কিছুদিন ধরে খেয়াল করছি আমার শাশুড়ি বেশ অসুস্থ বোধ করছে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনা আবার মাঝে মাঝে বমিও করছে। প্রেসার ডায়াবেটিসের রোগী হয়তো ডায়বেটিস বা প্রেশার বেড়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে রান্না রুম থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি মা রান্না রুমের মেঝেতে পড়ে আছে তাড়াতাড়ি করে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বললাম,
– আম্মা শরীর কি বেশি খারাপ করছে?
– হ্যাঁ মা, আজ আমার শরীরটা একটু বেশিই খারাপ লাগছে।
– মা বাবাকে কল করে বাবাকে আজ অফিস না করে বাসায় চলে আসতে বলি?
– না মা থাক আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি শুনলে তখন তাড়াহুড়ো করে তোমার বাবা ছুটে চলে আসবে। তার চেয়ে আমাকে বরং রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসো একটু রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
শাশুড়ি মাকে ধরে নিয়ে উনার রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললাম আপনি আর উঠবেন না। কোন কিছু লাগলে বা দরকার হলে আমাকে বলবেন আমি এসে দিয়ে যাব। মা বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে যাও কিছু লাগলে আমি ডাক দিব।
মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে এসে রবিনকে একটা কল দিলাম। কল দিয়ে সবটা বললাম মায়ের পড়ে যাওয়া মাথা ঘোরা এগুলো সবই বললাম। সব শুনে রবিন বলল,
– আসলে ভুলটা আমাদেরই ছিল মাকে আরো আগে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার দরকার চিলো কিন্তু আমরা তা নেইনি সময়ই বের করতে পারিনা কোনোভাবে। বেশ কিছুদিন ধরেই তো দেখছি মা অসুস্থ বোধ করছে। কিন্তু আমরা অবহেলা করে গেছি।
– রবিন, আমি তো সেদিন মাকে বলেছিলাম যে
মা!
বাবা বা রবিন কেওই তো সময় করে উঠতে পারছেনা চলুন আমি আপনাকে নিয়ে যাই ডাক্তারের কাছে কিন্তু মা ই তো যেতে চাইলেন না।
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি কি করা যায়। বাবার সাথে কথা বলে দেখি আজ বাবা অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়ে মাকে নিয়ে না হয় ডাক্তারের কাছে যাবে। আমার বিকেলে একটা মিটিং আছে মিটিং শেষ করে বাসায় আসছি।
– আচ্ছা আমি রাখছি তুমি বাবার সাথে কথা বলে দেখো বাবা কি বলেন।
রবিনের সাথে কথা শেষ করে মোবাইলটা রাখতেই কিছুক্ষণ পর দেখি বাবা মানে আমার শ্বশুর মশাই কল করেছে। ওপাশ থেকে…
– বৌমা!!
– হ্যাঁ বাবা বলেন।
– রবিন কল করেছিলো তোমার মা নাকি আজ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল?
– হ্যাঁ বাবা মা আজ পড়ে গেছে।
– ব্যাথা পেয়েছে নাকি কোথাও?
– না বাবা সেই ভাবে ব্যাথা পাইনি কোথাও।
– বৌমা তুমি কি এখন ফ্রি আছো? যদি ফ্রী থাকো তাহলে তোমার মাকে নিয়ে হসপিটালে চলে যাও আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাখছি তোমরা গেলেই দেখে দিবে।
– হ্যাঁ বাবা আমি এখন মোটামুটি ফ্রী।
– তাহলে আর দেরি করোনা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো।
– ঠিক আছে বাবা।
– তোমার মায়ের কাছে টাকা রাখা আছে মনে করে নিয়ে যেও।
– আচ্ছা বাবা।
ওহহহো আমার পরিচয়টা তো আপনাদের দেওয়াই হয়নি। আমি সোহেলী রহমান। আমরা দুই বোন ভাই নাই। আমি বড়ো ছোটো বোনটা এবার এইস এস সি দিবে। আমি মাস্টার্স শেষ করে জব করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে। কিছুদিনের মাঝে রবিনের সাথে বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের পর শাশুড়ি মা বললেন মা তুমি চাইলেই বাইরে চাকরি করতে পারো কিন্তু মা তোমার বাবা তো চাকরি করে বাইরে বাইরে থাকলো আর আমিতো সারাজিবন একাই কাটিয়ে দিলাম তুমি যদি চাও তাহলে বাইরে চাকরি না করে আমার ঘরে বসে আমার সাথে গল্প করার চাকরিটা নিতে পারো।
সেদিন মায়ের কথা শুনে মুচকি হেসে বলেছিলাম আচ্ছা মা আমি না হয় আপনার সাথে গল্প করার চাকরিটাই নিলাম বলেই মা মেয়ে শব্দ করেই হেসে উঠলাম। বিয়ের আগে রাবিনের সাথে তেমন একটা কথাবার্তা হয়নি কেও কাওকে সেইভাবে চেনা-জানাও হয়েছিলনা।এক প্রকার হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়ে গেছিলো। তবে রবিন মানুষটা বেস্ট। জীবন সঙ্গী হিসাবে সে একজন পার্ফেক্ট মানুষ। রবিন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে।
মায়ের বিয়ে অনেক বছর রবিন জন্ম নিয়েছিলো। আরেকটা বাচ্চার খুব ইচ্ছে ছিলো মায়ের। পরবর্তীতে আরেকটা বাচ্চা নেয়ার অনেক চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ পাক সে আশা পুরোন করেননি। কিন্তু এখন মাকে দেখলে মনে হয় আমার বিয়ের পর মা যেনো আমাকে পেয়ে উনার আরেকটা সন্তানের দুঃখটা একটু কমেছে। আমিও আমার মত করে চেষ্টা করি যতটা পারি ভালোবাসা আর সময় দিয়ে আগলে রাখতে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি মা শুয়ে শুয়ে কি যেনো ভাবছে আনমনে ডেকে বললাম ….
– মা! উঠুন রেডি হয়ে নেন বাবা রবিন দুজনেরই আসতে অনেক দেরি হবে। আমি আপনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
– আবার ডাক্তার কেনো? হয় প্রেসার বেড়েছে না হয় ডায়বেটিস ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। লাগবেনা ডাক্তারের কাছে যাওয়া।
– মা আপনি প্রায় ২০/২৫ দিন ধরে একই কথা বলে চলেছেন। আর কোনো কথা শুনাবোনা উঠুন এবার অনেক হয়েছে।
রীতিমত জোর করেই মাকে রেডি করিয়ে রেখে আমি রেডি হয়ে এসে দুজন বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় এসে একটা রিকশা নিয়ে হসাপাতালে পৌঁছালাম। হাসপাতালে বাবা আগেই সিরিয়াল দিয়ে রেখেছিলো তাই আর গিয়ে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। মাকে নিয়ে ডাক্তারের সামনে বসে আছি। ডাক্তার মাকে কিছু প্রশ্ন করে তিনি কেমন যেনো একটু আনমনা হয়ে গেলেন। ডাক্তার বাবার পূর্ব পরিচিত তাই কোনো দ্বিধা না রেখেই বললাম,
– আঙ্কেল কি বুঝলেন? মায়ের কি সমস্যা?
– আঙ্কেল আমার দিকে কেমন যেনো চুপ হয়ে আছে, একটা সময় তিনি বললেন আগে কিছু টেস্ট করাতে হবে তারপর বোঝা যাবে আসলে সমস্যা কি। আমি কিছু টেস্ট লিখে দিচ্ছি ওগুলো করিনে আনো।
আমার মনের মধ্যে অজান ভয় কাজ করতে শুরু করলো আঙ্কেল এমন চিন্তিত কেনো মায়ের কি হয়ছে? মায়ের খারাপ কিছু হয়নিতো? এসব ভাবতে ভাবতেই টেস্টের কাগজ গুলো হাতে নিয়ে মাকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে ল্যাবের দিকে গেলাম। সব টেস্ট করিয়ে অপেক্ষা করছি রিপোর্টের।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর চেম্বার থেকে এক নার্স বেরিয়ে এসে বললো স্যার আপনাদের ডাকছে ভিতরে। আমি মাকে সাথে করে অনেকটা ভয় আর আতংক নিয়ে ভিতরে গিয়ে বসলাম। ডাক্তার আমার হাতে রিপোর্টগুলো ধরিয়ে দিয়ে চুপ করে রইলেন। রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। রিপোর্ট হাতে নিয়ে সবটা পড়ে আমিও দাঁড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়লাম মায়ের পাশে রাখা চেয়ারটাতে।
চলবে…..
#শেষ_বয়সের_প্রাপ্তি
পর্বঃ ১
লেখনিঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)