ফিলোফোবিয়া ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির ) ৭

0
536

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

ঝড়ো হাওয়া বইছে। অন্ধকার হয়ে আছে চারিপাশ। বৃষ্টির দুএক ফোঁটা ভুবন ছুঁইছে। বাসের সামনের সিটটায় গম্ভীর হয়ে বসে আছে শতাব্দ। চোখ বুজে কপালে আঙ্গুল বোলাচ্ছ। রাগ চাপানোর যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুতেই হচ্ছেনা। জুবাইদা ছাড়া সবাই বাসে উঠেছে। জুবাইদাকে খুঁজতে সমুদ্রকে পাঠিয়েছে। এখন সমুদ্রও দেরি করছে। এদিকে সাতটা বাজতে চলছে। আকাশের অবস্থা খারাপ। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে।খানিক বাদেই জুবাইদাকে নিয়ে সমুদ্র এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে দুইজন বাসে উঠল। শতাব্দকে রাগী গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে থাকতে দেখে। জুবাইদা সমুদ্রের পিছনে মুখ লুকাল। ভীতু কন্ঠে বলল,
‘ ভাই ওয়াশরুমে ছিলাম। ফ্রেশ দেরি হয়েছে।’
শতাব্দ আগের মতই চোখ বুজে। জুবাইদা উত্তরের অপেক্ষায় রইল। শতাব্দ প্রতিক্রিয়া করল না কোন। সমুদ্রের পিছন থেকে বেরিয়ে আশেপাশে চোখ বুলাল জুবাইদা। প্রিয়’কে খুঁজছে। কিন্তু দেখছে না কোথাও। আঁতকে উঠল জুবাইদা। চেঁচিয়ে বলল,
‘ প্রিয় কোথায় সমুদ্র ভাই?’
চট করে চোখ খুলল শতাব্দ। কপাল কুঁচকে পিছনে ফিরল। গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ তোর সাথেই তো ছিল।’
‘ আমার সাথে ছিল না ভাই।’
ধমকে উঠল শতাব্দ,
‘তোর সাথে ছিল না মানে?’
ভয়ে কেঁদে ফেলল জুবাইদা। বিরবির করে বলল,
‘ ভিতরে আমি একা ছিলাম। ও আগেই চলে এসেছিল।’
সমুদ্রের দিকে তাকাল শতাব্দ। চাহনির অর্থ বুঝল সমুদ্র। বলল,
‘ দোতলা নিচতলা সব জায়গায় দেখেছি ভাই। ভিতরে কেউ নাই ।’
আর একমুহূর্ত দেরি না করে, গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়ল শতাব্দ। পিছন পিছন সমুদ্র জুবাইদা আরো অনেকে গেল। তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজল, বাগান খুঁজল। ভেতরে কর্মরত সবাইকে জিজ্ঞেস করল। লাভ হলো না কোন। কোথাও মিলল না প্রিয়। চিন্তায় মাথা ধপধপ করছে শতাব্দের। শরীর কাঁপছে। মাঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলাল। কোথাও নাই প্রিয়।চুল গুলো পিছনে টানল। ভীষণ ছন্নছাড়া লাগছে। হুট করে মেয়েটা কোথায় চলে গেল?
সমুদ্র ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ ভাই! ও আবার চলে যায়নি তো?’
ক্ষি*প্ত দৃষ্টিতে তাকাল শতাব্দ। সমুদ্র থতমত খেয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল,
‘ না বলছিলাম কি! গাড়ি খুঁজতে গিয়ে যদি গ্রামে ঢুকে যায় আবার!’
জুবাইদা বিরক্ত হলো। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল,
‘ গাড়ি ভিতরে ছিল ও বাহিরে খুঁজতে যাবে কেন?’
সব কিছু বিরক্ত লাগছে শতাব্দের। মাথা চেপে পাশের বেঞ্চটায় বসে পড়ল। মস্তিষ্ক কাজ করছেনা কোন। আচমকা শাদের দিক শতাব্দের চোখ পড়ল। কাচুমাচু হয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে অদ্ভুত ভয়। শতাব্দের খটকা লাগল। শাদকে কাছে ডেকে, ভনিতা বিহীন শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘ প্রিয় কোথায় শাদ।’
আঁ*তকে উঠল শাদ। ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘ আমি জা..জানিনা ভাইজান।’
শতাব্দের ক্*ষিপ্ত চাহনিটা আরো গভীর হলো। ক্রো*ধে হাত পা কাঁপছে। চোখ বুজে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল আবার,
‘ আমি জানতে চেয়েছি প্রিয় কোথায়?’
‘ ভাই’
‘ কোথায় প্রিয়?’ ক্ষি*প্ত কন্ঠে গ*র্জিয়ে উঠল শতাব্দ।
গর্জনে কেঁপে উঠল শাদ সহ বাকি সবাই। ভয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল শাদ,
‘ বাড়ির পেছনের ওয়াশরুমে’
মুহূর্তে বাড়ির পেছন দিকে ছুটে গেল শতাব্দ। ওয়াশরুমের দরজা খুলে আলো জ্বালাতেই হতভম্ব হয়ে রইল। ফ্লোরে পড়ে আছে অচেতন প্রিয়। পাশের দেয়ালে র*ক্তের সামান্য ছাপ। কপাল কেটেছে। তাড়াতাড়ি করে প্রিয়’কে কোলে তুলে নিলো শতাব্দ।দ্রুত ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। জুবাইদা পানি নিয়ে এসে শতাব্দের দিক বাড়িয়ে দিলো। পানির গ্লাসটা ধরতে পারছেনা শতাব্দ।হাত কাঁপছে। চোখমুখ ভীষণরকম অশান্ত অস্থির। কোনরকম পানির ছিটা দিয়ে প্রিয়’কে ডাকলো। অচেতন প্রিয় আলতো চোখ খুলল। বিরবিরিয়ে কিছু বলল তারপর আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। ড্রেসিং করে কপালে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো শতাব্দ। হল ঘরে অপেক্ষা করছে সবাই। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন্টা খানেক প্রিয়’র পাশে বসে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করল শতাব্দ। প্রিয় অচেতন তখনো। খানিক বাদে একটু নড়েচড়ে উঠল। শতাব্দের দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো। একটু স্বাভাবিক হতেই, বসতে চাইল প্রিয়।বাহু ধরে উঠে বসালো শতাব্দ। পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে পুরোটা পানি গিলে নিল। চোখে মুখে এখনো প্রচন্ড ভয়। অস্থির উত্তেজিত হয়ে বলল প্রিয়,
‘ বাড়ি যাবো। এক্ষুনি বাড়ি যাবো আমি।’
বলতে বলতেই বিছানা ছেড়ে নামল। শতাব্দ হাত ধরে আটকালো। বিছানায় বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। শান্ত হচ্ছে না প্রিয়। সে আগের মতই ভীত, উত্তেজিত। ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,
‘ তুমি ঠিক আছো?’
উপর নিচ মাথা ঝাকাল প্রিয়। আশেপাশে পাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ জুবাইদা কই?’
‘ আছে বাহিরে’
‘ আমি বাড়ি যাবো।’ নিথর গলায় আবারো বলল প্রিয়।
খানিক চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল শতাব্দ,
‘ যেতে পারবে?’
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। শতাব্দ বাড়ি ফিরার ব্যবস্থা করল। বৃষ্টি কমতে গাড়ি উঠল সবাই।
শহর আর ইন্দিরাপুরের মাঝামাঝি হাইওয়ের কাছাকাছি হসপিটালটার সামনে বাস থামল। এতরাতে নিঝুম রাস্তায় গাড়ি থামায় কিছুটা অবাক হলো সবাই।
জুবাইদার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে ঘুমে মগ্ন প্রিয়। আলতো স্বরে কেউ ডাকলো। ভয়ে ছিটকে উঠল প্রিয়। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাল। শতাব্দকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।
‘ আমাদের নামতে হবে।’
প্রিয় আশেপাশে তাকালো। গাড়ি হাইওয়েতে থেমে। এখানে কোথায় নামবে? কিছু বুঝে উঠার আগেই শতাব্দ আলতো করে প্রিয়’র হাত টেনে ধরল। সামনের দিক পা বাড়াল। ঘুম থেকে সদ্য জেগে উঠা প্রিয় এসব দেখে হতভম্ব। মন্ত্রমুগ্ধের মত শতাব্দের পিছুপিছু গেল। গাড়ি থেকে নামার সময় শতাব্দ আদেশ স্বরে সমুদ্রকে বলে গেল ‘ সবাইকে ঠিকঠাক নামিয়ে আব্বার গাড়ি নিয়ে এখানে আসবি। আর হ্যাঁ গাড়ি যেন ড্রাইভারই চালায়।’
শেষ কথাটা বেশ শাসিয়েই বলল শতাব্দ। বাধ্য ছেলের মত মাথা ঝাকাল সমুদ্র।

চেকআপ শেষে ওয়েটিং রুমের বসে আছে প্রিয়। ঔষধ কিনতে বাহিরে গেছে শতাব্দ। অনেক নিষেধের পরও শুনেনি সে। জোর করে ডাক্তার দেখিয়ে প্রিয়’কে এখানে বসিয়ে রেখে গেছে। চোখ বুজে কপালে হাত বোলাচ্ছ প্রিয়। অন্ধকারে দেয়ালের ভাঙ্গা ইট লেগে অনেকটাই কেটে গেছে। মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে। প্রচন্ড ব্যথা করছে।
‘ খুব ব্যথা করছে?’
শতাব্দের ডাকে ঘোর কাটল প্রিয়’র। চোখটা লেগে এসেছিল। নড়েচড়ে বসল। আড়চোখে তাকালো। ঔষধ নিয়ে ফিরে এসেছে শতাব্দ। ক্লান্ত চোখমুখ। বৃষ্টি’র পানিতে গা ভিজে।চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে।
‘ ভিজে গেছেন, ঠান্ডা লাগবে আপনার।’
প্রিয়’র কন্ঠে কিঞ্চিত চিন্তার আবাশ। ফ্যানের নিচে বসল শতাব্দ। ঘাড় থেকে শার্টের কলারটা ছাড়িয়ে পিছন দিকে হেলিয়ে দিলো। বলল,
‘ লাগবেনা। ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে যাবে।’
‘ এসবের দরকার ছিল না কোন।’
উত্তর দিলো না শতাব্দ। ফোন টিপতে ব্যস্ত। খানিক চুপ থেকে প্রিয় আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমরা কখন বাড়ি ফিরবো। খালা চিন্তা করছে!’
‘ করছেনা। ফোনে কথা হয়েছে।’
‘ কখন যাবো আমরা?’
‘সমুদ্র গাড়ি নিয়ে আসছে। দশ মিনিট লাগবে।’
ফোনের স্কিনে চোখ রেখে উত্তর দিলো শতাব্দ। খানিক বাদেই সমুদ্র এসে পৌঁছাল। বৃষ্টির বেগ প্রচন্ড। গাড়ি থেকে নামল না আর সমুদ্র।তাড়াতাড়ি করে পিছনে গিয়ে বসলো প্রিয়। পাশেই শতাব্দ। ঝুম বৃষ্টি। অন্ধকার রাস্তা। ওড়না দিয়ে গাঁ ডেকে নিলো প্রিয়। হাতটাও গুটিয়ে ফেলল। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে তার। জ্বর আসছে কি? হয়তো। ঘুমঘুম চোখজোড়া লেগে আসছে বারবার। একটু ঘুমাবে কি? জানালার কাঁচে মাথা হেলিয়ে দিলো প্রিয়। মিনিট দু’একে ঘুমে তলিয়ে গেল।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে জানালার সাথে প্রিয়’র মাথা লাগছে বারবার। ঘুমের ঘোরেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। লক্ষ করল শতাব্দ। প্রিয়’কে কাছে টেনে। আলতো করে মাথাটা শতাব্দের কাধে রাখল। স্বস্তি পেল প্রিয়। কুঁচকে থাকা কপালটা মিয়িয়ে গেল। বেঘোরে আরো গভীর করে শতাব্দকে জড়িয়ে ধরল। আষ্টেপৃষ্টে মিশে, বুকে আলতো করে নাক ঘষল। শতাব্দ সোজা শক্ত হয়ে বসে রইল। বুকের কম্পন বেড়েছে কয়েকগুন। নিশ্বাসের উঠানামাটাও প্রচন্ড। প্রিয়’র গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ বারবার বেকাবু করছে তাকে। কাঁপা কাঁপা হাতটা প্রিয়’র মাথায় চলে গেল আচমকা। চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে। আলতো হাতে মাথা বুলিয়ে দিতে লাগল। জ্বরে তপ্ত প্রিয় বিরবির করে বলল,
‘ আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি আপা। আপা আমাকে নিয়ে যেওনা। আমার ভয়.. করে আপা। আপা।’
ধীরেধীরে বিরবির আওয়াজটা বাড়তে লাগল। উত্তেজিত হচ্ছে প্রিয়।শান্ত করার চেষ্টা করল শতাব্দ। বলল,
‘ শান্ত হও। কেউ নিবেনা তোমায়। আমি আছি।’
আবারো বিরবির করতে করতে শান্ত হলো প্রিয়। ঘুমে তলিয়ে গেল। প্রিয়’র ঘুমন্ত মুখপানে নিমিষ চেয়ে আছে শতাব্দ। কাজল লেপ্টানো চোখ, আতুর মুখ। এলোমেলো কেশ। জানালায় জমে থাকা বৃষ্টি কণার আড়াল হতে ল্যাম্পপোস্টের উপচে আসা মৃদু আলো পড়ছে মুখে। ক্লান্তির ছাপ তার রূপের মাধুর্য ছাপাতে পারেনি একটুও। বরং বেড়েছে আরো। মুখশ্রী জুড়ে এক আদুরে ভাব। কপালে ভেসে থাকা ব্যান্ডেজটা যেন চন্দ্রতে ফুটে থাকা আঁক। খুব করে জানতে চাইছে মন! ‘আকাশের চাঁদটা বেশি সুন্দর নাকি তার বুকে লুকিয়ে থাকা এই চাঁদটা?’

গলির মাথায় এসে নরম স্বরে ডাকল শতাব্দ। পিটপিট করে চোখ মেলল প্রিয়। শতাব্দকে দেখে তড়বড় করে উঠতে চাইল। পারল না। মাথা যন্ত্রণায় নেতিয়ে পড়ল। হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাল শতাব্দ। কপালে হাত রেখে জ্বর মাপল। প্রচন্ড জ্বর।ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা প্রিয়। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল শতাব্দ’র। প্রিয়’র গালে হাত রেখে বুঝানোর স্বরে বলল,
‘ বাড়ি গিয়ে এক্ষুনি ঔষধ খেয়ে নিবে।’
জ্বরে মাথা কাজ করছেনা প্রিয়’র। না বুঝেই মাথা ঝাকাল। ততক্ষণে আয়েশা বেগমও চলে এসেছে। মোটা চাদরে জড়িয়ে নিলো প্রিয়’কে। কিছু জিজ্ঞেস করলেন না তিনি। শতাব্দ আগেই ফোনে সব বলেছে।
‘ কিছু প্রয়োজন হলে ফোন করবেন।’
আয়েশা বেগম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। প্রিয়’কে নিয়ে উপরে চলে গেল। পিছন থেকে স্থির চেয়ে রইল শতাব্দ। বুকের অস্বস্তি অশান্তিটা যেন বাড়ল। শান্তি পাচ্ছেনা কোথাও। সেই রাতে আর ঘুম হলো না তার। বাড়ি ফিরল ভোর চারটায়।

চলবে……….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here