প্রেমবিভ্রাট ৩২ তানভীর তুহিন

0
634

প্রেমবিভ্রাট
৩২
তানভীর তুহিন

দীপ্তি খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তুহিন দীপ্তির একটা পা নিজের হাতে ধরে পায়ের পাতায় ঠোট চেপে ধরে রেখেছে। তুহিনের চোখের পানিতে দীপ্তির পা প্রায় পুরোটা ভিজে গেছে। দীপ্তি কিছুই বলছে না। বহুদিন পরে তুহিনের স্পর্ষে যেনো সে নতুন করে বাঁচতে শিখছে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছে সে। এক অদ্ভুত শিরশিরে অনুভুতি হচ্ছে দীপ্তির। দীপ্তি চোখ বন্ধ করে রেখেছে খাটের চাদর খামচে ধরে। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। তুহিন দীপ্তির পা থেকে ঠোট সড়িয়ে দীপ্তিকে টেনে নিচে নামায়। নিচে নামিয়ে দীপ্তিকে নিজের কোলে বসিয়ে নেয় তুহিন। দীপ্তির এলোমেলো চুলগুলোতে মুখ ডুবিয়ে দেয় তুহিন। আজ খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে এই চুলের ঘ্রান উপভোগের। দীপ্তি তুহিনের কোলে বসে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে। নিজের অভিমানি সত্তাটা বলছে তুহিনকে সড়িয়ে দিতে, তুহিনের থেকে নিজেকে সড়িয়ে নিয়ে একটু শাসিয়ে নিতে তুহিনকে। কিন্তু সে সত্তার সব জোর যেনো ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে তুহিনের এই আলতো-গভীর স্পর্ষগুলো। এই মুহুর্তে তুহিনের থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার স্পর্ধা বা সামর্থ্য কোনটাই নেই দীপ্তির। দীপ্তি মাথানামিয়ে রেখে চুপচাপ তুহিনের নিবিড় স্পর্ষ অনুভব করছে। তুহিন দীপ্তির মুখ উঠিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। অভিমানি দৃষ্টিতে তুহিনের চোখের দিকে তাকায় দীপ্তি। দীপ্তির চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত, চোখে স্পষ্ট হাজারো অভিমান এবং অভিযোগ। তুহিন দীপ্তির চোখে ঠোট ছোয়ায়। তারপর দীপ্তির কপালে নিজের ঠোটজোড়া বেশ কিছুক্ষন চেপে ধরে রাখে। দীপ্তির মাথার পেছনের অংশের চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথাটা একদম শক্তভাবে চেপে ধরে তুহিন নিজের ঠোটজোড়ার সাথে।

তুহিন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে। চোখে তার প্রবল আপরাধবোধের ছাপ। দীপ্তিও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। সে খুজছে তার আগের তুহিনকে। তার চোখে প্রাপ্তি আর অভিমানের ছাপ। তুহিনের চোখের নিষ্পাপ বর্ণন টা খুজছে দীপ্তি, একটু খুজতেই তার সন্ধান পেয়ে যায় দীপ্তি। আগের মতোই নিষ্পাপ এই চোখের বুলি। তুহিনের চোখে সেদিনের সে হিংস্রতার কোনো ছাপ খুজে পায় না দীপ্তি। বরং হদিস পায় উন্মাদনার, আগের থেকেও তীব্র ভালোবাসার উন্মাদনা। যে উন্মাদনায় খুব অনায়াসেই দীপ্তিকে কাবু করে নেওয়ার প্রবল ক্ষমতা রয়েছে। দুজন দুজনকে দেখছে। প্রানভরে দেখছে, জন্মান্তর ধরে যেনো এই চোখ দুজোড়া একে অপরকে খুজেছে। কিন্তু খুজে পায় নী। আজ খুজে পেয়েছে। তাই প্রানভরে দেখে নিচ্ছে একে অপরকে। দীপ্তির ঠোট দুটো যেনো ইশারায় ডাকছে তুহিনকে। ঠোট দুটো খুব টানছে তুহিনকে, তুহিন ঠোটের দিকে এগোয়। দীপ্তিও কোনোপ্রকার বাধা প্রদান না করে, চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। তুহিনের ঠোট আর দীপ্তির ঠোট ছুঁইছুঁই অবস্থা তখনই কী একটা ভেবে হঠাৎ ঠোট সরিয়ে নেয় দীপ্তি। তুহিন আহত দৃষ্টিতে তাকায় দীপ্তির দিকে। দীপ্তি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তুহিনের দীপ্তির ওপর অধিকার তো আছে কিন্তু তা প্রয়োগে রয়েছে হাজারো দ্বিধাবোধ। তুহিন একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। তখন দীপ্তি যেরকম নিয়েছিলো ঠিক সেরকম। তুহিন নিচের দিকে তাকিয়ে আদ্র-ভেজা কন্ঠে বলে, ” আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো না দীপ্তি। ”
দুজনে একসাথেই দুজনের দিকে তাকায়। দীপ্তির চোখে বিস্ময়ের ছাপ। তুহিন আবার আদ্র-ভেজা কন্ঠে বলে, ” আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। আমি যদি তোমার যায়গায় হতাম তাহলে কখনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। ক্ষমা করতামও না। তুমিও আমায় ক্ষমা করে দিও না। ক্ষমা করে দিলে হয়তো ভবিষ্যতে আবারও এমন গর্হিত কিছু করে বসবো। একদম ক্ষমা করবে না আমায়। ”
কেঁদে দেয় তুহিন। অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। দীপ্তির হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে তুহিন। কান্না জারি রেখে বলে, ” আমায় ক্ষমা করার দরকার নেই। শুধু আমার থেকে আমার অধিকারটুকু কেড়ে নিও না প্লিজ। আর আমার উপর সেই আগের মতো অধিকার ফলানোটাও বন্ধ করে দিও না। ” কথা বলতে পারছে না তুহিন। কান্নায় তার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। দীপ্তি মুগ্ধনয়নে দেখছে তুহিনকে। অথচ দীপ্তির কিন্তু এখন চরম রাগ হওয়ার কথা। তুহিনকে দূরে ঠেলে দেবার কথা। কিন্তু সেটা পারছেই না দীপ্তি। বারংবার মুগ্ধ হচ্ছে তুহিনের কথাগুলোর ওপর। তাহলে এটা কী তার ভালোবাসার অন্ধত্ব? নাকি আসলেই তুহিন মুগ্ধ হবার মতো করেই তাকে মানিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। সে ব্যাপারে সন্দিহান দীপ্তি।

তুহিন দীপ্তির মাথার পাশটায় নিজের মাথাটা ঠেকিয়ে বলে, ” প্লিজ ফিরিয়ে দিও না আমায়। তোমাকেই তো চাচ্ছি। আর তুমি তো আমারই। ফিরিয়ে দিয়ো না আমায়। আমি নাহয় ভুলে বুঝেছিলাম। ভুল বুঝে এতদিন দূরে দূরে থেকেছি, দূরে রেখেছি। তুমি ফিরিয়ে দিয়ে আর দূরত্ব বাড়িয়ে দিও না প্লিজ। আমি তোমায় চাই ব্যাস শেষ। যা করতে বলবে, আমি তাই করবো। আমি তোমার থেকে কোনো সুযোগও চাচ্ছি না কোনো প্রকার ক্ষমাও চাচ্ছিনা। শুধু তোমাকে চাচ্ছি। তুমিতো সেদিন বলেছিলে না? যে, তুমি অনন্তকালের জন্য শুধু আমার। তাহলে আজ? আজ কী ভুলে যাবে সেকথা? আজ কী সেসব অস্বীকার করে, আমায় অস্বীকার করতে পারবে? কথাদিচ্ছি আর কখনও অমর্যাদা করবো না তোমার। ফিরিয়ে দিয়ো না প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ! ” কেদে দেয় তুহিন।

এতো ভালো করে কীভাবে কথা বলো তুমি তুহিন? যেকোনো মেয়েই তো মুহুর্তে বশীভূত হয়ে যাবে তোমার কথায়। মনে মনে কথাগুলো ভাবে দীপ্তি। আজ কেমন যেনো খুশির জলস্রোতের সৃষ্টি হয়েছে তার বুকের মধ্যে। আজ একদম নতুন ধরনের বুকের উত্তালভাব আবিষ্কার করেছে দীপ্তি। মনে হচ্ছে সে নতুন করে তুহিনের প্রেমে পড়ছে। এতকিছুর পরেও দীপ্তির কেনো যেনো বিন্দুমাত্র অভিযোগ করতে ইচ্ছে করে না তুহিনের বিরুদ্ধে। দীপ্তির মন চাচ্ছে আত্মসম্মানের তোয়াক্কা না করে নিজেকে সমর্পন করে দিতে তুহিনের কাছে।

দীপ্তি সেলোয়ার কামিজ পড়া ছিলো। তুহিন দীপ্তির কামিজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাতটা পেটে চেপে ধরে। তুহিনের আকস্মিক স্পর্ষে দীপ্তির সারা শরীর শিরশির করে ওঠে। এই আলতো খানিক স্পর্ষেও যেনো আজ আবেগের পরম আবেশ মাখানো আছে। আসলেই কী এই আলতো খানিক স্পর্ষে এতো আবেশ মাখানো? নাকি এ আবেশ তুহিনের স্পর্ষ অনুভবের তীব্র চরম আকাঙ্ক্ষার অসুখ? এ ব্যাপারেও সন্দিহান দীপ্তি।

তুহিন দীপ্তির পেটে হাত রেখে গালে নাক ঘষতে ঘষতে বলে, ” ওর জন্য হলেও নিজেকে আমায় দিয়ে দাও না। তুমি তো না চাইতেই আমার হয়ে গিয়েছিলে। এবার আমি তোমাকে চাইছি তাহলে কেনো উত্তর দিচ্ছো না? এবার চাওয়া সত্ত্বেও বাধা কোথায়? ফিরিয়ে দিও না প্লিজ। তুমি ফিরিয়ে দিলে আমার যে আর তোমায় চাওয়ার মুখ থাকবে না। কারন সে মুখ আমার নেই। সে অধিকার, সে জোর আমার নেই। তা আমি আগেই খুইয়ে বসেছি। ”

তুহিনের কন্ঠ আবার জড়িয়ে আসে। কান্নার কারনে সে কথাই বলতে পারছে না।

দীপ্তি ভাবছে, কীভাবে আর আটকে রাখবো নিজেকে? তোমার থেকে দূরে সরে থাকাটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা এই কয়েকটাদিনে অন্তরের অন্তস্থল থেকে অনুভব করেছি আমি। যে অনুভুতি এতটাই নির্মম যন্ত্রণাদায়ক ছিলো যে বহুবার আমার আত্মার আত্মহত্যা হয়ে গেছে। বলেছিলাম তো আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেবো তোমার কাছে। মোটেই ফিরিয়ে দেবো না তোমায়। তাহলে কথার বরখেলাপ করি কীভাবে? আমার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে তুমি। তোমার ভালোবাসা, এই ভালোবাসার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারাটা অনেকাংশে নিজের সৌভাগ্য আমার কাছে। সবার ভাগ্যে কী এরকম ভালোবাসা জোটে? কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতেই দীপ্তি তুহিনের পিঠ জড়িয়ে ধরে তুহিনের বুকে মাথা রাখে। তুহিন শক্ত করে দীপ্তির মাথাটা চেপে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে। দীপ্তিকে একদম মিশিয়ে ফেলে নিজের সঙ্গে। তুহিন যা চাচ্ছিলো তা পেয়ে গেছে ভেবেই কয়েকফোটা আনন্দ অশ্রু’র বিসর্জন দেয়।

এভাবে বেশ কিছুক্ষন থাকার পর। দীপ্তি তুহিনের বুকে মাথা রেখে অভিমানি স্বরে বলে, ” কেনো চাচ্ছো আমায়? ”
তুহিন ঝটপট উত্তর দেয়, ” ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য। ”
দীপ্তিরও সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা অভিমানি প্রশ্ন, ” তাহলে এতদিন আমায় ছাড়া কীভাবে ছিলে? ”

তুহিন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তারপর বলে, ” ভালো কী ছিলাম? বহুবছর একা ছিলাম তো তাই তেমন কষ্ট হয়নি। তবে একটা চাপা কষ্ট ছিলো যেটা ভালোথাকা নামক কাঠের ঘুণ হিসেবে কাজ করছিলো। ভালো মোটেই ছিলাম না। ”

দীপ্তি আর কিছু বলে না। তুহিনের বুকে মাথা রেখে বেশ কিছুক্ষন কেঁদে নেয়। আজ যেনো কেঁদেই সুখবিলাস করছে দীপ্তি।

তুহিন আর দীপ্তি তুহিনদের বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়ানো। দীপ্তির বাড়ির কেউই ওদের আটকায়নী। কারন দীপ্তি স্পষ্ট বলেছিলো তার বাবা-মা আর ভাইকে, ” আমি তুহিনের সাথে যাবো। দেখছিলেই তো ওকে ছাড়া কীভাবে বেঁচে থেকেও মরে যাচ্ছিলাম প্রত্যেক মুহুর্তে। খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওভাবে বেঁচে থাকতে। ওভাবে শ্বাস নেয়াটাও কেমন যেনো যন্ত্রণাদায়ক। আমি ওভাবে বেঁচে থাকতে চাই না। ওর সাথে ভালো থাকতে চাই। আর ভাইয়া তুই তো সবটা জানিস। ও সব ভুল বুঝেই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই প্লিজ কেউ আটকিও না আমায়। ” দীপ্তির সুখের কথা ভেবে। ওর বাড়ির কেউই ওকে আটকায় না। কেউই চায় না দীপ্তির সুখের পথে কাটা হতে।
দুজনে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। তুহিন অপেক্ষা করছে আসাদ সাহেবের অনুমতির। তুহিন চোখ মেলাতে পারছে না নিজের বাবার সাথে। মাথা উঁচু করে তাকাতে পারছে না নিজের বাবার দিকে। তাই মাথা নিচু করে অনেকটা অপরাধির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ সাহেব হাত পিছনে বেধে দাঁড়িয়ে আছে। খানিক মুচকি হেসে আসাদ সাহেব বলে, ” ভেতরে আয়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ”

তুহিন ভেতরে ঢুকেই সোজা সিড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে যায়। দীপ্তি ভেতরে ঢুকতেই আয়েশা এসে দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। তারপর আসাদ সাহেব আর শায়লা বেগমও এসে দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরে। শায়লা বেগমতো খানিক বকাবাকিও শুরু করে দেয় দীপ্তিকে, ” আমার নাতি তোর পেটে অথচ তুই কেমন শুকিয়ে গেছিস। আজ থেকে দিনে ৬ বেলা করে খাবার খাবি। ” বলেই চোখে কান্না নিয়ে হেসে দেয় শায়লা বেগম। সবাই বেশ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি আসাদ সাহেব। নিজের ছেলে অবশেষে তো একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিলো।

রাতে তুহিন দীপ্তির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।

চলবে!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে ►
” Tanvir’s Writings “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here