রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ৪৮

0
580

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৪৮

“কৃষ্ণচূড়ার” মানুষ গুলোর খরাপ সময় যেন পিছুই ছাড়ছে না, রোদেলা চলে যাবার পর নানীও চলে গেলেন ওর পরপরই….

ছোট মামা অনেক চেষ্টার পরও নোভেলকে বাগে আনতে না পেরে সাহায্য নিলেন তার প্রাক্তন স্ত্রী নোভার। অনেক কষ্টে তার নম্বর সংগ্রহ করে তাকে সব খুলে বললেন, স্বীকার করলেন তার করা ভুলের কথা। তার করা অন্যায়ের কথা। এবং খুব অনুরোধ করে বলেছিলেন ছেলেকে বুঝিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। যাতে বখে যাওয়া ছেলেকে শুধরাতে পারে, সামনের দিনগুলো উজ্জ্বল হয় ওর।

নোভাও সব মায়েদের মতো নিজেও তার ছেলের ভবিষ্যৎ ভালো হোক তাই চাইবেন। এ চাওয়া দোষের কিছু না। তিনি ছেলেকে তার কাছে ডেকে পাঠালেন এত বছর পরে প্রথমবারের মতো অসুস্থতার কথা বলে। নোভেল মায়ের অসুখের কথা শুনে দ্রুত গেলো ওর নানু বাড়ি যশোরে। সেখানে গিয়ে দেখলো ওর মা এখন সুস্থ। নানা-নানি এতদিনে পর ওকে পেয়ে রেখে দিলো কিছুদিন।

এ কয়টা দিন ওর মা তার সংসার জীবনের দুঃখ দূর্দশার গল্প শোনাচ্ছিলেন নোভেলকে। এত বছরে এ, দীর্ঘ ফুরসত কিংবা সুযোগ তার কখনো হয় নি।

দুঃখ করে বললেন- আজ তার কোথায় থাকার কথা ছিলো, আর তিনি কোথায় আছেন। ভাইদের সংসারে আশ্রীত হয়ে থাকার কষ্ট নোভেলকে ব্যাখ্যা করতে হলো না। ও যে তিনদিন ছিলো তাতেই তার বিগত জীবনের দুঃখ গাঁথা পড়া হয়ে গেছে নোভেলের। সবচেয়ে বেশী যা স্পর্শ করেছে ওকে তা হচ্ছে ওর মায়ের এত বছর অব্দি একা থাকা। অজপাড়াগাঁয়ে থেকে হাইস্কুলে মাস্টারি করেন তিনি। তারপর যেটুকু অবসর পান, সংসারের এই কাজ সেই কাজ করেন। তা না হলে এত বছর এখানে থাকা মুসকিল হতো। সবার মন জুগিয়ে চলা চারটি খনি কথা….!

নোভা অত্যান্ত রূপসী । তার বয়স এখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই হলেও চেহারার লাবন্য এখনো উবে যায় নি। হঠাৎ দেখায় কেও আঁচ করতে পারবে না তার বয়স।

ডিভোর্সের পর যে তাকে কেও গ্রহণ করতো না কিংবা গ্রহণ করতে চায় নি এ কথা বলা মুশকিল। কিন্তু তিনি পারেন নি নতুন করে শুরু করতে এমনকি চেষ্টা ও করেন নি। তার বাবা মা অনেক বুঝিয়েছিলেন বয়স থাকতে। কিন্তু এখন আর এসব নিয়ে কোন কিছু বললেন না।

জীবণটা তার বলতে গেলে বৃথাই গেলো। কত বছর স্বামীর ঘর করেছিলেন তিনি….? অংকের হিসেবে
চার বছর আট মাস তেরো দিনের দিন তিনি তার স্বামীর পাঠানো ডিভোর্স লেটার পান। যাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন
পাগলের মতো ভালোবেসে। যাকে পেতে তিনি তার বড় ভাইকে রেখেই বিয়ে করেছিলেন কিশোরী নোভাকে, যিনি মেট্রিকুলেশন পাস করে কলেজ ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

বন্ধুর বড় ভাইয়ের বিয়ে খেতে যশোর এসেছিলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানেই প্রথম দেখেছিলেন নোভাকে। পাগলপ্রায় হয়ে বড় ভাই-ভাবীকে কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ে এসেছিলেন যশোরে। সবাইকে বুঝিয়ে পরের মাসেই প্রবাসী বড় ভাইকে রেখে বিয়ে হয়েছিল তাদের। কত ভালোবাসা ছিলো ভাবা যায়…..!

এখানেই শেষ নয় ঢাকায় এনে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন নতুন বৌ কে । ইন্টারমিডিয়েট পাশ করিয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। যদিও অনার্স পাশের আগেই তাদের বিয়েটা ভেঙে যায় ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে।

নজর লেগেছিলো তাদের সম্পর্কে। তার তিন ননাশ এত বড় বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একজনেরও ভালো ঘরে বিয়ে হয় নি। সকলেরই মোটামুটি অবস্থা। খেয়েপড়ে দিন কাটে কোনরকমে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিলো নাসিমার। তারা জীবনে না পেয়েছে স্বামীর সুখ না টাকার….

তারা মোটের উপর সহ্য করতে পারতো না এসব ভালোবাসা, ভালোথাকা। আদিখ্যেতা মনে হতো এসব তাদের কাছে। উঠতে বসতে কথা শুনাতো বাবার বাড়ির কমজুড়ি নিয়ে। গরিব ঘরের মেয়ের এত কেন ঢং।

তারা বুঝতো না তার ভাই-ই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করতো বৌ কে। নোভার মুখ এনেছিলো তারাই। সহ্যের তো একটা সীমা আছে….

এত বছর পর তা ঠিক ধরতে পেরেছিলো রোদেলা। তাই তো আলাদা হয়ে যেতে চেয়েছিলো বেঁচে থাকতে। কিন্তু নোভার যখন সংসার ভাঙলো রোদেলা তখন ছোট্ট একটা মেয়ে। তার কি সাধ্য তিন খালার সাথে যুদ্ধ করে। নোভেলকে ওর ফুফুরা যা বুঝাতো ও অন্ধের মতো তাই বুঝেছিলো। এত বছর ধরে ও শুনে আসছে ওর মায়ের সম্পর্কে নানান বাজে কথা। যা একটা সময় ওকে বাধ্য করে ওর মাকে ঘৃণা করতে। কিন্তু এখানে এসে দেখে চিত্র পুরো উল্টো।

নোভার যে এত কষ্ট তার জন্য কে দায়ী……
নোভেলের বাবা….?
ওর বাবা যত না দায়ী তার চেয়ে বেশী দায় নাসীমার।
তিনিই নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছেন সংসারটাকে। তিন বছরের ছেলে রেখে চলে এসেছিলো নোভা । ভেবেছিলো মা ন্যাওটা ছেলে পালতে যখন হিমসিম খাবে তখন ওকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। আর তিনি তো আলাদা বাসা না নিলে যাবেই না, তা তো বলেই এসেছেন আসার সময়।

কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিলো পুরো উল্টো। নাসিমা নিজের ছোট্ট মেয়ে প্রিসিলাকে রেখে আগলে ধরেছিলেন নোভেলকে। কারন ওর মা ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিলো যে সব দোষ গিয়ে পরেছিলো নোভার ঘাঁড়ে। কেমন মা এটুকু ছেলেকে ফেলে চলে গেলো। আরো কত কত কথা….

সময় গড়াতে গড়াতে দিন পেরিয়ে হয় সপ্তাহ…
নোভার অপেক্ষা স্বামী নিতে আসবে…
সপ্তাহ গড়ায় মাসে…
তখন দুজনেরই অহং এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে কেওই তা ভেঙে সমনে এগুতে পারে না।

অথচ নোভার নিজের সংসার বাঁচাতে নেয়া সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিলো তা-ই কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হলো। তার স্বামী অবশেষে বাধ্য হলেন আলাদা বাসা নিতে, এমনকি দেশও আলাদা হয়ে গেলো। মধ্যি খানে নোভা…..
নোভা হলো বলির পাঠা ……

নোভা যখন মানুষের কাছ থেকে শুনেছিলো তার স্বামী আবার বিয়ে করেছে। বিশ্বাস ই করেন নি তিনি। ভেবেছিলেন তাকে কষ্ট দিতে এসব গুজব ছড়াচ্ছে ঐ পরিবার….

কিন্তু নোভেলের মেঝো ফুফুর বাড়িতে একদিন গিয়ে যখন শুনলেন সত্যিই তার স্বামী নতুন বৌ নিয়ে ঘর করছে…
তখন কিন্তু তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। এরপর আর কোন যোগাযোগ রাখেন নি তিনি। দাবী ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বামী আর সংসারের প্রতি। কাগজপত্রের হিসেবে নোভেলের বাবা-মায়ের ডিভোর্স এখনো হয় নি। কারন নোভা সেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে নি।

প্রথম প্রথম ছেলেটাকেও দেখতে দিতো না নাসিমা। ওর ভালোর জন্য নাকি ওর থেকে নোভার দূরে থাকা জরুরী। এসব শোনার পরও লুকিয়ে নোভেলের স্কুলে গিয়ে দেখা করে আসতো। বাবার বাড়ি যশোর হওয়ায় ঘন ঘন দেখাও হতো না মা-ছেলের….

তারপর………
জীবন বয়ে গেছে সেকেন্ড , মিনিট, ঘন্টার হিসেবে। সেসব আবার গড়িয়েছে বছরে….
কিন্তু নোভা একাই রয়ে গেছে স্বামীর ঐ চার বছরকার ভালোবাসা বুকে আগলে রেখে। ছেলেকে দেখাও বাদ দিয়েছে একটা সময়, নাসিমা একদিন অপমান করে বলেছিলো-
ওর ভালো চাইলে কেও যেন ওকে দেখতে না আসে….
তিনি তাই মেনে নিয়েছিলেন।

সেদিন বিকেলে নোভেলকে তিনি বলেন-
এখন আমি ম*রেও শান্তি পাবো নোভেল, তোমার বাবা তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। বাকীটা তোমার ভালো ভবিষ্যৎ এর চিন্তা। তুমি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাও। যাকে আঁকড়ে ধরে এখানে পরে আছো, একটু ভেবে দেখো সেই কিন্তু আমাদের দূরে থাকার কারন….

সেখান থেকে ফিরে নোভেল একমাসের মধ্যে চলে যায় ইংল্যান্ড, মিথ্যা মায়া ছিড়ে, সব ছেড়ে ওর বাবার কাছে।

এরপর যেন নাসিমার টনক নড়ে, যতটা না রোদেলা নড়াতে পেরেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশী। নোভেলের যাওয়া টা সুস্থ স্বাভাবিক ছিলো না। বিশ্রীরকম ঝগড়া হয় ফুফু আর ভাতিজার মধ্যে। অনেক কথা বলে নোভেল-
যার প্রতিটি কথাই ছিলো যৌক্তিক…..

নাসিমা এখন একা….
তিনি নোভেলকে আঁকড়ে ধরে তার মেয়েদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, দিনের পর দিন অবহেলা করে গিয়েছেন, মায়া ভালোবাসা ও ওরা কোনদিন পাননি তার কাছ থেকে, কারন তিনি ভাবতেন ওরা দুই-বোনেই তার এই দূর্দশার কারন। এই অবহেলা, ভালোবাসাহীন সম্পর্ক একটু একটু করে রোদেলাকে নিশ্চিত মৃ*ত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে । আজ তিনি শোকে পাথর…
কারন যাকে আঁকড়ে তিনি তার পৃথিবী গড়েছিলেন, সে তার কক্ষপথ বদলে ফেলেছে। তিনি এখন নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ….
দুনিয়া বড়ই নির্মম জায়গা….

এমন নাসিমারা ভালোবাসা না পায়, না কাওকে দেয়…
সন্তানেরা হয়তো মা বলে একটা সময় মেনে নেয় সব, ভয়ে, লজ্জায়, পরিস্থিতির শিকার হয়ে। কিন্তু মন থেকে আসা অকৃত্রিম ভালোবাসা হয়তো তারা কখনো পান না…
না নিজের লোকেদের কাছ থেকে না তাদের কাছ থেকে যাদের আঁকড়ে ধরে আপনদের দূরে রেখে দেয় অবহেলায়।

নোভেল তার হিসেব বুঝে নিলো, তার হিসেবটাও বুঝিয়ে দিলো, কিন্তু নাসিমা….
তার হিসেব কে মিলাবে এখন….

previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=475325531298647&id=100064636124543
Next:
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=477649454399588&id=100064636124543

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here