রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব- ৪৩
রোদেলা চলে গেছে আজ চতুর্থ দিন। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ওর খোঁজ করা হয় নি। নোভেল আর সুফিয়ান সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছে। থানায় জিডিও করা হয়েছে।
বাড়িতে সবাই মোটামুটি শঙ্কিত। তরুণী মেয়ে ঘরের বাইরে আর বর্তমান সময়টা কত খারাপ। চারদিকে নানান খবর আসছে প্রতিদিন। সেদিন খবরে দেখালো – ষাটোর্ধ এক মহিলাকে গন ধ*র্ষ*ণ করেছে কয়েকজন যুবক মিলে।
সমাজের পরিস্থিতি কোন জায়গায় দাড়িয়েছে তা এমন খবরই জানান দেয়। যে সমাজে মা-নানীর বয়সী কেও শঙ্কা মুক্ত না সেখানে রোদেলা তো…..
তাছাড়া যে পরিস্থিতিতে ওকে বের করে দেয়া হয়েছে তাতে আ*ত্ন*হ*ত্যার ব্যাপারটা ও ইঙ্গিতে মাথায় রাখতে বলেছেন বড় মামী। তাই ওরা হসপিটাল গুলোতেও যাচ্ছে কোন খবর পেলেই।
নাসিমা ঐ রাতের পর পুরোই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলে না। খাওয়াদাওয়া ও করে না ঠিকঠাক। ঘরের দরজা আটকে কাঁদে শুধু। নোভেলকে নতুন নতুন জায়গায় খোঁজ নিতে ঠিকানা দেন।
তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন রাগের মাথায় কত বড় ভুল করেছেন তিনি, কিংবা আদৌ বুঝেন নি। তবে তার আচরণ পুকুরের জলের মতো শান্ত হয়ে গেছে। আচার আচরনে কোন উত্তাপ নেই, কথায় কোন ঝংকার নেই, নেই ভুল ধরার বালাই, কাজ কর্ম যদিও সবই করছেন স্বাভাবিক ভাবে কিন্তু তিনি কেমন যেন বদলে গেছেন। তবে সেটা কেমন বদল তা বোঝা মুসকিল। কারন তিনি তো সবসময়ই নিজেকে রহস্যে মুড়ে রাখেন। তাকে ভেদ করা ভীষণ কঠিন।
নানী সেই রাত থেকে কাঁদছেন তো কাঁদছেনই। নাসিমাকে বকছেন, কেন সে এমন করলো মেয়েটার সাথে। বড় মামীরও মন খারাপ। রোদেলাকে মেয়ের মতো দেখতেন তিনি। সেদিন রাতে তার কান্নার আত্ন চিৎকারে আশেপাশের সবাই ভেবেছে যে তার স্বামীর হয়তো কিছু একটা হয়ে গেছে। এখনো তিনি কাঁদেন, রান্নার সময়, খাওয়ার সময়, ওর কাপড়, জুতা ধরে কান্না করেন তিনি সময়ে অসময়ে। ঠিক যেমনটা করার কথা ছিলো ওর জন্মদাত্রী মায়ের।
নোভেল দিনরাত শুধু দৌড়াচ্ছে এদিক থেকে সেদিক। একদিন পর সব খুলে বলে সাহায্য নিয়েছে সুফিয়ানের। যেখান থেকেই খবর আসুক না কেন দৌড়ে গেছে সেখানে। রাত নেই দিন নেই খুঁজেছে রোদেলাকে। হসপিটালের মর্গ থেকে শুরু করে স্টুডেন্টের বাসা, কলেজের বন্ধুবান্ধব
সবখানেই খোঁজ করেছে ওরা।
এই বাড়ির একমাত্র নিশ্চিন্ত মুখ প্রিসিলা। ওর যেন কোন চিন্তাই নেই বোনের জন্য। ও খাচ্ছে, সময় করে কোচিং এ যাচ্ছে, রাতের বেলা নিয়ম করে নাটক দেখছে, কোন কারনে সেটা মিস করলে দুপুরে সেটা দেখে নিচ্ছে, বিকেলে কল্লোলের উপহার দেয়া ক্যামেরায় নানান ছবি তুলে তা পর্যবেক্ষণ করছে। নতুন নতুন ট্রিকস শিখছে ছবি তোলার।
রোদেলার ব্যাপারে ওর যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর আচরণে মনে হচ্ছে রোদেলা বলে কেও এখানে কোন দিন ছিলোই না। কত রহস্যময়ী চরিত্র প্রিসিলা….
নাতাশাদের বাড়ির মানুষ জেনেছে তিনদিন পর। এসব তো আর ডেকে জানানোর কথা না। তারা আর কি করতে পারে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া। তবে শোভন যখন জানলো এসবের পিছনে ও নিজেই কারন তখন থেকেই অনুতাপের আগুনে জ্বলেছে। কি করছে, কোথায় আছে এ-ই ভেবেছে দিনরাত। খোঁজ নিচ্ছে নোভেলের কাছ থেকে।
নোভেল আর সুফিয়ান প্রতিদিন একবার করে যায় থানায়। তারা যথেষ্ট চেষ্টা করছে ওকে খুঁজতে, কিন্তু ফোনের সর্বশেষ লোকেশন ওদের বাড়ির আচেপাশে হওয়ায় তারা বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না।
বড়মামার অবস্থা ও ভালো না এদিকে। বেশ কয়েকদিন হলো ঔষধ বন্ধ। চিকিৎসা তো আরো আগে বন্ধ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা সিদ্ধান্ত নেয় নিচের ঘরগুলো ভাড়া দেওয়ার। যা পাওয়া যায় তাতে ইউটিলিটির বিল গুলো তো অন্ততঃ দেয়া যাবে।
রোদেলার চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে নোভেলের জীবণে। ও যেন বড় একটা ধাক্কা খায় রোদেলা চলে যাবার পর। নিয়মিত কাজ করতে থাকে সুফিয়ানের এক প্রোজেক্টে। সেখানে বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইটে সাপ্লাইকৃত সকল ধরনের মালামালের হিসেব রাখে ও । প্রতিদিন বিকেলে ওকে ৫০০ করে টাকা দেয়া হয়। সুফিয়ান ইচ্ছে করেই ওকে প্রাপ্যর চেয়ে কম দেয় সুফিয়ান। কারন টাকার মর্মটা ওর শেখা জরুরী। নোভেল সে টাকার পুরোটাই তুলে দেয় বড় মামীকে। আপাততঃ সংসার খরচ চলছে সেখান থেকেই। তাছাড়া নাসিমার দুই বোন ও রীতিমতো সহায্য করছে ওদের সংসারে।
এ পরিবারের এমন বিপদের দিনে সুফিয়ান যেন আরো কাছে এসেছে তাদের, ঠিক পরিবারের বড় ছেলের মতো। প্রথম প্রথম কয়দিন বাজার সদাই করে দিয়ে গেছে, বড় মামী তখন বলেছিলেন – বাবা তুমি কতদিন এমন দিবে, তারচে বরং ঐ টাকাটা যদি তোলার ব্যাবস্থা করে দিতে…….
ও বলেছে-
চিন্তা করবেন না, এ সপ্তাহের মধ্যে একটা খবর জানাবে আমাকে। এদিকে সুফিয়ানের ও চেষ্টা তদবির চলছে পূর্বাচলের জমির টাকাটা তুলে দিতে। এ সময় তাদের এ টাকাটা ভীষণ জরুরি।
নাতাশাও এসেছে অসুস্থ শরীর নিয়েই, বেচারীর এমন হাল পানিটা পর্যন্ত খেয়ে রাখতে পারছে না, বমি করে ফেলে দিচ্ছে। না খেতে পেরে অনেক শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে শোভন। ও নিজেও ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। কারো সাথে কথা বলে নি। বসবার ঘরে সোফায় চুপ করে বসে ছিলো এক কোনে স্থির দৃষ্টিতে। তারপর কোন রকম নাশতা না খেয়েই চলে গেছে কাওকে কিছু না বলেই। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটা ওর জন্য ও কতটা কষ্টের । এদিকে নাতাশা বাড়ি এসেই কেঁদে বুক ভাসিয়েছে বোনের এমন চলে যাওয়ার কথা শুনে।
নাতাশাকে শান্ত করতে বলে বড় মামী জানায় বিকেলে এক হুজুরের বাড়ি যাবে, তিনি নাকি নিখোঁজ ব্যাক্তির সন্ধান দিতে পারে। নাতাশা কিছুদিন থাকবে ঠিক করে এসেছে তাই ওর মা ওর ব্যাগপত্র ওর ঘরে রেখেছে। নাতাশা তা নিয়ে গিয়ে উঠেছে রোদেলার ঘরে। ওর খুব কষ্ট হয় কেন ওর কষ্টটার ভাগিদার হতে পারলো না তা ভেবে। দুজনই যে কতো ভালোবাসে দুজনকে, তাহলে আজ কেন এমন হলো, কেন ও বাড়ি থেকে বের হয়ে ওকে ফোন দিলো না। সেই আক্ষেপেই ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
পরদিন কল্লোলও কিছু টাকা পাঠায় নাতাশার একাউন্টে, বাবার চিকিৎসা শুরু করতে বলে….
কিন্তু চাইলেও ওর পরিবারের এমন দৈন্য দশার কথা খুলে বলতে পারে না ও ওর শ্বশুর বাড়ির লোকদেরকে। এমনকি কল্লোলকেও। কারন সবকিছু এত হঠাৎ হয়ে গেলো যে নাতাশাই সবকিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আসলে মানুষের জীবণ যে কত আনপ্রেডিক্টেবল তার বাস্তব উদাহরণ ওর বাবা। একটা অসুখ সব শেষ করে দিলো, সব………..
রোদেলার খোঁজ নিতে কল্লোল ওর এক পুলিশ বন্ধু যে কি না পুলিশের এস.আই তার নম্বর দিয়ে বলে নোভেলকে দিতে। সে নাকি ওকে খুঁজতে সাহায্য করতে পারবে তা জানায়। নাতাশা নোভেলকে ফোন নম্বর দেয়, নোভেল বলে আপা- এখনকার থানার ওসি খুবই ভালো লোক, তিনি খুবই আন্তরিক ভাবে দেখছেন ব্যাপারটা। আপাততঃ কোন সাহায্যের দরকার নেই। দোয়া করতে বল…
গতকাল নাতাশার মা সেই হুজুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন ও ভালো আছে, এবং ভালো লোকের কাছেই আছে। যার কাছে আছে তাতে কোন চিন্তা নাই ওকে নিয়ে, এবং ও ফিরে আসবে……
কিন্তু আজ বিকেলে হঠাৎ নাসিমার ফোনে ফোন এসেছে। ওপাশ থেকে একটা লোক বলছে- মগবাজারে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, একেবারে স্পট ডে*থ, ডে*ড ব*ডির ব্যাগ থেকে পাওয়া কলেজের আইডি কার্ড থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করলাম। নাসিমা যেন কিছুই বুঝতে পারছে না, কি বলছে ওপাশ থেকে….
রান্নাঘরের মেঝেতে কেমন যেন মাথা ঝিম ধরে পরে গেলো সে। রান্নাঘর থেকে হুড়মুড় করে কিছু পরার শব্দে বড় মামী দৌড়ে এসে দেখেন নাসিমা মেঝেতে পরে আছে, চিৎকার করে ডাকেন তিনি নোভেলকে। তখনও ফোনটা বাজতেই থাকে। ফোনটা রিসিভ করে প্রিসিলা…..
ওপাশ থেকে একই কথা পুনরাবৃত্তি হয় আবারো, প্রিসিলা কেঁদে নোভেলকে ফোনটা দিয়ে বলে দেখ তো কি বলছে… নোভেল লোকটার কথা শুনে মাটিতে বসে পরে…..
ওকে বসে পরতে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে প্রিসিলা…
বড় মামী জিজ্ঞেস করে কিরে- কি বললো….
নোভেল কাঁদতে কাঁদতে বলে বড় আম্মা আপার এক্সিডেন্ট হইছে, স্পট ডে*থ…….
সেই মুহূর্তে রওনা দেয় নোভেল মগবাজারে, সুফিয়ানকে জানায় ফোন করে সব সুফিয়ান যেন বিশ্বাস ই করে না এসব… দৌড়ে গিয়ে গাড়ি বের করে। নিজে ড্রাইভ করার সাহস হচ্ছে না ও তাই ওর এক এসিস্ট্যান্ট কে বলে গাড়ি চালা। যদিও ও সবসময় ই নিজে ড্রাইভ করতে পছন্দ করে।
বিপদের পথ যেন ফুরায়ই না….
প্রতিটা সিগনালে জ্যাম। এত বিশ্রী লাগছে ওর যেন জ্যাম জিনিসটার সাথে ওর এ যাবৎ কালে পরিচয়ই ছিলো না। নোভেল পথিমধ্যে বাস থেকে নেমে যোগ দেয় সুফিয়ানের সাথে। দু’জনেই চুপ…
কোন কথা বলবার জন্য খুঁজেই পাচ্ছে না হয়তো….
অবশেষে সেখানে পৌঁছে দেখে একটা মেয়ের লাশ, বুক থেকে উপরের অংশ এমন বাজে ভাবে থে*ত*লে গেছে যে….. প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় একটা বাস মেয়েটাকে ধাক্কা দেয়, সেখানকার লোকজন হৈ হৈ করে তেড়ে আসায় ভয়ে ড্রাইভার আর গাড়ি থামায় নি, সেই বডির উপর দিয়েই গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যায়। যার কারনে ডে*থ ব*ডিটার এমন করুন অবস্থা। জ্যাম থাকার কারনে গাড়িটা নিয়ে কেটে পরতে পারে নি। তাই গাড়িটাকে একটু সামনে এগিয়ে থামিয়ে ড্রাইভার পালিয়েছে।
লা*শ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে। নাসিমা, বড় মামী, নাতাশা বসে আছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে। লা*শ সনাক্তের জন্য পুলিশ গায়ের জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ আর ফোন দিয়েছেন পরিবারের সামনে। ব্যাগ দেখে বড় মামী কান্নায় মাটিতে গড়াগড়ি খায়, ফোনটাও রোদেলার, তবে ভিতরে সিমটা নতুন। পার্স, আইডি কার্ডে সবই রোদেলার….
সেখানে যেন হঠাৎই এক শোকের ছায়া নেমে আসে, ওদের আর্তনাদে ভারী হয়ে যায় ওখানকার বাতাস…
নাসিমা ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে, কথা বলে না অনেকক্ষণ, লা*শ বের করার সময় নাসিমার ধ্যান যেন ভঙ্গ হয়, চিৎকার করে বলে-
মারে…………..
স্থব্ধতার থমথমে আকাশ ভেঙে প্রথম বারের মতো পরে শোকের বৃষ্টি। যে বৃষ্টি ক্রমেই রূপ নেয় ঝড়ের, ভেতরকার ঝড় যেন উপরে বের করে দিতে চাইছেন তিনি। তার মেয়ে, তার প্রথম সন্তান, যে দুর্দিনে সংসারোর হাল ধরেছিলো, যার সবচেয়ে বেশী অবদান তার সংসারে এবং যার প্রতি সবচেয়ে বেশী অবহেলা অন্যায় তিনি করে এসেছেন দিনের পর দিন। আজ যে মেয়েটাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে তার…
কিন্তু রোদেলার শরীরটার যে নাম বদলে গিয়ে লা*শ হয়েছে, তাকে ধরে আদর করার মতো কোন উপায় নেই, একটা শরীর পরে আছে স্ট্রেচারের উপরে, বুক নেই, মাথা নেই শুধু কাটা অংশে র*ক্ত আর দুটি অক্ষত পা। সেই পা দুটি ধরেই আজ অঝোরে কাঁদছেন তিনি। তার ভাগ্যে মেয়েটাকে আদর করাও জুটলো না….
কি নিয়তি…
কি নির্মম নিয়তি………….
চলবে….
(সবাই অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবা….)
previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=468220395342494&id=100064636124543
next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=470586731772527&id=100064636124543