বিবাহনামা পর্ব ১ + ২
——————————-
“এই যে দুলাভাই, এদিকে একবার আসুন তো।”
আমার শ্যালক শুভ্র। দিন রাত ডাকাডাকির ওপরই আছে ছেলেটা। যেন ও ছাড়া এ জগতের আর কেউ ইহজন্মে বিয়ে থা করেনি।
শ্বশুরবাড়িতে যে আরামে আয়েশে গা এলিয়ে থাকবো সেই উপায় নাই।
অগত্যা যেতেই হলো,
“দুলাভাই, বুটের ডাল দিয়ে গোরুর একটা আইটেম করলে কেমন হয় বলেন তো। মেজবান রেজালা এসব তো থাকছেই।”
ভালো হয় তো। আলাদা করে ডাল করবার খরচ বেঁচে যাবে।
“তাহলে গরুর কালা ভূণাটাও লিস্টে রাখি কি বলেন?”
“মন্দ হয় না। আচ্ছা গরুর মাংসের চাঁটনি হয় না? বেশ জমবে তাহলে। বাবুর্চিকে বলে দেখো তো একবার। বানাতে পারবে নাকি। দাওয়াতি মানুষজন নতুন রেসিপি দেখে নির্ঘাত চমকে যাবে।”
কথাটা বলে বেশি জুঁত করতে পারলাম না। শুভ্র আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে। বোয়াল মাছের মতো কোৎ করে গিলে না ফেললেই বাঁচি।
“ফাইজলামি করেন মিয়াঁ? গরুর মাংসের চাঁটনি! শালার বিয়ে বলেই এমন তামশা করতেছেন। সব বুঝি আমি। বড়পা এই বড়পা দুলাভাই আমার মাথাটা গরম করে ফেলছে একদম। জলদি এক গ্লাস লেবুর শরবত দিয়ে যা এখানে।”
আমি পরিস্থিতি আরো খানিকটা গুনগনে করতে জ্বলন্ত কাঠ কয়লায় খানিক ঘি ছড়িয়ে দিলাম।
“বেশি করে বরফ দিও মৌরি। শুভ্রর গরম শরবত বিলকুল লাইক করেনা।”
এবার শুভর বড়পা মানে আমার স্ত্রী মৌরির জন্য অপেক্ষা করছি। তুর্না নিশিথীনির গতিতে তেড়ে না আসলেই হলো।
বাবুর্চি গুলিও হয়েছে এক একটা রাম গাধা। কত করে বললাম রুপচাঁদা ডিপ ফ্রাই না শ্যালো ফ্রাই করে দোপেয়াজা করবে। তাও কিনা পরশু ভোরে করার কথা। এখনই প্রায় পনেরটা মাছ কড়কড়ে করে ভেজে রেখে দিয়েছে। কার ভালো লাগে এসব।
“মৌরি এই মৌরি আমাকেও এক গ্লাস লেবুর শরবত দাও। এক মাত্র শালার বিয়ে অতচ কোনো আদর আপ্যায়নই নাই।”
“কে বলেছে তোমাকে কলুর বলদ সাজতে। ক্ষনে ক্ষনে তো ছেলেটাকে ক্ষ্যাপিয়ে মারছো।”
“না ক্ষ্যাপিয়ে কি করবো বলো। পাঁচ’শ লোক খাওয়াবে তাও গরুর আইটেম হবে নাকি চারটা। রাতে আবার হলুদে নাচবে চৌদ্দটা গানের সাথে। কিছু হিন্দি কিছু সিন্ধি। সেই রিহার্সেলের আওয়াজে আমার কান ঝালাপালা হবার উপক্রম। কোনো মানে হয়?”
” অবশ্যই মানে হয়। তোমার মতো বেরসিক মানুষ এসবের কি বুঝবে। এক পাঞ্জাবি পরে এসে তিন কবুল বলে তো বিয়ে করলে। আজ অব্দি তোমার সংসারের ঘানি টানছি।”
“ঘানি আবার কবে টানালাম তোমাকে দিয়ে মৌরি। বেস্ট কোয়ালিটির সরিষার তেল কিনে খাই। তার ওপর বছরের তিনশ পয়ষট্টি দিন মশারীটা পর্যন্ত আমি টানাই। এতো বড় মিথ্যা অপবাদ কি করে দিলা মৌরি।”
“ধুর বাবা তোমার মত জাঁদরেল উকিলের সাথে কেউ কথায় পারে। কোথায় ঘানি আর কোথায় মশারী টানি।”
ধপ করে শরবতের গ্লাস রেখে রাগে গজ গজ করতে করতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো শুভ্রর বোন ওরফে আমার স্ত্রী মৌরি।
এই মেয়েটার একটাই দোষ। রাগটা একদম নাকের আগায় তির তির করে। কথার নিশানা একটু এদিক সেদিক হকেই চট করে রেগে আগুন।
ওদের ভাই বোনের নানান রকম বিতং বাদ দিয়ে আমি বাবুর্চি ব্যাটার দিকে নজর দিলাম।
তা বাবুর্চি সাহেবের এটা কত তম পাক?
বাবুর্চির সাথে সাহেব শব্দের সংযোজন আমার নতুন আবিষ্কার। এইমাত্রই এই মহৎ আবিষ্কার খানা করলাম।
তবে সাহেব সম্বোধনে খুশি হলেও ব্যাটা আমার কথার মর্মোদ্ধার করতে ব্যার্থ হয়েছে।
“ভাইজান বাংলায় বলেন।”
“বাংলায়ই তো কইলাম বাবুর্চি সাহেব।”
“কি কন পাক ফাক। এই গুলান কিন্তুক ভালা কথা না। আমি ভদ্র ঘরের পোলা।”
“আরেহ কি যন্ত্রণায় পড়লাম। পাক মানে হইলো রান্না। আমি জানতে চাইছি এইটা আপনার কততম রান্না।”
“কিলিয়ার কইরা বলবেন না। এইটা নিয়া নিরানব্বই। আরেকটা বিবাহের রান্ধন রানলে সেঞ্চুরী হইবো।”
“বাহ দারুন তো। কেউ খেলার মাথে সেঞ্চুরি হাকায় আর কেউ রান্নার পাতিলে। তা সেঞ্চুরি হবে হবে বাবুর্চি সাহেব আপনি কি মনে করে, পরশুর জন্য রাখা রুপচাঁদা এখনই কড়কড়ে ভাজি করলেন। যদি এই অভাগাকে একটু বুঝিয়ে বলতেন।”
“আসলে ভাইজান, এইটা আমার শাগরেদের ভুল। পোলাটা কানে খাটো। বলছেন দোপেয়াজা। শুনেছে ভাজা ভাজা। কী মুসিবত বলেন তো।”
“বিয়ের রান্না বান্নায় এসমস্ত তং বং আমার না পছন্দ। দাওয়াতী মানুষ যদি কবজি ডুবিয়ে খেয়ে আঙুলই না চাঁটে সেটা আবার কেমন দাওয়াত। সাতটা ভেজেছেন ভেজেছেন। বাকিটা পরে তরতাজা ভাজবেন। এখন রাখেন”
বাবুর্চিকে ব্যাটাকে কঠিন গলায় বললাম এবার।
“কানে খাটো না লম্বা সে হিসাব পরে করবো। আধা ঘন্টার মধ্যে আজকের মেনুর মোরগ টেস্ট করাবেন কিন্তু।”
এই বলে গমগমিয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলাম। কিছুক্ষন জিরিয়ে নেয়া উচিৎ।
ওমা মৌরি কোথায় যাচ্ছে এখন? টুসিকেও সাথে নিচ্ছেনা। বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
” বাবা, আমিও যাবো। মা নিবেনা বলছে”
একঘন্টা পর অনুষ্ঠান। এখন কোথায় যাচ্ছে তোমার মা? নিশ্চই পার্লারে।”
“তেমনই তো হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু যাচ্ছি কোথায় দেখো। হাসপাতালে!”
আমার মুখটা বরাবর তিন ইঞ্চি পরিমানে হা হয়ে গেলো। বলে কি এই মেয়ে। উৎসবের দিনে কার আবার কি হলো?
বিবাহনামা পর্ব ২
————————
“হাসপালাতালে না গিয়ে উপায় কি? বিবাহের কন্যা বেহুঁশ।”
“কী হেঁয়ালি শুরু করে দিলা মৌরি। এমন সিচুয়েশানে কেউ হেঁয়ালি করে?”
আমি উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলাম। মৌটুসিটাও মায়ের ওপর অভিমান করে আমার কোলে চড়ে বসে আছে।
“আমার কোন কথাটা তোমার হেঁয়ালি মনে হলো টুসির বাবা?”
ওহ্ বলতে ভুলে গিয়েছি। মৌরি আমাকে টুসির বাবা বলে ডাকে। মা মেয়ে দুজনের নামেই মৌ আছে কিনা। তাই মৌ বাদ দিয়ে শুধু টুসি।
মৌরি ঠোঁটে লিপ্সটিক দিতে দিতে কথাগুলো বলছে।
“এইযে বললে কন্যা বেঁহুশ। আর তাছাড়া ঠোঁটে রগরগে লিপস্টিক লাগিয়ে নিশ্চই কেউ হাসপাতালে যায় না।”
“যেই বিয়েতে কনে বেঁহুশ হয়ে চিৎপ্টাং হয়ে পড়ে থাকে। সেই বিয়েতে কনের ননাশ কড়া করে লিপস্টিক ঘষেই হাসপাতালে যায়।”
নারী জাতির কথা এমনিতেই আমার সহজে বোধগম্য হয় না। এখন তো আরো বড় প্যাঁচ লেগে গেলো।
“আমি পই পই করে বলছিলাম। যে মেয়ে কথা বলার সময় অমন নাক মুখ নাচায়। সেই মেয়ের নির্ঘাত মৃগী রোগ আছে। নইলে কেউ এমনি এমনি ফিট খেয়ে পড়ে? আমার এমন আদরের ছেলেটা শেষে কিনা একটা মৃগী রোগীকে পছন্দ করলো!”
যাক শ্বাশুড়ি মহোদয়ার লম্বা মন্তব্যে আমি বুঝতে পারলাম বিবাহের কন্যার মাঝে কিছু একটা সমস্যা তো আছেই।
“আম্মা কি শুরু করলা বলোতো। বিয়ের আগেই নিজের
ছেলের বউয়ের বদনাম শুরু করছো। মর্জিয়া কিটো ফলো করছিলো। প্রেসার ফল করায় মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ওর হিমোগ্লোবিন ও কম। তাই ওরা হাসপাতালের ভর্তী করে দিয়েছে।”
“এই এই, কি ফলো করছিলো আরেকবার বলো? আমি জানতাম মানুষ ফেসবুকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করে। কিটো আবার কোন গ্রাম? খায় না মাথায় দেয় মৌরি?”
“দেখছো ছাব্বির দেখছো? কি ভুলভাল বুঝাইতেছে আমারে!”
শ্বাশুড়ি আম্মার কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে। না হলে কেউ কাউকে ফলো করে অজ্ঞান হয়ে যায়?
এরই মাঝে আমার শ্যালক তথা হবু বর শুভ্রর আগমন ঘটলো দৃশ্যে।
“এই আপা, গাড়ি রেডি। কান্তা, মলি, সায়েরা ওদেরকেও নিয়ে নে। মর্জিয়া হাসপাতাল থেকেই আবার পার্লারে যাবে। আমাকে চুলের জন্য ম্যাচ করে পার্পল অর্কিড নিতে বললো। তুই সাজবিনা? আর টুসি? ওর লেহেঙ্গা কোথায়?”
শুভ্রর তাড়া দেখে আমার অস্থিরতা আরো বাড়লো,
“আমাকে কি বুঝিয়ে বলতে তোমাদের বেশি সময় লাগবে শুভ্র। বাবুর্চিকে কাজ দেখিয়ে এসেছি। কি হলো, খোলসা করে বলো। আমাদের কনের কি হয়েছে?”
“তেমন কিছু না দুলাভাই। ও স্ট্রিক্ট ডায়েট ফলো করেছিলো। ভাত খায়নি আজকে পনেরদিন। তাই প্রেসার ফল করেছে। আপনি ওদিকটা সামলান।”
টুসিটা এখনো গলা ধরে বসে আছে। আর আমি ভাবছি পনেরদিন ভাত না খেয়ে মর্জিয়া কি খেয়ে ছিলো। বাতাস তো নিশ্চই নয়।
শ্বাশুড়ি আম্মা একদমই রাজি ছিলেননা এই বিয়েতে। তার মতে এই মেয়ের চেয়ে লক্ষ গূণ সুন্দরী মেয়ে উনি শুভ্রর জন্য খুঁজে বের করতেন। এখন কিটোর কথা শুনে উনি যারপরনাই হতাশ।
বাবুর্চিকে আবার বলে এসেছি পোলাও বসাতে চুলায়। আমার কি আর এসব খুচরা কাজ নিয়ে বসে থাকলে চলবে?
“তোমার পাঞ্জাবী, কোট সব আলমারীর তিন নাম্বার তাকে রেখে দিয়েছি। পরে রেডি হয়ে থাকবে। আমরা একেবারে সাজগোজ করেই ফিরবো।”
বলেই মৌরি টুসিকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।
বাড়িভর্তি এতো লোক। তবুও মৌরি বাড়িতে নেই দেখে কেমন পাতালপুরীর মত ফাঁকা লাগছে চারপাশ। আমি কি আমার রাগী বউটাকে খুব বেশি ভালোবাসি। বাসি হয়তো!
“দুলাভাই, হলুদের প্যান্ডেলে গেন্দা ফুল দিতে মানা করছে মৌরি আফা। জাবেরা দিতে কইছে। আমি কি ফুল আনতে যামু?”
দারোয়ান রশিদের কথাবার্তা আমি এমনিতেই অর্ধেক বুঝি অর্ধেক বুঝিনা অবস্থা। সে আবার এই জাবেরা ফুলের উদ্ভাবন কোত্থেকে করেছে আল্লাহ মালুম।
“তোমার আপা কি বলেছে? নেড়েচেড়ে ঠিক করে বলো। জাবেরা কোন দেশি ফুল? চীন দেশী?”
“আফনে আফারে ফুন কইরা জিগান দুলাভাই। আমার তো আবার সব কথায় দুষ।”
মুখটা কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো রশিদ।
মাত্র ওরা রওনা হলো। এখন আমার ফোন পেয়েই নিশ্চিত ঝাড়ি দিবে মৌরি।
“হ্যালো, মৌরি। জাবেরা ফুল কোন দোকানে পাওয়া যায়? কেমন দেখতে?”
“এটা আবার কেমন ফুল? কে বলছে এই আজগুবি ফুলের কথা। একটা কাজও কি তুমি আমাকে ছাড়া করতে পারোনা টুসির বাবা!”
” আমি আবার কি করলাম। রশিদই তো বললো। নাও ধরো ওকেই বুঝিয়ে বলো।”
যাক ওরা বুঝে নিক জাবেরার ঝামেলা। আমি দেখি মোরগ পোলাও কতদূর এগোলো।
“দুলাভাই ও দুলাভাই, এইডা জার্ভেরা ফুল। এইবার বুঝছি”
একগাল হাসি দিতে দিতে বললো রশিদ। হাসির সাথেই ওর পোঁকায় খাওয়া সামনের দাঁতের পাটি ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
আমি কঠিন গলায় বললাম,
” হাসি বন্ধ করো রশিদ। ফুল নিয়ে এমন ভুল আর কখনো করবেনা।”
আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। শ্বশুর পক্ষের আত্বীয় স্বজনেরা এক এক করে সব আসছেন। তাদের জন্য আলাদা চুলায় চা আর গরম ডালপুরির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। এখনো পুরোপুরি স্বন্ধ্যে না নামলেও দিনের আলো ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। প্যান্ডেলে আমি স্ট্যান্ড ফ্যানের ব্যাবস্থা করেছি। তবুও ঘামে ভিজে জবজব করছে আমার আড়ং এর ফতুয়াটা।
আমার নিজের বিয়ে হয়েছে সম্পুর্ন আয়োজনহীন এক মাঘ মাসের রাতে। তাই শুভ্রর বিয়েতে নিজ হাতে সব কিছু করে অন্য রকম এক আনন্দ পাচ্ছি।
” দুলাভাই স্টেজ কেমন সাজালাম একবার দেখে যান। শুভ্র ভাই পথে আছে। উনি আসার আগে যদি একবার আপনি দেখতেন।”
আমার খালাতো শ্যালক নাজমুলের ডাকে উঠে গেলাম।
” বাহ্ চমৎকার করে সাজিয়েছিস তো তোরা। কিন্তু দুই পাশে আরো কিছু রজণীর লতা বাড়িয়ে দে। আর সামনের চেয়ারগুলো সার করে সাজিয়ে রাখ।”
ওদের বলে এসে আমি বার বার গেটের দিকে তাকাচ্ছি। মৌরিরা আসবে না নাকি। মর্জিয়াকেও তো হলুদ দিতে যেতে হবে আমাদের।
“ছাব্বির বাবা একটু এদিকে শুনে যাও।”
শ্বাশুড়ি আম্মার গলার স্বর হঠাৎ এরকম শোনাচ্ছে কেনো?
আমি তড়িঘড়ি সব ফেলে বাড়ির ভেতরে গেলাম। চারতলা বাড়ির নীচতলার দুই ইউনিট জুড়েই মৌরিরা থাকে। অবশ্য এখন আমিও এইখানেই থাকি। যাওয়ার মতো সেরকম কোনো জায়গা নেই আমার।
তবে আম্মা আমাকে গর্ভের সন্তানের মতই স্নেহ করেন।
গিয়ে দেখি আম্মা নিজের ঘরে একা চুপচাপ বসে আছেন। সারা বাড়ি মানুষজনের ঢল। অথচ আম্মার রুমটা ফাঁকা।
“ছাব্বির আসছো। তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। মৌরি ফেরার আগেই বলে ফেলতে চাই। তবে তার আগে আমার প্রেসারটা একটু চেক করো তো বাবা। শরীরটা কেমন ঘাম দিতেছে”
আমি ওয়াড্রবের ওপর থেকে ডিজিটাল প্রেসার মাপার যন্ত্রটা নামালাম। এলাচি কে ডেকে আম্মার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে বললাম। এলাচিকে ডেকে দেখি বিপদ আরো বাড়লো। লোকজন সবাই একে একে এসে আম্মার ঘরে ভীড় বাড়াচ্ছে।
“এই ঘরে এখন কেউ আসবানা। আমার কিছু হয়নাই। শুভ্রর বউ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। আমি শক্ত মানুষ। একদম ঠিক আছি।”
আমিও এবার মুখ খুললাম,
“যাননা সবাই। আমি তো আর বানরের খেলা দেখাচ্ছিনা এখানে। কি দেখাচ্ছি খেলা?”
কথা শুনে যে যার ঘরে ফিরে গেলো। কিন্তু জনরোলে কলকল করে উঠলো চাপা গুঞ্জন। তবে আমিও যে খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়িনি তা কিন্তু নয়। হাজারটা কাজ ঘাঁড়ের ওপর বন্দুকের নলের মতই তাক করে রাখা। এক ইঞ্চি ভুলচুক হবার সুযোগ নেই। শুভ্র বিয়ে না করে আমি করে ফেললেই বেশ হতো।
ধুর! এক মৌরিকে নিয়েই আমার জীবন ছাই হয়ে বাতাসে উড়ছে। আরেকজন এলে হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজে ছাইও আর অবশিষ্ট পাওয়া যাবেনা।
আমি আপাতত এসব ভাবা বাদ দিয়ে আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মাকে যতটুকু চিনি। সরলমনা হাসিখুশি মানুষ তিনি। আমার শ্বশুর আব্বা মারা যাবার পরও কখনো এতোটুকু বিচলিত হতে দেখিনি।
কিন্তু এতোদিন বাদে কঠোর গোপনীয়তায়, আম্মা কি কথা বলবেন আমাকে?
মা কি জিনিস আমি জানিনা। মায়ের গাঁয়ের সুঘ্রাণের কথা জীবনে বহুবার শুনেছি। কিন্তু সেই ঘ্রানের সাথে আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের কোনোও সম্পর্ক নেই। তবে এ বাড়িতে আসার পর আম্মার আসে পাশে ঘুর ঘুর করে আমি সেই ঘ্রানটা খুঁজে মরতাম। আম্মা হয়তো বুঝতে পারতেন না কখনো।
কাঠের চেয়ারটা টেনে আম্মার বিছানার পাশে বসলাম। প্রেসারটা অনেক বেশি।
” আম্মা এলাচিকে বলি পাতলা করে একটু তেঁতুলের শরবত করে দিক। খেলে আরাম পাবেন।”
” আচ্ছা, বলো। কিন্তু আমার কথাটা? ”
” হ্যাঁ আম্মা বলেন, আমি শুনতেছি।”
” নাফিজের কথা তো তুমি সবই জানো। আমার ননদ জাহানারার একমাত্র ছেলে। মৌরির সাথে যার বিয়ে হতে গিয়ে ভেঙে গেলো।”
আম্মা হঠাৎ কেনো এসব কথা বলছেন? আমি জানিনা। মৌরি প্রচন্ড রাগি একথা সত্য। আমাকে ভালোবাসেনা সে কথাও সত্য। কিন্তু এখন নাফিজ ভাইয়ের কথা আনার কি প্রয়োজন পড়লো?
আমি সমস্ত উৎকন্ঠা আড়াল করে বললাম।
“আম্মা, নাফিজ ভাইকে না চেনার তো কিছু নেই।
উনি আমার সতীন হতে হতেও শেষ পর্যন্ত হননি।”
আমি দু’ঠোঁট ফাঁক করে কিছুটা হাসার চেষ্টা করলাম।
“ছাব্বির, সব সময় কিন্তু ঠাট্টা তামাসা ভালো লাগেনা। ছেলে মানুষের সতীন আবার কি হ্যাঁ? সতীন হয় মেয়েদের।”
” তাহলে ছেলেদের ক্ষেত্রে কি হবে আম্মা? তাছাড়া আমি জানি মৌরি এখনো নাফিজ ভাইয়ের কথা ভেবে প্রায় রাতেই কাঁদে।”
কথাটা বলে শেষ করে দেখি।
আম্মা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
” তুমি কি আমাকে কথাটা বলতে দিবেনা ছাব্বির?”
আম্মার চোখে ভয়াবহ বিরক্তির ছাপ!
(চলবে)
লেখা : Noor Helen
১১/০৪/২০২১