ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ১৯
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
আদ্রিয়ান রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার পাশে আদিব ভাইয়া থুতনিতে হাত রেখে মিটমিটিয়ে হাসছেন। আদ্রিয়ান দরজায় হেলান দিয়ে জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার এখন নিজের ওপর ভীষণ রকমের রাগ হচ্ছে। আমি আসলেই একটা গাধা, মানে একেবারে নিম্নমানের গাধা। নইলে বারবার এভাবে ফাঁসার পরেও কথা বলার সময় একটু সতর্ক হতে শিখলাম না। ড্যাম! আচ্ছা সবসময় আমারই টাইমিং ভুল হয়? নাকি উনিই ভুল সময় ভুল জায়গায় এন্ট্রি নেন? না আমার কেনো দোষ হবে? আমি তো আর ভুল কিছু বলিনা? আসলে ওনার আসার টাইমিং গুলোই ভুল হয়। সব দোষ ওনার। এসব ভাবতে ভাবতেই অাপি একটু জোরপূর্বক হেসে বলল,
— ” আরে আদ্রিয়ান, আদিব তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো আছো? এসো ভেতরে এসোনা?”
আদিব ভাইয়াও একটু হাসার চেষ্টা করে ভেতরে চলে এলেন আর আদ্রিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়েই এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
— ” আসলে কী বলোতো বউমনি? শুরুতে ভেতরে আসতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু নিজের সম্পর্কে এতো এতো প্রশংসা শুনে আর শোনার লোভটা সামলে রাখতে পারলাম না। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে বলো? আমারও ভীষণ ভালো লেগেছে। তাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।
তারপর মুখে সেই হাসি রেখেই বললেন,
— ” থ্যাংক ইউ সো মাচ বেবি।”
আমার চোখ সাথে সাথে বড় বড় হয়ে গেলো। ইফাজ আর আদিব ভাইয়া দুজনেই হালকা গলা ঝাড়লেন। তারপর সবাই চুপ। এক্চুয়ালি আমি যা যা বলেছি সেগুলো শোনার পর ওনার এরকম বিহেবে আমি ‘থ’। আর আমার মনে হচ্ছে বাকি সবারও একই অবস্থা। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো কথা বাড়াতে পারছেন না চুপ করে আছে। আমি নিচের দিকে হাত কোচলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরিবেশটা নিরব ছিলো। নিরবতা ভেঙ্গে আদ্রিয়ান বলে উঠল,
— ” আরে সবাই এভাবে চুপ করে বসে আছো কেনো? আমি থাকায় প্রবলেম হচ্ছে?”
ইফাজ ভাইয়া হেসে দিয়ে বলল,
— ” আরে প্রবলেম হবে কেনো? আমরা কথা বলছি তো?”
এরপর সবাই আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সজীব ভাইয়া আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” তো আদ্রিয়ান? কেমব্রিজ থেকে তো ইঞ্জিনিয়ারিং কম্প্লিট করে এলে। শুনেছি ল্যাবও আছে? কী করো ল্যাবে?”
আদ্রিয়ান বেডে হেলান দিয়ে বলল,
— ” তেমন কিছু না ভাইয়া। কিছু রিসার্চ, সফটওয়্যার এসব নিয়েই সবে কাজ শুরু করেছি।”
সজীব ভাইয়া একটু কৌতূহলী হয়ে বলল,
— ” এক্সাক্টলি এখন কী নিয়ে কাজ করছো?”
আদ্রিয়ান আদিব ভাইয়ার দিকে একবার তাকালো আদিব ভাইয়াও একটু মেকি হেসে সজীব ভাইয়াল দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” নাহ তেমন কিছু না। আসলে ইশরাকের মৃত্যুর পর আর নতুন কিছু শুরু করিনি পুরোনো কিছু কাজই কম্প্লিট করছি।”
ইশরাক ভাইয়া নামটা শোনার সাথে সাথেই আমার সবার মন ভার হয়ে এলো। সবার চেহারাতেই বিষন্নতা। আদ্রিয়ান শক্ত চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো ব্যাপারটা সামাল দিতে অর্ণব ভাইয়া বলল,
— ” আচ্ছা আদ্রিয়ান ভাইয়া তোমার তো ইউ কে থেকে বা বিদেশ থেকে অনেক ভালো ভালো কাজের অফার এসছে। আফটার অল কেমব্রিজ এর স্টুডেন্ট তুমি? ওখানে সেটেল হওয়ার ইচ্ছে হয়নি?”
আদ্রিয়ান নিজেকে সামলে বলল,
— “ছোটবেলাতে খেলেছি এই দেশের মাটিতে, এইদেশের খেয়েছি, এই দেশেই বড় হয়েছি তাই ফার্স্ট চয়েজ তো এই দেশটাই হবে তাইনা? এখানে থেকে যখন কাজ করা যাচ্ছে বিদেশ কেনো যাবো? তবে মাঝে মাঝে রিসার্চ এর কাজে ইউ কে তে যেতে হতে পারে।”
এভাবে নানা কথায় সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর আমি ভাবছি যে ছেলেটা এতো শান্ত কেনো আছে? আমি ওনাকে যতোটুকু চিনি এভাবে আমি এতকিছু বলার পর উনি সিউর আমার বারোটা বাজাবেন। এই শান্তি যে ঝড়ের আগের শান্তি সেটা আমি খুব বেশি করেই ফিল করতে পারছি।
বিকেলের দিকে আব্বু আম্মু ফুপা সুলতানাপ্পি চলে গেলেন। কিন্তু সবাল জোরাজুরিতে ভাইয়ারা, কাব্য আর ওহি থেকে গেলো।
_________________
রাতে আমি আমি করিডর দিয়ে পায়চারী করছি। ভাবছি রুমে যাবো? কিন্তু যদি রুমে গেলো উনি কিছু বলেন। আজ রাতে ওনার কাছে যাওয়াটা ভীষণ রিস্কি হয়ে যাবে। এতোটা রিস্ক নেবো? আপির রুমেও যেতে পারবোনা।কিন্তু যাবোটা কোথায়? জাবিনের রুমে। ইয়েস ওটাই একমাত্র বাঁচার জায়গা। এসব ভেবে জাবিনের রুমের দিকে পা বাড়ালাম ঠিক তখনই কেউ হুট করেই আমার হাত ধরে ফেলল। আমি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান। ওনার এক্সেপ্রেশন দেখে বুঝতে পারছি না উনি রেগে আছেন নাকি নেই। মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” কী ব্যাপার এতো রাত হয়ে গেছে এখনো রুমে আসছো না। কোথায় যাচ্ছো?”
আমি একটু হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললাম,
— ” অব্ জ্ জাবিনের রুমে যাচ্ছিলাম।”
— ” এতো রাতে ওর রুমে গিয়ে কী করবে?”
এখন কী বলবো? দূর এর এখনই এখানে আসতে হলো? আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে রেখে বললাম,
— ” আজ আমি জাবিনের রুমে গিয়ে শোবো।”
উনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “কেন?”
— ” আমার আজ ওর কাছে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”
— ” হঠাৎ এমন উদ্ভট ইচ্ছে হওয়ার কারণ।”
আমি একটা শ্বাস ফেলে সাহস জুগিয়ে বললাম,
— ” আমার মন চাইছে আজ ওর কাছে ঘুমাতে তাতে আপনার কী?”
উনি এবার আমার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে ধমকে বললেন,
— ” কানের নিচে একটা পরলে আর কিছু মনেও চাইবেনা আর ইচ্ছেও করবেনা। চুপচাপ রুমে চলো।”
আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। উনি আমার হাত ধরে একপ্রকার টেনেই রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তাও আবার কি লক করে দিলেন। আমি একট অবাক হলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম উনি একটু সরলেই আমি বেড়িয়ে যাবো। বুঝলেন কীকরে সেটা? তারপর আমার দিকে একপলক তাকিয়ে ওয়াসরুম চলে গেলেন। আমি খাটে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। আমি শিউর আজ এই ছেলে আমার ক্লাস নেবেই নেবে। কেনো যে এতো প্যাচাল পারি আমি। কিছুক্ষণ পর উনি বেড়িয়ে এলেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা বাঁকা হাসলেন সাথে সাথেই আমার গলা গুকিয়ে এলো। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। উনি আমার দিকে যতো এগোচ্ছেন আমার হার্ট ততো জোরে বিট করছে। আমি শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। উনি আমার কাছে এসে আস্তে করে আমার কোমরে হাত রাখলেন। সাথে সাথে আমার শরীরে জেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আমি চমকে তাকালাম ওনার দিকে। কোমরে আলতো হাতে স্লাইড করে ওনার হাত আমার পিঠের ওপর দিকে কোমরের ওপর পাশে চলে গেলো। উনি হালকা টান মেরে আমায় একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। পুরো ব্যাপারটাই আমার মাথা ওপর দিকে যাচ্ছে। উনি আমার চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরলেন। ওনার নিশ্বাস সরাসরি আমার মুখের ওপর এসে পরছে। উনি মুখটা আমার দিকে এগিয়ে আনতেই আমি মাথাটা হালকা পিছিয়ে তোতলানো গলায় বললাম,
— ” ক্ কী করছেন?”
উনি ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
— ” কই কী করছি। যেটা সবাই করে সেটাই করছি নিজের বউ কে আদর করছি।”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। উনি সেই হাসি মুখে রেখেই বললেন,
— ” তাছাড়া তুমিই তো বলছিলে আমি কী জেনো? হ্যাঁ নিরামিষ? আমি নিরামিষ নাকি আমিষ সেটারই প্রুভ দিচ্ছি।”
বলে উনি আবার আমাকে কাছে টানতে গেলেই আমি বললাম,
— ” অব্ আমিতো মজা করছিলাম। বিশ্বাস করুন।”
উনি ভ্রুটা হালকা কুচকে বললেন,
— ” ওহ তাই? কিন্তু আমি তো সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছি সোনা। এখন কিছুই করার নেই।”
এটুকু বলে উনি হালকা করে ধাক্কা দিয়ে আমায় বেডে ফেলে দিলেন। আমি এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। উনি বেডের ওপর এক পায়ের হাটু রেখে উঠতে উঠতে বললেন,
— ” কী জেনো বলছিলে আমি আস্ত বজ্জাত? আনরোমান্টিক?”
আমি আধশোয়া অবস্থায় হালকা পিছিয়ে তাড়াতাড়ি হকচকিয়ে বললাম,
— ” না না আপনি কেনো ওসব হবেন। আমি তো এমনিই বলে ফেলেছি।”
উনি হাটু দিয়েই একটু এগিয়ে বললেন,
— ” ঠিকই বলেছো। সত্যিই ঘরে এমন সুন্দরী বউ থাকতে কী আর নিরামিষ হয়ে থাকা ঠিক? একদমি না?”
ওনার কথা শুনে গলাটা আরও শুকিয়ে গেলো। পাগল হয়ে গেলো নাকি লোকটা? হঠাৎ এমন বিহেভ করছে কেনো? উনি এবার আমার ঘাড়ের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— ” আমার মধ্যে ডিফেক্টস আছে না নেই সেটার প্রমাণও তো দিতে হবে তোমাকে তাইনা?”
আমি চোখ বন্ধ করে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
— ” অ্ আমার কোনো প্রমাণের দরকার নেই।”
উনি ঘাড়ের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে বললেন,
— ” কিন্তু তোমার মনে যখন প্রশ্ন আমাকে তো প্রমাণ দিতে হবে তাইনা। আমার প্রেসটিজ ইস্যু এটা। সো আমিতো প্রুভ দেবোই।”
বলে উঠে নিজের টি-শার্ট টা খুলে ফেললেন। আমি এবার প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম, যদিও নিচে নীল চিকন স্লিভস এর পাতলা গেঞ্জি আছে। সত্যিই কী এসব করবেন নাকি? হালকা ওঠার চেষ্টা করে আমি কাঁদোকাঁদো গলায়,
— ” প্লিজ ছেড়ে দিন আমি আর কোনোদিন এসব বলবোনা।”
উনি আমার কাধ ঠেলে শুইয়ে দিয়ে বেডের দুই পাশে হাত রেখে বললেন,
— ” বলে যখন ফেলেছো দাম তো দিতেই হবে। রাইট বেইবি?”
বলে আমার গা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নিলেন। আমার এবার শ্বাস আটকে আসছে। আমি ওসব মজার ছলে বললেও এসবের জন্যে মোটেও প্রস্তুত নই। মেন্টালি, ফিজিক্যালি কোনোভাবেই নয়। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আমি কাঁপাকাঁপা গলায় অস্ফুট স্বরে বললাম,
— ” প্লিজ..”
উনি পাত্তা না দিয়ে আমার ঘাড়ের কাছের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতেই আমি কেঁদে দিলাম। আমার কান্নার আওয়াজ পেয়ে উনি মাথা তুলে শক্ত কন্ঠে বললেন,
— ” এখন কাঁদছো কেনো? রোমান্স করার খুব শখ না তোমার? সেটাই তো করছি। এখন কষ্ট পাচ্ছো কেনো?”
আমি কিছু না বলে চোখ নিচে রেখে কাঁদছি। উনি উঠে বসে ওড়নাটা আমার গায়ে দিয়ে বললেন,
— ” আশাকরি এসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে পালিয়ে গেছে? এবার এসব ভুলে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। কাজে লাগবে।”
বলে উঠে দাঁড়িয়ে টি-শার্ট টা পরে ব্যালকনিতে চলে গেলেন উনি। আমি হাটু গুটিয়ে বসে নিরবে কাঁদছি। ভালো করে বললেও তো হতো। খুব কী দরকার ছিলো এরকম ব্যবহার করার?
#চলবে…