ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ২২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
সকালে রোদের আলো চোখে পরতেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। কাল রাতে অনেক ক্লান্ত থাকায় বেশ গভীর ঘুভে তলিয়ে গেছিলাম। রোদের তাপে বেশ বুঝতে পারছি যে বেলা হয়ে গেছে অনেক। কেউ এখনও আমায় ডাকলোনা কেন? একটা ছোট্ট হাই তুলে উঠে বসে আড়মোড়া দিয়ে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলাম। এতই চমকালাম যে লাফানোর স্টাইলে পিছিয়ে গেলাম। নিজের দুচোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? আদ্রিয়ান আমার পাশে বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখছে। একটা কালো রং এর চিকন স্লিভস এর গেঞ্জি, আর কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছেন। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, চোখেমুখে একরাশ ক্লান্তির ছাপ।নিশ্চিয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি। নইলে এটা কীকরে সম্ভব? আদ্রিয়ান এখানে কীকরে আসবেন? আর কেনই বা আসবেন। আমি প্রথমে চোখ কচলে দেখলাম যে না সেই একই দৃশ্য, এবার হাতে হালকা করে চিমটি কাটলাম। আর মুখ দিয়ে হালকা “আহ” টাইপ শব্দ করে উঠলাম। আমার এমন আওয়াজে উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে। ওনাকে দেখে হালকা চমকে উঠলাম আমি। ওনার চোখ মুখ সব লাল হয়ে আছে। দাঁড়িগুলো একটু বড় হয়েছে। এই দুদিন সেভ করেন নি নাকি? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ফোনটা রেখে। বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
— ” ওহ ম্যাডাম তাহলে উঠে গেছেন নাকি? আপনারই ওঠার অপেক্ষা করছিলাম।”
বলে উঠে গিয়ে দরজাটা লক কর দিলেন। আমি এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম। উনি দরজা বন্ধ করা মানেই আমার বারোটা বাজাবে। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
— ” অ্ আপনি এখানে? আপনি এখানে কী করছেন হ্যাঁ? কেনো এসছেন এ বাড়িতে ? কী চাই?”
উনি আমার কথাটা শুনে ঠোঁট কামড়ে ধরে আমার চোখ সরিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” আরে বাহ। মুখেতো বুলি একেবারে খইয়ের মতো ফুটছে।”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ওনার চোখে মুখে তীব্র রাগ স্পষ্ট। তাই ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস করে উঠতে পারলাম না। উনি আমার কাছে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন,
— ” কার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে এখানে এসছো তুমি?”
আমি মাথা তুলে ওনার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি এবার আগের থেকে একটু উচ্চস্বরে বললেন,
— ” কী হলো বলো? আমাকে কিচ্ছু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে চলে এলে তাও একা একা। তারপর এখানে চলে এসছো সেটা নিজেতো আমাকে জানাওই নি। উল্টে নিজের বাবা মাকে বলে এসছো ভুল করেও যাতে আমায় না জানায় তুমি কোথায় এসছো? সিরিয়াসলি? ভাগ্যিস বউমনি আমায় বলল যে তুমি এখানে থাকতে পারো। নইলে এতক্ষণে মেন্টাল হসপিটালে থাকতাম আমি।”
আমি ওনার দিকে আর তাকানোর সাহস পাচ্ছিনা যেভাবে রেগে আছেন না জানি কী করে বসেন। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু হাত কচলে যাচ্ছি। উনি এবার বেড থেকে আমার ফোনটা তুলে হাতে শক্ত কন্ঠে বললেন,
— “ফোন সুইচড অফ করে কেনো রেখেছিলে হ্যাঁ? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া কতোবার কল করেছি তোমায় আমি? তোমার সাহস কীকরে হয়।”
বলে ফোনটা ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দিলেন। ওনার আচরণে যথেষ্ট ভয় পেলেও মনের মধ্যে একটু সাহস জুগিয়ে হালকা তুতলিয়ে বললাম,
— ” অ্ আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই এসছি। আপনা..”
কথাটা শেষ করার আগেই।আমার হাত ধরে এক টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে গিয়ে কোমর খুব জোরে চেপে ধরে দাঁতেদাঁত চেপে বলল,
— ” খুব বেশি ইচ্ছে হচ্ছে তোমার আজকাল? ডানা গজিয়ে গেজে? তোমার যা ইচ্ছে হবে করবে তাইনা? কানের নিচে জোরে কয়েকটা পরলে সব ইচ্ছে বেড়িয়ে যাবে। এতো সাহস তোমার যে আমাকে কিচ্ছু না জানিয়ে এখানে চলে এসছো?”
আমি এবার নিজের ভয়টাকে দমিয়ে দিয়ে ওনার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে বললাম,
— ” কেনো বলবো আপনাকে? কে হন আপনি আমার? কীসের জোর খাটাচ্ছেন আমার ওপর?”
উনি ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আরেকহাত আমার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
— ” অা’ম ইউর হাজবেন্ট। স্বামী হই আমি তোমার। বিয়ে হয়েছে আমাদের। তোমার ওপর সমস্ত রকমের জোর খাটানোর অধিকার আছে আমার। আর সবকিছুই তোমার আমার সাথে ডিসকাস করেই করা উচিত।”
আমি ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
— ” অধিকার নয়। বলুন দায়বদ্ধতা। আমাকে সবাই জোর করে আপনার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে তাই হয়তো আপনি নিজের দ্বায় সারতে চাইছেন? আমি আপনার দায়িত্ব তাই এখানে দেখতে এসছেন আমি ঠিক আছি কী না তাইতো? যদি সেটাই হয় দেন ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আপনাকে এই দায় থেকে মুক্ত করে দিলাম। আজকের পর আপনাকে আর আমায় নিয়ে ভাবতে হবেনা। আপনি আপনার মতো ফ্রি লাইফ লিড করতে পারেন।”
বলে আমি ওনার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে উনি আমায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
— ” একলাইন বেশি বেশি না বুঝলে তোমার হয়না তাইনা?”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
— ” বেশি বুঝেছি তাও আমি? কিন্তু এজ পার আই নো। আমি কোনোকিছু বেশি বা কম বুঝিনি। আমি সেটুকুই বুঝেছি যেটুকু আপনি আমায় বলেছেন। আপনি বলেননি আমি শুধুই আপনার দায়িত্ব? বলেন নি যে আমার জায়গায় অন্যকেউ মানে আপনার পছন্দের কেঊ থাকলে আপনি এরকম করতেন না। তাহলে আপনার দয়া নিয়ে কেনো থাকবো আমি আপনার কাছে? আমার কী কোনো সেল্ফরেস্পেক্ট নেই?”
কথা গুলো বলার সময় আমার গলা ধরে আসছিল। আর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কেঁদে দিয়েছি আমি। উনি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে তারপর মুচকি হেসে আলতো হাতে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে আমার দুই বাহুতে হাত রেখে বললেন,
— ” বলেতো ছিলাম ঠিকই। কিন্তু কী বলোতো? এখন ভেবে দেখলাম বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন আর এসব করে কী লাভ? এরকম.. কী জেনো বলো তুমি? হ্যাঁ সুইট কিউট ভোলিভালি একটা বউ যখন পেয়েছি তখন আর নো ছাড়াছাড়ি। সোজা তুলে নিয়ে গিয়ে বুকের পিঞ্জিরায় বন্দি করে রেখে দেবো।”
আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কী বলতে চাইলেন উনি? উনি কী সত্যিই আমায় মেনে নিতে চাইছেন? নাকি এটাও দায়বদ্ধতা মনে করেই করছেন? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,
— ” এবার যাও তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পরবো।”
আমি কিছু একটা ভেবে হকচকিয়ে বললাম,
— ” নাহ আমি কোথাও যাবোনা। আপনি চলে যান।”
উনি ওনার সেই বিখ্যাত স্টাইলে ভ্রু বাকিয়ে বললেন,
— “যেতে তো হবেই বেইবি। সেটা আজ যাও বা কাল। তুমি যদি তোমার মামাবাড়িতে কয়েকটা দিন বেড়াতে চাও তো বেড়াও কে বারণ করেছে? কিন্তু আমিও আমিও আমার মামা শশুর বাড়িতে ততোদিন থাকবো যতোদিন আমার বউ থাকবে।”
আমি বিরক্তি নিয়ে কোমরে দুই হাত রেখে বললাম,
— ” নতুন করে কী ড্রামা শুরু করলেন বলুন তো? মতলব কী আপনার?”
আদ্রিয়ান আমার চুল নেড়ে দিয়ে বললেন,
— ” মতলব তো অনেক কিছুই। কিছু বাকিটা রাতে বলবো। আপাতত চলো খিদে পেয়েছে কাল রাত থেকে না খেয়ে আছি জানো? প্লিজ বাকি প্রশ্ন পরে করো এখন খেতে চলো। ”
উনি না খেয়ে আছে শুনে একটু খারাপ লাগলো। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ডাইনিং এ গেলাম।
____________________
ডায়নিং টেবিলে মুখ ফুলিয়ে বসে বসে ব্রেকফাস্ট করছি আমি। আদ্রিয়ান আমার পাশেই বসেছেন। মামী বলল,
— ” বাপরে বাপ। কী বউ পাগল ছেলে রে বাবা।একটা রাতের জন্যেও বউকে ছেড়ে থাকতে পারলোনা? জানিস সেই ফজরের আজানের সময় এসছে এখানে। আরে সকালেও তো রওনা দেওয়া যেতো তাইনা। কিন্তু না পাগল ছেলে রাতেই বেড়িয়ে গেছে।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। ভোররাতে এসে পৌছেছে এখানে পাগল নাকি ছেলেটা? নানু বলল,
— ” কীরে অনু আমার নাতজামাই তো তোকে চোখে হারায়। এমন করে একা ফেলে চলে এলি? বেচারা একটা রাতও থাকতে পারেনি দেখলি।”
আমি কিছু বলল তার আগেই আদ্রিয়ান,
— ” আসলে কী বলোতো সুইটহার্ট ? তোমার নাতনি একটু বেশিই বাচ্চা। একটু বেশিই বোঝে। দেখো আমি ওর মন মতো একটু কাজ করতে পারিনি তাই বলে আমার মতো একটা অসহায় অবলা ছেলেকে একা ফেলে চলে এল।”
আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি অসহায়? অবলা? আর এখন সব দোষ এই নন্দ ঘোষের? বাহ রে ভাই বাহ। আর কী কী দেখতে হবে। নানু বলল,
— ” অনু এটা কিন্তু একদম ঠিক করোনি তুমি। ছেলেটার সারারাত জেগে চোখ মুখের কী অবস্থা হয়েছে দেখো?”
মামা হেসে বলল,
— ” আমিতো আগেই বলেছিলাম নিশ্চয়ই তোমার নাতনি ছেলেটার সাথে ঝগড়া করে এসছে। তাইতো ওই মাঝরাতেই ছেলেটা চলে এলো”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” কে বলেছে কে আসতে? চলে যেতে বলোনা? আমি এখান থেকে যাবোনা। আর আমি আমার মামা বাড়িতে কতোদিন থাকবো সেটা আমার চয়েজ। উনি বলার কে?”
আদ্রিয়ান খাবার চিবুতে চিবুতে বললেন,
— ” হ্যাঁ আমিও থাকছি তাহলে?”
— ” কেনো আপনি কেনো থাকবেন?”
উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
— ” আমি আমার মামাশশুর বাড়িতে কতোদিন থাকবো সেটা আমার চয়েজ। তুমি বলার কে? রাইট সুইটহার্ট?”
নানু হেসে বললেন,
— ” একদম। তোমারও তো পুরো হক আছে।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম দুজনের দিকে। সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, মামা, মামী নানু সবাই মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। আদ্রিয়ানকে ভালো ভালো বেড়ে খাওয়াচ্ছে আর সে আরাম করে খাচ্ছেন। পুরো দমে জামাই আদর যাকে বলে সেটাই হচ্ছে। অথচ আমার ভ্যালুই নেই? আমি ভ্রু কুচকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি। আজব! তাছাড়া করবে না কেনো? মহান কাজ তো। সারারাত না ঘুমিয়ে জার্নি করে ভোররাতে বউয়ের কাছে চলে এসছে? এটাতো সম্রাট শাজাহানের তাজমহল তৈরীর চেয়ে কোনো অংশে কম কিছু মোটেই না। আহা! কেমন একটা মমতাজ মমতাজ ফিলিংস আসছে। যদি আমার মামার বাড়ির লোকেরা ঐতিহাসিক হতেন তাহলে নিশ্চিত আজকের এই ঘটনা নিয়ে তারা ইতিহাস রচনা করে ফেলতেন। এটা সত্যিই এক ঐতিহাসিক কান্ড। ফিলিং প্রাউড। হুহ যত্তোসব ধপের চপ। ডিসগাস্টিং।
#চলবে…
( রি-চেইক করার সময় হয়নি। টাইপিং মিস্টেকগুলো কষ্ট করে বুঝে নেবেন।)