শেষ_কান্না
পর্ব_৫
#লেখা_Bobita_Ray
ভোরের দিকে অরুর ঘুমটা ভেঙে গেল।বিছানা থেকে ওঠে এলোমেলো কাপড় ঠিক করে পরার সময় নিজের অজান্তেই পেটে এক হাত চলে গেল।অরু পেটে হাত বুলিয়ে নিজের অনাগত সন্তানকে ফিসফিস করে বলল,
-“শুনতে পাচ্ছিস বাবু?তুই তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে চলে আয়।তোর মা যে বড্ড একা রে।
রথী অরুর কাঁধে হাত রেখে বলল,
-“কে বলল তুমি একা?আমি কী তোমার কেউ না?
অরু মুচকি হেসে কথা ঘুরিয়ে বলল,
-” তুমি ঘুম থেকে ওঠে গেছ?চলো আশেপাশে কোথাও হেঁটে আসি।
-“হুম চলো।
ভোরের হিম বাতাসে নদীর পাড় ঘেঁষে অরু, রথী পাশাপাশি হাঁটছে।দু’পাশে সারি সারি কাশফুল মৃদু বাতাসে দুলছে।রথী এক গুচ্ছ কাশফুল তুলে এনে অরুর হাতে দিল।অরু বিনিময়ে মিষ্টি করে একটু হাসল।তারপর কাশফুল হাতে নিয়ে এগোতে লাগল সামনের দিক।বেশকিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর রথী বলল,
-“চল ভাবি এখন বাড়ি যাই?
-“আর একটু থাকি না ভালো লাগছে খুবউ!
-“না ভাবি আবার কাল আসব। আম্মা ঘুম থেকে ওঠে আমাদের না দেখলে বকবে।
অরু মন খারাপ করে বলল,
-“চলো!
অরু, রথী বাড়ি আসতেই ফুলমতি চিল্লাফাল্লা শুরু করে দিল।অরুকে উদ্দেশ্যে করে চিৎকার করে বলল,
-“ঐ ছেমড়ি তুর মাই বাপে আদব-কায়দা শিকাই নাই? কুন বাড়ির বউ গো দেখছালো যে বিয়ান বেলা ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ কইরা ঘুরবার যায়! পেটে যে একখান বাজাইয়া ঘুরতেছাস। যদি সক্কালের কূ বাতাসে তুর পেটের খান নষ্ট হইয়া যায় তার দায় ক্যারা নিব?হুন তোরে আজ সাফ সাফ কইয়া দিলাম বেশি ফালাফালি করবি না।আর ঐ রথী ঐ ঘরের কাম কাজ থুইয়া তুই গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরতেছাস ক্যাঁ।যা কাম কর?
রথী অরু মাথা নিচু করে চলে গেল।ফুলমতি সারা সকাল এই নিয়ে বকবক করল।
দেখতে দেখতে কেটে গেল তিনটে মাস,এখন অরু পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট।পেটও বড় হয়েছে।এই তিনমাসে উঠতে বসতে ফুলমতি কটু কথা শোনায় অরুকে। যা তা বলে অপমান করে।পুরোটা সময় অরু দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে। কারণ একবার রাগের বশে শাশুড়িকে দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল অরু বিনিময়ে সেদিন রায়হান হাতের কাছে না পেয়েছে তাই দিয়েই উত্তম-মাধ্যম মাইর দিয়েছে অরুকে।চিকুন লাঠি দিয়ে এলোথেলো মারতে মারতে হাত,পিঠ, গলা, বুক লাল করে ফেলেছিল।শক্ত করে গলা চেপে ধরেছিল, খুব খারাপ ভাষায় গালাগালি দিয়েছিল। সেদিন রথী না থামালে হয়ত মরেই যেত অরু। মাইর খেয়ে পুরো দুটো দিন ব্যাথায় ছটফট করেছে অরু।মাইর খাওয়ার পর থেকে এখন আর ভয়ে কাউকে কিছু বলে না অরু।রোবটের মতো চুপচাপ থাকে।মাঝে মাঝে রাকিব পেছন থেকে জাপটে ধরলে,বুকে হাত দিলেও কোনো প্রতিবাদ করে না অরু।শুধু নীরবে চোখের জল ফেলে।আর রায়হান তো এক কাঠি উপরে প্রতিরাতে জোর করে অরুর সাথে মেলামেশা করে।অরু বাঁধা দিলেও শুনে না।এখন রায়হানের স্পর্শে ভালোবাসা খুঁজে পায় না অরু, শুধু চাহিদা খুঁজে পায়।রায়হান খুব বাজে ভাবে অরুর শরীরে হাত দেয়।আগে রায়হানের স্পর্শে শরীরে কাঁপন ধরে যেত আর এখন গা ঘিনঘিন করে।তবুও মুখ বুজে পরে থাকে। বাড়ির সমস্ত কাজ একা হাতে করে । সারাদিনের ক্লান্ত শরীর যখন বিছানায় এলিয়ে দেয় ঘুমে চোখ বুজে আছে ইচ্ছে করে না রায়হানের মনোরঞ্জন করতে কিন্তু বাধ্য হয়ে করতে হয়।ফুলমতি এখন রথীকেও কোন কাজ করতে দেয় না,অরুর সাথে মিশতে দেয় না।সবসময় চোখে চোখে রাখে মেয়েকে।বলে,
-“ঐ ছ্যাঁচড়া ছেমড়ির সঙ্গে থাকলে তুইও খারাপ হইয়া যাইবি।মাখামাখি কম কর।
একদিন দুপুরে রায়হান খেতে বসে অরুকে বলল,
-“ভাবছি একটা ব্যবসা করব কী বল অরু?
-“যা ভালো বুঝ!
-“ব্যবসা তো আর এমনি এমনি করা যাবে না। তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। বিয়ের সময় তো তোমার বাবা কোন যৌতুক দিল না।আজ তোমার বাবাকে ফোন করে এক লক্ষ টাকা চাইবে।
অরুর মুখটা মলিণ হয়ে গেল।থমথমে গলায় বলল,
-“আমি পারব না!
রায়হান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“পারবে না মানে কী?যদি আমার সংসার করার ইচ্ছে থাকে তাহলে টাকা আনবে আর না হলে আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে।তোমার মতো চরিত্রহীনাকে বাড়ি থেকে বের করতে আমার এক মিনিটও সময় লাগবে না।এতদিন তো ঘাড়ে বসে বসে সবার হাড্ডি, মাংস চিবিয়ে খেলে এখন নিজের রাস্তা মাপ।
ফুলমতি পান চিবুতে চিবুতে বলল,
-“হ তুর শ্বশুড়ের আক্কিল দেইখা মরি।কেমন বেডা, ম্যাইয়ার কুনু খুঁজ খবর নেয় না।শরীলে কুনু মায়া দয়ার বালাই নাইক্কা।আজ যদি তুর বউয়ের জায়গা আমার রথী থাকত তাইলে আমরা কি ম্যায়াডারে ফালাইতে পারতাম?কুনু দিনও না।অবশ্য আমার ম্যাইয়াডা অনেক ভালা।আর ভালো হইবোই না ক্যাঁ!কুনু অজাত-কূজাতের রক্ত তো আমার ম্যাইয়ার শরীলে বইতাছে না হুহ।
পুরোটা সময় অরু ভাত নাড়াচাড়া করল। রায়হানের কথা আর শাশুড়ির খোঁচা মারা কথা শুনে ভাত আর গলা দিয়ে নামল না।তাছাড়া অরুর ইদানীং সময়ে অসময়ে খিদে লাগে কিন্তু শাশুড়ির কটু কথা শুনে লজ্জায় পেট পুড়ে খেতে পারে না।সেদিন তো মুখের উপর বলেই ফেলল,
-“এলো বউ পেটে কী রাক্ষস নিয়া ঘুরতাছ না কি এত খায় খায় কর ক্যাঁ?পোয়াতি অবস্থায় রাক্ষসের মত খাইলে পেটের বাচ্চা বড় হইয়া যাইবো।তহন আর নরমালে বাইর হইবো না।তুমি তো দেহি কোন কিছু বাছো না! এক চাপা খাও। শোন ডাব,লাউ, শৈল মাছ, বাইম মাছ,ডিম,কলা,এগুলান খাইবা না।
শাশুড়ির কথা শুনে অরু মনে মনে হাসে হাইরে, না বুঝে পুষ্টিকর খাবারই তাকে খেতে বারণ করছে।অরু সিত্তর বাচ্চাটা নিশ্চিত অপুষ্টিতে ভুগবে।
রাতে ঘরে এসে সিগারেট ধরাল রায়হান।অরুর প্রথম প্রথম খুব বমি আসত সিগারেটের গন্ধে কিন্তু এখন সয়ে গেছে।তাছাড়া রায়হানের নিত্য দিনের অভ্যাস সিগারেট খেয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে অরুর ঠোঁট চেপে ধরে।তারপর সময় নিয়ে আস্তে আস্তে চুষতে থাকে অরু ঠোঁট।অরু বাঁধা দিলেও শুনে না।আজও তার ব্যতিক্রম হল না অরু দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরে আসতেই অরুকে বিছানার সাথে চেপে ধরল রায়হান।তারপর অরুর ঠোঁটের মাঝে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।অরু কিছুক্ষণ ছটফট করতে করতে এক সময় থেমে গেল।দু’চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।মিনিট পাঁচেক পর অরুকে ছেড়ে দিতেই অরু শক্ত গলায় বলল,
-“তোমার কী আমাকে মানুষ বলে মনে হয় না?সব সময় জোরাজুরি করো কেন?
-“জোরাজুরি না করলে তো ধরা দাওনা।আমারও তো চাওয়া-পাওয়া আছে।আর তোমার ঢঙ দেখি বাঁচি না।বিয়ের আগে তো সারাক্ষণ একটু আদর পাওয়ার জন্য আমার গা ঘেঁষতে আর এখন দূর দূর করো কেন?না কি এখন আর ফিলিংস হয় না।ভালো লাগে না আমাকে?
-“ভুলে যেও না রায়হান এখন আর আমি একা না।তোমার জোরাজুরির জন্য যদি আমার বাচ্চার কিছু হয় না তাহলে আমি তোমাদের কাউকে ছাড়ব না।
-“বাজে কথা রাখ! তুমি আমার কাছে নিজেকে সোঁপে না দিলে কিন্তু আমি অন্য যায়গা যেতে বাধ্য হবো।
-“রায়হান এসব কী বলছ তুমি?একটু কী ধৈর্য ধরতে পারবে না?
রায়হান অরুর বুকে আলতো করে কামড় দিয়ে বলল,
-” না পারব না।ঘরে তোমার মতো সুন্দরী বউ থাকলে কোনো পুরুষই নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না।
-“রায়হান আমি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিন তোমার ঘরে আসতে পারব না।লোকে দেখলে খারাপ ভাববে।
রায়হান অরুর গলায় ছোট ছোট চুমু খেয়ে বলল,
-“না এলে আমিও কাল থেকে অন্য মেয়েদের কাছে যাব।
অরু কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“তোমার যা খুশি কর, যেখানে খুশি যাও, প্রতিদিন এসব আমার ভালো লাগে না।
রায়হান অরুর চুলের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে বলল,
-“তাহলে কী ভালো লাগে তোমার?
-“আমি জানি না।
-“তুমি যদি আমাকে খুশি না করো তাহলে আমিও বাধ্য হবো দ্বিতীয় বিয়ে করতে!বলেই অরুর শাড়ির কুঁচি এক টানে খুলে ফেলল।অরু আর কথা বাড়াল না,বাঁধাও দিল না। দাঁত, মুখ চেপে নিজেকে সোঁপে দিল মানুষরুপী জানোয়ারের হাতে।
***
আজ দু’বছর পর প্রতীক রাজশাহী থেকে ঢাকা ফিরছে। এতদিন পড়ালেখার চাপে ঢাকা একদম যাওয়া হয়নি।গেলেও দু’রাত থেকে আবারও ছুটতে হয়েছে রাজশাহী।এবার বেশ কিছুদিনের ছুটিতে যাচ্ছে।মূলত আজ অরুদের বাসায় যাবে। অরু প্রতীকের মামাতো বোন।যেদিন থেকে প্রেম, ভালোবাস বুঝতে শিখেছে সেদিন থেকে অরুকে মন প্রান দিয়ে ভালোবেসেছে প্রতীক।কখনো মনের ঘরে জমিয়ে রাখা সুপ্ত ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলা হয়নি অরুকে।সারাক্ষণ একটা ম্যাচিউর ভাব নিয়ে চলত অরুর সামনে।অরুও খুব সম্মান করে প্রতীককে।তাছাড়া নানু ছোটবেলায় কথায় কথায় অরু আর প্রতীকের বিয়ে ঠিক করে রেখে গেছে।সেই থেকে মনে প্রাণে নিজের বউ ভাবে অরুকে।কিন্তু প্রতীক বরাবরই চাপা স্বভাবের শান্তশিষ্ট ছেলে।বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফুটে না।অরুকে নিয়ে নিজের অনুভূতির কথা,ফিলিংসের কথা,ভালোলাগার কথা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।এমনকি অরুও জানে না।প্রতীকের বাবা মাও রাজশাহী থাকার কারণে অরুদের সাথে আগের মতো খুব একটা যোগাযোগ নেই।মেয়েটা হয়ত এতদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে।এবার আর দেরি করবে না প্রতীক নিজের মনের জমানো আবেগময় কথা সব অরুকে বলবে,বলবে কতটা ভালোবাসে অরুকে।দেখাবে নিজের বুকের বাম পাশে পুড়িয়ে “অরু” নাম লেখার চিহৃটা।প্রতীক কলেজে থাকা অবস্থায় আবেগের বশে একবার লোহার শিক গরম করে বুকে অরুর নাম লিখেছিল। সেই পোড়া দাগটা আজও স্পষ্ট বোঝা যায়।আচ্ছা অরুকে আমার মনের কথাগুলো বললে ওর রিয়াক্সশন কেমন হবে?ও কি খুব রাগ করবে?না কি আমার বুকে মাথা রেখে অনেক অনেক অভিযোগ করবে?কথাগুলো ভাবতেই লাজুক একটা হাসি দিল প্রতীক।
****
দুপুর গড়িয়ে বিকাল,বিকাল গড়িয়ে সন্ধা,সন্ধা পেড়িয়ে রাত হতে চলল,তবুও রথীর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।রায়হান, রাকিব,হন্ন হন্ন করে খুঁজছে কিন্তু কোথাও নেই।প্রতিদিনের মতো আজও মুখটা ভার করে স্কুলে গিয়েছিল রথী।কিন্তু বিকালে সবাই ফিরেছে রথী ফিরেনি।রায়হান রথীর সব বান্ধুবীর বাড়ি খোঁজ নিয়েছে কিন্তু কেউ বলতে পারল না রথী কোথায়।স্কুল ছুটির পর ওকে কেউ কোথাও দেখেনি।ফুলমতি হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদছে আর পাগলের প্রলেপ বকছে।গ্রামের মহিলারা ফুলমতিকে নানান কথা বলে শান্তনা দিচ্ছে।অরু ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে।আজ কিছু মাস যাবৎ মেয়েটার সাথে শাশুড়ির ভয়ে খুব একটা কথা হয় না।শুধু চোখাচোখি হলে দুজনেই নিঃশব্দে লাজুক হাসি দিত।এ বাড়িতে আসার পর থেকে একমাত্র রথীই অরুকে সঙ্গ দিয়েছিল,সারাক্ষণ ভাবি,ভাবি করে পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করত।সেই মেয়েটা আজ না বলে কোথায় হারিয়ে গেল। ভাবতেই অরুর বুকটা কেঁপে উঠল।
চলবে