চৈত্রের_বিকেল #পর্ব_৪ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
504

#চৈত্রের_বিকেল
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
লোকজনের সরগম, সকলেই খাওয়ায় ব্যস্ত। চারদিকে অল্পসল্প হৈচৈ হওয়া সত্ত্বেও কাব্যর বলা কথাটি চৈত্রীর কর্ণকুহরে হানা দেয়। শুভ্রকে স্টেজে পাঠিয়ে দিয়ে দু’কদম ফিরে আসে সে কাব্যর কাছে। চৈত্রীকে এতটা কাছাকাছি পেয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কাব্য। এত সুন্দর সে বোধহয় ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। চোখের পলক নড়ছে না। তবে হৃদকম্পন হচ্ছে প্রচণ্ড। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না কখনো।

চৈত্রী কোমরে হাত গুঁজে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কাব্যর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। দু’চোখে অমায়িক মুগ্ধতা। ভ্রুঁ জোড়া মসৃণ হওয়ার বদলে আরও খানিকটা কুঁচকে গেল চৈত্রীর। এরকম মুখাবয়ব করা কাব্যকে সেও তো প্রথমই দেখল। সে বাম ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,

‘এইযে মিস্টার, আমার নাম চৈত্র নয়; চৈত্রী। আর তখন থেকে ওরকম করে তাকিয়ে কেন আছেন?’

‘তুমি সুন্দর তাই!’

‘ফ্লার্ট করছেন?’

কথাটি অনেকটা ঘোরের মাঝেই বলে ফেলেছিল কাব্য। চৈত্রীর কড়া কথার সুরে সে নিজেকে অল্প সময়ের জন্য হলেও সামলে নিল। পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে বলল,

‘তুমি ফ্লার্ট করার মতো মেয়ে নও। বাই দ্যা ওয়ে, চৈত্রী থেকে চৈত্র নামটা বেশি সুন্দর।’

‘তাই? আগে বলবেন না! তাহলে বাবা-মাকে বলতাম চৈত্রী নাম পালটে চৈত্র রাখতে।’

কাব্য হেসে ফেলে। চৈত্রী এই প্রথম খেয়াল করল হাসলে কাব্যকে সুন্দর লাগে। কাব্য বলল,

‘না বলে ভালোই করেছ।’

চৈত্রী কিছু বলল না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কাব্য বাঁ পেশে হাসিটা হেসে চৈত্রীর চোখে চোখ রেখে বলল,

‘ভালো হয়েছে এজন্যই যে, চৈত্র নামে শুধু আমি ডাকব।’

‘পুরান পাগলে ভাত পায় না; নতুন পাগলের আমদানি।’ বলে চৈত্রী সেখান থেকে চলে যায়।

কাব্য হাসে। যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বলে,’শুধু পাগল নয় চৈত্র; তুমি তো আমায় বদ্ধ উ’ন্মা’দ বানিয়ে ফেলেছ এক দেখাতেই।’
.
অনুষ্ঠান সব শেষ। এবার বাড়িতে ফেরার পালা। সবকিছু রাতের মধ্যেই গোছগাছ করে রাখতে হবে। সকালের ট্রেন মিস দেওয়া যাবে না। তাই ক্লান্ত লাগা সত্ত্বেও সবাই এখন ব্যাগ প্যাকিং করছে। চৈত্রীর মা ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে তাই তার আর কাজ নেই কোনো। সে রুহানিয়ার রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। খুব সম্ভবত এর মাঝে ঘুমিয়েও পড়েছে।

সমুদ্র খুব হৈ-হুল্লোড় করে রুমে ঢুকলেও, যখন দেখল চৈত্রী ঘুমুচ্ছে তখন সে পা টিপে টিপে এগুলো। মন খারাপ করে রুহানিয়া ব্যাগ গুছাচ্ছিল। যত-ই সে সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয় করুক না কেন, দিনশেষে ভীষণ কষ্ট হয়। তবে এটাও ধ্রুব সত্য যে, তাকে এই ঘোর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শুভ্র এখন বিবাহিত। ও-কে নিয়ে ভাবাটাও অন্যায়। এখান থেকে বের হতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু তাকে পারতে হবে। সমুদ্রকে দেখে চোখের কোণ থেকে পানিটুকু মুছে বলল,

‘কিরে হিরো? এখানে কী?’

সমুদ্র চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল,’সুইটহার্ট ঘুমিয়েছে?’

রুহানিয়া হেসে সমুদ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’হ্যাঁ, তোর সুইটহার্ট ঘুমায়। এখন কী দরকার ও-কে?’

‘সুইটহার্টকে তো দরকার নেই। তোমাকে দরকার।’

রুহানিয়ার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। সমুদ্রের গাল টিপে ধরে বলে,’শেষমেশ কি তুই আমাকেও লাইন মারছিস?’

‘আহ্! ব্যথা লাগছে আপু।’

‘লাগুক। তোর ফাজলামো ছুটাব আমি।’

সমুদ্র নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। বলল,’তুমি তো আমার আপু হও। তোমায় কেন লাইন মারব?’

‘চৈত্রীও তো তোর আপু হয়। ও-কে কেন লাইন মারিস?’

‘ছি! ও আমার সুইটহার্ট হয়। ও-কে কি আমি আপু ডাকি? তুমি আমার আপু হও; তাই তোমাকে আপু ডাকি।’

সমুদ্রকে কিছুটা গম্ভীর দেখাল। রুহানিয়া শব্দ করে হেসে ফেলে। বসা থেকে উঠে আবার ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলে,

‘আচ্ছা এখন আমাকে কী দরকার তোর শুনি?’

‘তোমাকে আমার দরকার নেই। শুভ্র ভাইয়ার বন্ধুর দরকার।’

রুহানিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কোন বন্ধু?’

‘উমম! কী যেন নাম? ওহ মনে পড়েছে। জিহাদ ভাইয়া।’

‘তার আমাকে কী দরকার?’

‘জানিনা তো। আমায় বলল তোমাকে একটু ডেকে দিতে।’

‘কোথায় সে?’

‘ছাদে।’

‘আচ্ছা তুই যা।’

সমুদ্র দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বলে,’আপু একটা কথা বলি?’

‘কী?’

‘সুইটহার্টকে গালে একটা চুমু দেই?’

রুহানিয়া চোখ পাকিয়ে বলে,’ভাগ এখান থেকে।’

সমুদ্র দৌঁড়ে চলে যায়। রুহানিয়া হাসে। চৈত্রীর দিকে এক পলক তাকিয়ে আদুরেভাবে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। হেসে মনে মনে বলে,

‘সমুদ্রটা চৈত্রীর বড়ো হলে, নির্ঘাত সমুদ্র ও-কে ছাড়া কাউকে বিয়েই করত না।’

ব্যাগ সম্পূর্ণ না গুছিয়েই ছাদে গেল রুহানিয়া। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে দেখতে পেল জিহাদ ছাদে পায়চারি করছে। সে রুহানিয়াকে দেখে বলল,

‘এতক্ষণ লাগে আসতে?’

‘এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’

জিহাদ নিজেকে সামলে নিল। বলল,’কই নাতো! আপনার আসতে দেরি হলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

‘ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম।’

‘কাল তো আপনিও ঢাকায় যাবেন তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘এটা ভালো ডিসিশন। কিছুদিন অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসলে আপনার ভালো লাগবে।’

রুহানিয়া কিছু বলল না। জিহাদ কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল,

‘আপনি ঢাকায় গেলে কি আমাদের দেখা হবে?’

রুহানিয়া আকাশের দিকে তাকায়। কেন জানি, ভারী দীর্ঘশ্বাস বুকচিরে বেরিয়ে আসে। রেলিঙের ওপর দু’হাত রেখে বলে,

‘আল্লাহ্ চাইলে হবে।’

‘আপনার ইচ্ছে নেই?’

রুহানিয়া চুপ করে থাকে। জিহাদ বলে,’আচ্ছা যে কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম। বলব?’

‘অবশ্যই।’

‘কিছু মনে করবেন না তো?’

‘সেটা তো আপনি কী বলছেন,সেই কথার ওপর নির্ভর করছে।’

জিহাদ হাসল। বলল,’আপনার ফোন নাম্বারটি কি পেতে পারি? না মানে, তাহলে ঢাকায় যাওয়ার পর আপনি চাইলে দেখা করা যাবে।’

রুহানিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিহাদকে নিজের ফোন নাম্বারটি দিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসে।
_______
কাব্যর সাথে চৈত্রীর আর দেখা হয়নি। সকালে ঘুম ভাঙার আগেই চৈত্রীরা চলে গিয়েছে। রুম পেরিয়ে উঠোনে আসতেই কাব্যর কেমন যেন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। আজ বাচ্চাদের হৈচৈও নেই। বাকিরা বাকিদের মতো ব্যস্ত। সে জানে না চৈত্রীদের কখন যাওয়ার কথা; শুধু এতটুকুই জানত আজ ওদের মতো চৈত্রীরাও চলে যাবে।

সে উদাস নয়নে উঠানের একপাশে বসে। দৃষ্টি মাটিতে স্থির। চোখের পাতায় গতকালের শাড়ি পরিহিতা কাব্যর সেই চৈত্র। কিন্তু আজ তার উপস্থিতি নেই। চলে গেছে তবে? সে অনিচ্ছুকভাবে কষ্ট পাচ্ছে নাকি নিজে নিজেই চৈত্রীকে নিয়ে বেশি ভাবছে বলে কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছে না। তবে বুকের ভেতর এই নতুন ব্যথাটি ভয়ংকর যন্ত্রণাময়।

ঘুম ঘুম চোখে তিতাস এগিয়ে আসে। হাই তুলে কাব্যর কাঁধে হাত রেখে বলে,’কিরে? এখানে কেন বসে আছিস? রেডি হ। যাবি না?’

কাব্য এক পলক তাকিয়ে থমকায়। স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করে দেখে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতটাই কষ্ট হচ্ছে যে, সে কথাও বলতে পারছে না। অথচ তার না হয়েছে বিচ্ছেদ; আর না আছে বিরহ। শুধুমাত্র কারও অনুপস্থিতিও কি এতটা ব্যথা, ক্লেশ বুকের ভেতর টর্নেডোর মতো ঝড় তুলে দিতে পারে? শব্দটি বোধ হয় ‘কারও’ নয় বরঞ্চ ‘চৈত্রী’ হবে। কারেকশন করলে লাইনটা হয়, শুধুমাত্র চৈত্রীর অনুপস্থিতিতে সে এতটা ক্লেশবোধ করছে! এলোমেলো চিন্তায় গুছিয়ে উত্তর তো দেওয়া দূরে থাক, ঠিকমতো হু, হা-ও করতে পারছে না। কেমন ব্যথাতুর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রয়েছে তিতাসের দিকে।

কাব্যর উদাস ভঙ্গি, ব্যথাতুর দৃষ্টি দেখে তিতাস কিছুটা ঘাবড়ে যায়। কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

‘অসুস্থ নাকি তুই?’

কাব্য প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’না, ঠিক আছি।’

শুভ্রর উপস্থিতি ঘটে তখন। সে দুই বন্ধুর দিকে এগিয়ে এসে বলে,’কিরে তোরা এখন ফ্রেশ হোসনি? খাবি কখন?’

কাব্য রয়েসয়ে বলল,’এইতো এখন ফ্রেশ হয়ে রেডি হব। বাকি সবাই কি চলে গেছে?’

‘বাকি সবাই কারা? ছোটো মামারা আর চৈত্রীরা চলে গেছে। সাথে রুহানিয়াও গেছে। ক’দিন নাকি ঢাকায় বেড়াবে।’

কাব্যর বুকের ভেতর বয়ে চলা কষ্টের নদীর স্রোত হুহু করে বাড়তে থাকে। এই স্রোতে সে ঠাই পাচ্ছে না। যার কথা মনে পড়লেই আগে রাগ হতো, তার কথা মনে করে এখন কষ্ট হচ্ছে। হায়রে নিয়তি! অপছন্দের ব্যক্তিও বুঝি বুকের এতটা দখল করে নিতে পারে? পারেই তো! না পারলে কি আর কাব্যর মতো বুঝদার একজন ছেলে চৈত্রীর জন্য এমন হা-হুতাশ করত!

সকালের নাস্তা সেরে ওরাও সবাই গ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার জন্য রওনা হয়।
.
.
সাদা রঙের গ্রিল বেয়ে বেয়ে তিন, চারটে করলা গাছ অনেক উঁচু অব্দি চলে গেছে। গাছগুলোর বয়স বেশি নয়। চৈত্রীর গাছের ভীষণ শখ তার মায়ের মতোই। মা ছাদ বাগান করেছে, আর চৈত্রী করেছে বারান্দা বাগান। তার বারান্দায় ফুলের পাশাপাশি রয়েছে করলা গাছ ও পুইশাক গাছ। পুইশাক গাছ খুব একটা না বাড়লেও করলা গাছ তরতর করে অল্প সময়ের মধ্যেই বেড়ে গেছে। গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে চৈত্রী যখন দেখতে পায় তার করলা গাছে দুটো হলুদ ফুল ফুটেছে, তখন আর তার খুশি দেখে কে! মা এসে ফুল দুটো দেখিয়েছে বলে কিছুক্ষণ মায়ের সঙ্গে আহ্লাদ করে সে। রুহানিয়াকে আগ্রহভরে দেখিয়েছে,

‘দেখো আপু দেখো, আমার করলা গাছে ফুল ধরেছে।’

রুহানিয়া প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসেছিল। এখন গোধূলি বিকেল। রুহানিয়া বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। মৃদু মৃদু বাতাসে করলা গাছের পাতাগুলো নড়ছিল। তার বুকের ভেতর চাপা কষ্টগুলোও একটু একটু করে বাড়ছিল। শত চেষ্টা করেও শুভ্রকে পুরোপুরি ভুলতে পারছিল না। সময় লাগবে সে জানে। কিন্তু এই সময়ের সীমা যে কতটা তা সে জানে না। আর জানে না বলেই স্বস্তি পাচ্ছে না। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে যাচ্ছে। নিরবে কখনো কখনো আবার চোখের পানিও ফেলছে। ভেবেছিল শুভ্রর থেকে দূরে আসলে হয়তো ভালো থাকবে। অথচ তার ভাবনা ভুল ছিল। কোনো কিছু করেই সে ভালো থাকতে পারছে না। কষ্ট তার পিছুই ছাড়ছে না।

মাগরিবের আযানের পর চৈত্রীকে নিয়ে ছাদে হাঁটছিল রুহানিয়া। সেই সময়ে জিহাদের নাম্বার থেকে ফোন আসে। গতকাল নাম্বার দেওয়ার পর সাথে সাথেই ম্যাসেজ করেছিল জিহাদ,’এটা আমার নাম্বার।’ রুহানিয়া বুঝতে পেরেছিল এই আমিটা ‘জিহাদ!’ পরিচিত যে কারও নাম্বার সে ফোনে সেইভ করে রাখে। এমনকি প্রয়োজনে কলেজ, ভার্সিটির কেরানীর নাম্বারও!

রুহানিয়া একবার চৈত্রীর দিকে তাকাল। ও ফোন নিয়ে আকাশের ছবি তুলছে। আরও কিছুটা দূরত্বে সরে গিয়ে রুহানিয়া ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল,

‘কেমন আছেন?’

জিহাদ সালামের উত্তর নিয়ে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি। আপনি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌।’

কথাটি বলার সময়ে রুহানিয়ার ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে; যেটা জিহাদও শুনতে পায়। আর সে এটাও আন্দাজ করে নেয়, রুহানিয়া ভালো নেই।

জিহাদ বলল,’কী করছেন এখন?’

‘ছাদে হাঁটছি।’

‘এই সময়ে ছাদে কী করছেন?’

রুহানিয়া মৃদু হেসে বলল,’ভয় পাওয়ার কিছু নেই। লাফ দেবো না। এই সময়ে ছাদের হাওয়া ঠাণ্ডা থাকে বেশি। তাছাড়া সাথে চৈত্রীও আছে।’

‘ওহ আচ্ছা দু’বোন ছাদে।’

‘জি।’

কিছুক্ষণ নিরবতা। মৌনতা কাটিয়ে জিহাদ কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’আসলে আরও আগেই ফোন করতাম। কিন্তু আপনি কি না কি ভাববেন তাই সাহস পাইনি।’

‘তাই? দেরি করে দেওয়াতে কি কিছু ভাবতে পারি না?’

জিহাদের কিছুটা ভয় লাগল। সে বিষন্নতায় ডুবে গিয়ে বলল,’আপনি কি রাগ করেছেন? কথা বলতে না চাইলে আমি আর আপনাকে বিরক্ত করব না।’

‘কে বলল আমি বিরক্ত হয়েছি?’

‘তাহলে ঐ কথা বললেন যে?’

‘আপনি অযথা কৈফিয়ত দিলেন। তাই আপনার কথার পিঠে ঐ কথাটি বলেছি। বিরক্ত হইনি।’

‘থ্যাঙ্কস টু আল্লাহ্।’ কথাটা বিড়বিড় করে বলে গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বলল,

‘একটা কথা বলব?’

‘বলুন।’

‘কিছু মনে করবেন না তো? বকবেনও না।’

‘আচ্ছা।’

‘আপনি তো ধানমন্ডি আছেন তাই না?’

‘জি।’

‘আমি মোহাম্মদপুর থাকি। দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি নয়। তাই বলছিলাম যে, দেখা করবেন আজ? এখন?’

সাহস নিয়ে কথাটি বললেও মনে মনে জিহাদ একটু ভয়-ই পাচ্ছিল। রুহানিয়া আবার না তাকে ছে’চ্রা ভেবে বসে! আদতে সত্যিকার অর্থে সে রুহানিয়ার জন্যই দেখা করতে চেয়েছিল। বাইরে বের হলে, ঘুরলে অল্প সময়ের জন্য হলেও রুহানিয়ার মন ভালো হবে; তাই দেখা করার প্রস্তাব জানিয়েছে জিহাদ।

রুহানিয়া কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,’কিন্তু এখন কীভাবে সম্ভব?’

‘আপনি চাইলেই সম্ভব। সন্ধ্যামাত্র! ঢাকা-শহর অনেক রাত অব্দি জেগে থাকে। আপনি চৈত্রীকে সাথে নিয়ে বের হোন।’

বাড়িতে থাকতে রুহানিয়ারও ভালো লাগছিল না। বাইরে যেতে পারলে তার ভালো লাগবে বলে ধারণা। তবে সে অবশ্য আজ নয়; কাল সকালে চৈত্রীকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। এদিকে জিহাদ যখন এত করে বলছিল, তখন সে মুখের ওপর না-ও করে দিতে পারছে না। সে চৈত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

‘কিন্তু চৈত্রীকে কী বলব?’

‘বলবেন বাসায় ভালো লাগছে না। বাইরে কফি খাবেন। ও যেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে ঐ রেস্টুরেন্টের ঠিকানা নিয়ে আমায় ম্যাসেজ করুন।’

‘ঠিক আছে। এখন রাখছি।’

চৈত্রীকে বলা মাত্রই রাজি হয়ে যায়। কারণ সেও খুব ভালো করেই জানে রুহানিয়ার মাইন্ড রিফ্রেশ করা প্রয়োজন। রুমে গিয়ে দুজনে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ি থেকে রেস্টুরেন্ট খুব একটা দূরেও নয় তাই বাবা-মা নিষেধ করেনি। রিকশায় উঠে রেস্টুরেন্টের নাম জিজ্ঞেস করে জিহাদকে ম্যাসেজ করে দিয়েছে রুহানিয়া। ওরা রেস্টুরেন্টের কাছে পৌঁছিয়ে দূরে জিহাদকে দেখতে পায়। চৈত্রী তখনো তাকে দেখেনি।

রুহানিয়া ম্যাসেজ করে,’এত জলদি চলে এলেন?’

জিহাদের রিপ্লাই আসে,’আপনাদের সাজুগুজু করা লাগে। কিন্তু আমাদের এত সাজুগুজু করা লাগে না।’ সাথে হাসির ইমুজি।

চৈত্রী রুহানিয়াকে মৃদু ধাক্কা দিতেই ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরায় রুহানিয়া। দুজনে চলে যায় রেস্টুরেন্টের ভেতরে।

জিহাদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাব্য। তার চোখে অজস্র ঘুম। ইচ্ছে করছে জিহাদকে কাচা গিলে খেতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। হাজার হোক, বন্ধু মানুষ! সে নিভু নিভু দৃষ্টিতে জিহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এভাবে ঘুম থেকে টেনেটুনে তুলে এনে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?’

‘আরে ব্যাটা তুই দেখে ঘুমে ঢুলে পড়ে যাচ্ছিস।’

‘তাও তো তোর একটু দয়ামায়া হলো না।’

‘তিতাস তখন বাসায় থাকলে তখন আনতাম না বন্ধু সত্যি।’

‘নাটক বন্ধ কর। কেন এসেছি আমরা সেটা বল?’

‘রুহানিয়ার সাথে দেখা করতে।’

চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় কাব্যর। বিস্মায়ভূত হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কার সাথে?’

‘রুহানিয়ার সাথে। তোকে পরে সব খুলে বলব। এখন চোখে-মুখে একটু পানি দিয়ে তুই স্বাভাবিক হ।’

‘আমার স্বাভাবিক হওয়া লাগবে কেন? ও কি আমাকে দেখতে এসেছে? শালা! তলে তলে এতদূর?’

‘না জেনে উলটা-পালটা কথা বলিস না শালা! এখন চল।’

রেস্টুরেন্টে গিয়ে জিহাদকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে কাব্য ওয়াশরুমে যায়। মেয়ে মানুষের সামনে কি আর এমন এলোমেলোভাবে যাওয়া যায়? মান-ইজ্জতেরও তো একটা ব্যাপার আছে। বাসায় যেই টি-শার্ট পরে ঘুমিয়েছিল সেটাই পরে এসেছে। শুধু ওপরে একটা শার্ট জড়িয়েছে। শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে চোখে-মুখে পানি দিয়ে ঘুম ঘুম ভাবটা দূর করল। দূর করলে বললে মিথ্যে বলা হবে। কারণ ঘুম ভাবটা তার এখনো কাটেনি। সে চেষ্টা করছে। চুলগুলো পানি দিয়ে ভিজিয়ে হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ভেতরে ঢোকে। তার দিকে পিঠ করে বসে ছিল রুহানিয়া আর চৈত্রী। কাব্যকে দেখে বসার জায়গা করে দিয়ে জিহাদ একটু সরে বসে বলল,

‘এখানে বোস।’

চৈত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর আগেই কাব্য এসে তার সামনে বসেছে। দুজনে এখন মুখোমুখি। তারা দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভাবতেই পারেনি যে আবার দেখা হবে। কিন্তু দেখা হয়েছে। জিহাদ ভেতরে এসেই বলেছিল তার সাথে আরও একজন বন্ধু এসেছে। কিন্তু সে যে কাব্য হবে ক্ষুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি চৈত্রী।

কাব্য অস্পষ্টভাবে বলল,’চৈত্র!’

চৈত্রী কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রুহানিয়ার দিকে তাকাল। এমন প্রত্যাখানে সচকিত হলো কাব্য। সেও নিজের অপ্রস্তুত ভাব সামলে নিয়ে রুহানিয়াকে জিজ্ঞেস করল,

‘ভালো আছেন আপু?’

রুহানিয়া মৃদু হেসে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনি?’

কাব্য চৈত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে হেসে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌, অনেক ভালো আছি এখন।’

এরপর সে হুট করে চৈত্রীকে বলল,’এই পিচ্চি বাচ্চা এখানে বড়োরা কথা বলছে। তুমি কী করছ?’

চৈত্রী হা হয়ে যায়। তার কি তাহলে চলে যাওয়া উচিত। রুহানিয়া কিংবা জিহাদ কিছু বলার পূর্বেই কাব্য বলল,

‘তুমি আমার সাথে অন্য টেবিলে চলো। ওদেরকে কথা বলতে দাও। ভয় নেই, আমি তোমার সাথে অযথা কথা বলব না। জাস্ট সঙ্গ দেবো; যাতে বোরিং না হও।’

রুহানিয়া বলল,’আরে না, না তোমরাও থাকো।’

কাব্য বলল,’সমস্যা নেই আপু।’ এরপর আবার চৈত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এখনো বসে আছো কেন? ওঠো।’

চৈত্রী ভাবল আসলেই হয়তো দুজনের ব্যক্তিগত কোনো কথা থাকতে পারে। রুহানিয়ার তরফ থেকে ব্যক্তিগত না হলেও জিহাদের তরফ থেকে হতে পারে। আর ঠিক এজন্যই হয়তো বন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে এসে কাব্য এত পায়তারা করছে চৈত্রীকে সরানোর জন্য। সে তাই বিনাবাক্যে উঠে অন্য জায়গায় বসল। পিছু পিছু কাব্যও গেল।

রুহানিয়া তখন জিহাদকে বলল,’ওদের যাওয়ার কিন্তু প্রয়োজন ছিল না।’

‘আপনি কি রাগ করলেন?’

‘না, রাগ করিনি। কিন্তু কাব্য ভাইয়া মনে হয় অন্য কিছু ভেবেছে আমাদের নিয়ে।’

‘সমস্যা নেই। সত্যিটা তো আমরা জানি। আমি ও-কে দেখার করার ব্যাপারে আগে কিছু বলিনি তো তাই হয়তো ভেবেছে। আমি বলে দেবো আমাদের মধ্যে কিছু নেই।’

কাব্য চৈত্রীর মুখোমুখি বসতে যাবে চৈত্রী তখন হুঙ্কার দিয়ে বলে,

‘খবরদার! আপনি এখানে বসবেন না। অন্য কোথাও বসুন। অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে।’

কাব্য কিছু না বলে আগে বসল। টেবিলের ওপর হাত রেখে বলল,

‘কেন বসব না? এই জায়গাটুকু তোমার বাবার না, আমার শ্বশুরেরও না। সূতরাং তোমার পারমিশন আমি চাইনি।’

চৈত্রী কথার মিনিং বুঝে ওঠার আগেই কাব্য বলল,’শোনো, অযথা ঝগড়া করবে না। মুড এখন ফ্রেশ আছে। ঝগড়া করতে মন চাচ্ছে না। এনিওয়ে কফি খাবে?’

‘না।’

‘কেন খাবে না?’

‘ইচ্ছে করে না, তাই খাব না।’

‘আইসক্রিম খাবে?’

‘না।’

‘তাহলে চা?’

‘কিচ্ছু খাব না!’

‘কেন কিচ্ছু খাবে না? চা খাও। চা খেলে ভাল্লাগবে। তুমি, আমি এবং চা। দারুণ কম্বিনেশন হবে চৈত্র।’

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

বিঃদ্রঃ প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ভুগতেছি দু’দিন ধরে। গ্রামে ছিলাম, গতকাল এসেছি। চোখ, নাক দিয়ে পানি পড়ছে। চোখ দিয়ে পানি পড়তে পড়তে বাম চোখ ফু্লে গেছে। বেশিক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েও থাকতে পারছি না। চোখ ব্যথা করে। তাই গল্পও দিতে পারিনি। তিনদিনে এই পর্বটা লেখা হয়েছে। যাই হোক, সবাই দোয়া করবেন।
হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here