জলফড়িং #রোজা_ইসলাম #পার্ট ১৪

0
422

#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১৪

সূর্যের উত্তাপে ধরণী মিইয়ে গেছে! দগদগে সূর্যের উত্তাপ, ভ্যাপসা গরমে বাসাতের ছিটেফোঁটা নেই। ক্ষণে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে তাতে ভ্যাপসা গরম দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে সব মিলিয়ে বিক্ষিপ্ত, বিক্ষুব্ধ মেজাজে আছে আদি।
একটা সাপ্তাহ চলে গিয়েছে না গুরুজনেরা আওয়াজ তুলেছে, না ইরা নিজের মুখ খুলে পরিস্থিতি সংযত করার চেষ্টা করেছে। বিষয়টা কোনও দিকে মোড় নিচ্ছে আদি বুঝতে অক্ষম! অথচ প্রহর আয়েত্তে নেই, দেখতে দেখতে কয়েকটি দিন-রাত্রি পেড়িয়ে গেছে। আদি সমস্ত চেষ্টা করেও রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও সক্ষম হতে পারেনি। ইরা’কে ফোন দিলে আদি যখন ফোন রিসিভ করে কথা বলতে উদ্যত হয়েছে, তার আগেই রাহুল আদির কণ্ঠে শুনে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নিজের ব্যাক্তিত্ব, খোলশ শান্ত রাখতে পারেনি আদি ভাই-বোনের নিরব অবজ্ঞার পাত্র সে, বিষয়টি ঠাওর হতে-ই। ক্ষুণ্ণ মেজাজে এ-কদিন শুধু রাগান্বিত আচরণ করেছে ইরার সঙ্গে। রুম বন্দী, সবার নজর বন্দী, সবার চোখে দোষী ইরা সব নিরবে সহ্য করে গিয়েছে। নিস্তব্ধ কক্ষে নিরবে শুধু কেঁদে কেঁদে চক্ষু ফুলিয়েছে। দ্বিধান্বিত ইরা’র অস্থির লোচনে কিসের যেন নিরব, নিস্তব্ধ আকুতি। নিরব মায়া ভরাট চক্ষে ভেসে তার ব্যাকুলতা। যেন দ্রুত-ই সব ঠিক হয়ে যায়!
____________

আজ ইরা’র বাসার সবাই বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছে। যেতে বাধ্য হয়েছে, কারোই মনমানসিকতা ছিলো না এ-ই সময় দাওয়াতে যাওয়ার কিন্তু পরিস্থিতি অনেক সময় কূলে থাকে না। অনিচ্ছুক শর্তেও অনেক কিছু করতে হয়! সেটাই হয়েছে ইরা’র পরিবার বর্গের সঙ্গে।

তবে শুধু যায়নি ইরা, আদি। ইরা’কে আসলে কেউ নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করেনি। সবার ভাবভঙ্গি অবলোকন করার পর ইরা বাসায় একা থাকবে ভেবেই আদি নিজেও যায়নি।

বাসায় কেউ নেই বলে আদি আজ অফিসেও যায়নি ইরা’র জন্যে! ইদানীং আদি ঠিকঠাক অফিসেও যায় না। বাসায় থাকছে সে সর্বদা। ওর ধীর বিশ্বাস ইরা পালিয়ে যেতে পারে রাদের সঙ্গে! তন্মধ্যে আজ বাসায় কেউ নেই অফিস যাওয়ার যেন প্রশ্ন-ই আসেনা!

ইরা সে-ই রাতের পর রাদের দেওয়া ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিলো। রাদের সঙ্গে ঐ রাত থেকেই যোগাযোগ বন্ধ। তীব্র ভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো ইরা। আদি ধমকে ধমকে ও’কে অনেক শাসিয়ে রেখেছে। ভীত, আহত হৃদয়, শঙ্কিত মনে ভয় জেঁকে গিয়েছিলো যদি আদি ফোনটা কোনও ভাবে পেয়ে যায়, তো রক্ষা পাওয়া মুশকিল! আদি কী করে ফেলে কে জানে? ফলস্বরূপ আর ফোন অন করা হয়নি। আজ বাসায় কেউ নেই সে-ই ভিত্তিতে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়েছে অভ্যন্তরে। লুকিয়ে রাখা প্রাণপুরুষের ফোনটা বের করে পরিচিত নম্বরে কল লাগালো বহু কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির নিকট! কয়েক বার লাগাতার রিং বেজে কল কেঁটে গেলো! ইরা তৎপর চক্ষে চেয়ে ঘড়িতে নজর বুলালো। পাক্কা চারটা বাজে ঘড়িতে। তন্মধ্যে ওর ছোট্ট মুঠোয় ফোনটা বাইব্রেট করে উঠে। কালবিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করে কানে রাখে ফোন। অতঃপর ব্যাস্ত গলায় বলে উঠে,

—” রাদ? কেমন আছো? ”

ওপাশ থেকে পরিচিত কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠের বদলে একটি ভিন্ন নিরুদ্বেগ কণ্ঠ ভেসে এলো!

—” রাদ একটু অসুস্থ ইরা। আমি কাশিশ বলছি!”

ইরা’র ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা যেন কেউ খামচে ধরে। স্বাভাবিক হৃদযন্ত্রের বিদ্যুতটি অস্বাভাবিক আচরণে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক মুহূর্তে। অর্থাৎ নাক ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেলে ও৷ কিয়ৎক্ষণ চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ ইরা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ক্রন্দনরত মলিন গলায় ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে,

—” রাদ অনেক কষ্ট পেয়েছে তা-ই না ভাইয়া! আমি সেদিন একটু কথা বলতে পারিনি। আমার জন্যে সব হয়েছে কিন্তু আমি কী করবো? কাউ’কে বেঁছে নিতে পারবো না আমি ভাইয়া, আমার সবাই’কে চাই। আমি না রাদ’কে কষ্ট দিতে চাই না পরিবারকে। আমি কী করবো?”

কাশিশের ভীষণ মায়া হলো ইরা’র জন্য ইরা’র কণ্ঠ ভীষণ মলিন, অথচ সমুদ্র গভীর মায়ায় ভরপুর। তবে কণ্ঠে স্পষ্ট মেয়েটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালো নেই। কাশিশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—” ইরা, কেঁদো না ছোট আপু! রাদের একটু জ্বর এসেছে মাত্র তেমন কিছুই হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে ডোন্ট ক্রাই।”

ইরা মাথা দুলিয়ে বিরতিহীন অশ্রুবিসর্জন দিয়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা গলায় অনুরক্তি সুরে বলল,

—” কিচ্ছু ঠিক হবে না ভাইয়া৷ আদি ভাইয়া..!”

বাক্যটি সম্পূর্ণ করেনি ইরা। চক্ষু মুছে নিজেকে ধাতস্থ করে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে আওড়ায়,

—” ভাইয়া, আমি কী একটু ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবো?”

কাশিশ ভ্রুঁদ্বয় কুঞ্চিত করে! ঠোঁট চেপে আগ্রহী গলায় বলল,

—” আদি ভাইয়া কী ইরা বলো? সব ঠিক আছে? আদি কী তোমাকে মেরেছে?”

ইরা তৎক্ষনাৎ মলিন গলায় দ্বিরুক্তি করে বলল,

—” না, না ভাইয়া! তেমন কিছুই না। একটু রাদ’কে দিন না ভাইয়া প্লিজ?”

কাশিশ একটু পাশ ফিরে রাদের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করলো। বিধ্বস্ত, বেসামাল রাদ প্রকট জ্বরে বেশকিছু রাত্রি নির্ঘুম কাঁটিয়েছে। তন্মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার প্রখর জ্বর নিয়েও শুধু বারবার ফোনে চক্ষু বুলিয়েছে ছেলেটা এই বুঝি ইরা কল দিলো বলে। সে কী তার অস্থিরতা, নিপিড়ন ব্যাকুলতা! কিছু অব্যক্ত কষ্ট, অনুভূতি যা না সহ্য করতে পারে সে, না কাউকে বলতে। চাপা কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন স্থবির রাদের। সব মিলিয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! ফলস্বরূপ অফিস থেকেও ছুটি নিতে হয়েছে। আজ কিয়ৎক্ষন পূর্বেই দুপুরে একটু খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। রাদের মলিন মুখশ্রীতে চেয়ে ডাকতে ইচ্ছে করছে না কাশিশের। আবার ইরা ফোন দিয়েছে কাশিশ রাদ’কে তুলে দেয়নি জানলেও রাদ ওকে মেরেও ফেলতে পারে ভেবেই তৎক্ষনাৎ নরম গলায় বলল,

—” ওয়েট, আমি ডাকছি ওকে!”

অতঃপর কাশিশ ডাকতে লাগলো রাদ’কে। দু’বার নাম ধরে মৃদুস্বরে ডাকতেই উঠে ঝট করে রীতিমতো বসে গেলো রাদ। অসুস্থ ক্ষীণ, মোলায়েম গলায় বলল,

—” কিছু বলবি!”

কাশিশ ফোন বাড়িয়ে দিলো রাদের সম্মুখে। ফোনের দিকে ইশারা করে বলল,

—” ইরা কল দিয়েছে!”

রাদ সপ্রতিভ হয়। কয়েক মুহূর্ত স্থির চেয়ে অবিচল ভঙ্গিতে বলিষ্ঠ পরিপক্ব হাতের মুষ্ঠিতে ফোন তুলে কানে রাখতেই ভেসে এলো সেই পরিচিত মিষ্টি মায়াময়, মোলায়েম কণ্ঠস্বর,

—” হ্যালো, রাদ..?”

নিস্তব্ধ রাদ, গাঢ় চক্ষে কাশিশের দিক তাকালো। কাশিশ বন্ধুর নিরব ভাষা বুঝলো। অর্থাৎ নরম পায়ে বেরিয়ে গেলো কক্ষ হতে!

—” রাদ, প্লিজ কথা বলো। আমি ভয়ে ফোন লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম!”

রাদ অবিচল ভঙ্গিতে নিরুদ্বেগ গলায় বলল,

—” বুঝেছি,”

এহেন সংকীর্ণ প্রত্যুত্তরে স্পষ্ট রাদ ঠিক নেই। গলার স্বরে গুরুগম্ভীর ভাবভঙ্গী! ইরা অশ্রুসিক্ত চক্ষু জোড়া পিটপিটিয়ে। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিকওদিক চক্ষু ঘুরায়। পরপর কণ্ঠ স্বর নিচু করে নরম, কোমল গলায় বলল,

—” রেগে আছো? আমি আদি ভাইয়ার ভয়ে..! ”

ইরা পুনর্বার ফুঁপিয়ে উঠলো। কান্নার তোড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে মেয়েটা। রাদ গম্ভীরমুখে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অবিচল ভঙ্গিতে! ওর শ্বাসনালী হতে ছোট ছোট গরম শ্বাস নির্গত হচ্ছে এবং ও মনোযোগ দিয়ে ওর ইরানীর কান্না শুনছে৷ রাদের অসুস্থ অস্বাভাবিক চক্ষুদ্বয় দ্বিগুণ রক্তিম হ’য়ে উঠছে। কিন্তু কিছু বলতে যেন সে ইচ্ছুক অথবা প্রস্তুত নয়! ইরা এবার অধৈর্য্যে সঙ্গে চাপা গলায় চিৎকার করে বলল,

—” প্লিজ, রাদ কথা বলো। আমার কষ্ট হচ্ছে। আই এম স্যরি বাবা। ”

আকস্মিক রাদ গাঢ় গলায় বলল,

—” স্যরি, কেন বলছেন আপনি? ”

হতবিহ্বল, স্তব্ধ হয়ে গেলো ইরা রাদের মুখে আপনি সম্মোধন শুনে। ওর কান্নায় ভাটা পড়েছে। নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে অজান্তে! রাদ পুনরায় গম্ভীর আওয়াজে বলল,

—” কেন স্যরি বলছেন?”

ইরা অপ্রতিভ হ’য়ে পড়ে। বিচলিত ভঙ্গিতে অনুযোগের সুরে বলে,

—” আদি ভাইয়া আমাকে প্রেশার দিচ্ছিলো রাদ। বার বার রুমে আসতো। আমি ভয়ে ফোন বের করতে পারিনি। প্লিজ একটু বুঝো!”

—” বুঝেছি। তো বলুন কেমন আছেন আপনি? ”

ইরা’র ধৈর্য বাধভাঙ্গলো। দুশ্চিন্তা, হতাশা, তিরস্কারে আচমকা রেগে গেলো! রাগান্বিত গলায় ঝট করে বলল,

—” তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না রাদ। আমি কোথায় যাবো তাহলে? কেন বুঝতে পারছো না আমাকে?”

রাদ বিস্মিয়কর এক কাণ্ড ঘটালো। অতর্কিতভাবে আকস্মিক ফোন কেঁটে দিলো। ইরা হতভম্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিয়ৎক্ষন স্তব্ধতায় কেঁটে গেলো প্রহর। অথচ রাদের ফিরতি ফোন এলো না। আচানক সম্বিৎ ফিরে পেলো যেন ইরা! অতঃপর নিজেই ব্যাস্তভঙ্গিতে বারবার কল লাগালো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। অথচ ফোন বন্ধ! ইরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

আদি ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলো, মূলত্য ইরা’কে পাহারা দিচ্ছিলো৷ ইরা’র সশব্দে রোদন কানে পৌঁছাতেই ছুটে এলো ওর রুমে। ইরা নিজের রুম লক করতে পারেনা। সেই সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আদি ওর রুম বাহিরে দিয়ে লক করে রাখে৷ ফলস্বরূপ আদির অতর্কিত আগমনে ইরা হাতের ফোন লুকাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে! এটা ও আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলো৷

আদি ইরা’র দিক পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ! ইরা কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে অথচ চক্ষুদ্বয় জলে টইটম্বুর। মুখশ্রী রক্তিম। বুঝাই যাচ্ছে ও ভীষণ কেঁদেছে। ওর সম্মুখে এসে আদি ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

—” কাঁদছো কেন? ”

ইরা থতমত চেহারা নিয়ে উঠে বসলো। নতমস্তকে বলল,

—” এমনই! ”

এহেন দায়সারা জবাব যেন কাম্য নয়। আদি রেগে গেলো। রাগান্বিত গলায় চেঁচিয়ে বলল,

—” আমি জিজ্ঞেস করেছি কাঁদছিস কেন?”

ইরা’র সহ্য হলো না আর আদি’র বারাবাড়ি! ঝট করে কিঞ্চিৎ আওয়াজ করে বলল,

—” মন চাইছে তা-ই কেঁদেছি! তুমি জিজ্ঞেস করা কে?”

আদি’র কী হলো ইরা’র গালে আঘাত করে বসলো। অতর্কিত আক্রমণে ইরা হতভম্ব একইসাথে ব্যাথিত। থাপ্পড়’টা এতটা জোরে ছিলো ইরা’র শ্যাম, রক্তিম মুখশ্রীতেও আঙুলের ছাপ পড়ে গেলো। ইরা গালে হাত রেখে পূর্বের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো! ইরা’কে এভাবে কাঁদতে দেখে আদির যেন হুঁশ এলো। অর্থাৎ নিজেকে নিজে বি’শ্রী ভাষায় গা’লি দিতে ভুললো না৷ ও যত বেশী ইরা’র সাথে নরম ব্যাবহার করবে ভাবছে। আসলে ততই রেগে যাচ্ছে। আচরণ করছে কঠোর! ওর সকল প্রচেষ্টা ব্যার্থ হচ্ছে। কেন যেন ভয়ে বক্ষজুড়ে কম্পন সৃষ্টি হলো ইরা’কে আঘাত করে। আদি দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেললো মস্তিষ্ক হতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো সাবধানে! অতঃপর নরম ভঙ্গিতে বসলো ইরা’র পাশে৷ ভীতসন্ত্রস্ত ইরা তৎক্ষনাৎ দূরে যাওয়ার প্রয়াস করতেই, আকস্মিক আদি ওর বাহু চেপে টেনে নিজের বক্ষে ফেলে ইরা’র ছোট্ট দেহখানি! ইরা অস্বস্তিতে ছোটাছুটি শুরু করে তৎক্ষনাৎ। দ্বিগুণ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে বলল,

—” কী করছো তুমি? ছাড়ো আমাকে, ভাইয়া ছেড়ে দাও আমাকে। আম্মু!”

ইরা’র এহেন চিৎকারে আদি কিছু না ভেবেই তৎক্ষনাৎ চাপা গলায় বলল,

—” হুঁশ, চুপ একদম চুপ! বায়ায় কিন্তু কেউ নেই ভুলে যাস না!”

ইরা দ্বিগুণ ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করলো। আদি ততই শক্ত করে ওকে জড়িয়ে নিচ্ছে নিজের সঙ্গে নির্বিঘ্নে। ইরা আবারও ভাঙ্গা গলায় চেঁচালো,

—” ছাড়ো। অসভ্য ছেলে। তুমি ভুল করছো ভাইয়া। আমি এর জন্যেই তোমাকে শুধু মাত্র ঘৃণা করি। জোড় করে কিছু হয়না এটা তুমি বুঝো না কেন!”

অসহায় ইরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে! ছোট্ট শরীর’টা গলা কাঁটা মুরগির মতো ধাপাচ্ছে। কিন্তু আদির পুরুষালী শক্তি’র কাছে ওর সকল শক্তি যেন নগন্য। আদি নিজেও কী চাইছে ঠাওর করতে অক্ষম। ক্ষণে এলোমেলো হাতে ইরা’র চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ক্ষণে ইরা’কে চেপে ধরছে নিজের সঙ্গে। যেন ছেড়ে দিলেই ইরা হারিয়ে যাবে।

আদি’র এহেন স্পর্শে পাগলামিতে ইরা’র সমস্ত কায়া ভয়ে থরথর কাঁপতে লাগলো। বিষাক্ত লাগলো আদি’র নিশ্বাস গুলো। শেষ চেষ্টা সরূপ আদির বুকে গায়ের সমস্ত জোড়ে ধাক্কা দিতেই। আদি ইরা’র কপালে শক্ত চুমু খেয়ে বসলো! ইরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো তাতে! আদি ক্ষীণ আওয়াজে ইরা’র কানে কিছু বলতে উদ্যত হয়েছিলো। তার আগেই রাশভারী গলায় কেউ চিৎকার করে উঠলো,

—” আদি, ছাড় ওকে!”

আকস্মিক আদি হকচকিয়ে থমকে গেলো। ইরা দরজায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রাণ ফিরে পেলেও। আদি তৎক্ষনাৎ ইরা’কে ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হলো। মুহূর্তে কপালে চিকন ঘামের সৃষ্টি হ’য়েছে ওর। দরজায় আজমল খাঁন দাঁড়িয়ে! আদি আজ বাবা-র চক্ষে, চক্ষুদ্বয় রেখে একত্র করতে অক্ষম! আজমল খাঁন নিজেকে সংবরণ করতে চেষ্টা করলো তবে উনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তেড়ে এগিয়ে এসে তৎক্ষনাৎ আদি’র গালে পরপর দুটো আঘাত করলেন গায়ের জোড়ে। ইরা এহেন পরিস্থিতিতে ভয়ে বেডে বসে থাকা অবস্থাতেই পাঞ্জাবির কোণা টেনে বড় বাবা’কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ওর কম্পিত শরীর তখনও ভীত। ততক্ষণে সবাই একে একে ওর রুমে চলে এসেছে। কিয়ৎক্ষন নিরব, নিস্তব্ধে টইটম্বুর কক্ষে হতে আদি ইরা’র দিকে একবার নিষ্প্রভ চক্ষে তাকিয়ে। রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাকি সবাই আজমল খাঁনের ইশারায় আদি’র পিছু পিছু রুম ত্যাগ করলো। রয়ে গেলো শুধু ইরা’র বাবা। আজমল দীর্ঘশ্বাস টেনে ইরা’র পাশে বসলেন। মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলালেন। উনার চক্ষে বিঁধে রইলো ইরা’র গালে জ্বল জ্বল করতে থাকা আদি’র আঙুলের স্পষ্ট ছাপ! পুনর্বার বেশ সময় নিয়ে ব্যথিত শ্বাস ফেলে গম্ভীরমুখে নরম গলায় শুধালেন,

—” আমি তোমার আচরণে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম মা। রেগেও ছিলাম। তবে যা করার করে ফেলেছো, আমি সব বুঝি। তোমাকে যেমন সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করতে পারিনি। তেমনই ছেলের নির্বোধ অন্যায় ও মেনে নিবো না আমি৷ তোমাকে একটা স্পষ্ট কথা বলি। কালকে পর্যন্ত আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম আদির সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। ঘরের ছেলের উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু আজকে পর.. যাইহোক আমি তোমাকে বেষ্ট কিছু দিতে চাই ইরা। আজ আমি বলছি যদি তোমার পছন্দ করা ছেলে আমার চোখে বেষ্ট হয়। তবে আমি তোমার বিয়ে তোমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই দিবো। তোমাকে কষ্ট পেতে হবে না। শুধু বাবা’র উপর বিশ্বাস রেখো, আমাদের সিদ্ধান্ত’কে সম্মান করো। ঠিক আছে?”

ইরা হেঁচকি তুলে কাঁদছিলো। কম্পিত মস্তকে সেভাবেই মাথা দুলিয়ে বাবা-র সিদ্ধান্তে সায় জানালো। নিরব, নিস্তব্ধ থাকা আজিম খান এবার মুখ খুললেন! আচানক গম্ভীর আওয়াজে বললেন,

—” কিন্ত.. ভাই!”

আজমল খাঁন সাহসা উচ্চস্বরে বললেন,

—” চুপ কর, ছেলে ভালো হলে আমাদের বাঁধা দেওয়ার কারণ দেখছি না। ঘরের ছেলের উপর বিশ্বাসে আজ ঘাটতি চলে এসেছে আমার। তাছাড়া পাত্র দেখতে সমস্যা দেখছি না আমি! দেখলেই তো আর বিয়ে হবে যাবে না?”

আজিম কিঞ্চিৎ শব্দ আর ব্যায় করলেন না। ইরা’র রক্তিম গালে চাঁর আঙুলের ছাপ উনার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রকাশ না করলেও একটা মাত্র মেয়ে উনার কলিজার টুকরা। বড় ভাই আদরে রাখেন বলেই উনি যথেষ্ট শাসনে করেন! যেন আহ্লাদ বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়! তা-ই ব’লে বাড়ির ছেলে এভাবে মেয়ের গায়ে হাত দিবে উনি মেনে নিবেন না! তবে ইরা’র পছন্দের ছেলের সঙ্গে ইরা’র বিয়ে এটাও উনি মেনে নিতে পারছেন না। ঘরের ছেলের উপরেই আর বিশ্বাস নেই সেখানে বাহিরের একটা অপরিচিত ছেলে কেমন হবে উনার ধারণা হয়ে গেছে!

চলবে!

[এটুকু লিখতে কী পরিমাণ যে কষ্ট হয়েছে। কোনও দিন গল্প লিখতে এতটা কষ্ট করা লাগেনি। কাল সারাদিন লিখিছি। এক লাইন লিখি পাঁচ লাইন কাটি। রাতেও লিখি ভাবি আবার ঘুম পায়। মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো আমার এসব করতে করতে। ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে গেছি। সকালে উঠেই আবার লিখতে বসেছি। এখন দুপুর ১ঃ২৯ বাজে। আমার লিখা শেষ হয়েছে। কিন্তু মন মতো হয়নি। এই পর্বটা আমি অতীতের জন্য বরাদ্দকৃত রেখেছিলাম, হলো কই। কেমন যেন বাক্য, ছন্দ সাজাতেই পারছিলাম না। তাই কালকে গল্প দিব বলেও দিতে পারিনি। তার জন্য দুঃখিত! আজকের পর্বটা এক কথায় জোর করে লিখা জোড় করে আর যাই হোক লিখালিখি হয়না। তাই ভালো হয়নি হয়তো ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিবেন🥀]#জলফড়িং
#রোজা_ইসলাম
#পার্ট ১৪

সূর্যের উত্তাপে ধরণী মিইয়ে গেছে! দগদগে সূর্যের উত্তাপ, ভ্যাপসা গরমে বাসাতের ছিটেফোঁটা নেই। ক্ষণে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে তাতে ভ্যাপসা গরম দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে সব মিলিয়ে বিক্ষিপ্ত, বিক্ষুব্ধ মেজাজে আছে আদি।
একটা সাপ্তাহ চলে গিয়েছে না গুরুজনেরা আওয়াজ তুলেছে, না ইরা নিজের মুখ খুলে পরিস্থিতি সংযত করার চেষ্টা করেছে। বিষয়টা কোনও দিকে মোড় নিচ্ছে আদি বুঝতে অক্ষম! অথচ প্রহর আয়েত্তে নেই, দেখতে দেখতে কয়েকটি দিন-রাত্রি পেড়িয়ে গেছে। আদি সমস্ত চেষ্টা করেও রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও সক্ষম হতে পারেনি। ইরা’কে ফোন দিলে আদি যখন ফোন রিসিভ করে কথা বলতে উদ্যত হয়েছে, তার আগেই রাহুল আদির কণ্ঠে শুনে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নিজের ব্যাক্তিত্ব, খোলশ শান্ত রাখতে পারেনি আদি ভাই-বোনের নিরব অবজ্ঞার পাত্র সে, বিষয়টি ঠাওর হতে-ই। ক্ষুণ্ণ মেজাজে এ-কদিন শুধু রাগান্বিত আচরণ করেছে ইরার সঙ্গে। রুম বন্দী, সবার নজর বন্দী, সবার চোখে দোষী ইরা সব নিরবে সহ্য করে গিয়েছে। নিস্তব্ধ কক্ষে নিরবে শুধু কেঁদে কেঁদে চক্ষু ফুলিয়েছে। দ্বিধান্বিত ইরা’র অস্থির লোচনে কিসের যেন নিরব, নিস্তব্ধ আকুতি। নিরব মায়া ভরাট চক্ষে ভেসে তার ব্যাকুলতা। যেন দ্রুত-ই সব ঠিক হয়ে যায়!
____________

আজ ইরা’র বাসার সবাই বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছে। যেতে বাধ্য হয়েছে, কারোই মনমানসিকতা ছিলো না এ-ই সময় দাওয়াতে যাওয়ার কিন্তু পরিস্থিতি অনেক সময় কূলে থাকে না। অনিচ্ছুক শর্তেও অনেক কিছু করতে হয়! সেটাই হয়েছে ইরা’র পরিবার বর্গের সঙ্গে।

তবে শুধু যায়নি ইরা, আদি। ইরা’কে আসলে কেউ নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করেনি। সবার ভাবভঙ্গি অবলোকন করার পর ইরা বাসায় একা থাকবে ভেবেই আদি নিজেও যায়নি।

বাসায় কেউ নেই বলে আদি আজ অফিসেও যায়নি ইরা’র জন্যে! ইদানীং আদি ঠিকঠাক অফিসেও যায় না। বাসায় থাকছে সে সর্বদা। ওর ধীর বিশ্বাস ইরা পালিয়ে যেতে পারে রাদের সঙ্গে! তন্মধ্যে আজ বাসায় কেউ নেই অফিস যাওয়ার যেন প্রশ্ন-ই আসেনা!

ইরা সে-ই রাতের পর রাদের দেওয়া ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিলো। রাদের সঙ্গে ঐ রাত থেকেই যোগাযোগ বন্ধ। তীব্র ভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো ইরা। আদি ধমকে ধমকে ও’কে অনেক শাসিয়ে রেখেছে। ভীত, আহত হৃদয়, শঙ্কিত মনে ভয় জেঁকে গিয়েছিলো যদি আদি ফোনটা কোনও ভাবে পেয়ে যায়, তো রক্ষা পাওয়া মুশকিল! আদি কী করে ফেলে কে জানে? ফলস্বরূপ আর ফোন অন করা হয়নি। আজ বাসায় কেউ নেই সে-ই ভিত্তিতে কিঞ্চিৎ সাহস জুগিয়েছে অভ্যন্তরে। লুকিয়ে রাখা প্রাণপুরুষের ফোনটা বের করে পরিচিত নম্বরে কল লাগালো বহু কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির নিকট! কয়েক বার লাগাতার রিং বেজে কল কেঁটে গেলো! ইরা তৎপর চক্ষে চেয়ে ঘড়িতে নজর বুলালো। পাক্কা চারটা বাজে ঘড়িতে। তন্মধ্যে ওর ছোট্ট মুঠোয় ফোনটা বাইব্রেট করে উঠে। কালবিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ কল রিসিভ করে কানে রাখে ফোন। অতঃপর ব্যাস্ত গলায় বলে উঠে,

—” রাদ? কেমন আছো? ”

ওপাশ থেকে পরিচিত কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠের বদলে একটি ভিন্ন নিরুদ্বেগ কণ্ঠ ভেসে এলো!

—” রাদ একটু অসুস্থ ইরা। আমি কাশিশ বলছি!”

ইরা’র ছোট্ট হৃদপিণ্ডটা যেন কেউ খামচে ধরে। স্বাভাবিক হৃদযন্ত্রের বিদ্যুতটি অস্বাভাবিক আচরণে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক মুহূর্তে। অর্থাৎ নাক ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেলে ও৷ কিয়ৎক্ষণ চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ ইরা শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ক্রন্দনরত মলিন গলায় ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে,

—” রাদ অনেক কষ্ট পেয়েছে তা-ই না ভাইয়া! আমি সেদিন একটু কথা বলতে পারিনি। আমার জন্যে সব হয়েছে কিন্তু আমি কী করবো? কাউ’কে বেঁছে নিতে পারবো না আমি ভাইয়া, আমার সবাই’কে চাই। আমি না রাদ’কে কষ্ট দিতে চাই না পরিবারকে। আমি কী করবো?”

কাশিশের ভীষণ মায়া হলো ইরা’র জন্য ইরা’র কণ্ঠ ভীষণ মলিন, অথচ সমুদ্র গভীর মায়ায় ভরপুর। তবে কণ্ঠে স্পষ্ট মেয়েটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালো নেই। কাশিশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—” ইরা, কেঁদো না ছোট আপু! রাদের একটু জ্বর এসেছে মাত্র তেমন কিছুই হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে ডোন্ট ক্রাই।”

ইরা মাথা দুলিয়ে বিরতিহীন অশ্রুবিসর্জন দিয়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা গলায় অনুরক্তি সুরে বলল,

—” কিচ্ছু ঠিক হবে না ভাইয়া৷ আদি ভাইয়া..!”

বাক্যটি সম্পূর্ণ করেনি ইরা। চক্ষু মুছে নিজেকে ধাতস্থ করে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে আওড়ায়,

—” ভাইয়া, আমি কী একটু ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবো?”

কাশিশ ভ্রুঁদ্বয় কুঞ্চিত করে! ঠোঁট চেপে আগ্রহী গলায় বলল,

—” আদি ভাইয়া কী ইরা বলো? সব ঠিক আছে? আদি কী তোমাকে মেরেছে?”

ইরা তৎক্ষনাৎ মলিন গলায় দ্বিরুক্তি করে বলল,

—” না, না ভাইয়া! তেমন কিছুই না। একটু রাদ’কে দিন না ভাইয়া প্লিজ?”

কাশিশ একটু পাশ ফিরে রাদের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করলো। বিধ্বস্ত, বেসামাল রাদ প্রকট জ্বরে বেশকিছু রাত্রি নির্ঘুম কাঁটিয়েছে। তন্মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার প্রখর জ্বর নিয়েও শুধু বারবার ফোনে চক্ষু বুলিয়েছে ছেলেটা এই বুঝি ইরা কল দিলো বলে। সে কী তার অস্থিরতা, নিপিড়ন ব্যাকুলতা! কিছু অব্যক্ত কষ্ট, অনুভূতি যা না সহ্য করতে পারে সে, না কাউকে বলতে। চাপা কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন স্থবির রাদের। সব মিলিয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! ফলস্বরূপ অফিস থেকেও ছুটি নিতে হয়েছে। আজ কিয়ৎক্ষন পূর্বেই দুপুরে একটু খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। রাদের মলিন মুখশ্রীতে চেয়ে ডাকতে ইচ্ছে করছে না কাশিশের। আবার ইরা ফোন দিয়েছে কাশিশ রাদ’কে তুলে দেয়নি জানলেও রাদ ওকে মেরেও ফেলতে পারে ভেবেই তৎক্ষনাৎ নরম গলায় বলল,

—” ওয়েট, আমি ডাকছি ওকে!”

অতঃপর কাশিশ ডাকতে লাগলো রাদ’কে। দু’বার নাম ধরে মৃদুস্বরে ডাকতেই উঠে ঝট করে রীতিমতো বসে গেলো রাদ। অসুস্থ ক্ষীণ, মোলায়েম গলায় বলল,

—” কিছু বলবি!”

কাশিশ ফোন বাড়িয়ে দিলো রাদের সম্মুখে। ফোনের দিকে ইশারা করে বলল,

—” ইরা কল দিয়েছে!”

রাদ সপ্রতিভ হয়। কয়েক মুহূর্ত স্থির চেয়ে অবিচল ভঙ্গিতে বলিষ্ঠ পরিপক্ব হাতের মুষ্ঠিতে ফোন তুলে কানে রাখতেই ভেসে এলো সেই পরিচিত মিষ্টি মায়াময়, মোলায়েম কণ্ঠস্বর,

—” হ্যালো, রাদ..?”

নিস্তব্ধ রাদ, গাঢ় চক্ষে কাশিশের দিক তাকালো। কাশিশ বন্ধুর নিরব ভাষা বুঝলো। অর্থাৎ নরম পায়ে বেরিয়ে গেলো কক্ষ হতে!

—” রাদ, প্লিজ কথা বলো। আমি ভয়ে ফোন লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম!”

রাদ অবিচল ভঙ্গিতে নিরুদ্বেগ গলায় বলল,

—” বুঝেছি,”

এহেন সংকীর্ণ প্রত্যুত্তরে স্পষ্ট রাদ ঠিক নেই। গলার স্বরে গুরুগম্ভীর ভাবভঙ্গী! ইরা অশ্রুসিক্ত চক্ষু জোড়া পিটপিটিয়ে। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিকওদিক চক্ষু ঘুরায়। পরপর কণ্ঠ স্বর নিচু করে নরম, কোমল গলায় বলল,

—” রেগে আছো? আমি আদি ভাইয়ার ভয়ে..! ”

ইরা পুনর্বার ফুঁপিয়ে উঠলো। কান্নার তোড়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে মেয়েটা। রাদ গম্ভীরমুখে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে অবিচল ভঙ্গিতে! ওর শ্বাসনালী হতে ছোট ছোট গরম শ্বাস নির্গত হচ্ছে এবং ও মনোযোগ দিয়ে ওর ইরানীর কান্না শুনছে৷ রাদের অসুস্থ অস্বাভাবিক চক্ষুদ্বয় দ্বিগুণ রক্তিম হ’য়ে উঠছে। কিন্তু কিছু বলতে যেন সে ইচ্ছুক অথবা প্রস্তুত নয়! ইরা এবার অধৈর্য্যে সঙ্গে চাপা গলায় চিৎকার করে বলল,

—” প্লিজ, রাদ কথা বলো। আমার কষ্ট হচ্ছে। আই এম স্যরি বাবা। ”

আকস্মিক রাদ গাঢ় গলায় বলল,

—” স্যরি, কেন বলছেন আপনি? ”

হতবিহ্বল, স্তব্ধ হয়ে গেলো ইরা রাদের মুখে আপনি সম্মোধন শুনে। ওর কান্নায় ভাটা পড়েছে। নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে অজান্তে! রাদ পুনরায় গম্ভীর আওয়াজে বলল,

—” কেন স্যরি বলছেন?”

ইরা অপ্রতিভ হ’য়ে পড়ে। বিচলিত ভঙ্গিতে অনুযোগের সুরে বলে,

—” আদি ভাইয়া আমাকে প্রেশার দিচ্ছিলো রাদ। বার বার রুমে আসতো। আমি ভয়ে ফোন বের করতে পারিনি। প্লিজ একটু বুঝো!”

—” বুঝেছি। তো বলুন কেমন আছেন আপনি? ”

ইরা’র ধৈর্য বাধভাঙ্গলো। দুশ্চিন্তা, হতাশা, তিরস্কারে আচমকা রেগে গেলো! রাগান্বিত গলায় ঝট করে বলল,

—” তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না রাদ। আমি কোথায় যাবো তাহলে? কেন বুঝতে পারছো না আমাকে?”

রাদ বিস্মিয়কর এক কাণ্ড ঘটালো। অতর্কিতভাবে আকস্মিক ফোন কেঁটে দিলো। ইরা হতভম্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিয়ৎক্ষন স্তব্ধতায় কেঁটে গেলো প্রহর। অথচ রাদের ফিরতি ফোন এলো না। আচানক সম্বিৎ ফিরে পেলো যেন ইরা! অতঃপর নিজেই ব্যাস্তভঙ্গিতে বারবার কল লাগালো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে। অথচ ফোন বন্ধ! ইরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

আদি ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলো, মূলত্য ইরা’কে পাহারা দিচ্ছিলো৷ ইরা’র সশব্দে রোদন কানে পৌঁছাতেই ছুটে এলো ওর রুমে। ইরা নিজের রুম লক করতে পারেনা। সেই সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আদি ওর রুম বাহিরে দিয়ে লক করে রাখে৷ ফলস্বরূপ আদির অতর্কিত আগমনে ইরা হাতের ফোন লুকাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে! এটা ও আগেই প্ল্যান করে রেখেছিলো৷

আদি ইরা’র দিক পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ! ইরা কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে অথচ চক্ষুদ্বয় জলে টইটম্বুর। মুখশ্রী রক্তিম। বুঝাই যাচ্ছে ও ভীষণ কেঁদেছে। ওর সম্মুখে এসে আদি ক্ষীণ আওয়াজে বলল,

—” কাঁদছো কেন? ”

ইরা থতমত চেহারা নিয়ে উঠে বসলো। নতমস্তকে বলল,

—” এমনই! ”

এহেন দায়সারা জবাব যেন কাম্য নয়। আদি রেগে গেলো। রাগান্বিত গলায় চেঁচিয়ে বলল,

—” আমি জিজ্ঞেস করেছি কাঁদছিস কেন?”

ইরা’র সহ্য হলো না আর আদি’র বারাবাড়ি! ঝট করে কিঞ্চিৎ আওয়াজ করে বলল,

—” মন চাইছে তা-ই কেঁদেছি! তুমি জিজ্ঞেস করা কে?”

আদি’র কী হলো ইরা’র গালে আঘাত করে বসলো। অতর্কিত আক্রমণে ইরা হতভম্ব একইসাথে ব্যাথিত। থাপ্পড়’টা এতটা জোরে ছিলো ইরা’র শ্যাম, রক্তিম মুখশ্রীতেও আঙুলের ছাপ পড়ে গেলো। ইরা গালে হাত রেখে পূর্বের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো! ইরা’কে এভাবে কাঁদতে দেখে আদির যেন হুঁশ এলো। অর্থাৎ নিজেকে নিজে বি’শ্রী ভাষায় গা’লি দিতে ভুললো না৷ ও যত বেশী ইরা’র সাথে নরম ব্যাবহার করবে ভাবছে। আসলে ততই রেগে যাচ্ছে। আচরণ করছে কঠোর! ওর সকল প্রচেষ্টা ব্যার্থ হচ্ছে। কেন যেন ভয়ে বক্ষজুড়ে কম্পন সৃষ্টি হলো ইরা’কে আঘাত করে। আদি দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেললো মস্তিষ্ক হতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো সাবধানে! অতঃপর নরম ভঙ্গিতে বসলো ইরা’র পাশে৷ ভীতসন্ত্রস্ত ইরা তৎক্ষনাৎ দূরে যাওয়ার প্রয়াস করতেই, আকস্মিক আদি ওর বাহু চেপে টেনে নিজের বক্ষে ফেলে ইরা’র ছোট্ট দেহখানি! ইরা অস্বস্তিতে ছোটাছুটি শুরু করে তৎক্ষনাৎ। দ্বিগুণ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে বলল,

—” কী করছো তুমি? ছাড়ো আমাকে, ভাইয়া ছেড়ে দাও আমাকে। আম্মু!”

ইরা’র এহেন চিৎকারে আদি কিছু না ভেবেই তৎক্ষনাৎ চাপা গলায় বলল,

—” হুঁশ, চুপ একদম চুপ! বায়ায় কিন্তু কেউ নেই ভুলে যাস না!”

ইরা দ্বিগুণ ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করলো। আদি ততই শক্ত করে ওকে জড়িয়ে নিচ্ছে নিজের সঙ্গে নির্বিঘ্নে। ইরা আবারও ভাঙ্গা গলায় চেঁচালো,

—” ছাড়ো। অসভ্য ছেলে। তুমি ভুল করছো ভাইয়া। আমি এর জন্যেই তোমাকে শুধু মাত্র ঘৃণা করি। জোড় করে কিছু হয়না এটা তুমি বুঝো না কেন!”

অসহায় ইরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে! ছোট্ট শরীর’টা গলা কাঁটা মুরগির মতো ধাপাচ্ছে। কিন্তু আদির পুরুষালী শক্তি’র কাছে ওর সকল শক্তি যেন নগন্য। আদি নিজেও কী চাইছে ঠাওর করতে অক্ষম। ক্ষণে এলোমেলো হাতে ইরা’র চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ক্ষণে ইরা’কে চেপে ধরছে নিজের সঙ্গে। যেন ছেড়ে দিলেই ইরা হারিয়ে যাবে।

আদি’র এহেন স্পর্শে পাগলামিতে ইরা’র সমস্ত কায়া ভয়ে থরথর কাঁপতে লাগলো। বিষাক্ত লাগলো আদি’র নিশ্বাস গুলো। শেষ চেষ্টা সরূপ আদির বুকে গায়ের সমস্ত জোড়ে ধাক্কা দিতেই। আদি ইরা’র কপালে শক্ত চুমু খেয়ে বসলো! ইরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো তাতে! আদি ক্ষীণ আওয়াজে ইরা’র কানে কিছু বলতে উদ্যত হয়েছিলো। তার আগেই রাশভারী গলায় কেউ চিৎকার করে উঠলো,

—” আদি, ছাড় ওকে!”

আকস্মিক আদি হকচকিয়ে থমকে গেলো। ইরা দরজায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রাণ ফিরে পেলেও। আদি তৎক্ষনাৎ ইরা’কে ছেড়ে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হলো। মুহূর্তে কপালে চিকন ঘামের সৃষ্টি হ’য়েছে ওর। দরজায় আজমল খাঁন দাঁড়িয়ে! আদি আজ বাবা-র চক্ষে, চক্ষুদ্বয় রেখে একত্র করতে অক্ষম! আজমল খাঁন নিজেকে সংবরণ করতে চেষ্টা করলো তবে উনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তেড়ে এগিয়ে এসে তৎক্ষনাৎ আদি’র গালে পরপর দুটো আঘাত করলেন গায়ের জোড়ে। ইরা এহেন পরিস্থিতিতে ভয়ে বেডে বসে থাকা অবস্থাতেই পাঞ্জাবির কোণা টেনে বড় বাবা’কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ওর কম্পিত শরীর তখনও ভীত। ততক্ষণে সবাই একে একে ওর রুমে চলে এসেছে। কিয়ৎক্ষন নিরব, নিস্তব্ধে টইটম্বুর কক্ষে হতে আদি ইরা’র দিকে একবার নিষ্প্রভ চক্ষে তাকিয়ে। রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বাকি সবাই আজমল খাঁনের ইশারায় আদি’র পিছু পিছু রুম ত্যাগ করলো। রয়ে গেলো শুধু ইরা’র বাবা। আজমল দীর্ঘশ্বাস টেনে ইরা’র পাশে বসলেন। মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলালেন। উনার চক্ষে বিঁধে রইলো ইরা’র গালে জ্বল জ্বল করতে থাকা আদি’র আঙুলের স্পষ্ট ছাপ! পুনর্বার বেশ সময় নিয়ে ব্যথিত শ্বাস ফেলে গম্ভীরমুখে নরম গলায় শুধালেন,

—” আমি তোমার আচরণে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম মা। রেগেও ছিলাম। তবে যা করার করে ফেলেছো, আমি সব বুঝি। তোমাকে যেমন সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করতে পারিনি। তেমনই ছেলের নির্বোধ অন্যায় ও মেনে নিবো না আমি৷ তোমাকে একটা স্পষ্ট কথা বলি। কালকে পর্যন্ত আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম আদির সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। ঘরের ছেলের উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু আজকে পর.. যাইহোক আমি তোমাকে বেষ্ট কিছু দিতে চাই ইরা। আজ আমি বলছি যদি তোমার পছন্দ করা ছেলে আমার চোখে বেষ্ট হয়। তবে আমি তোমার বিয়ে তোমার পছন্দ করা ছেলের সাথেই দিবো। তোমাকে কষ্ট পেতে হবে না। শুধু বাবা’র উপর বিশ্বাস রেখো, আমাদের সিদ্ধান্ত’কে সম্মান করো। ঠিক আছে?”

ইরা হেঁচকি তুলে কাঁদছিলো। কম্পিত মস্তকে সেভাবেই মাথা দুলিয়ে বাবা-র সিদ্ধান্তে সায় জানালো। নিরব, নিস্তব্ধ থাকা আজিম খান এবার মুখ খুললেন! আচানক গম্ভীর আওয়াজে বললেন,

—” কিন্ত.. ভাই!”

আজমল খাঁন সাহসা উচ্চস্বরে বললেন,

—” চুপ কর, ছেলে ভালো হলে আমাদের বাঁধা দেওয়ার কারণ দেখছি না। ঘরের ছেলের উপর বিশ্বাসে আজ ঘাটতি চলে এসেছে আমার। তাছাড়া পাত্র দেখতে সমস্যা দেখছি না আমি! দেখলেই তো আর বিয়ে হবে যাবে না?”

আজিম কিঞ্চিৎ শব্দ আর ব্যায় করলেন না। ইরা’র রক্তিম গালে চাঁর আঙুলের ছাপ উনার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রকাশ না করলেও একটা মাত্র মেয়ে উনার কলিজার টুকরা। বড় ভাই আদরে রাখেন বলেই উনি যথেষ্ট শাসনে করেন! যেন আহ্লাদ বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়! তা-ই ব’লে বাড়ির ছেলে এভাবে মেয়ের গায়ে হাত দিবে উনি মেনে নিবেন না! তবে ইরা’র পছন্দের ছেলের সঙ্গে ইরা’র বিয়ে এটাও উনি মেনে নিতে পারছেন না। ঘরের ছেলের উপরেই আর বিশ্বাস নেই সেখানে বাহিরের একটা অপরিচিত ছেলে কেমন হবে উনার ধারণা হয়ে গেছে!

চলবে!

[এটুকু লিখতে কী পরিমাণ যে কষ্ট হয়েছে। কোনও দিন গল্প লিখতে এতটা কষ্ট করা লাগেনি। কাল সারাদিন লিখিছি। এক লাইন লিখি পাঁচ লাইন কাটি। রাতেও লিখি ভাবি আবার ঘুম পায়। মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো আমার এসব করতে করতে। ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে গেছি। সকালে উঠেই আবার লিখতে বসেছি। এখন দুপুর ১ঃ২৯ বাজে। আমার লিখা শেষ হয়েছে। কিন্তু মন মতো হয়নি। এই পর্বটা আমি অতীতের জন্য বরাদ্দকৃত রেখেছিলাম, হলো কই। কেমন যেন বাক্য, ছন্দ সাজাতেই পারছিলাম না। তাই কালকে গল্প দিব বলেও দিতে পারিনি। তার জন্য দুঃখিত! আজকের পর্বটা এক কথায় জোর করে লিখা জোড় করে আর যাই হোক লিখালিখি হয়না। তাই ভালো হয়নি হয়তো ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিবেন🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here