রোদোলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৪
থানার যাবতীয় কাজ শেষ করে সবার বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা। বাদ এশা রোদেলার জানাজার নামাজ। কৃষ্ণচূড়া গিজগিজ করছে মানুষে। যেন মানুষের ঢল নেমেছে। একেকজন একেক কথা বলছে। কেও কেও বলছে নাসিমার উগ্র মেজাজের ব*লি হলো মেয়েটা, কেও কেও বলে আহারে… কত কষ্টেই না প্রাণটা বের হইছে মেয়েটার, কেও আবার বলছে আ*ত্ন*হ*ত্যা করছে গো…
কম সহজে কি কেও এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়….
একটা মানুষের জন্য একটা পরিবার কিভাবে ভেঙে গেলো সেসব কথাও শোনা গেলো কারো কারো মুখে। একজন বললো- শোন এই চোপার কারনেই তো স্বামীর ঘর করতে পারলো না, ছোট ভাইটা অতিষ্ঠ হয়ে বৌ নিয়ে চলে গেলো বিদেশে , যু*ব*তী মাইয়্যাডারে রাতবিরেত বাড়ির বাইর করলো, সে ফিরলো লা*শ হয়ে…
এরপর ও যদি এই মহিলার শিক্ষা না হয় তাহলে এই বেডি মরলেও মানুষ হইবো না।
তার কথায় সায় দিলো অনেকেই। সব কথাই রোদেলার পক্ষে। সবাই এই মৃ*ত্যুর জন্য দুষছে নাসিমাকে। একজন বললো মা*র*লে*ই কি খু*নি হয় গো বইন… ঘরের মধ্যে যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে যারা এমন পথের দিকে এগিয়ে দেয় তারাও কিন্তু খুনি। কিন্তু আফসোস তাদের বিচার হয় না। এমন ফুলের মতো মেয়ের মৃ*ত্যু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব।
লা*শ গোসল করানোর সব আয়োজন করা হলো, কি আর গোসল করাবে একে। এমনি অভাগা পুরো শরীরটা নিয়েও যেতে পারলো না। শেষে গোসল করিয়ে কা*ফ*নে*র কাপড়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে ওকে । কাওকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না, কি দিবে দেখতে…
কি দেখবে তারা….
নাতাশার শ্বশুরবাড়ির লোক এলো আটটার মধ্যে, শোভনের মা বাড়ির ভিতরে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে, কল্লোলের মা আর বাবাও পাশে বসা। শোভন তার পাশেই বসে, তারা যেন মানতেই পারছে না। কি সান্ত্বনা দিবে, তা খুঁজেই পাচ্ছে না।
কান্না আহাজারিতে ভারী হচ্ছে চারপাশের আকাশ বাতাস। নোভেল সান্ত্বনা দিচ্ছে নাসিমা আর প্রিসিলাকে। রোদেলার নানুর অবস্থা খারাপ। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে এ খবর পাওয়ার পর থেকেই । কথাও বলতে পারছেন না তিনি। রোদেলার খালামনিরা সেখানে ব্যাস্ত। ডাক্তার আনা হয়েছে বাড়িতে। রোদেলার মা মূর্ছা গেছেন দুবার, দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছিলো শেষবারে।
এমন একটা পরিস্থিতি যে কে কাকে সান্ত্বনা দিবে। সবাই কাঁদছে অঝোরে। এমন টগবগ এক মেয়ে যে কিনা জীবণের বড় বড় ঝড় সামলে এতদূর এসেছে, তার এমন করুন পরিনতি কেওই মানতে পারছে না। সবাই ভালোবাসতো ওকে ওর বিনয়ী ব্যাবহারের জন্য। কোনদিন কারো সাথে মুখ কালো করে কথা বলে নি ও। এখনকার সময়ে এমন মেয়ে দেখাই যায় না। যে কিনা পরিবারের কথা চিন্তা করে শোভনের মতো একটা ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
আল্লাহ কেন এমনি করে ওকে নিয়ে গেলো তার আক্ষেপ কারো মুখে মুখে। ছোট মামীর বাবার বাড়ির লোকও এসেছে, তারাও হতবিহ্বল এমন ঘটনায়। কেওই মানতে পারছে না এমন অকাল মৃ*ত্যু।
শোভন একটু দেখতে চায় রোদেলাকে, লা*শে*র পাশে বসে থাকা মহিলারা বলে কি দেখবা বাবা, দেখার কিছুই নাই। তবুও দাঁড়িয়ে থাকে ও জিদ করে। না দেখে ও যাবে না। পরে পাশে থাকা পুরুষরা বলে মেয়ে মানুষের লা*শ পুরুষের দেখতে নেই….. ও তখন বসে পরে খাটটার সামনে। সেটাকে ধরে রাখে শক্ত করে, ও যেন রোদেলাকে ধরে আছে এমনি ভাব। ওর মা ওকে এ অবস্থায় দেখে কেঁদে ফেলেন, ছেলেটা সারাজীবন কষ্টই পেলো শুধু। রোদেলাকে নিয়ে একটু সুখি হতে চেয়েছিলো। তাইতো ওর বাবার শত অনিচ্ছা সত্বেও রোদেলাকে ঘরের বৌ বানাবে বলে কথা দিয়েছিলো শোভনকে। শোভনের বাইরের আবরনে কোন কষ্টের ছিটেফোঁটা না থাকলোও ওর ভিতরটা যে কত গভীর ক্ষতে পূর্ণ তা কেবল ওর পরিবারের মানুষই জানে। ওর মা ওকে আগলে ধরে বসে পরে ওর পাশেই। শোভন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে। খুব চেষ্টা করে কাঁদতে, কিন্তু কান্না যেন পথ ভুলেছে আজ। ওর মা ওকে ভিতরে গিয়ে বসতে বলে, কিন্তু ও সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়। পাশের চায়ের দোকানে বসে থাকে। মাথাটা জ্যাম লাগছে ওর, কি হলো ওর সাথে ও যেন বুঝতে পারছে না…. হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পরে ও। সবার থেকে এ কান্না আড়াল করতেই ওর এখানে আসা। কষ্ট দেবার বেলায় খোদা কেন ওর সাথে কোন আপোষ করে না।
কেন….
কেন……..
কেন………….
রোদেলার বাবা আসে রাত নয়টায়..
মেয়েকে শেষ বারের মতো দেখতে এসেছে সে। এখানে আসবার মতো মুখ তার নেই যদিও, তবুও মেয়ের এমন খবরে নিজেকে আটকে রাখতে পারেন নি তিনি। তিনি খবর পেয়েছেন তার এক বন্ধুর মারফতে, সেই দুপুরেই। রাজশাহী থেকে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো…
লা*শে*র খাট ধরে কাঁদতে থাকে তিনি। বাবা হওয়ায় কা*ফ*নে*র কাপড় খুলে দেখানো হয় তাকে। পা দুটো কে ছুঁয়ে দেখেন তিনি। মেয়ে বড় হওয়ার পর খুব একটা দেখা হয় নি ওর সাথে। তিনি এমনি বাবা যে জানে না মেয়ের কোন হাতে তিল আছে, চিবুকে টোল আছে কি নাই, চুল বড় না ছোট, মেয়েটা লম্বায় কতটুকু, হাত পায়ের আঙুল লম্বা লম্বা না খাটো খাটো… এসব ভেবে চোখ বন্ধ করে রোদেলাকে কল্পনা করতে চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু বাস্তব এমন কঠিন যে সেই ছোট্ট রোদেলা যে ক্লাস টেইনে পড়তো তার চেহারাটাই ভাসছে চোখের সামনে। এত চেষ্টা করেও মনে করতে পরছে না। পাশে বসে থাকা মহিলা দ্রুত কাপড় বেঁধে দেন। এরপর শুরু হয় তার গগন বিদরী চিৎকার। মাটিতে গাড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। নিজেকে গালমন্দ করতে থাকেন মেয়ের এমন পরিনতির জন্য। কিন্তু এত সব কথার কি দাম আছে আজ। কোন দাম নেই….
প্রিসিলা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে বাবার এমন আর্তনাদ। এমন আর্তনাদে ওর মন কেন যেন ভিজছে না আজ। বাবা নামের এই মানুষটাকে মনে মনে একটু ভালোবাসতে চাইতো ও। কিন্তু যখন রোদেলা পেছনের গল্প গুলো বলতো, ওর মায়ের সাথে ওদের সাথে করা অন্যায় গুলোর ব্যাপারে বলতো তখন লোকটাকে ঘৃনা হতো ওর। তার জন্য সবার এই পরিনতি। এই মানুষটা ঠিক থাকলে আজ ওদের এই জায়গায় দাঁড়াতে হতো না। ওদের ও সুন্দর একটা পরিবার থাকতো, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার থাকতো ।
সবশেষে এগারোটা বাজলো ক*ব*র*স্থা*নে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। পরিচিত, অপরিচিত কত মানুষ এসেছে এখানে, কিন্তু সুফিয়ান কোথাও নেই। ও যে নেই তার খবরও কারো নেই। কেন নেই লোকটা…. আজ যে তার প্রিয়তমাকে শেষ বারের মতো দেখার দিন, আর কোনদিন চাইলেও তো দেখা হবে না এই মানুষটাকে। কেমন মানুষ সে….
যে তার ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ বারের মতো একটু দেখতেও এলো না…..
এত মানুষ এসেছে জানাজার নামাজে অকল্পনীয়…
পঞ্চায়তের ক*ব*র*স্থা*নে দা*ফ*ন করা হবে ওকে। মাটি খুঁড়ছে দুজন। তারপর একে একে সব কাজ সম্পন্ন করে নামানো হলো ওকে।
আমাদের সবার প্রিয় রোদেলাকে…..
যে সেই ছোট্ট বেলা থেকে নিপিড়ীত, বাবা-মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, সবার কাছে বাবা মায়ের ভুলের জন্য লাঞ্চিত। যার মায়ের ভালোবাসার পরিবর্তে সবসময় অবহেলাটাই জুটেছিলো, আপন পর সবার কথার বাণেও জর্জরিত ছিলো যার অন্তর। যার দিন কেটেছে রাত পার হবার আশায়। যার জীবণে কোন শখই পূরণ করা হলো না, পছন্দের জামা, জুতা, ব্যাগ, কানের দুল কিংবা এক বোতল গাঢ় লাল নেইল পলিশ…., যে ভাবতো অনেক টাকা হবে যখন তখন সব শখ পূরণ করবে, মাকে ভালো সাইকেট্রিক্স দেখাবে, নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করবে, তারপর বিয়েশাদি নিয়ে ভাবার সময় থাকলে ভাববে….
মায়ের ভালোবাসা পাওয়া হলো না, স্বপ্ন পূরণ হলো না,
প্রিয়তমর অখন্ড ভালোবাসা পেয়েও যা ছুঁয়ে দেখা হলো না,
বাঁধা হলো না ঘর…
জীবণ কাটলো যার পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে, সেই ছোট্ট বেলা থেকে, যার চিন্তা ছিলো আগামীকাল খাবার কোত্থেকে আসবে, বোনের পড়ার খরচ, কাপড়চোপড় বই-খাতা আরো কত কি….
আজ তার ছুটি….
সকল দায়িত্ব থেকে
সকলের লাঞ্চনা থেকে,
মায়ের অবহেলা থেকে,
নিজেকে লুকিয়ে রাখার থেকে
আজ তার ছুটি……………………….
তাকে আজ শায়িত করা হলো চির নিদ্রায়। রোদেলার জীবণে সব কষ্ট হয়তো এরিমধ্যে শেষ হলো। এর পরে পরকালের জীবণে ইশ্বর হয়তো ওর সব না পাওয়ার হিসেবটা ঠিক করে করবেন। সকলের এই দোআ ওর প্রতি।
রাত একটা বাজতে চললো, বাড়ির সবাই কেমন চুপ মেরে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়তো সবাই…
সবাই আজ শান্তিতে ঘুমাবে। এ কয়দিন কেওই ঠিকঠাক ঘুমুতে পারে নি রোদেলার চিন্তায়। কোথায় আছে, কি করছে, কি খেয়েছে এসব ভাবনা ছিলো সবার মনে। আজ সবাই নিশ্চিন্ত। নিখোঁজ রোদেলার খোঁজ হয়েছে আজ। যেখানে রয়েছে সেখান থেকে কোথাও আর হারিয়ে যাবার ভয় নেই।
আহারে রোদেলা………
আহারে জীবণ…..
কত যন্ত্রণার……
কত বেদনার..
কত নির্মম…
চলবে……
previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=469686995195834&id=100064636124543
Next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=472921141539086&id=100064636124543
(সবাই অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবা তোমাদের মতামত, অনুমান, ভাবনা গুলো…)
আর যুক্ত হতে পারো আমাদের ফেসবুক গ্রুপ- Storymania-স্টোরিমেনিয়া তে
Storymania-স্টোরিমেনিয়া