প্রেমবিভ্রাট ২৯ তানভীর তুহিন

0
494

প্রেমবিভ্রাট
২৯
তানভীর তুহিন

মৌ ফোন করেছে। ক্লিনিকে নাকি কী এক হার্ট পেশেন্ট এসেছে যার কম্পিলিকেশন’স খুব বেশি। খুব চ্যালেঞ্জিং অপারেশন নাকি। তুহিনকে যেতেই হবে। তুহিনের অবস্থা মাতাল প্রায়। এই অবস্থায় অপারেশন করা ওর পক্ষে সম্ভব না। তুহিন মৌকে বলে, ” ক্লিনিকের অন্য কোনো সার্জনের কাছে কেইস হ্যান্ডওভার করো। বোস বাবুকে বলো সার্জারি করতে, কোনো কম্পিলিকেশন’স ক্রিয়েট হলে আমায় ফোন দিও। ”

হন্তদন্ত কন্ঠে মৌ বলে, ” স্যার, বোস স্যার অলরেডি ইন কেইস। উনি পারবেন না নাকি। উইথইন থ্রি আওয়ার যদি সাক্সেসফুলি সার্জারিটা করা না হয় তাহলে পেশেন্টে মারা যাবে। ”

তুহিন মাথাটা হালকা ঝেড়ে নেয়। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু এভাবে তো আর দায়িত্ব ছেড়ে পিছিয়ে যেতে পারে না সে। হাজার হোক একটা মানুষের বাঁচা মরার মাঝের প্রশ্নবোধক সে।

তুহিন মৌকে বলে, ” ওটি রেডি করো। আমি এসে সোজা ওটিতে ঢুকবো। ”

মৌ বলে, ” ইয়াহ। শিওর স্যার। ”

ব্রাশ করে চোখে মুখে বেশি করে পানি ছিটিয়ে নিচ্ছে তুহিন। অবস্থার উন্নতি নেই, আগের মতোই মরন ঘুম পাচ্ছে তার। টলমল পায়ে বাথরুম থেকে খাটে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে তুহিন। চোখটা কয়েকমুহূর্তের জন্য লেগে গেছে। চোখ খুলতেই ক্লিনিকের কথা মনে পড়ে যায় তার। না এভাবে চলবে না। তুহিন ফ্রিজ থেকে একটা লেবু বের করে কেটে চিপে রস খেয়ে নেয়। মুখটা লেবুর টকে মুহুর্তেই বিস্বাদ হয়ে গেছে একদম। তবুও আগের থেকে একটু ফ্রেশ লাগছে। টেবিলের ওপর থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়ে তুহিন। গন্তব্য ক্লিনিক।

এস্কেলেটর চেপে রেখেছে তুহিন। ব্রেকের মুডে নেই সে। গাড়িটাও ঠিকমতো চালাতে পারছে না। সামনের দৃশ্যপট কিছুটা স্পষ্ট, বাকিটা অস্পষ্ট। তুহিনের ফোনে আবার কল আসে। আয়েশা ফোন করেছে।তুহিন ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ ওঠে, ” কেমন আছিস ভাইয়া? ”
তুহিন বলে, ” এইতো ভালোই। কী অবস্থা তোর? কেমন আছিস? ”
– ” হুম ভালো। আমার ইঙ্গেজমেন্ট ঠিক হয়ে গেছে। ”

এসব বিয়ে-ফিয়ে নিয়ে তুহিনের সমস্ত আগ্রহ মরে গেছে। এসবের ওপরে আর কোনোপ্রকার বিশ্বাস বেঁচে নেই তুহিনের। তাই আয়েশার ইঙ্গেজমেন্ট এর কথা শুনে খুশি হওয়া তো দূরে থাক বরং খানিক হতাশ হয়ে পড়েছে তুহিন। তুহিন কোনো কথা বলছে না, চুপ করে আছে।

আয়েশা বলে, ” কী হলো? কথা বলছিস না যে? ”
তুহিন বলে, ” তুই বিয়েতে রাজি? ”
– ” হ্যা। ওর সাথে আমার প্রায় ৫ বছরের রিলেশনশিপ। ”
তুহিন খানিক হাসে। তারপর বলে, ” এতোবছর ধরে টেম্পু চালিয়ে গেলি অথচ আমায় কিছুই জানালি না? ”
– ” কেমন যেনো লজ্বা লাগতো। তাই বলিনি। ”
– ” তা ছেলের নাম কী? ”
– ” আদনান..”
– ” ওহ আচ্ছা। হ্যাভ এ নাইস লাইফ আশু। যদিও বিয়ের পরে জীবন নরক হয়ে যায়। তবুও চেষ্টা করিস সব মানিয়ে গুছিয়ে ভালো থাকতে। ”
– ” হুম। বিয়েতে আসবি না ভাইয়া? আমি তোকে আর জানুকে একসাথে দেখতে চাই আমার বিয়েতে। ”
– ” তোর চাওয়া পুরন করতে না পারার জন্য কষ্ট লাগবে। তবে আমি দেশে থাকলে অবশ্যই তোর বিয়েতে আসবো। আমার একটা মাত্র বোন বলে কথা! ”

আয়েশা চুপ। কী বলবে সে?

আচমকা আয়েশা বলে, ” তুই দেশে থাকলে মানে? কোথায় যাবি তুই? ”
তুহিন আয়েশার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলে, ” আব্বু কেমন আছে রে? আমার কথা বলে-টলে কিছু? ”
– ” ভালো নেই রে। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করে না। শুকিয়ে গেছে একদম। তোকে ছাড়া ভেঙে পড়েছে একদম। ”

তুহিন দীর্ঘশ্বাস বিয়োগ সেড়ে বলে, ” ভাত-পানি খাক আর না খাক। হার্টের ঔষধ গুলো খাইয়ে দিস ঠিকমতো। এবার এট্যাক এলে কিন্তু সেটা মেজর আকার ধারন করবে! ”
– ” হু। ”

তুহিন ক্লিনিকে চলে এসেছে। তাই আর কথা বাড়াবে না সে। বাড়াবে কী? কারো সাথে কথা বলার মতই কিছু খুজে পায় না সে।
তুহিন বলে, ” আচ্ছা রাখছি রে। ক্লিনিকে এসেছি। ওটি আছে একটা। ”
– ” এই সকাল বেলা ওটি? মাত্র তো ৮ টা বাজে! ”
– ” হ্যা! ইমারজেন্সি আছে নাকি। ”
– ” ওহ আচ্ছা রাখছি। নিজের যত্ন নিস। ”
– ” তুইও, রাখছি।”

তুহিন ফোন রেখে ক্লিনিকে ঢুকে যায়। তুহিনের ঘোর এখন অনেকটাই কেটে গেছে। তুহিন ক্লিনিকে ঢুকছিলো আর খেয়াল করছিলো ক্লিনিকের স্টাফরা কেমন যেনো অদ্ভুত নজরে তাকাচ্ছিলো ওর দিকে। তুহিন ওটির সামনের করিডোরে যেতেই মৌকে দেখতে পেলো। মৌ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তুহিনকে দেখে সে অনেকটাই হতাশ এবং আশাহত।

মৌকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুহিন বিরক্তিভরা কন্ঠে বলে, ” কী দেখছো এভাবে? গেট রেডি ফর দ্যা ওটি। ”
– ” স্যার আপনি শর্ট’স আর টি-শার্টে ক্লিনিকে এসেছেন? ”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই তুহিনের চোখ দুটো একবারের জন্য নিজেকে আপাদমস্তক উপর-থেকে নিচ দেখে নেয়। প্রচুর বিরক্তি আর বদমেজাজে দাত খিটে চোখ বন্ধ করে নেয় তুহিন। তারপর খানিক ভড়কে মৌ কে বলে, ” তো অপারেশনের জন্য কী ফর্মাল ড্রেস লাগবে? অপারেশন হাত দিয়ে করবো নাকি ড্রেস-আপ দিয়ে? ” তুহিন এমন দৃঢ় ভঙ্গিতে কথাটা বলে যে মৌ বুঝে নেয় তুহিন ইচ্ছা করেই এভাবে এসেছে।

মৌ হালকা ভয় পেয়ে বলে, ” না স্যার তেমন কিছু না। ওটি রেডি। চলুন না। আপনার প্রোটেক্টিভ গাউন, গ্লাভস, মাস্ক সব ওটিতেই আছে। ”
– ” হুম চলো! ”

তুহিনের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। আসার সময় ড্রেসটা চেঞ্জ করবে না সে? শেষে কিনা ক্লিনিকে টু-কোয়াটার প্যান্ট আর টি-শার্ট পড়ে চলে এলো সে? এজন্যই হাসপাতালের সবাই ওরকম অদ্ভুত ভঙ্গিতে দেখছিলো তুহিনকে। এবার ব্যাপারটা খোলসা হয় তুহিনের কাছে।

তুহিন ওটিতে ঢুকে গায়ে প্রোটেক্টিভ গাউন, হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পড়ে নেয়। অপারেশন শুরু করে দেয়। এই মেজাজে এই শারিরীক পরিস্থিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে তুহিনের। মাঝে মাঝে মাথাটায় কেমন যেনো চির ধরা ব্যাথা উঠছে, মাথাটা ছিড়ে যায় যায় অবস্থা। বহু কষ্টে নিজেকে দাড় করিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা পরে অপারেশন শেষ করে তুহিন। তুহিনের মতে অপারেশন সাক্সেস্ফুল। তুহিন টলমল পায়ে দেয়াল ধরে ধরে ওটি থেকে বের হচ্ছে। পা টা ভীষন কাপছে, দাঁড়িয়ে থাকা দ্বায় হয়ে যাচ্ছে তুহিনের পক্ষে। মাথাটা ব্যাথায় ছিরে যাচ্ছে একদম। ওটির বাইরে পেশেন্টের বাড়ির লোকজন দাঁড়িয়ে। তুহিনকে এমন হালতে দেখে তারা তীব্র ক্ষেপে যায়। এ কেমন ক্লিনিক? ডাক্তারদের কী অবস্থা? আরো নানান কথা। তুহিন এসব কথায় কর্নপাত না করে চেম্বারে ঢুকে যায়। চেম্বারে থাকা স্ট্রেচারটায় গা এলিয়ে দেয় তুহিন। মাথাটা কেমন যেনো ভনভনিয়ে ঘুরছে। চারপাশের সবকিছু চড়কির মতো লাগছে। খুব অশান্তি লাগছে তুহিনের। গা গুলিয়ে বমিয়ে আসছে। নাড়ি মুখে চলে আসতে চাইছে। একবার তার বোধ হচ্ছে সে মেঝে ভাসিয়ে বমি করে দেবে।তার বমির চাপ পেয়েছে। আবার সে চাপ হারিয়ে যায়। খানিক শান্তির সন্ধানে চোখ বন্ধ করে নেয় তুহিন। মাথা ঘুরানিটা আরো ঝেকে ধরে তুহিনকে। সাথে মাথাব্যাথা আর অস্থিরভাব তো আছেই।

কিছুক্ষন বাদে খানিক স্বাভাবিক হয় তুহিন। মৌ দৌড়ে এসেছে তুহিনের চেম্বারে। মৌ হাঁপানো গলায় বলে, ” স্যার পেশেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। দম যায় যায় অবস্থা। পালসরেট একদমই কম। ”

তুহিনের একটু আরাম লাগছিলো। এখন আবার উঠে হেটে ওটি অবধি যেতে হবে। যা তুহিনের পক্ষে অসম্ভব। তুহিন নিশ্চিত এখন উঠে হাটা শুরু করলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তুহিন হাতের ইশারায় মৌকে কাছে ডাকে। কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না তার। মৌ কাছে আসতেই তুহিন স্ট্রেচার থেকে পা নামিয়ে মৌ এর কাধে ভর দিয়ে নিচে নামে। তারপর অস্ফুট গলায় বলে, ” চলো। ”

ওটির করিডোর দিয়ে মৌ এর কাধে ভর করে হেটে যাচ্ছে তুহিন। পেশেনপার্টির লোকজন কান্নাকাটি করছে। তারা জেনে গেছে পেশেন্টের অবস্থা খারাপ। পেশেন্টপার্টির একজন এসে তুহিনের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে, ” আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয় তাহলে তোকে আমি ফাসিতে লটকাবো। কী টুট..টুট* এর ডাক্তার হইছিস তুই? মাতাল কোথাকার। ”
তুহিনের কানে এসব কিছুই ঢুকছে না ঠিকমতো। তবে তুহিন বেশ ভালোই বুঝতে পারছে পেশেন্টপার্টি খুব ক্ষেপে আছে। আর ওর কলার ধরা ছেলেটি বোধহয় রোগির ছোটভাই। তুহিন সবসময় চেষ্টা করে রোগির পরিবারকে সাহস জুগিয়ে সৌজন্যতার সাথে কথা বলতে। কারন তুহিন জানে যখন একটা মানুষ ওটিতে থাকে তখন তার বাড়ির লোকের ঠিক কী অবস্থা হয়। ওটির মানুষটার থেকে বেশি কষ্ট হয় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রিয়জনদের। তুহিন কাপাহাতে সামনের ছেলেটার হাতটা কলার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ মৌ এর কাধে ভর করে ওটিতে ঢুকে যায়।

ওটিতে ঢুকে দুজন ওয়ার্ড বয়ের সাহায্যে দাঁড়িয়ে থেকে রোগির আরেকিটা মাইনোর সার্জারি সাড়ে তুহিন। প্রায় আধাঘন্টা বাদেই পেশেন্টের অবস্থার উন্নতি হয়।

তুহিন ওটি থেকে বেড়িয়ে পেশেন্ট পার্টির উদ্দেশ্যে বলে, ” আপনাদের পেশেন্ট সম্পুর্ন ভালো আছে। একটু বাদেই জ্ঞান ফিরবে তখন কথা বলতে পারবেন। ” বলেই তুহিন আবার মৌ এর কাধে ভর করে চেম্বারের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করে।

পেশেন্টপার্টির মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো তারা তুহিনকে ডাক্তার বলে গন্যই করে না। আর তুহিন যে তাদের পেশেন্টের প্রান বাচিয়েছে তা তারা মানতে সম্পুর্ন নারাজ।

তুহিন চেম্বারে বসে আছে। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা ফেলে রেখেছে। ভালো লাগছে না কিছু। কেমন যেনো অস্থিরতা কাজ করছে দেহে। প্রায় সাত-আটজন মানুষ ঢুকে যায় তুহিনের চেম্বারে। তুহিনের চোখ এখনও সামনের পরিষ্কার দৃশ্য পাঠাতে পারছে না মস্তিষ্কে। সবটাই কেমন যেনো ঝাপসা। একজন সামনে এগিয়ে এসে বলে, ” আমরা হেলথ মিনিস্ট্রি থেকে এসেছি। আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে আপনি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অপারেশন করেছেন। ”

তুহিনের চোখে সামনে থাকা লোকটার মুখ অস্পষ্ট হলেও তার কথাগুলো স্পষ্ট। আর কথাগুলো শুনে তুহিন বেশ ভালোভাবেই বুঝে যায় তার ক্যারিয়ার ঠিক কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে।

তুহিনের ভাবনাই ঠিক হয়। যদিও তুহিন যতটা মারাত্মক ভেবেছিলো পরিনতি ততটা মারাত্মক হয়নি। ওই অপারেশনের তিনদিনের মাথায় তুহিনের মেডিকেল লাইসেন্স ৬ মাসের জন্য বাতিল করে দেওয়া হয় এবং তুহিনকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়। ভাগ্যিস রোগী এখনও জীবিত। যদি রোগী মারা যেত তাহলে সারাজীবনের জন্যই হয়তো তুহিনের মেডিকেল লাইসেন্স বাতিল করে দিতো আদালত। তার সাথে কারাদণ্ডও হতে পারতো।

মাত্রই রায় শোনানো হলো। কোর্টের বাইরে বেরোতেই আসাদ সাহেবের সাথে মুখোমুখি হয় তুহিন। কোর্টের বাইরে প্রেসের লোকজন গিজগিজ করছে। তুহিন বের হতেই আসাদ সাহেব তুহিনের গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে বেলে, ” এই তোমার স্বিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা? এই নিয়েছো তুমি সিদ্ধান্ত? নিজের ক্যারিয়ারটাকে জাস্ট ধব্বংস করে দিয়েছো তুমি। ”

তুহিন কিছুই বলে না। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, আসাদ সাহেবকে এড়িয়ে চলে যায় তুহিন।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ►
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here