দুই দুয়ারী পর্ব ৭

0
174

দুই দুয়ারী

পর্ব ৭

নজরুলের অনুপস্থিতি আমার জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক ছিল, তার চেয়েও বড় কথা, বাড়ির প্রতিটা মানুষকেই আনন্দিত মনে হচ্ছিলো। আমি আমার ছাত্রকে দীর্ঘসময় নিয়ে পড়াতে শুরু করলাম, নিজের জ্ঞান প্রকাশের সুযোগ পারতে হাতছাড়া করি না। ছেলেটা ভালো, পড়াশুনায় বেশ মন আছে, সে আমার কথা হা করে গেলে । বলতে নেই, সারাজীবন আমি খারাপ ছাত্রের তকমা পাওয়া মানুষ, এই প্রথম নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে পেরে খারাপ লাগছে না। অবশ্য ভবিষ্যতের গল্প, ঢাকা শহরের গল্প করতে মাঝে বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলাম না আমি জানি, কিন্তু সেই আমার কাছে আমার জীবনটা খুব অপ্রিয় ছিলোনা!

আমি আমার তরুণী দাদির সাথেও অন্যরকম একটা সখ্য গড়ে তুলেছি একয়দিনে। একদিন তাকে দেখেছিলাম বাড়ির পেছনে, কুয়ার পাড়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে। হঠাৎ অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল আমার, উনি কি পানিতে ঝাঁপিয়ে পরবার চিন্তা করছেন কিনা ভেবে নিয়ে নিজের অজান্তেই ” বাবা” বলে অস্ফুট চিৎকার করে উঠেছিলাম।

আমি দৌড়ে গিয়ে লোক লজ্জা আর একাল সেকালের পরোয়া না করে ওকে ধরে ফেললাম, ধমক দিয়ে বললাম, ” কি করছেন? ”

খুব অবাক হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ” পানি দেখি। লাফ দিমুনা। আমার পেটে বাচ্চা আছে না? ”

আমি বন্ধ করে রাখা নিঃশ্বাস জোরে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম, ” ঠিক।ঠিক বলেছেন “।

সাধারণ অবস্থায় গ্রামের বধূকে এভাবে ধরে ফেলার অপরাধে এতক্ষনে কান্নাকাটি শুরু হয়ে যাবার কথা ছিল, অথচ উনি হেসে ফেললেন, ” আমার কাছে কি আপনার? যতখন বাড়িতে থাকেন, ঘুরঘুর করেন আশেপাশে।”

আমি বলতে চাইলাম, আমি ছোটবেলার মত খাওয়া শেষ করে আপনার আঁচলে মুখ মুছতে চাই দাদি। নামাজ না পড়ার জন্য বকা খেতে চাই। আর আপনার পেটের ছেলেটা যখন আমাকে বকে, আপনি তাকে বেশ করে ধমকে দেন, তখন আপনার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই।

উনি মনের কথা কতটা টের পেলেন জানিনা, নিজেই আবার বললেন, ” আপনেকে আমার কেন যেন ভাইয়ের মত মনে হয়।”

” তুমি তো আমাকে ভাই বলেই ডাকো বুড়ি ” মনের ভুলে বলে ফেললাম।

পুরোটা সে ধরলোনা, শুধু বুড়িটা শুনে নিয়ে হাসতে লাগলো, ” আমি বুড়ি? হিহিহিহি। কিছু খাইতে চাইলে বলবেন, আমি রান্না করে খাওয়াবো। ”

আমি হাসলাম, গ্রামের নারীদের ভালোবাসা প্রকাশের একমাত্র উপায় হলো রান্না করে খাওয়ানো। তখন খেয়াল করলাম, আমার অন্য একজন নারীর কথা মনে পড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের একটা অনুভূতি হওয়া শুরু করেছে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই, হায়রে জ্বালা!

তবে এর পরে থেকে দাদি বেশ সহজ হয়ে এলেন। কি আশ্চর্য কথা যে আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ আমাকে চিনতে পারলোনা, অথচ এই মহিলা, ঠিক ঠিক আমাকে একটু হলেও চিনতে পেরেছেন।

***

চেয়ারম্যান সাহেবের ছায়া হিসেবে খ্যাত কলিমের সাথেও আমি একটু বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠলাম। এই বাড়ির বাজার সদাই করা হয় একটু দূরের বাজার থেকে, সেই বাজারের কাছে ঢাকায় যাবার বাস থাকা সম্ভব, এমন শুনেছি বহুবার। আমি যেচে পরে কলিমের সঙ্গী হলাম এবারে।

বাজারটা একটু দূরেই, সুতরাং লোকটার সাথে গল্প করার সুযোগ রয়েছে, আমি সবচেয়ে সহজ পথটাই বেছে নিলাম, ” কলিম ভাই, বিয়ে করেছেন? ”

আমি যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি সফল হলাম। তার মুখে যে হাসিটা দেখলাম এই প্রশ্নের পরে, তাতে না চাইতেই আমিও হেসে ফেললাম। সে লাজুক হেসে বলল, ” না।”

আমি হো হো করে হেসে ফেললাম, ” কিন্তু করতে চান, তাই তো? ”

কলিমের ভাবমূর্তি বেশ কঠিন ধরণের, চেয়ারম্যানের চামচা বা ছায়া বলে তার বিশেষ খ্যাতি বা কুখ্যাতি আছে। তার চেহারা সবসময়েই গম্ভীর থাকে, তাকে দেখলে মনে হয় যে কোন মুহূর্তে যে কাউকে পিটিয়ে শুইয়ে দিতে পারে। অথচ সে নরম কণ্ঠে বললো, ” আসছে মাসেই করার ইচ্ছা। আম্মা আব্বা গেসিলো তাঁদের বাড়ি পস্তাব নিয়া। রাবেয়া বলছে…. ” আমার দিকে অদ্ভূতভাবে তাকালো, ” আপনারে নিয়া যাইতে “।

” আমাকে? ইয়া আল্লাহ কেন? ”

জানা গেলো, আমার গাছের নিচে বসে থাকার ব্যাপারটা গ্রামে ছড়িয়ে গেছে, শুধু রাবেয়া কেন, বাকি আরো অনেকের ধারণা হয়েছে আমার মধ্যে অদ্ভুত কিছু আছে। আমার একটু মন খারাপ হয়, আমার মধ্যে যদি বিশেষ কিছু থাকতো, আমি শেফালীর অপমান হতে দিতাম না।

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, গরুর গাড়ির নিচে হারিকেন ঝুলিয়ে আমরা ফিরছি। মিটিমিটি আলোয় গ্রামের পথে চলতে আমার বেশ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে সত্যিই নতুন জীবনটাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।

” আপনি চেয়ারম্যান সাহেবকে খুব পছন্দ করেন, তাই না? ”

” হ্যাঁ। উনি আমার বাপের সমান”।

” কারণটা কি বলেন তো? ” আমি জানতে চাই।

” আমার জন্মের সময় আম্মা মরতে নিসিলো, উনি জোর কইরা মফস্বলে নিয়া বাঁচাইসে তারে। এই গল্প ছোটকাল থেকে শুইনা আসছি। তারপর বড় হইয়েই ওনার সঙ্গে জুইড়া গেলাম। খারাপ কিছু তো দেখিনাই। আর সবার কথা বাদ থাক, আমার বোনটারে বিয়া দিলো উনি, জামাইরে দোকান কইরা দিসে পাশের গ্রামেই। আমারে এতো ভালো পায়, নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালো পায়। আমি জানি উনি বললে আমি জান দিয়া দিতে পারি ”

” আর গ্রামের মানুষ? ভালোবাসে ওনাকে? ”

” যারা ভালো পায়, তারা খুবই ভালো পায়। যারা পায়না তারা পায়না। উনি কিন্তু যারা তারে ঘিন্না করে, তাদের বিপদেও বুকটা পাইতা দেয়। দেশে দুর্ভিক্ষ নামতেসে শুনি, দেখেন আমরা কিন্তু ভালোই আসি। সব উনার জন্য।”

আমি কিছুক্ষন চুপ করে থাকি, কয়েকটা হিসাব মিলাতে তবু কষ্ট হয় আমার, বলি, ” যুদ্ধের সময়…

” হা উনি অস্ত্র হাতে নিয়া মাঠে নামেনাই, নিজামুদ্দিন সাহেব নামসিলো। কিন্তু ওনার ভয়ে হানাদাররা এই গ্রামের তেমন ক্ষতি করতে পারেনাই। হা ছিল কয়েকজনের সাথে উনার খাতির, উনি তাদেরকে বলসিলেন, তোমরা যা করার অন্যদিকে গিয়া কোরো। আমার গ্রামে হাত দিতে পারবানা। ”

” ক্ষতি একদম হয়নাই সেটা কি ঠিক? মিলি? ”

কলিম এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, ” ওইটা যে কেমনে হয়া গেল। কপাল। কিন্তু ওরে জীবিত ফেরৎ আনসে কিন্তু আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবেই “।

” আর নজরুল? ”

” এইটা একটা সমস্যা। উনি ছেলেরে কিছু বলতে পারেনা। কতবার আমার সাথে কান্দে, বলে কলিম, একটা ছেলে মানুষ করতে পারলাম না। কিসের ভালা মানুষ আমি?”

***

” কালকে আমারে আবার দেখতে আসবে ” বলে মিলি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। ওর হাসি ভীষণ সংক্রমক, আমিও হাসতে লাগলাম।

” পাত্র মনে করেন আব্বার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ” ওর মুখ এখনো হাসি হাসি, ” আপনার সমান ছেলেমেয়ে হবে আমার “।

আমি আবারো অবাক হলাম, গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে, অথচ কি সুন্দর ব্যঙ্গ করে কথা বলতে জানে ও। গলা খাকারি দিয়ে বললাম, ” কেউ আসবেনা। চিন্তা কোরোনা”।

” কি করবেন? ”

” হাত পা ভেঙে রাস্তায় ফেলে রাখবো ” আমি অর্থহীন প্রগলভ কথা বলতে শুরু করেছি, আমি টের পাই, কিন্তু আটকাতে পারিনা। এখানে এলে আমার যুক্তি তর্ক খুব একটা কাজ করেনা।

মিলি কিন্তু বিশ্বাস করলো, মুহূর্তেই সত্যিকারের সরল গ্রামকন্যা হয়ে বললো, ” সত্যিই? তাইলে আমার পালানোর দরকার নাই? ”

” নাহ। একদম না ”

***

তাসের আড্ডায় আমার নতুন বন্ধু জামরুল আর তার ছোটভাই আমিরুল। দুজনেই ভীষণ দুষ্ট আর ভীষণ চঞ্চল। সকালে আমি ওদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। আমাকে দেখলে ওরা খুশি হয়, ঢাকার মানুষ তাদের বন্ধু, ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে ওরা।

ওদের বাড়ির একটু দূরে গিয়ে আমরা বসলাম। এরা পাতার বিড়ি খেয়ে নিজেরাই কাশতে থাকে খক খক করে, আমি সময় নস্ট না করে বললাম, ” জানো পাগলা ঘটক আবার মিলির জন্য পাত্র আনছে? ”

ওরা হিহি করে হাসে, ” হেরে যে বিয়া করবো তার কপালে দুঃখ আছে। এমনেইতো ক্যাম্পের মেয়ে তারপর পাগলা। রাত বিরাতে ঘুরে, একা একা কথা বলে “।

আমার হাত নিশপিশ করে ঘুষি মেরে ওর নাক ফাটিয়ে ফেলতে কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ” আজকে বিকালে আসবে। এইগুলা তাদের গিয়া বলতে পারবানা? মনে করো, ঘোরে ঢুকার আগেই? ”

ওরা দুজন আরো খুশি হয়ে গেলো। কোন কারণ ছাড়াই মানুষ মানুষের চরিত্রের খারাপ দিকটা বের করতে পারলে খুশি হয়, আর এরাতো আমাকে ভাবতো বিশেষ কিছু, তাই আনন্দ লুকাতে পারলোনা।

” কাজ হইয়া যাবে ভাই। কেউ যাবেনা ওগো বাড়ি ”

আমি জানি কাজ হবে, তাই নিশ্চিত মনে হাঁটতে শুরু করি। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ওটা কি বললো ছেলেগুলি? ওকে যে বিয়ে করবে তার কপালে দুঃখ আছে? কি আশ্চর্য এই কথাটা আমার আগে মনে হলোনা কেন? আমি কি আমার কপালে সেই দুঃখটুকু চাইতে পারিনা?

আচ্ছা তাহলে আমরা থাকবো কোথায়? মিলিকে আমি খাওয়াবো কি? আর ওর যে কলেজে পড়ার এত ইচ্ছে তার কি হবে? চমকে উঠলাম।আমার সময়ে এই বয়সে আমি বিয়ের কথা ভাবতে পারতাম? কারো দায়িত্ব নেবার কথা?

আমিতো রোজ বাইরে থেকে ফিরে সোফার উপর পরনের কাপড় ছুড়ে ফেলতাম। আবার সেই আমি সকালে বাড়ি মাথায় তুলতাম বাইরে যাবার ভালো জামা না ধোয়া থাকলে! আমিতো ক্ষুধা পেলেও মার সাথে রাগ করতাম, আগেই কেন খাইয়ে দিলোনা! প্রতিদিন পকেটের শেষ পয়সাটা শেষ করে বাড়ি এসে মাকে বলতাম, মা রিকশা নিচে দাঁড়িয়ে, ভাড়াটা পাঠাবার ব্যবস্থা করো। এই কয়েকটা মাস আমাকে এতো বদলে দিলো কিভাবে?

***

কলিম বিয়ে করতে চায়, এই সংবাদে চেয়ারম্যান সাহেব বাচ্চাদের মত খুশি হয়ে গেলেন। প্রথমে তো হা হা করে হাসলেন কতখন, পানের পিক চিবুক বেয়ে পরছে, খেয়ালই করলেন না। তারপর ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

জানা গেলো, বোনের বাড়ি ঘুরতে গিয়ে পাশের গ্রামের রাবেয়াকে তার মনে ধরেছে, রাবেয়াও নিমরাজি। কলিম লজ্জিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই চেয়ারম্যান একে ওকে ডেকে দুটো খাসি জবেহ করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। এমনকি দুই দিনের পরিচিত আমি, আমাকে বললেন, ” তুমি ঝিনাইদহ শহরে যাও। শাড়ি ফারি যা লাগে কিনা আনো। তুমি ঢাকার মানুষ, ভালো জিনিস কিনতে পারবা। টাকার চিন্তা আমার”।

শাড়ি কেনার কথায় কেন যেন আমার খুব লজ্জা লজ্জা করতে লাগলো। আমি ততক্ষনে মিলিকে কি রঙে মানাবে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। আমি ওর জন্য চুড়ি ও কিনবো, এক গাদা কাঁচের চুড়ি, পৃথিবীতে যত রঙ আছে সব রঙের। আর নুপুর কিনবো, নুপুর গুলি আমি নিজ হাতে ওর পায়ে পরিয়েও দেবো।

ভাবনায় ছেদ পরলো, কলিম বলছে, ” চাচা পাগল হইসেন কেন? এতো তাড়াহুড়া নাই তো ”

” আরে ব্যাটায় কয় কি? জোয়ান মানুষ, অবশ্যই তাড়াহুড়া আছে ” এই বলে তিনি ঠা ঠা করে হাসতে লাগলেন।

***

পুরো দিনটা ঝিনাইদহ শহরে কাটালাম একদিন, আমার সাথে কলিম ভাই। দুজন মানুষের পছন্দে কত পার্থক্য থাকতে পারে, হাড়ে হাড়ে টের পেলাম সেটা। আরো যে জিনিসটা আমাকে প্রচন্ড নাড়া দিয়ে গেলো, সেটা হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা।

আমি আসলে অন্য কারো জন্য খুব শখ করে কখনো কিছু কিনিনি আগে। নিজের জন্য কিনেছি, শার্ট প্যান্ট ঘড়ি, পাঞ্জাবী এইসব হাবিজাবি। অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হয়েছে, জানা নেই।এক বন্ধু জন্মদিনে দাওয়াত করেছিল একবার, মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওকে দিয়ে বলেছিলাম, কিনে নে। তার ওপর আমার জীবনে একমাত্র নারী ছিলেন আমার মা, তাকেও যে প্রয়োজনীয় বা শখের জিনিস কিনেই নিতে হয়, এমন ভাবনাই মাথায় আসেনি আগে, শখ করে কিনে দেয়া তো অনেক দূরের কথা।

এই মুহূর্তে মায়ের অভাব হঠাৎ প্রচন্ড হয়ে উঠলো, তাকে একবার দেখার জন্য মনটা হাহাকার করছে। মা বলতো, আমার রাজপুত্রের মত ছেলে, ওর জন্য রাজকন্যা আনবো একদিন। রাজকন্যা না, অজপাড়া গাঁয়ের নিপিড়িত একটা মেয়েকে আমি আমার পুরো সত্ত্বায় স্থান দিয়েছি, জানলে মা কি খুশি হতেন? আচ্ছা মা তো এখনো জন্মই নেননি!

মার কথা ভেবে যখন সন্তর্পনে চোখ মুছছি, দেখলাম কলিম ও চোখ মুছছে। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ” কলিম ভাই? ”

” চেয়ারম্যান চাচা” সে বললো ধরা গলায়, ” আমার উনাকে বাপ ডাকতে ইচ্ছা করে “।

যা হোক অবশেষে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কিছু অর্থ ধার করলাম। ধার বলছি, কারণ আমার পুরোপুরি ইচ্ছে আছে শোধ করার। বুঝতে পেরে গেছি যে আমাকে কাজ করতে হবে।

***

সবসময়ের মত আমার সব গল্প মিলিদের পুকুর পাড়ে এসে থামে। আজও তাই। আমি কমদামি শাড়ি আর চুড়ি হাতে করে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। দুই একটা মশা যে বিরক্ত করছেনা তা নয়, আমি ওদের উপেক্ষা করে মনোনিবেশ করেছি জোনাকি পোকায়। কি সুন্দর আলোর নাচানাচি! ঢাকা শহরের সোডিয়াম লাইট এর কাছে কিছু না।

” আপনের ঘুম নাই? রোজ রোজ এইখানে আইসা বইসা থাকেন? ”

” যতদিন তোমার ঘুম নেই, ততদিন আমারো ঘুম নেই। একদিন আমার পাশে তুমি শান্তিতে ঘুমাবে, সেদিন আমিও ঘুমাবো। ”

মিলি অবাক হয়ে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল, হাত দিয়ে চেপে রেখেছে মুখ, আমি সেই হাত সরিয়ে নিজের মুঠোয় নিলাম, ” আমাকে বিয়ে করবে? ”

” আপনার মাথা খারাপ হইসে। আপনি জানেন আমি….

” হুশ। তোমার জন্য শাড়ি কিনেছি মিলি। আর চুড়ি। দেখো তোমার ভালো লাগে কিনা ”

হারিকেনের আলোয় মিলি অনেক সময় নিয়ে দেখলো, শাড়িটি বুকের কাছে ধরে রেখেছে। আমি জানি ওর কান্না পাচ্ছে, কিন্তু কি ভীষণ শক্ত আর অদ্ভুত মেয়েটা, কোনোভাবেই কাঁদবেনা! দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে।

আমি হেসে উঠলাম, ” কান্না আসলে কাঁদতে পারো। আমিই তো! আমার সামনে এত ভান করতে হবেনা “।

” কালকে আলো থাকতে আইসেন। নাইলে শাড়ি চুড়ি পরলে দেখবেন কেমনে? ”

” আমি একটা কাজ যোগাড় করবো। তারপরে তোমার বাবাকে বলবো। ঠিক আছে? ”

” আচ্ছা ” সে হাসলো। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য সেই হাসিতে দেখলাম আমি, আমার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি খুব শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরি, আর অনেক অনেক আদর করি। কিন্তু আমি তা করবোনা। শরীর নিয়ে ওর মনে ভয় আছে, আমি সেখানে বেপরোয়া অনুপ্রবেশ করবোনা। এখন শুধু মানুষটাকেই ভালোবাসবো, আর কিছু ভাববো না।

” আপনি শুধু মুখে বলেন, আসলে আমাকে আপনার ঘিন্না করে, আমি বুঝি ”

” তবু এমন কথা বলতে পারলে? ” মনমরা হয়ে যাই, আর কিভাবে ওকে বুঝাতে পারি?

” নাইলে তো কাছে আইসা বসতেন। এত দূরে বসে কেউ? ”

আমি সাত আকাশের উপরে উড়তে শুরু করলাম।

আগের পর্ব

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1677832326065121/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here