#রোদেলা
লেখাঃ #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৬
ঐ ঘটনার অনেকদিন পার হয়েছে। বাড়ি ফিরে এসব বিষয়ে আর কোন কথা কেও তুলে নি। বড় মামী বলেছেন একটু সময় নাও, পরে এসব বলো। তাছাড়া আমরাও তো আছি ওকে বোঝানোর।
সেদিন মেহমান কোনমতে বিদায় করে নাসিমা রোদেলাকে খুঁজে সবার সামনে ডেকে আরেক দফা চিৎকার চেচামেচি করে। বলে-
: ভাবী আপনি না বলেন সোনার টুকরা মেয়ে, এই মেয়ে আজ কি বলছে জানেন আপনি….?
এই মেয়ে আমারে শাসায়া – বলে ঐ ছেলেকে নাকি বিয়ে করবে না, আর যদি ওরে কেও জোড় করে তাহলে ও নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, আমার পেটের ছাও, আমারে কয় ম্যাউ। ওকে জিজ্ঞেস করেন কোন বেডা ও রেডি করে রাখছে। মা*গীর কত বড় সাহস আমারে শাসায়।
সবাই নাসিমাকে শান্ত হতে বললেন। সবাই সেদিকেই ব্যাস্ত। কেও একটা বারের জন্য তাঁকে ধমকালো না কেন এই ভাষায় কথা বলে। আসলে এসব কথাবার্তা শুনতে শুনতে এখন ডালভাত হয়ে গেছে। কেও রোদেলাদের দিকে খেয়ালও করে না। রোদেলা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এদিকে সন্ধ্যায় নাসিমার বোনেরা এলো এসব শুনে। তারও কেও একটা বারের জন্য রোদেলাকে স্বান্তনা কি বুঝ তো দিলোই না উল্টো বোনকে শাসিয়েছে শুনে রোদেলাকে কথা শুনালো। সেই পুরাতন কেচ্ছা কাহিনী।
তোদের দিকে চেয়ে আমার বোনের জীবণ শেষ, আর বিনিময়ে তোরা আমার বোনের সাথে এমন করস…
তোরা না থাকলে আমরা আমাদের বোনকে রাজার হালে রাখতে পারতাম, তোরা তো নিমকহারামের বংশ,
বড় হয়ে গেছস এখন তোদের মা দরকার নাই, কোনদিন শুনবো কার হাত ধরে চলে গেছস, কষ্ট করস নিজের ভবিষ্যৎ করে নিচ্ছিস আমার বোনের কি ভবিষ্যৎ।
আরো কত কথা….
কিন্তু কেও একটা বারও খবর নিলো না ক্ষতবিক্ষত রোদেলার। কিসের ভিতর দিয়ে ও যাচ্ছে তা কেও জানতেও চাইলো না। তারা পরে রইলো ঐ কথায়, যে কথা বলেছে ও তাদের বোনকে। কোন প্রেক্ষিতে এই কথাগুলো আসলো তার উৎস কেও খুঁজলো না। রোদেলা নির্বিকার হয়ে শুনে যাচ্ছিল সব।
সেদিন রাতে খেয়ে ওরা বাসায় ফিরে ছিলো। বড়রা সবাই বলেছিলো কিছুদিন যাক পরে এসব ব্যাপারে আবার কথা হবে ওর সাথে। নাসিমা কি বুঝলো তা বোঝা গেলো না।
বাড়ি ফিরে আরেক অশান্তি। নাসিমা কথা বলে না রোদেলার সাথে। ঘরের কাজকর্ম ধুপধাপ শব্দ করে, আছড়ে করে।
নাসিমা বেগমের আচরন ও ইদানীং অদ্ভুত। অশান্তির শেষ যেন নেই ওদের।
রোদেলা তেমনি ঠান্ডা আর শান্ত। ওর মায়ের বিপরীত। ও বাড়ি ফিরে নিজের মতো কাজকর্ম, পড়শোনা করে খায় দায়। ও নিজেও কোন কথা বলে না। ওদের দুঃখ শোনার কেও নেই তাই ওদের দুঃখ রেখেও লাভ নেই। ন্যায় অন্যায়ের বিচার নাই করুক, একটা মানুষ তাঁকে বললো না এত বড় মেয়েকে কেও এভাবে বলে…? তারা সবাই সেইফ জোনে থাকে। কে আবার বলে বিশ্রী কথার আক্রমণের শিকার হবে। তার তো ঐ এক অস্ত্র।
এভাবেই দিন চলতে লাগলো মা মেয়ের মধ্যে তৈরী অদৃশ্য দেয়ালের মাঝে। এরমধ্যে একদিন আরেক কেচ্ছা, ছোট মামা তার ব্যাবসা গুটিয়ে নিচ্ছে, তিনি বাইরে চলে যাবেন। নোভেল বেঁকে বসেছে ও যাবে না। এ নিয়ে দেন দরবার চলছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। রোদেলা এসবে গা করে না। ন্যায় অন্যায় বলতে গেলে শুনতে হবে আমাদের ভাইবোনের ব্যাপারে তুই নাক গলানোর কে….?
সেদিন অনেক রাতে বড় মামা ফোন করে আসতে বললেন নাসিমাকে। এত রাতে মেয়ে দুটিকে একা রেখে যাবেন তাই ওদেরকেও সাথে নিলো। বাড়ি গিয়ে দেখা গেলো সেই ছোট মামার বিদেশ গমনের কেচ্ছা। নিজের বুঝ পাগলেও বুঝে শুধু নোভেল বুঝে না। ও মামার ব্যাবসা বুঝে পেতে চায়। মামা কি বোকা যে ওকে ব্যাবসা বুঝিয়ে দিবে। এ নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে কাহিনি হচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে কৃষ্ণচূড়া। এ বাড়ির তিন ভাগ তিন ভাইয়ের। বোনেরা এ বাড়ি পায় নি। মেঝো মামা মারা যাওয়ায় এ বাড়ি এখন দুই ভাইয়ের। বড় মামার পূর্বাচলে বাড়ি করার সময় ছোট মামার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো বছর চার আগে। জামি কেনার কাজটা বড় মামা একদম ঝুঁকের মাথায়ই করেছে। তা শোধ করার কোন নাম গন্ধ নেই। সেই টাকার হিসেবে এই বাড়ি তার নামে লিখে দিতে বলছে।
বড় মামার কোন উপায় নেই। সে টাকার অভাবে বাড়িই কম্পিলিট করতে পারছে না। তার টাকা শোধ করবে কিভাবে। তাছাড়া নাসিমার দীর্ঘ এগারো বছরের যাবতীয় ভাড়ার টাকাও নাসিমা বড় ভাইয়ের কাছে পায়। যদিও সে টাকা সে চাইবে না বলে মনে মনে ঠিক করেছে।
বাকী দুই বোন এসব কেচ্ছায় নেই। তাদের একজন ননাশের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে আরেকজনের ছেলেমেয়ের পরীক্ষা। প্রকৃতপক্ষে তারা এসব কেচালে জাড়াতে চায় না। যত দায় নাসিমার। তিনি হচ্ছেন এ বাড়ির প্রধান বিচারপতি। এ গোপন নাম রোদেলা আর প্রিসিলার দেয়া।
রাত শেষের দিকে কিন্তু কথার শেষ হয় না। আড়াইটা পর্যন্ত চলে এই দেনদরবার। শুধু মারামারি বাকী ছিলো দুই ভাইয়ে। শেষে বড় মামা বের হয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। যদিও এটা তার নাটক ছাড়া কিছুই না। আসলে তিনি এখন দিশেহারা। তার এখন কোন পথ খোলা নেই।
বড় মামার একমাত্র ছেলে নিশাদকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে পড়ার নামে ঘোড়ারডিম, ব্যাবসা শুরু করেছিলো। টাকার জোগান দিয়েছেন বড় মামাই। সেখানে তার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের দিন ঘুরতে আর সময় লাগবে না ভাবনাটা এটাই ছিলো। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো না। নিশাদ যখন ব্যাবসাটাকে একটু দাড় করালেন তখনই ঠুস করে বিয়ে কর ফেললেন। আর ওর বউ….
সে তো স্ট্রাগল দেখেনি, এফোর্ট দেখেনি, টাকার যোগান কোত্থেকে এসেছিলো তাও দেখেনি দেখেছে প্রতিষ্ঠিত পুরুষকে। তাকেই সে বিয়ে করেছে। এখন বাবা-মাকে যখন দেখবার সময় তখন বউর নজরদারি।
এসব নিয়ে অনেক কাহিনি হয়েছে। বড় মামা প্রকৃতপক্ষে পূর্বাচলের জমিটা নিশাদের ভরসায়ই কিনেছিলেন। অবশেষে এসব অশান্তি দেখে বড় মামা নিশাদকে বলেছে – বাবারে আমার দায়িত্ব ছিলো তোদের মানুষ করার, প্রতিষ্ঠিত করার, আমি তোদের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কোন ত্রুটি রাখি নি। সাধ্যের মধ্যে সেরাটাই দিয়েছি সবসময়।
আমার সাথের সবার কত অর্থ বিত্ত। আর আমার একমাত্র সম্পদ আমার ছেলে ইন্জিনিয়ার। পড়াশোনা চুলায় দিয়ে তুই ব্যাবসা করছিস তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। তোরা ভালো থাকলেই আমি খুশি। আমাদেরকে তোর আর দেখতে হবে না, এসব নিয়ে তোর সংসারে অশান্তি হোক তাও আমি চাই না। তোর উপর থেকে আমি সবরকমের দাবি উঠায় নিলামরে বাবা। আজ থেকে তোর বাবা-মা নামক পিছুটান, তাদের প্রতি কর্তব্য আর রইলো না। দেশে আসলে আসিস আমার বাড়ি আমার সাধ্য মতো যা করার তা পালন করবো।
ঐ যে ধাক্কা খেয়েছে, আজও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। ভেবেছিলো বাড়ি তৈরী করে তা ভাড়া দিয়ে ঋণ ও শোধ করবে বাড়ির কাজও সম্পন্ন করবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে নি। ঐ জায়গাটা এখন বড় মামার গলার কাঁটা।
তাইতো দায়িত্ব হোক কিংবা বোঝা কিছুটা কমাতেই এত কম বয়সে নাতাশার বিয়ে দিয়ে দেন তিনি। কখন কি হয়ে যায়। এসব সবই বুঝে রোদেলা। কিন্তু ওদের সাথে ওর বড় মামা অন্যায় করছেন তাও কিন্তু সত্যি। তাই এসব ভেবে আর মায়া লাগে না ওর তাঁর জন্য। উনি তো ওদের চেয়ে বেশী অসহায় না…
এই বিপদে বড় মামার একমাত্র ভরসা তার পুত্র নিশাদ। কিন্তু তিনি তার কাছে যাবেন না। এ মুহূর্তে নাসিমাও কিছুটা শংকিত। কারন তার সব কিছু বড় ভাই নামক তলাবিহীন ঝুড়িতে তিনি বহুকাল আগেই সমর্পণ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে তার করনিয় কি তিনি বুঝতে পারছেন না।
একদিকে বড়মামার কেচাল, এদিকে নোভেল তাদের সাথে যাবে না, ঐ দিকে ছোট মামা কৃষ্ণচূড়া লিখে দিতে বলছে। এই ত্রিমুখী সংকটে এখন এই পরিবারটি। সাথে নাসিমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
এদিকে ছোট মামাও চিন্তিত ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। এতে তো সমাধান হবে না। তাই তাদের চাচাকে ডাকা হলো পরদিন। সাথে তিন বোনদের ও। তার হাতে সময় বড় কম। নাসিমা বাড়িতেই ছিলো, বাকী দুই বোন এলো বিকেলে। সন্ধ্যায় তাদের চাচা সবাইকে নিয়ে বসলেন। বাকী দুবোন গা ঝাড়া, তারা নাসিমার মতো ভুল করে নি। প্রাপ্য সম্পদ বিক্রি করে অন্য জায়গায় জমি কিনে রেখেছেন। তাই তাদের দায়ে পরে নামমাত্র আসা। নাসিমা যে দুবোনের সাথে আলদা করে পরামর্শ করবে সেই ফুসরতও পেলো না।
বিচারে কোন সমাধান হলো না। বড় মামার কাছে যা টাকা পান তা এই বাড়ির অর্ধেক সম্পদের মূল্যের চেয়ে কম। এই বাড়ির অর্ধেকের দাম এখন কম করে হলেও ৫০ লক্ষ টাকা। আর ছোট মামা পান ৩৬ লক্ষ্য টাকা। যদিও টাকাটা তিনি একবারে দেন নি, কয়েক দফায় দিয়েছিলেন। নিশাদের ব্যাবসা দাড় করানোর সময় আর জমি কেনার সময়। খুব ভালো একটা জমি পেয়ে হাত ছাড়া করতে চাননি বড় মামা। তাই বিচার বিবেচনা না করেই হুট করে পুরো টাকা ধার করে জমি কিনে ফেলেছিলেন।
যদিও টাকাটার সুদ হিসেব করলে তা ৫০ লক্ষ ও ছাড়িয়ে যাবে। ছোট মামা বলেছেন পাওনা টাকা তাকে দিতে হবে না, বাড়ি লিখে দিল বাকী টাকাও তিনি দিয়ে দিবেন। বড় মামা এ কথা শুনে কেবল চেয়ে ছিলেন তার দিকে।
বোনদের ও দেখা গেলো না নাসিমার কিংবা বড় ভাইয়ের পক্ষ হয়ে কোন কথা বলতে। খারাপ সময় হলে যা হয় আর কি। তারা কেন তাদের জন্য নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করবেন। শেষে বড় মামা সময় চাইলেন, প্রয়োজনে পূর্বাচলের জমি বিক্রি করে দিবে
তবুও তার ভাগের বাড়ি উনি দিবে না।
এদিকে নোভেলও উৎপাত ওর বাবার সাথে। ওর বাবা ব্যাবসা এরিমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। ও বললেই তো আর হবে না। বাড়ির অংশ বিক্রি করে দিবেন যে কোন সময়। বড় মামাকে টাকার জন্য ফোর্স করে করে যদি বাকী অংশ ও নেয়া যায় তাহলে একদাগে বাড়ি বিক্রি করলে ভালো দাম পাবেন তাই তার এই তৎপরতা।
সম্পত্তি খুবই জটিল জিনিস, থাকলেও জ্বালা না থাকলেও জ্বালা। একজন বসে আছে লিখে নেবার ধান্ধায়, একদাগে বিক্রি করলে ভালো দাম পাবে, আরেকজন যে পথে বসে যাবে তার খবর নেই। সেই আরেকজন বাইরের কেও না। তারই রক্তের আপন মায়ের পেটের বড় ভাই….
যে বাবা মারা যাবার পর এতগুলো ভাইবোনদের মানুষ করেছে, পড়াশোনা করিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। সংসার দেখে নিজের দিকেও খেয়াল রাখেন নি। নিজে বিয়ে করেছে জীবণের মধ্যাহ্নে…. তাই তো ষাটোর্ধ বয়সী বড় মামার নাতাশার বয়সী নাতনি থাকার কথা। অথচ এত যে ত্যাগ এটা তারই প্রতিদান। আসলে মানুষ যখন টাকার নেশায় বুদ হয়ে যায় তখন টাকা ছাড়া আর কিছু চোখে দেখে না। ঐ টাকা তাদের সকল ইন্দ্রীয়তে মোহর মেরে দেয়। ধীরে ধীরে টাকা হয়তো অনেক থাকে কিন্তু ভিতরটা অনুভূতিহীন কুটুরিতে পরিনত হয়। যেখানে আপন-পর, মায়া সহানুভূতি কিচ্ছু থাকে না
চলবে…..
কমেন্ট কিন্তু করবা, নাহলে খবর আছে তোমাদের 😅
previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=454823410015526&id=100064636124543
Next:
https://www.facebook.com/100064636124543/posts/457906773040523/