বিপরীতে_তুমি_আমি #পর্বঃ১৯

1
1960

#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ১৯
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম

কেন? কোথায় যাবেন আপনি?

অর্ণব সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে। সামনের কাঠগাছটার দিকে দৃষ্টি ধরে রেখে স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়,

গন্তব্যে!

কিন্তু তাই বলে দেখা হবে না কেন? আর… আর আপনি না কি যে বলতে চেয়েছিলেন?

হুম! এটাই। এতোদিন ক্যরিয়ার গঠনের ধাপ হিসেবে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এখন সরাসরি ক্যরিয়ার গঠন করতে হবে। সুযোগ এসেছে কাজে লাগাতে হবে।

আপনার ক্যরিয়ারের সাথে আমার কি সম্পর্ক?

এখানে আর থাকছি না। দেখা হবে কি করে?

দেখা করতে আসবেন না?

না। দরকার দেখছি না কোনো। এতোদিন চেনা পরিচয় ছিল। তাই শুধু যাওয়ার আগে জানাতে চেয়েছিলাম।

শুধু চেনা পরিচয়?

এছাড়া আর কোনো সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হয় না।

অর্ণবের প্রতিটি কথার উত্তরে কিরণ নতুন অর্ণবকে খুঁজে পাচ্ছে। বুঝে যাচ্ছে অর্ণব পরোক্ষভাবে বোঝাতে চাচ্ছে কিরণের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। কিরণের বুক কাঁপছে। সে যা ভাবছে তা সত্যি হোক চাইছে না। কিন্তু সে এটাও জানে এইটা খুব একটা মিথ্যেও হবে না। নিজের ভেতরের ছটফটানি থামাতে এবার সোজা সাপ্টা কথা বলার প্রস্তুতি নিয়ে বললো,

বিশেষ কেউই নয়?

যেমন?

কিরণ অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণবের দৃষ্টি এখনোও অন্যত্র। কিরণ নিজের দৃষ্টি অর্ণবের মাঝে স্থির রেখে জিজ্ঞাসা করলো,

আপনি আমায় ভালোবাসেন না?

অর্ণব যেনো চমকে ওঠলো। কিরণ এভাবে সোজাসাপটা এ প্রশ্ন করবে তা হয়তো ভাবে নি। কিরণের দিকে তাকালেও সেই দৃষ্টি স্থির রাখতে পারে নি। মুখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বটগাছটা একটা বিশাল পুকুরের পাশে। বেশ গোছানো পুকুর। মূলত কলেজ ক্যাম্পাসে হওয়ার দরুণ পুকুরটাকে পরিচ্ছন্ন ও পরিচর্যায় রাখা হয়। অর্ণব নিজের হাত দুটো পকেটে গুজেই পুকুরের দিকে মুখ ঘুরে দাঁড়ালো।
কিরণ অর্ণবের মৌনতা বুঝতে পারলো। কিরণের কান্না পাচ্ছে। ভিষণ কান্না! কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো গর্জে ওঠতে চাইছে। কান্নায় দম ভারি হয়ে আসছে। ঠোঁট চেপে কোনো রকমে কান্না ধরে রেখেছে। ওঠে দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু তার যে পুরো শরীর কাঁপছে। পা দুটো ভর নিতে পারবে কিনা সেই সন্দেহে ভুগছে। দু হাত দিয়ে সান বাঁধনো বসার জায়গা খামছে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। নিজেকে সামলানোর কি প্রচেষ্টা তার মাঝে! এক পর্যায়ে নিজেকে ধাতস্ত করলো কিরণ। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বসলো। তবুও অভ্যন্তরের হাশপাশ কমছে না। তবু অর্ণবের পিঠটার দিকে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে নিজে নিজে বলতে শুরু করলো,

স্কুলে থাকতে ছোট বড় সকল সমস্যার সমাধান আপনি নিয়ে আসতেন। আলাদিনের যাদুর জিনির মতো। বাহানা হলেও আপনার উপস্থিতি কোনো না কোনো ভাবে যৌক্তিক বুঝিয়ে দিতেন। দশম শ্রেণীর সাহেল ভাইয়ার যে আমি প্রতি অনুভূতি ছিল তা বুঝেছিলাম। তিনি বিভিন্ন ভাবে কথা বলতে চাইলেন। একদিন কি যেন বলতে চাইলো। সেই মুহুর্তেই আপনি কাঁধে হাত রেখে বন্ধু সুলভ আচরণ করে কোথায় যেনো নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে আর আমার কাছে আসতে দেখি নি। কলেজের কোনো ভাইয়াকে বোন ছাড়া ডাকতে শুনি নি। এখনো তার অন্যথা হয় নি। প্রাইভেট থেকে ফেরার রাস্তায় রিকশার অভাব দেখি নি। চায়ের দোকানের সামনে দুদিন দুটো ছেলেকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তৃতীয়দিন তাদের দেখি নি। রাস্তায় বখাটের পাল্লায় পড়েছিলাম মনে আছে? আপনি বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে আসছিলাম। কিছুদিন আগের ঘটনাই তো। ওরা যখন আমার পিছু নিচ্ছিলো আপনার হাতে তখন ফোন। যেনো কিছুই হয় নি। ভিষণ রাগ ওঠেছিল জানেন? আপনার বন্ধু রাফি ভাইয়া এগিয়ে এসে আমাদের সাথে করে এগিয়ে দিল। তবুও আপনি এলেন না। তখন একটা খারাপ লাগা কাজ করলেও পরেরদিন শুনলাম বিকেলে নাকি ওদের পুলশ।ধরে নিয়ে গিয়েছে। ইভটিজিং এর মামলায়। আপনি প্রতিটি কাজ ছিল খুবই নীরবে। মানুষ যতটা না করে তার থেকে বলে বেড়ায়। কিন্তু আপনাকে দেখেছি তার উল্টোটা। এসকল কাজই কি এমনি এমনিই ছিল? দয়া করে বলবেন না আপনি এর কোনোটার সাথেই জড়িত না। এমন তো আরো কতশত উদাহরণ রয়েছে। সেগুলো নাই বা দিলাম।

ছোটদের প্রতি বড়দের কর্তব্যকে যদি ভালোবাসা মনে করো তাহলে ভুলটা এখানে তোমার ভাবনায়।
তোমার জায়গায় অন্য যেকোনো মেয়ে থাকলে আমি ওগুলোই করতাম।

অন্য যেকোনো মেয়ে?

হ্যা!

কিরণ নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। ফ্যাল ফ্যাল কর কেবল তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। তার দেখে আসা অর্ণব আর আজ সামনে থাকা অর্ণবের মাঝে কত পার্থক্য! এক দিনেই মানুষ এতো পরিবর্তন হতে পারে? এইটা আদৌও সম্ভব? নাকি সত্যিই তার ভাবনাই মিথ্যা? অর্ণব কিরণের দিকে তাকাচ্ছে না। বুলেটের মত তীক্ষ্ণ কথাগুলো অবলীলায় বলে যাচ্ছে দৃষ্টি সামনে রেখে। কি শান্ত! কি অবিচল! কিন্তু কিরণ তো পারছে না শান্ত থাকতে। সে তো পারছে না রোবট মানব হয়ে নির্বিঘ্নে কথা বলতে, জবাব চাইতে। কন্ঠনালী কেঁপে উঠছে নিসৃত শব্দের সাথে সাথেই। কিরণ আর কথা বলতে পারলো না। অসাড় হয়ে আসা শরীরটাতে কিছুটা শক্তি সঞ্চার করা প্রয়োজন। মনের জোড় প্রয়োজন। ধীরে ধীরে কিরণ নেমে দাঁড়ালো। মনে হলো যেনো ভুমিকম্প হচ্ছে। প্রায় সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প। যেকোনো সময় ভূমি ফেটে ওঠবে। কিরণের এই অসাড় শরীরটা সেই গহ্বরে পড়ে রইবে।
কিরণ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দু হাতের মুঠোয় তার জামার দু পাশের প্রান্ত। আকাশের দিকে মাথাটা উঁচু করে তাকিয়ে প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিলো। মানুষ যখন দুঃখে পতিত হয় তখন সে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিরণ এ কথার মর্মার্থ টের পেলো। শুকনো গলায় ঢোক গিলে। কন্ঠ শান্ত হয়ে আসছে। চারপাশটাই কেমন যেন নির্জীব লাগছে। নিজের ভেতরের উত্তাল ঝড়টাও থেমে আসছে হঠাৎ। কিরণ বুঝতে পারলো ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ। কালবৈশাখী থেমে হয়তো ঘূর্ণিঝড়ের সূত্রপাত হচ্ছে। সে যাই হোক। এখানে না হোক। নরম মনটা যেটুকু গলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে সেটুকু গুছিয়ে অর্ণবের চোখের আড়াল হতে পারলেই শান্তি। কিরণ শান্ত গলায় বললো,

ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে অগ্রিম শুভকামনা। আপনার আমার পথ মানে আমাদের চেনা পরিচয়ের সফর আজ এ মুহুর্তে শেষ হলো তবে। আল্লাহ হাফেজ!

কিরণ আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ালো না। অর্ণবকে পিছু ফিরতে দেখেই মূলত দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছে। অর্ণবের মুখোমুখি আর হতে চায় না। সেই শক্তিটুকুও নেই। একটা বারের জন্য পিছন ফিরেও দেখে নি। দেখলে হয়তো জানতো তার বিপরীতে থাকা মানুষটার ব্যাথাকাতুরে মুখটা। রক্তিম চোখ জোড়া। ভেতর থেকে ভাঙা পরিপাটি বিবর্ণ শরীরটা।
—–

ঘড়ির কাটার শব্দে চমকে উঠে অর্ণব। ঘুমে লেগে আসা চোখজোড়া দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো রাতের শেষ প্রহর। কিরণ এখনো তার পায়ের কাছে ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। অগোছালো হয়ে আসা কয়েকটা চুল সযত্নে কানের পিঠে গুঁজে দিলো। সাবধানে কোলে তুলে নিলো কিরণের ঘুমে কাতর শরীরটা। বিছানায় শুয়ে দিয়ে চাদরটা টেনে দিলো বুক পর্যন্ত। পাশেই নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে। পাশে ফিরে কিরণকে দেখে নেয়। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কিরণের প্রমত্ত মুখটা ছবির মতো অর্ণবের চোখে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সেসব দৃশ্য কিরণ সজ্ঞানে দেখলে নির্ঘাত বলতো এ কান্ড কিছুতেই তার নয়। হয় এ মেয়ে তার প্রতিরূপ নতুবা অর্ণব ভিডিওর সাথে কোনো কারসাঝি করেছে। নির্দ্বিধায় বলে ওঠতো, ‘ অর্ণব! আপনি অসভ্যের সাথে সাথে অত্যন্ত ধুরন্দর লোক। আপনাকে আমি জেলে পাঠাবো একদিন দেখে নিয়েন। ‘

অর্ণব কথাগুলো মনে করতেই আনমনেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। কিরণের ললাটে গভীর চুমু দিয়ে কিরনকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। ঘাড়ে মুখ গুজে চোখ বন্ধ করে নেয়। মত্ত হওয়া বউয়ের এতটুকু ফায়েদা উঠানোই যায়। ইহা জায়েজ।

খাওয়া দাওয়া সেড়ে মাত্রই ঘরে ডুকেছে কিরণ। আজকে তার বাতিল কৃত পরীক্ষাটির পুনরায় পরীক্ষা হবে। ভোরে নিজেকে অর্ণবের বুকে আবিষ্কার করে বেশ অবাক হয়। মাথাটাও ভার হয়ে ছিল। গতকালকের নেশা করাটা তো তার মনে আছে কিন্তু তার পরের ঘটনা মাথা ঠুকেও মনে করতে পারে নি। অর্ণবের সাথে এক পশলা ঝগড়া করেও কোনো সুবিধা করে ওঠতে পারে নি। মানুষটা বরাবরের মতোই নীরব ছিল। সারা দুনিয়ার মানুষ যার রাগ সম্পর্কে অবগত সেই মানুষটার সাথে এক বিছানায় থেকেও রাগটা দেখতে পেলো না। কিরণ কিছুতেই অর্ণবকে রাগাতে পারে না। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। বরং তাকে কোলে করে নিয়ে গোসলে ছেড়ে দিয়ে দরজা আটকে দিয়েছিলো। গোসল না করে কিরণকে আজ ঘরের বাহিরে বের হতে দেবে না। মাথা ভারের কারণে কিরণও বাঁধা দেয় নি।

খাওয়া শেষে ঘরে এসে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। দ্রুত জামা বদলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াবে তখনই দেখতে পেলো অর্ণবও রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। পড়নের সাদা শার্টটার হাতা গুঁজছে। চুলগুলো আঁচড়ানোও শেষ! অর্ণবের কাজের দ্রুততা দেখে কিরণের চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা। আনুমানিক পাঁচ মিনিট হয়েছে কিরণ পোষাক পরিবর্তন করতে গিয়েছে। এরই মাঝে অর্ণব পুরোপুরি তৈরী। অর্ণবের বেশ ভুইয়ায় কিরণের মনে কিশোরী বয়সের ন্যায় অনিরাপত্তাহীনতা তৈরী হল। এ রূপ কোনো মেয়ে দেখলে নিশ্চিত সে একবার হলেও পিছু ঘুরে দেখবেই। পরক্ষণেই মনে পরলো অর্ণবের কর্মস্থলে কোনো মেয়ে নেই। মুহুর্তেই মন ফুরফুরে হয়ে এলো। শরতের এই শুভ্র মানবটকে আড়চোখে দেখে নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলটা আচড়িয়ে নেয়। কিরণ প্রায় ষাট শতাংশ তৈরী হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অর্ণবে তখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সে মানুষ পাঁচ মিনিটে পুরো তৈরী হতে পারে সেই মানুষ বিগত দশ মিনিট যাবৎ চুল, শার্টের ইং, হাতের ঘড়ি ঠিক করে যাচ্ছে। ভাবা যায়! কিরণ অর্ণবের দিকে আবারো আড়চোখে তাকিয়ে মনে মনে শ খানেক উদ্ভট গালি দিয়ে নিল। অর্ণবের এতো সাজগোজ, পরিপাটি হয়ে থাকা কিরণের মোটেও পছন্দ হয় না। ছেলে মানুষ এতো সাজতে হবে কেন? এমনিতেই দ্রব্যসামগ্রী ছাড়াই সে কিরণের থেকে এক দাগ বেশি উজ্জ্বল। সেই হিংসেতেই কিরণের ত্বক যেন জ্বলে আরো এক দাগ কালো হয়ে গিয়েছে। তার মাঝে তো আছেই নারী সন্ক্রান্ত ভয়। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে যাবে তখনই ঝড়ের বেগে ঠোঁটের উপর আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গেলো কিরণ। কি হলো বুঝতে পাক্কা এক মিনিট সময় লাগলো। যতক্ষণে বুঝেছে ততক্ষণে অর্ণব কিরণের ঠোঁট ছেড়ে পারফিউমের বোতলটা হাতে নিয়েছে। ঘাড়ের দুই পাশে স্প্রে করতে করতে স্বাভাবিক গলায় বলে,

আমি চুমু দেওয়ার আগে নো লিপস্টিক, নো মেরিল অনলি মাই লিপস।

কিরণের চোখে চোখ রেখে এক চোখ টিপে পারফিউমের বোতলটা হালকা শব্দ করে রেখে গটগটিয়ে বেড়িয়ে যায়। কিরণ পিছনে মূর্তির মতো শুধু তাকিয়ে থাকে অর্ণবের দিকে। আর বরাবরের মতোই অর্ণবের জন্য রাখা নির্দিষ্ট বকাটাই মনে ঘুরপাক খায় ‘ অসভ্য ‘।

চলবে ~~~~~

প্রিয় পাঠকগোষ্ঠী, নেক্সট না বললেও আমি নেক্সট পর্ব দিবো। তাই অনুগ্রহ করে সুন্দর, গঠনমূলক মন্তব্য করুণ। ধন্যবাদ।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here