিজ্ঞেস করে, ” কী হয়েছে? বলো? ডেকেছো কেনো? ”

আসাদ সাহেব কোনো কথা না বলে রিমোর্ট দিয়ে টিভিটা ছেড়ে দেয়। টিভির দিকে চোখ যেতেই খানিক হতাশ হয়ে পড়ে তুহিন। টিভিতে ওর সাথে সেই সাংবাদিকের ঝগড়ার ক্লিপিংসটা বারবার হাইলাইট করে দেখানো হচ্ছে। আর নিচের হেডিং এ লেখা, ” বিগশট হার্টসার্জনের হার্টব্রেক ”

তুহিন কিছুই বলছে না। বলার মতো কিছু খুজে পাচ্ছে না। আসাদ সাহেব ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ” তোর বিবেকবুদ্ধি কী লোপ পেয়েছে? কী এমন হয়েছে যে তুই সোজা ডিভোর্সের ডিশিসন নিয়ে ফেললি? আর এতোবড় ডিসিশন নিয়েছিস তুই আলোচনা করেছিস আমার সাথে? ”

তুহিন নিশ্চুপ। আসাদ সাহেবের এই চেঁচামেচি সহ্য হচ্ছে না তার। একেতো মেজাজ তিরিক্ষা হয়ে আছে তারমধ্যে এই অনাকাঙ্ক্ষিত চেঁচামেচি সহ্য করতে হচ্ছে। তুহিনের রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে। মেজাজ দাউদাউ তাপ দিচ্ছে।

আসাদ সাহেব আবার তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ” তোমার কোনো আইডিয়া আছে এই ক্লিপিংস গুলো তোমার ক্যারিয়ারে, তোমার পার্সোনাল লাইফে, সোসাইটিতে ঠিক কী প্রভাব ফেলবে? আর তোমার সাহস কী করে হয় ক্যামেরার সামনে এসব বলার। কোনোপ্রকার কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমার? আর ইউ টোটালি লস্ট ইট? ইউ ব্লাডি ফুল! ”

তুহিন দায়সারাভাব দেখিয়ে বলে, ” আমি এসব সোসাইটি-ফোসাইটির তোয়াক্কা করি না। আর ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়লে পড়ুক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। ”

আসাদ সাহেব আর নিজেকে দাড় করিয়ে ধরে রাখতে পারে না। তুহিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে; তুহিনকে সজোরে ধাক্কা মেরে বলে, ” যায় আসে না মানে কী? তোর কোনো অধিকার নেই নিজের ক্যারিয়ার এভাবে নিলামে ওঠানোর। ” কথা শেষে রাগে কাঁপতে থাকে আসাদ সাহেব।

এরকম চেঁচাচেচি আর ধাক্কাধাক্কি সহ্য হয় না তুহিনের। রাগের বাধ ভেঙেই যায় তার। তুহিন হুংকার তোলে, ” অধিকার নেই মানে কী? আমার কোনো ব্যাক্তিস্বাধিনতা নেই? আমার ক্যারিয়ার! আমার মাথাব্যাথা। ধ্বংস হলে হয়ে যাক। আর এখানে ক্যারিয়ারের প্রভাবের কথা আসছেই কোত্থেকে লোকজন কী আমার বউয়ের কাছে ট্রিটমেন্ট নেবে নাকি আমার কাছে নেবে? ”

আসাদ সাহেব তুহিনকে আগেরবারের চেয়েও তীব্র জোরে একটা ধাক্কা মেরে বলে, ” শুধু ভালো ট্রিটমেন্ট জানলেই হয় না। ভালো বিহ্যাভিয়ার, কনফিডেন্স আর ফোকাসের প্রয়োজন হয়। যা এখন আমি তোর মধ্যে দেখছি না। একবার বেষ্ট সার্জনের এওয়ার্ড পেয়ে কী ধরাকে সরা জ্ঞান করে নিয়েছিস তুই? আর তোর কীসের ব্যাক্তিস্বাধিনতা রে? যদি নিজের ব্যাক্তিস্বাধিনতার অজুহাত দেখিয়ে এরকম স্বিদ্ধান্ত নিস তাহলে তোর কোনো স্বাধিনতাই নেই। কোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও নেই তোর। সারাজীবন যেমন আমার কথা মেনে আমার সিদ্ধান্তে চলেছিস ঠিক সেভাবেই চলবি তুই। ঠিক সেভাবেই চলতে হবে তোকে। ” আসাদ সাহেব বেশ ঠান্ডা মাথার মানুষ। রাগ কীভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হয় তা সে জানে না। অকারনে সে রাগেও না। তবে একবার রাগলে সে রাগ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধুলিসাৎ করে দেয় সব।

তুহিনের রাগ এখন চতুর্থ আসমানে। তার বাবার এসব কথা জাস্ট আর মেনে নিতে পারছে না সে। রাগের চোটে তুহিনের চোখমুখ সকল রক্তবর্ন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এখনই ত্বক ফেটে রক্ত বের হয়ে যাবে। তুহিন চেঁচিয়ে ওঠে, ” তোমার কী অধিকার আছে? কী অধিকার আছে সবসময় তোমার সব সিদ্ধান্ত আমার উপরে চাপিয়ে দেবার? সবসময় তোমার সব সিদ্ধান্ত আমি কেনই বা মেনে নেবো? সবসময় তোমার সব সিদ্ধান্ত যে সঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই। ইউ আর নট গড, ইউ আর অলসো এ্যা হিউম্যান বিং লাইক মি। নিজের ডিশিসন নিজে নেবার মতো যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি আছে আমার মধ্যে। আর প্রত্যেকবার তোমার চেচানিতে থেমে যাবো না আমি। হ্যা আমি তোমায় নিজের আইডল মানি। মানি নিজের আদর্ষ। নিজের অনুপ্রেরনা ভাবি। তাই বলে এই না তোমার সব সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হবে। আমার ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছো এবার তুমি। আমি তো বিয়ে করতে চাইনি। তুমিই ধরেবেধে আমার বিয়ে দিয়েছো। তা আবার বিয়ে দিয়েছো কার সাথে? একটা চরিত্রহীনা মেয়ের সাথে। আর এই যে বলছো না ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়বে! ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়বে! সে দ্বায়ও তোমার। তোমার জন্যই হয়েছে সবকিছু। বেশ করেছি ওকে ডিভোর্স দেবার ডিশিসন নিয়েছি। ওকে তো ডিভোর্স আমি দেবোই পারলে আটকে দেখাও। আর আমি তোমার কেনা পুতুল না যে তোমার কথা মতো চলতে হবে আমাকে..।”

তুহিনের কথা শেষ হতে না হতেই আসাদ সাহেব কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দেয় তুহিনকে। একটা না, দুটো না, গুনেগুনে চার চারটা থাপ্পড় মারে তুহিনকে। এই মেজাজে, এই পরিস্থিতিতে থাপ্পড় গুলো ঠিক হজম হয় না তুহিনের। তুহিনের অগ্নিদৃষ্টি আসাদ সাহেবের পা থেকে মাথা অবধি ছুটে যায় একবার। তারপর আসাদ সাহেবের চোখ বরারবর গিয়ে কয়েকমুহূর্তের জন্য থেমে যায় সে দৃষ্টি। তুহিনের এ রুপ দেখে তীব্র অপমানিত বোধ করে আসাদ সাহেব। যে ছেলে কিনা কোনোদিন মুখের উপর কোনো কথা বলেনি সে ছেলে আজ এভাবে ব্যাবহার করছে তার সাথে।

তুহিনের রাগ অসীম মাত্রায় পৌছে গেছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যদি তার বাবা না হতো, তাহলে ঠিকই এখন তুহিন এই মানুষের প্রান গিলে নিতো। নিজের অগ্নিদৃষ্টি মেঝেতে নিক্ষেপ করে তুহিন। তারপর বা পায়ের পাশে থাকা টি-টেবিলটা সোজা একুরিয়াম বরাবর ছুড়ে মারে। মুহুর্তেই একুরিয়ামটি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

তুহিনের এ আচরনে আসাদ সাহেবের ক্ষিপ্রতা আরো বেড়ে যায়। তুহিনের হাত ধরে টেনে সদর দড়জার দিকে এগোতে এগোতে আসাদ সাহেব দাঁতচাপা গলায় বলে, ” তোমার মতো কুলাঙ্গারের এ বাড়িতে কোনো যায়গা নেই। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। ”

পিছন থেকে কেঁদে ছুটে এসে শায়লা বেগম বলে, ” তোমরা এবার থামো। এভাবে রেগে, ঝগড়া করে, সম্পর্ক শেষ কোরো না প্লিজ। ”

আসাদ সাহেব শায়েলা বেগমের দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে; গর্জে ওঠে, ” তুমি এখান থেকে সরো. নাহয় তোমায়ও বাড়ি থেকে বের করে দেবো। ”

শায়লা বেগম ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আর কিছু বলার সাহস হয় না তার। আয়েশা পিছনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। সে তার মুখের বুলি ভুলে বসেছে।

আসাদ সাহেব তুহিনকে বাড়ির বাইরে ধাক্কা মেরে বের করে বলে, ” নাও। এবার তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নাও। যতদিন না তুমি দীপ্তির সাথে সবকিছু মিটিয়ে নিচ্ছো ততদিন আমি তোমায় ক্ষমা করবো না। আর ততদিন তোমার এবাড়িতে যায়গাও হবে না। আর ততদিন আমি বা এ বাড়ির কারো সাথে তোমার কোনো প্রকার যোগাযোগ কিংবা সম্পর্কও থাকবে না। ”

তুহিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে, ” সব জানলে এ কথা তুমি বলতে না। ওর সাথে কোনোদিনই কিছু মিটবে না। এবার আমার সাথে তোমাদের যোগাযোগ আর সম্পর্ক রাখার দায়িত্ব তোমাদের। আমার কোনো দ্বায়ভার, দায়িত্ব নেই। ”

তুহিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। সোজা চলে যায় নেহালের অফিসের নিচে। নেহালকে ফোন দিয়ে বলে দিয়েছে, অফিসের নিচে আসতে। আর্জেন্ট কাজ আছে। নেহাল তুহিনের স্কুলফ্রেন্ড। নেহাল ওর বাবার রিয়েলস্টেটের ব্যাবসা দেখে। মুলত তুহিনের এখন থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট প্রয়োজন। সেজন্যই নেহালের সঙ্গে দেখা করা।

নেহাল আর তুহিন এখন গাড়িতে। তুহিন নেহালকে বলে, ” আমার একটা ফ্ল্যাট লাগবে। থাকার জন্য। ”

নেহাল একটু আগেই টিভিতে তুহিনের খবর টা দেখেছে। আর তুহিনকে দেখে বুঝতেও পারছে তুহিনের মেজাজ খারাপ আছে। তবুও কৌতুহল নিবারনে নেহাল তুহিনকে জিজ্ঞেস করে, ” টিভিতে এসব কী দেখাচ্ছে। তুই দীপ্তিকে ডিভোর্স দিচ্ছিস? আশিককে ফোন দিলাম আশিক বললো, তুই নাকি ওকে কোনো কারনই বলিসনি। আর এখন সাডেন আমায় বলছিস তোর নাকি থাকার জন্য ফ্ল্যাট লাগবে। তোর বাড়িতে কী হয়েছে? হোয়াটস গোয়িং অন তুহিন? ”
– ” টুট..টুট..টুট..টুট..টু…টু..! ”
তুহিন নেহালকে বাপ-মা তুলে মারাত্মক গালাগাল দিয়ে বলে, ” চুপ থেকে একটা ফ্ল্যাট ম্যানেজ করে দে। এতো ফ্যাচ ফ্যাচ ভালো লাগছে না। ”

নেহাল চুপচাপ তুহিনকে একটা ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। ফ্ল্যাটে গিয়ে নেহাল বলে, ” তুই এখানে থাকতে পারিস। কোনো সমস্যা হবে না আশাকরি। আর কোনো সমস্যা হলে আমায় বলিস আমি ফিক্স করে দেবো। ”
তুহিন বলে, ” রেন্ট কত? ”
এবার নেহাল একটু জোরগলায় বলে, ” এসব রেন্ট-ফেন্ট নিয়ে ভাবতে হবে না তোকে। তুই যতদিন, যতবছর ইচ্ছে থাক। ”
তুহিন খানিক বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, ” মাগনা হলে আমি থাকবো না। রেন্ট বল। ”

নেহাল বুঝতে পারে তুহিন এখন এসব তর্কাতর্কির মেজাজে নেই। তুহিন আর নেহালের সম্পর্ক বেশ ভালো। আর নেহাল কখনই তুহিনের থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে না। তবুও তুহিনকে খানিক স্বস্তি দেবার জন্য নেহাল বলে, ” তোর যা মনে হয় দিয়ে দিস। এখন আর কথা না বাড়িয়ে তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার অর্ডার করছি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু খাস নি। দুজনে একসাথে খাবো। ”

তুহিন আর কথা বাড়ায় না।

তুহিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এই ফ্ল্যাট থাকছে প্রায় ১৫ দিন।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ►
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here