রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ৪৭

0
645

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৭

নাতাশার কাগজপত্র তৈরী হয়ে গেছে। শরীরের যা অবস্থা তাতে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কেওই । প্রবাসে একলা এ অবস্থায় কি করবে তা ভেবেই দিশেহারা সবাই। তার উপর ওর বাবার এ অবস্থা, কখন কি হয়। একমাত্র মেয়ে নাতাশা। সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা।

কল্লোল কিন্তু এসব কথা পাত্তা দিচ্ছে না।
ও বলেছে এখানে সবাই সবকিছু একাই হ্যান্ডেল করে। কিন্তু কল্লোলের মা ওকে বলেছে এ অবস্থায় নাতাশাকে তাঁরা ছাড়বে না। কল্লোল আর কথা বাড়ায় নি। কারন ও জানে কথা যতই চালাচালি হোক শেষমেশ সিদ্ধান্ত মায়েরটাই অটল থাকবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তা মেনে নিলো।

তারা জানে যে বাচ্চাটা ঐ দেশে জন্ম নিলে বাই বর্ন ঐ দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। তবুও তারা নাতাশাকে ছাড়ে নি। কারন তারা চায় ছেলেও দেশে চলে আসুক। তাদের সাথেই থাকুক।

রোদেলার মৃ*ত্যুতে এই পরিবারটাও কেমন যেন দুঃসময় পার করছে। দূর্দশা যেন পিছুই ছাড়ছে না। শোভনকে নিয়ে সবাই চিন্তিত। কখন কি করে বসে।
সেদিন ছাদে উঠে একেবারে কিনারায় চলে গিয়েছিল শোভন, বুয়া কাপড় শুকাতে গিয়ে ওকে ডেকে সরিয়ে আনে। ও নিজেও হয়তো জানতো না কি হতে যাচ্ছিল।

শোভনের মা তাই ছেলেকে একলা ছাড়ে না, এ্যামি ও ভাইকে সময় দিতে এখানেই এসে থাকছে কিছু দিন ধরে। ও ওর ভাইকে ভীষণ ভালেবাসে।

যদিও সেন্টমার্টিন থাকতেই ভাইয়ের সাথে রোদেলাকে নিয়ে বিশাল কথা-কাটাকাটি হয় দুই ভাই বোনের মধ্যে। এ নিয়ে কথাও বন্ধ ছিলো বেশ কিছু দিন।

কারন এ্যামী রোদেলাকে পছন্দ করতো না।
এ কথার উত্তরে সেদিন শোভন এ্যামিকে একটা মাত্র কারন বলতে বলেছিলো ওকে পছন্দ না করার। জাস্ট একটি…..

এ্যামী বলেছিলো রোদেলা একটা ব্রোকেন ফ্যামেলীর মেয়ে। ওদের সাথে আমাদের স্যাটাসে যায় না।

এ কথা শুনে শোভন হেসে গড়িয়ে পরার অবস্থা। এমন একটা পরিস্থিতিতে শোভনকে হাসতে দেখে এ্যামী হতবাক হয়ে যায়, রাগান্বিত কন্ঠে ওকে বলে-
: এভাবে হাসার কি হলো…? আমি কি ভুল কিছু বলেছি, ও কি এই পরিবারের বউ হবার যোগ্য, তোর যোগ্য…?
: আপু হাসালে তুমি আমাকে, পরের দোষ ত্রুটির কথাই আমরা কেবল ভাবি, নিজেদের দোষ, ত্রুটির কথা একদম ভুলে যাই, তুমি কি বললা…
রোদেলা আমার যোগ্য কি না…..?
যার জন্মেরই কোন বৈ*ধতা নেই, তার যোগ্য অযোগ্য হওয়ার কি আছে….?

এ কথার উত্তরে এ্যামী হতবাক হয়ে রেগে শোভনকে চড় দিয়েছিলো, এ্যামী এসব শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এ বিষয়ে এ যাবৎ ওদের মধ্যে কোন কথা হয় নি। এ্যামী ভুলেই গিয়েছিল শোভনের কুৎসিত অতীতের কথা। হঠাৎ এসব শুনে যেন ধাক্কা খেলো ও।

চড় খেয়ে শোভন গাল ঘষতে ঘষতে হাসিমুখে বলেছিলো- কি আপু সত্যি বলায় রেগে গেলে। তুমি রাগলেই কি আমার জন্মকুণ্ডলী বদলে যাবে,
এ্যামী রাগান্বিত কন্ঠে বলেছিলে-
চুপ, একদম চুপ, আর একটা কথা বলবি না তুই,

: আমি কিছু না বললেই কি সব মিথ্যে হয়ে যাবে, বদলে যাবে আমার জীবণ ইতিহাস…..
বদলাবে না আপু, আমি যতটুকু বলছি তা আমার কুৎ*সিত অতীতের ধোঁয়া মোছা, আর খন্ডিত একটি অংশ মাত্র। পুরোটা তো আরে ভয়ংকর…. !

আমি সবকিছুতে এত তাড়াহুড়ো কেন করছি জানো… আমি ভয় পাচ্ছি রোদেলা যদি জেনে যায় আমার নোং*রা অতীত, যদি জেনে যায় আমি আমার বাবার লা*ল*সার শিকার হয়ে জন্মানো অ*বৈ*ধ সন্তান, আমার জন্ম…..

কথাটা শেষ না করতে দিয়েই এ্যামী শোভনের মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে,
শোভন এ্যামীর হাত সরিয়ে হাসতে থাকে উন্মাদের মতো। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ও বের হয়ে গিয়েছিলো শোভনের হোটেল রুম থেকে। এরপর ভাইয়ের সাথে কথা বলেনি আর, এমনকি ঢাকায় ফিরে ও না।

কিন্তু এ্যামী এখন বুঝেছে রোদেলার প্রতি শোভনের ভালোবাসা কত গভীর। কিন্তু এখন তো সে বুঝার কোন দাম নেই। এসব ভেবে কাঁদে এ্যামী। ভাবে হয়তো এসব মেনে নিলে ব্যাপারটা আজ এ জাশগায় দাঁড়াতো না।

ভাইয়ের এমন পরিস্থিতি জেনে এ বাড়িতে আসার পর ও ভাইয়ের সাথে গল্প করে, মুভি দেখে, বাইরে বের হতে চায়, ওর বন্ধুদেরকে আসতে বলে, ওরাও আসে গল্প করতে চেষ্টা করে, ভাইকে স্বাভাবিক জীবণে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ঐ আড্ডাটা ঠিক যেন জমে না। কারন ওর ভাইয়ের তো এসবে মন নেই, সে যেন পৃথিবী বহির্ভূত কোন দ্বীপের একক বাসিন্দা। কে কি বলছে, কি করছে সেদিকে খেয়াল নেই। এক মনে বসে সারাক্ষণ কি যেন ভাবছে।

বাইরে কোথাও যাওয়ার কথা বললেই শোভন কেবল রোদেলাকে দেখতে ক*ব*রস্থানে যেতে চায়। বার দুয়েক নিয়েও গিয়েছিল এ্যামী। কিন্তু সেখান থেকে এসে ও যেন আরো ভেঙে পরে। তাই এখন আর বাইরে যেতে সাধে না ও। ডাক্তার বলেছেন ট্রমা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে। তবে ওকে সবাই মিলে প্রচুর কোয়ালিটি টাইম দিন। আর ওর ভাবনাকে ডায়ভার্ট করুন।

এরি মাঝে এক শুক্রবারের দুপুরে এ্যামী খাবার টেবিলে ওর মাকে বলে- মা আমার আর থাকা সম্ভব না, তোমাদের পক্ষে একা ওকে দেখে রাখাও অসম্ভব। এভাবে চলতে থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে, কিছু একটা করার দরকার বলে আমার মনে হয়।

কল্লোলের বাবা বলেন-
: আমরা চেষ্টার তো কোন ত্রুটি রাখছি না।
: চাচা, আমি চিকিৎসার কথা বলছি না….
শোভনের বাবা বলে-
: তুমি কি বিদেশে নিয়ে যেতে চাচ্ছো…?
: না বাবা, আমি ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি….

এ কথা শুনে সবাই একসাথে এ্যামীর দিকে তাকায়,
এ্যামী সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে- ওকে সারাক্ষণ চোখেচোখে রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব না, ওর এখন এমন কাওকে দরকার যে ওর পাশে ছায়ার মতো থাকবে । এভাবে থাকলে ও সত্যি পাগল হয়ে যাবে….

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে এ্যামী আবার বলে-

: জানি ব্যাপারটা ততোটাও সহজ না, কিন্তু আমি আর ওকে এভাবে দেখতে পারছি না, ছয় ছয়টা মাস হয়ে গেলো। কোন পরিবর্তন নেই, সেদিন ডাক্তার বললে এই ট্রমার পিরিয়ড লম্বা হলে এখান থেকে বের করা কঠিন হয়ে যাবে। অনেক ভেবে এসব বললাম আমি, এটাই একমাত্র সমাধান যা আমাদের হাতে আছে,
বাকিটা তোমরা ভেবে দেখো-
কথাটা বলেই খাবারের প্লেট হাতে নিজের ঘরে চলে যায় ও।

টেবিলে থাকা সবাই-ই বুঝলো কথাটার গুরুত্ব, কিন্তু
এ পরিস্থিতিতে কারোই সাহস হলো না শোভনকে এসব ব্যাপারে বলার। তাছাড়া ওর জন্য এমন একটা মেয়ে দরকার যে ওর এই ট্রমা সম্পর্কে জানবে, এবং আন্তরিকতার সাথে ওকে এখান থেকে বের করে আনবে। কে এমন আছে যে সব জেনে দায়িত্ব নিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবণে ফিরিয়ে আনবে। বিয়ের পর স্বামী কিংবা স্ত্রীর কিছু হলে সেটা ঠিক করা তাদের দায়িত্ব থাকে, কিন্তু এমন কে আছে যে বিয়ের আগেই ওর দায়িত্ব নিয়ে ওকে স্বাভাবিক জীবণে ফিরিয়ে আনবে…….

ভালোবাসার মানুষ ছাড়া কার এত দায় এসবে জড়ানোর। মোটের উপর এটা একটা বিশাল রিস্ক।। বলতে গেলে জীবণ নিয়ে জু*য়া খেলা। কারন মেয়েটাকে শোভন কিভাবে নিবে তা কে জানে………

রাতে সবাই আবার এ ব্যাপারে বসলো। আগামী সপ্তাহে এ্যামীর চলে যেতে হবে ওর শ্বশুরবাড়ি সিলেটে। সেখান থেকে চাইলেই হুট করে আসা সম্ভব না। তার উপর এ্যামীর শ্বশুরও অসুস্থ। তাই সেখানে সিদ্ধান্ত হলো আপাততঃ একজন ফুলটাইম নার্স রাখা হবে শোভনের জন্য। এরপর সময় নিয়ে ওর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করতে হবে।

এখন এ্যামীর কোন ডিমান্ড নেই ভাইয়ের বৌর জন্য।
গরীব, ব্রোকেন ফ্যামেলি কিচ্ছু না…
ও শুধু খোদার কাছে এমন একটা মেয়েকে ভাইয়ের বৌ হিসেবে চায় যে ওর ভাইকে ভালোবেসে আগলে রাখবে, আর বের করে আনবে এই ঘোরে থাকা জীবণ থেকে…..

একেই হয়তো বলে ভাগ্যের পরিহাস….
এসব ভেবে সেদিন রাতে নামাজের বিছানায় অনেক কাঁদে এ্যামী। ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছ থেকে। আর মন ভরে দোয়া করে রোদেলার জন্য। ওকে যেন আল্লাহ ভালো রাখেন…
বেহেশত নসীব করেন…….

চলবে…

একদিন পর পর দেই গল্প,
আজ পর পর দিলাম…
কমেন্ট না করে কেও যাবা না….
previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=474430081388192&id=100064636124543
Next :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=476846427813224&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here