#কুয়াশায়_ঘেরা #পর্ব_০৬ #জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

0
305

#কুয়াশায়_ঘেরা
#পর্ব_০৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

জীবনকে আমরা যতটা সহজভাবে নিই, জীবন ততটা সহজ নয়। স্ট্রাগল করা ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। জীবন যুদ্ধে সবাই এক একটা সৈনিক।
তুর্শি মেয়েটাও হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্তে বাঁচার জন্য একজন সৈনিকের মতো লড়াই করে গিয়েছে।

প্রভাতির কাছ থেকে তেমন কোনো ইনফরমেশন পাওয়া যায়নি, যা কে*সটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অন্ধকারে প্রভাতি অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখ স্পষ্ট দেখেনি, তার উপর মুখের একপাশ দেখা গিয়েছে। তবুও ইলান বলল,
-“তুমি অন্ধকারে যতটুকু তার শরীরের গঠন দেখেছো তার একটা বর্ণনা দেবে। আমরা তার একটা স্কেচ তৈরি করবো।”

ইলানের কথায় দ্বিমত করেনি প্রভাতি।

-“তোমাকে বিকেলে এসে নিয়ে যাবো। তৈরি থেকো।”
বলে ইলান উঠে পড়লো আশরাফুলকে সাথে নিয়ে।
দুজনই আশরাফুলের রুমে স্থান নিলো। দরজা চাপিয়ে বারান্দার খোলা হওয়ায় গিয়ে দাঁড়ালো তাঁরা। আশরাফুল চিন্তিত গলায় বলল,
-“প্রভাকে নিয়ে আমার প্রচুর ভ’য় হচ্ছে। মা এসব ব্যাপারে কিছুই জানেনা। তাকে জানাইনি।”

ইলান সান্ত্বনা দিলো আশরাফুলকে। পিঠে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বলল,
-“রিল্যাক্স, আমি আছি তো!”

আশরাফুল ইলানের চোখে চোখ রাখলো। তার কন্ঠে দৃঢ়তা, চোয়াল জানান দিচ্ছে কঠোর ব্যক্তিত্ব। বন্ধু বলেও কোনো ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলল না। সোজাসুজি কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“কতটা আছিস আমি জানি। কিন্তু তোর এই থাকা না থাকা সম্পূর্ণ প্রভার উপর নির্ভর করে। প্রভা না চাইলে কিছুই সম্ভব নয়। আমার বোন সে। তার পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব আছে আমার কাছে। তাছাড়া প্রভা এখন আর বাচ্চা নেই, এডাল্ট পারসোন। নিজের লাইফ নিয়ে যেকোনো রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আর ক্ষমতা দুটোই তার হয়েছে। অন্ধের মতো তার উপর আমি নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারিনা।”

ইলানের চোয়াল জোড়া ও শক্ত হয়ে এলো ক্ষোভে, অপমানে। তার দোষ কতটুকু সে জানেনা। একজন মানুষকে কতটা চাইলে তাকে পাওয়া যায় সে ধারণা টুকুও নেই ইলানের। তার রাগ আশরাফুলের উপর নয়। তার সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, ঘৃ’ণা, ভালোবাসা, অভিমান প্রভাতির ওপর। খুব অহংকারবোধ নিয়ে চলে মেয়েটা। ইলান শান্ত অথচ গমগমে স্বরে জানান দিলো,
-“আমি আমাদের টিম থেকে সিকিউরিটি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। নিজের ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আয়।”

মাঝখানে বাঁধ সাধলো আশরাফুল।
-“প্রভাকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেবো। যতদিন না কে*সটা সলভ হচ্ছে, ততদিন সে ইন্ডিয়ায় থাকবে।”

বিস্ফোরিত নেত্রে চাইলো ইলান। কপালের রগ দপদপ করে ফুলে উঠলো। দাঁতে দাঁত লেগে শক্ত চোয়ালে লালিমা ছড়ানো একজোড়া চোখ ধপ করে জ্বলে উঠলো। মেয়েটাকে কিছুতেই দূরে সরানো যাবেনা। এখন আছে, দৃষ্টি সীমানায় আছে। দূরে গেলে চোখের তৃষ্ণা, একবুক হাহাকার নিয়ে তলিয়ে যাবে সে। আশরাফুলকে ধমকে উঠলো ইলান,
-“না বুঝে বোকার মতো কথা বলিসনা। প্রভা বাংলাদেশে থাকবে। আর তার সেইফটির জন্য আমাদের টিম রয়েছে। একবার ভেবে দেখ, যে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে সে কিন্তু ইন্ডিয়াতেও যেতে পারে। তাই ইন্ডিয়া ও ওর জন্য সেইফ না। কাছাকাছি থাকলে টেনশন ফ্রী থাকতে পারবি। আশা করি বুঝতে পেরেছিস।”

আশরাফুলকে চিন্তিত দেখা গেলো, তবে তার চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই অন্তরের অভিব্যক্তি।
দেরি করলোনা ইলান। তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লো। গায়ে অফিসের জ্যাকেট চাপিয়ে ফোন করলো শিহাব কে।

তুর্শির বাড়িতে গিয়ে জাকিয়া মেয়েটার সম্মুখীন হলো। মেয়েটার চোখদুটো নির্ভয়ে তাকিয়ে আছে। তার স্বচ্ছ দৃষ্টি বলছে মেয়েটা মিথ্যে বলছেনা।
“তুর্শির কোনো সম্পর্ক ছিলোনা। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”

মেয়েটির কথা শুনে আশাহত হলো ইলান।
সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনোভাবেই কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছেনা।

এখন একমাত্র ভরসা প্রভাতি। তার দেওয়া বর্ণনায় যতটুকু মানুষটিকে চেনা যায়।

———————

ইলানের ভাই মাহিন কালই বাসায় ফিরেছে। এখন হুট করেই বাসায় এসে আনোয়ারা জাহানের সাথে কুশল বিনিময় করলো। আনোয়ারা জাহানকে কেমন তিরিক্ষি মেজাজে কথা বলতে দেখা গেলো। মাহিন ধারণা করে নিলো উনার মানসিক সমস্যাটি পূনরায় চড়ে গিয়েছে। মাহিন এতদিন ভার্সিটির কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে থাকতো। প্রয়োজন ছাড়া তাকে বাসায় দেখা যায়না।
আনোয়ারা জাহানের মেজাজের কাছে হার মেনে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো সে। প্রভাতির সাথে দেখা করা হলোনা।

বিকেলেই ছাদে দেখা হয়ে গেলো প্রভাতির সাথে। অবাক হলেও মিষ্টি হেসে প্রভাতি জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি বাসায় কখন এলে?”

মিটিমিটি হেসে ছাদের দরজা থেকে সরে এলো মাহিন।
-“এসেছি গতকাল। সকালে তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েও পারিনি। আন্টি হাইপার হয়ে আছেন।
বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কিন্তু দিনদিন সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো।”

ঘন ঘন চোখের পলক ঝাপটিয়ে মৃদু শব্দে হাসলো প্রভাতি।
-“তুমি ও কিন্তু দিনদিন ফ্লার্ট করতে অতিরিক্ত অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছো।”

মাহিন অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-“এই যাহ! আমি ভাবলাম প্রশংসার বদলে প্রশংসা পাবো। কিন্তু এ তো দেখছি অপ’মান করতে ছাড়ছেনা।”

প্রভা বলল,
-“ওভার অক্টিং করা বাদ দাও। আমি নিচে যাচ্ছি। পরে দেখা হলে কথা বলবো।”

-“সেকি! কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

মাহিনের কথার প্রত্যুত্তরে জবাব দিয়েই সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিলো প্রভাতি।
-“তেমার ভাইয়ের সাথে তার অফিস যেতে হবে। কিছু কাজ আছে।”

মাহিন বলল,
-“ভাইয়াকে কষ্ট করে আসতে হবেনা। চলো আমিই তোমাকে দিয়ে আসছি।”

-“তোমার কষ্ট করতে হবেনা। তাছাড়া আমার কিছু শপিং করা দরকার আছে।”

মাহিন আশ্বস্ত করে বলল,
-“ডোন্ট ওরি! আমার কোনো প্রবলেম নেই। তুমি রেডি হয়ে নাও। আমি নিচে আছি।”

আর না করতে পারলোনা প্রভাতি। মাহিন ইলানকে কল করে জানিয়ে দিলো প্রভাতিকে সে নিয়ে আসছে।

“শিট” বলে চেয়ারে লাথি মে*রে বসে ইলান। মাহিন এই কে*স সম্পর্কে অবগত নয়। চারদিকে প্রভাতির জন্য বিপ*দের আশংকা। কিন্তু এই মুহূর্তে মাহিনকে সব খুলে বলা সম্ভব নয়। ইলান নিজে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যেকোনো দিক থেকে অ্যাটাক হতে পারে।

গাড়ি শপিংমলের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাহিন নেমে পড়ে প্রভাতির সাইডের দরজা খুলে দিলো। গাড়ি থেকে নেমে দুজনই ভেতরে ঢুকলো। কিছু ড্রেস দেখতে দেখতে একটা পছন্দ হলো। প্রভাতি ঠিক করলো ট্রায়াল দিয়ে দেখবে। এরমাঝে মাহিনের একটা ইমার্জেন্সি কল আসায় সে প্রভাতির কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে সাইডে গিয়ে দাঁড়ায়।

কথা শেষ করে এসে দেখলো প্রভাতি এখনো বের হয়নি। দরজার সামনে যেতেই দেখতে পেলো দরজা খোলা। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। ভ’য়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। জিহবা দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো প্রভাতির দিকে। মেয়েটা গলা কা*টা মুরগী, না না গলা কা*টা মানুষ হয়ে ছটফট করছে। র*ক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। কিছু বলতে চাইছে হাত উঁচু করে। মাহিন চিৎকার করে ডাকলো প্রভাতিকে। প্রভাতি গলায় হাত রেখেই ছটফট করে যাচ্ছে। কন্ঠনালিতে শব্দ ধারণ করতে পারছেনা।
মাহিনের চিৎকারে মানুষ জড়ো হলো। বুদ্ধি করে ইলানের নাম্বারে কল দিয়ে হাঁপানো গলায় বলল,
-“ভাই, ভাই প্লিজ রঙ্গনাতে চলে আয়। কে বা কারা প্রভাতির গলা কে*টে দিয়েছে।”

ওপাশে কি হচ্ছে আর কিছুই জানতে পারলোনা মাহিন।
রঙ্গনা শপিংমলের কাছাকাছিই ছিলো ইলান। দ্রুত ভেতরে এসেই পাঁজা কোলে তুলে নিলো প্রভাতিকে। আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলোনা। ইলানের শক্ত মুখশ্রী দেখে বোঝার উপায় নেই আদৌ তার ভেতরটা পুড়ছে কিনা!
মাহিন ড্রাইভ করছে। পেছনের সিটে মৃ*ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা প্রভাতিকে বুকের সাথে মিশিয়ে সামনে চোখ রাখলো ইলান। ব্যথা, অস্থিরতায় বারবার ইলানের শার্টের বুকের দিকটায় খা*মছে ধরছে প্রভাতি। দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস ওঠানামা করছে। অক্ষি কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দ নোনাজল। ইলান প্রভাতিকে নিজের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নিলো। বিড়বিড় করে বলল, “কিছু হবেনা তোমার। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

একবার বাইরে চোখ রেখে গাড়ির গতিবেগ লক্ষ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে মাহিনকে বলল,
-“ডু ফাস্ট ইডিয়ট।”

গাড়ির গতি আরও খানিক বাড়িয়ে দিয়েছে মাহিন।
দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো প্রভাতিকে। যেহেতু ক্রাইম ব্রাঞ্চ এর অফিসার ইলান মুনতাসীর ছিলো, তাই আপাতত পুলিশকে জানানোর জন্য কোনো প্রেশার পড়েনি।

অপারেশনের পর কেবিনে শিফট করা হলো প্রভাতিকে। ডক্টরের সাথে কথা বলে ইলান জানতে পারলো অন্তত দু’মাস প্রভাতি কথা বলতে পারবেনা। গলার ক্ষ’তটি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো কন্ঠনালি অকেজো করে দেওয়া। তবে পুরোপুরি সফল হয়নি তাদের উদ্দেশ্য। কন্ঠনালিতে প্রেশার পড়েছে। আপাতত দু’মাস সবকিছু মেনে চলতে হবে। নয়তো পরবর্তীতে সমস্যা হতে পারে।
ইলানের কাছে সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। আজ প্রভাতির বর্ণনায় স্কেচ করার কথা ছিলো। যাতে সে বর্ণনা দিতে না পারে সেই জন্যই এরকম একটা কৌশল অবলম্বন করলো শ*ত্রুপক্ষ।

আপাতত ইলানের চিন্তা আশরাফুলকে নিয়ে। সে যখন জানতে পারবে প্রভাতি হাসপাতালে আর হাসপাতালে থাকার কারণ, তখন কি করবে? প্রভাতিকে কি তার থেকে দূরে সরিয়ে দেবে? তাদের বন্ধুত্বে কি কোনো আঁচ আসতে শুরু করেছে?

————

আজ বিকেল থেকেই সিভিল ড্রেসে তুর্শির বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলো মুনির। দোকানে বসে চায়ের আড্ডায় দারুণ এক ইনফরমেশন পেলো সে।

এক প্রবীণ লোক অপরজনের সাথে চা সঙ্গ করে আলাপ ঝুড়েছেন। তাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু তুর্শি। প্রথম প্রবীণ লোকটি বললেন,
-“ইশরে! স্বপন সাহেবের একটা মেয়ের শখ আছিলো। ভাই ম*রার পর ভাতিজিরে দিয়া মেয়ের শখ মিটাইছিলো। এখন সেই মেয়েটার ও আকস্মিক মৃ*ত্যু?”

মুনির পেছন থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি কি স্বপন মির্জার কথা বলছেন? মানে যে মেয়েটি মা*রা গিয়েছে তার নাম কি তুর্শি?”

দ্বিতীয় প্রবীণ লোকটি বলল,
-“হ, তয় তুমি কে? এগুলো জেনে তোমার কি কাম?”

মুনির বলল,
-“এমনি জিজ্ঞেস করলাম চাচা। মেয়েটার মৃ*ত্যুর খবর লোকমুখে শোনা যায়। তাই কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না চাচা।”

দুই প্রবীণ আর মাথা ঘামালেন না। মনোযোগ দিলেন তাদের চায়ের আড্ডায়।
মুনির রাস্তায় নেমে পড়লো। মুঠোফোনে সেইভ করা একটি পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করে বলল,
-“স্যার! কে*সটা মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি সলভ হতে চলেছে।”

#চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here