রোদেলা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব- ৪০

0
713

#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব- ৪০

দিন দিন কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছেন মামা। তার মৃত্যুর প্রহর গুনা ছাড়া কোন উপায় নেই যেন আর। সবাই তা মেনেও নিয়েছে যেন ।

আজও আফজাল হোসেনের কাছে গিয়েছিল বড় মামী । পরপর তিনদিনেও দেখা পাননি তার। আজ যদি খোদা মুখের দিকে চান, দেখা হলেও হতে পারে। কিন্তু তিনি আজও খালি হাতে ফিরে এসেছেন। তিন দিন গিয়েছে কত রকমের কাহিনি দেখে এসেছেন তিনি। আজ যা দেখে এসেছে, মামী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর যাবে না সেখানে।

তার এলাকার এক মেয়ের স্বামী এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। ঘাতক ড্রাইভার ধরা পরছে এলাকাবাসীর হাতে। পুলিশের হাতে তাকে তুলে না দিয়ে টাকার মাধ্যমে মীমাংসা করে দিয়েছেন তিনি। মেয়েটাকে বুঝিয়েছেন তোর স্বামী তো মরেই গেছে, ড্রাইভারকে পুলিশে দিলে তোর স্বামী তো আর ফিরে আসবে না। তারচে ভালো টাকা নিয়ে নে। তুই বিধবা মানুষ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলতে পারবি কিছুদিন।

গাড়ির মালিকের কাছ থেকে তিন লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করে দিয়েছেন তারা। অসহায় বিধবা একটু যেন আশার আলো দেখেন ঐ টাকায়। অথচ আজ একমাস হলো আজ না কাল, কাল না পরশু এমনি করে ঘুরাচ্ছে….

মেয়েটা আজও এসেছিলো। এর আগে ও একদিন দেখা হয়েছিল ওর সাথে, সে সুবাদে ওর ঘটনা জেনেছেন তিনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মেয়েটাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে কি বলেছে কি করেছে আল্লাহ জানে, মেয়েটাকে ছোট বাচ্চা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যেতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করে কাঁদছে কেন…?

মেয়েটা উত্তরে শুধু বলে –

: ওরা মানুষ না খালা, সবগুলো অমানুষ। আমি অসহায় মানুষ আমারে সাহায্য করবো কি, উল্টা আমার এতিম পোলাপানের টাকা মাইরা খাইলো। আল্লাহ… আল্লাহগো কই বইয়্যা এগুলা দেহ তুমি….! আমি সহ্য করলাম আল্লাহ, তুমি সহ্য কইরো না….!

এ কাহিনি দেখে তিনি আর অপেক্ষা করেননি…
এরা এভাবেই বড়লোক হয়েছে। মানুষের হক মেরে, মানুষকে ঠকিয়ে। তারা সানগ্লাস চোখে চলে জীবণে রোদের তাপ কি তারা কিভাবে জানবে৷ এই মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে কিভাবে দিন পার করবে, দেখলেই তো মায়া হয়। অথচ ওদের টাকাটাই কিভাবে গায়েব করে দিলো….

বাড়ি এসে খাবার টেবিলে যখন এসব বলছিলো বড়মামী তার চোখ দুটো ভিজে উঠেছিলো। ঐ মেয়েটার আর নিজের দূর্ভোগের কথা ভেবে। স্বান্তনার ভাষা যেন হারিয়ে গেছে ওদের পৃথিবীতে। কি বলে স্বান্তনা দিবে। নিজেরাও তো নিস্বঃ। কেও সব হারিয়ে, কেও আপনজন হারিয়ে,

হঠাৎ নোভেল বলে বড় আম্মা জায়গার ব্যাপারটা নিয়ে সুফিয়ান ভাইকে একটু যদি বলে দেখতেন । যদিও ঐ এলাকার না তিনি, তবুও নেতা মানুষ তো হয়তো এর একটা সমাধান করে দিতে পারবেন।

বড় মামী নাসিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন নারে ওকে দিয়ে কাজ হবে না। এ এলাকায় হতো তাও চেষ্টা করতাম। ওরা অনেক খারাপ লোক। রোদেলা বলে – মামী আমরা শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি না। চেষ্টা করতে তো দোষ নাই। যদি উনি পারে কিছু করতে। নোভেল তুই এক কাজ কর তাকে ফোন করে মার সাথে কথা বলিয়ে দে। মা তুমি বলো বাসায় আসতে। ফোনে বলার চেয়ে সামনাসামনিই বললে ভালো হবে।

যে কথা সে কাজ, সুফিয়ানকে ফোন করা হলো। সুফিয়ান এলো পরদিন বিকেলে। অনেকদিন পর দেখা হলো সবার সাথে। কেমন যেন দিশেহারা ভাব তার মধ্যে। তবুও জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে চেষ্টা করছে সেটাকে ঢেকে রাখতে। কে কতটুকু বুঝেছে তা বোঝা যাচ্ছে না, তবে রোদেলার চোখে ফাঁকি দিতে পারে নি সে দিশেহারা ভাব। ফিরে যাওয়ার সময় এগিয়ে দিতে গিয়ে সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করে রোদেলা – কি ব্যাপার বলুন তো, আপনাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে…
মুচকি হেসে তিনি বললেন-
– আরে নাহ্…! তেমন কিছু না, আমার মা ও অসুস্থ, তাই মনটা একটু খারাপ। দোয়া করো আমার মায়ের জন্য।
– হায় খোদা, এতক্ষণে এ কথা বলছেন আপনি…?
কি হয়েছে তার…!
– হার্টে দুটো ব্লক ধরা পরছে, ঔষধ চলছে, কাজ না হলে অপারেশন করাতে হবে।
– আহারে…! আচ্ছা আমরা যাবো আপনাদের বাসায়, ঠিকানাটা দিন তো…
– নোভেল চিনে আমাদের বাড়ি, যদি যাও ও নিয়ে যেতে পারবে।
– আচ্ছা ঠিকাছে, খেয়াল রাখিয়েন তার, আর হ্যা নিজের খেয়াল ও রাখবেন। আপনি সুস্থ না থাকলে শক্ত না থাকলে আপনার মাকে নিয়ে হসপিটালে দৌঁড়াবেন কি করে…! আপনার মায়ের জন্য হলেও আপনাকে শক্ত থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে। আপনি না বড়…!
– মলিন হাসি হেসে বলে, এভাবে ভাবি নি তো…
আসলে মা ছাড়া আর কেউ নাই আমাদের, তাই তাকে হারানোর ভয় মনে জেঁকে বসেছে।
– ভয়ের কিছু নেই, আল্লাহ ভরসা। দোয়া রইলো…
– আচ্ছা, আসি তাহলে…..

রোদেলা দাঁড়িয়ে থেকে সুফিয়ানের চলে যাওয়া দেখলো। যে পর্যন্ত দেখা গেলো তাকে সে পর্যন্ত। কলাপসিবল গেইটে তালা লাগাতেই একটা গাড়ি এলো ওদের বাড়ির গাড়ি বারান্দায়। চিনতে সমস্যা হলো না রোদেলার এটা নাতাশার শ্বশুরবাড়ির গাড়ি। তাদেরকে দেখেই দৌড়ে উপরে উঠে গেলো রোদেলা। কারন গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে শোভন বসা। ও কোন মতেই শোভনের সামনে পরতে চায় না। তাই ও এভাবে উপরে উঠে গেলো। খুব সম্ভবত বড় মামাকে দেখতে এসেছেন তারা।

রোদেলা তিনতলায় ওর নানুর ঘরে চলে গেলো। মেহমান এলো, মামাকে দেখলো, নাশতা খেলো। কয়েক ঘন্টা হয়েছে তারা এসেছে। এখনো গিয়েছে কি না তা জানতে বারান্দা থেকে উঁকি দেয় নিচে। তিন তলার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওদের কালো রঙের গাড়িটা। আটটা বাজতে চললো গাড়ি এখনো গাড়িবারান্দায় দাড় করা। তার মানে তারা এখনো যায় নি। ভাবতেই হুড়মুড় করে একদল মানুষ ঢুকলো রোদেলার নানীর ঘরে। তার সাথে দেখা করতে এসেছে তারা।

রোদেলা ভুত দেখার মতো চমকে গিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে। কল্লোলের মা, শোভনের মা আর ফুফু এসেছেন ঘরে।
সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে, নাতাশার খোঁজ খবর নিয়ে কোন এক ছুতায় বের হয়ে যায় ঘর থেকে। ঘর থেকে বের হতেই আবার চমকে উঠে রোদেলা ৷ ঘরের দেয়াল ঘেঁষে শোভন দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না ও। হন হন করে নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে দোতালায়…

রোদেলার খুব ইচ্ছে হয় একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে শোভনকে। কিন্তু সব সময় সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। করা ঠিক ও না। এ পিছন ফিরে তাকানোর নতুন কোন অর্থ ও বের করুক তা ও চায় না। যদিও মায়া হয় ওর জন্য,
কিন্তু পেছনের ঘটনা মনে পরলে ওর ঘৃণা হয় ওর প্রতি। যে অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে ও রোদেলাকে, তাতে…..

ও জানে ভালোবেসেই এসব করেছে ও। কিন্তু ও কেন বুঝে না ভালোবাসার আরেক নাম অপেক্ষা… একটা সম্পর্কে দুজন দুজনকে চিনলোই না ভালো করে, হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এত সহজ এ সিদ্ধান্ত নেয়া। যেখানে জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তর একটি এটি….! কেন ওর এত তাড়াহুড়ো। তাড়াহুড়ো কোন কাজই যে ভালো না তা ওর চেয়ে ভালো কে জানে….

আঁকিব ও তাড়াহুড়ো করে হারিয়েছিলো রোদেলাকে। শোভন ও একই কারনে হারাতে বসেছে ওকে। যে ঝড় ওর উপর দিয়ে গিয়েছে এই ঘটনার পর তাতে ওর কষ্টটা একটু বেশীই ছিলো । আঁকিবের বেলায় ও অপরাধ করেছিলো আঁকিবকে ভালোবেসে। কিন্তু এবার…! কোন কথা নাই, বার্তা নাই, এমনকি ছোট্ট কোন ইঙ্গিত ও নাই ভালোবাসার । তার পরও
কোন দোষ না করেই দিনের পর দিন অসহ্য যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে রোদেলাকে। এসব কষ্টই ওকে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। যে ছেলে হুট করে ভালোবাসতে পারে সে যে হুট করে ভুলে ও যাবে না তা কে বলতে পারে….

সেখান থেকে এসে ওর ঘরে দড়জা ভিড়িয়ে বসে থাকে রোদেলা। তারা না যাওয়া পর্যন্ত বের হবে না ঘর থেকে। তারা ফিরবার সময় রোদেলাকে খুঁজে ওর ঘরের দড়জায় উঁকি দিয়ে বিদয়া নেয় । রোদেলা ঘরের ভিতরে থেকেই সালাম দেয়, আবার আসতে বলে, তারাও বলে নাতাশাকে দেখতে যেতে। রোদেলা বলে জলদিই যাবে ও…
নিচে কলাপসিবল গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় নাসিমা।

শোভনের একটা ক্ষীণ আশা ছিলো রোদেলা আসবে নিচ পর্যন্ত। কিন্তু না আসায় একটু কষ্ট পেলো ও। ছোট্ট একটা চিরকুট এনেছিলো সাথে করে। ফিরলোও সেটা সাথে করেই…

রাতে খেতে বসে সবাইকে বললো সুফিয়ানের মায়ের অসুখের কথা। সবাই ভীষণ আফসোস করলো, বললো সময় করে যাবে সবাই তাকে দেখতে। বড় মামী একটু সুর তুলতে চাইলেন শোভনের ব্যাপারে। ওর ফুফু আজ এসেছে রোদেলাকে দেখতে। রোদেলা চোখমুখ শক্ত করে বলে মামী এ বিষয়ে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এ বিষয়ে আর কোন কথা হোক তা আমি চাই না….

চলবে…

previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=460283472802853&id=100064636124543
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=463027469195120&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here