নেশা #পর্ব_০৮ #Sumaya_Tabassum_Kotha

0
1071

#নেশা
#পর্ব_০৮
#Sumaya_Tabassum_Kotha

” আপনি আমাকে আটকে রেখে গিয়েছিলেন কেনো? আমি কি মানুষ নাকি জীব-জন্তু? এভাবে আটকে রেখে যেতে হবে কেনো?
রাতে অফিস শেষে নির্ঝর বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে তৃষ্ণা রাগি দৃষ্টিতে কথাটা বললো।

— তুমি নিজে বোকা নাকি আমাকে বোকা ভাবো বুঝি না!

— মানে? কি বলতে চাইছেন?

— তোমার কি মনে হয়? এই বাড়ি থেকে যেখানে একটা পাখি আমার অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না,, সেখানে তুমি তিনদিন একা বের হয়েছো, সেটা আমি জানি না!

উনার শান্ত কন্ঠের ভয়ানক কথায় আমার আত্মার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

— কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি ককোথায় যাই? এএকদিনই পপালিয়ে ছিলাম।

— লাইক সিরিয়াসলি! এতোটা বোকা মনে হয় তোমার আমাকে? তৃষ্ণা আমি এতোটাও বোকা নই। মানুষ চেনার দক্ষতা আগে ছিল না। কিন্তু এখন আমি ঠিক চিনতে শিখেছি সবাইকে। শপিং এর বাহানায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে দশ লাখ টাকা কাকে দিয়েছো সেটাও জানি। কালকে আমি বাসায় না থাকার সুযোগে বাসা থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলে সেটাও আমি জানি। অবশ্য এসবে আমার কিছুই আসে যায় না। তোমাকে আমি কিনে নিয়েছি আর এখন তুমি আমার বউ। সো তোমার উপর আমার অধিকার দ্বিগুণ। আমি ভেবেছিলাম অন্তত কাল রাতের পর তুমি নিজেকে একটু হলেও শুধরে নেবে। বাট আই ওয়াজ রং। তুমি আগের মতোই আছো। প্রতারক!

.
নির্ঝরের এমন গা জ্বালানো কথা আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। এমনিতেই তিতলির টেনশনে আমার মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম আর উনি উনার ফালতু কথার ঝুলি খুলে বসে আছেন।
কিন্তু একটা ভাববার বিষয় আছে। সে যদি জানতো আমি লুকিয়ে কোথায় যাই তাহলে আমাকে বাঁধা কেনো দেন নি।

— আপনি যদি জানতে তাহলে বাঁধা দেন নি কেনো?

নির্ঝর কিছুক্ষণ বাম হাত দিয়ে তার কপালে স্লাইড করতে থাকে। হয়তো সে যেই কথাটা বলেছে সেটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। হয়তো সে বলতে চায় নি।

— আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম তুমি আর কতোটা নিচে নামতে পারো। তন্ময় কে টাকা দেওয়ার জন্য নিজেকে আমার কাছে বিক্রি করেছো। এতোটা ভালোবাসো তন্ময় কে! আর আমি! আমি যে তোমার স্বামী সেই খেয়ালটুকু আছে তোমার? কালকেও তুমি তন্ময়ের বাড়ি গিয়ছিলে। কেনো তৃষ্ণা? উত্তর দাও কেনো?

— এটা আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে বলতে বাধ্য নই।

— তৃষ্ণা! তুমি কি একবারের জন্যও আমাকে বুঝো না?

— ছাড়ুন আমাকে। রাতের জন্য রান্না করতে হবে। বাসায় কোনো সার্ভেন্ট নেই।

নির্ঝর আমার বাহু আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ আমার স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু আমি তার চোখে দিকে তাকাতে পারছি না। হয়তো তিতলির ব্যাপার টা উনি জানেন না।

উনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিচেনে চলে গেলাম।

.
.
.
.
.

খাবার টেবিলে উনার সাথে ভালো মন্দো আর কোনো কথা বলি নি। তবে উনার চোখ মুখ দেখে মনে হয়েছে উনি রেগে আছেন। কিন্তু আমি নিরুপায় উনাকে তিতলির সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবো না।

.

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন হঠাত কেউ পিছন থেকে আমার কোমড় চেপে ধরলো। পুরো বাড়িতে একমাত্র আমি আর নির্ঝর ব্যতিত অন্য কেউ নেই। তাই লোকটা যে নির্ঝর এটা বুঝতে আর বাকি নেই। কিন্তু উনার এভাবে জরিয়ে ধরায় আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

উনি উনার থুতুনি আমার ঘাড়ে ঠেকিয়ে দিয়ে শাড়ির নিচ দিয়ে আমার পেটে হাত রাখলেন। ইচ্ছে করছে একটা ধাক্কা দিয়ে উনাকে পিছন দিকে ফেলে দেই। কিন্তু কেনো যেনো ভাবনা কে বাস্তবায়িত করতে পারছি না।

নির্ঝরের গরম নিশ্বাস আমার ঘাড়ে পরছে। না চাইতেও শরীর বারবার কেঁপে উঠছে। উনি উনার দুহাত দিয়ে আমার পেটে স্লাইড করছেন। পরিস্থিতি ক্রমশ আরও বেশি অস্বস্তিকর হয়ে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না পেয়ে নির্ঝরের পেটে কুনুই দিয়ে পিছন দিকে ঠেলে ঘরের দিকে ছুট লাগালাম। কিন্তু বেশি দূর আর এগুতে পারলাম না। নির্ঝর আমাকে পিছন থেকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে কোলে তুলে নেন।

— নির্ঝর কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে।

— কোনো ছাড়া ছাড়ি নেই।

— এসব একদম ঠিক হবে না বলে দিলাম।

— কেনো?

— আপনি আমাকে ছোবেন না।

— কেনো? (ভ্রুঁ কুচকে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে)

— জানি না। নামান আমাকে।

নির্ঝর আমার কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। ভয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিলে আবার উনাকে বললাম আমাকে ছেড়ে দিতে কিন্তু এবারো আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন। নিজের সমস্ত ভার আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিলেন।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
এক মাস কেটে গেছে নির্ঝরের সাথে আমার বিয়ের। এই কয়েকদিনে নির্ঝর আর আমার মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হলেও কোথাও না কোথাও নির্ঝরের আমার প্রতি ঘৃণার রেশ রয়েই গেছে।

যেই উদ্দেশ্যে আমাকে বিয়ে করেছিলেন উনি, প্রতি রাতে উনার শয্যা সঙ্গী হয়ে সেই উদ্দেশ্য আমি পূরণ করে চলেছি। কোনোমতে দিন কেটে যাচ্ছে আমার। কিন্তু জীবন থমকে গেছে। এতোদিনে তিতলির সাথে একবারের জন্যও দেখা বা কথা হয় নি। নির্ঝরের দৃষ্টি এড়িয়ে তিনদিন তন্ময় আর তিতলির খোঁজে বেরিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে আমাকে। না জানি তিতলির সাথে কি করেছে ওই পশু টা। কেমন আছে তিতলি কোথায় আছে!

.
.
.

পড়ন্ত বিকেলের হালকা তির্যক রোদ, সেই সাথে হিমশীতল বাতাস।সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ছাদের কার্নিশ ঘেসে হাতে এক মগ নিয়ে দাড়িয়ে আছি। গোধূলী লগ্নটা উপভোগ করতে করতে পুরোনো সব স্মৃতির মাঝে বিচরণ করছিলাম।
নির্ঝর এখনও অফিস থেকে ফিরেন নি। এখন অবশ্য ফিরবেনও না। তার ফিরতে সন্ধ্যা পার হবে। কোনো সার্ভেন্টস্ নেই বাসায়। সার্ভেন্টসদের নির্ঝর সকালেই বিদায় করে দেন। রাতে আমাদের দুজনের জন্য রান্না টা আমাকেই করতে হয়।

জীবন কখন কোন দিকে বাঁক নেয় সেটা কেউ বলতে পারে না। একদিক দিয়ে আমার ভাগ্যে সুখ দিচ্ছে তো অন্যদিক দিয়ে আমার সবচেয়ে বড় সুখ কেড়ে নিচ্ছে। ভাগ্যের খেলা টা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।

.
কফি শেষ হতে না হতেই নিচে দরজায় কলিং বেল বাজা শুরু করলো। সচরাচর নির্ঝর এতো তাড়াতাড়ি আসেন না। আর উনি ব্যতিত এই বাড়িতে আর কেউ আসে না।

কফি মগটা কিচেনে রেখে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলে আমি যতোটা না অবাক হলাম তার চেয়েও সামনে থাকা মানুষগুলো বেশি অবাক হলো।
খুবই সুন্দর একটা মেয়ে নীল চুড়িদারে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। তার সাথে মধ্য বয়ষ্ক একজোড়া দম্পতি। তাদের পোশাক পরিচ্ছেদ বলে দিচ্ছে তারা ভিআইপি কেউ হবেন। এই এক মাসে প্রথম আমি ভিন্ন কোনো প্রাণীর মুখ দেখলাম এ বাড়িতে।

সামনে থাকা সুন্দরী মেয়েটি আমার দিকে ভ্রুঁ কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেলো। তার সাথে থাকা মানুষগুলোও বাড়ির ভিতরে ঢুকে পরলো। তাদের সবার সাথেই এক গাদা করে লাগেজ। তাদের ড্রাইভার এসে সেসব লাগেজ ড্রয়িং রুমে রেখে চলে গেলো।

.
.
মেয়েটা আমাকে আপাদমস্তক দেখে বলতে শুরু করলো,
— নির কোথায়?

— উনি তো অফিসে।

— হুম। কিন্তু তুমি কে? আর নির এর বাড়িতে কি করছো?

— আমি,,, আমি!

” ও এ বাড়ির নিউ সার্ভেন্ট স্নিগ্ধা।”
— বাড়ির সদর দরজায় দাড়িয়ে নির্ঝর স্বজোরে কথাটা বললো।

— নির তুমি নিউ সার্ভেন্ট হায়ার করেছো আর আমাকে একবার জানাও নি! এই এক মাসেই আমাকে পর করে দিয়েছো তাই না! তোমার সাথে আর কথা বলবো না।

— স্নিগ্ধা ডোন্ট এক্ট চাইল্ডিশ। তোমরা হঠাত করে এখানে কিভাবে এলে!

” কেনো নির তোমার বাড়িতে কি আমরা আসতে পারি না!”
— স্নিগ্ধার সাথে থাকা মহিলা টি নির্ঝেরের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুড়লো।

— আমি সেটা তো বলি নি আম্মু। আমার বাড়ি মানেই তো তোমাদের বাড়ি। হাও আর ইউ গাইজ?

স্নিগ্ধার সাথে আসা বয়স্ক দম্পতি হলো নির্ঝরের বাবা মা, রাজীব চৌধুরী আর নয়না চৌধুরী।

— আমরা ঠিক আছি নির। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না তুমি ঠিক আছো। (নয়না বেগম)

— আইম ফাইন অলসো। আম্মু তোমরা দুতলার ঘরে গিয়ে রেষ্ট নাও। লাগেজ আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

নয়না বেগম আর রাজীব সাহেব দুতলার ঘরে যাওয়ার জন্য সিড়ি বেয়ে উঠা ধরলে স্নিগ্ধা নির্ঝর কে চেপে ধরে গালে চুমু বসিয়ে দেয়। তৃষ্ণা সেখানেই উপস্থিত ছিল। নির্ঝরকে স্নিগ্ধার চুমু দেওয়ার দৃশ্য সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েও মাথা নিচু করে থাকে। এই মাত্র নির্ঝর তাকে সবার সামনে কাজের লোক বলে পরিচয় দিয়েছে। ভাবতেই তৃষ্ণার বুকটা মুচড়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত তার স্বামী তাকে তার বাবা মার সামনে কাজের লোক বানিয়ে দিলো!

স্নিগ্ধা গেষ্ট রুমে গেলে নির্ঝর তৃষ্ণার হাত ধরে তার ঘরে নিয়ে যায়।

— তোমাকে কে বলেছিল দরজা খুলতে? প্রতিদিন আমি নিজে থেকে লক খুলে ভিতরে আসি তাহলে আজ কেনো তুমি খুলতে গেলে।

আমি কিছু বলছি না। মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছি আর নির্ঝরের বলা সব কথা শুনছি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে নির্ঝর বিচলিত হয়ে আবার চেঁচাতে শুরু করলেন।

— আন্সার মি ড্যাম ইট! দরজা কেনো খুলতে গিয়েছিলে? তুমি স্নিগ্ধার সামনে না এলে এতো কিছু হতোই না। তোমাকে সার্ভেন্ট বলে পরিচয় দিতে হতো না আমার।

— আমি তো আপনার টাকায় কেনা গোলামই। তাহলে মানুষের সামনে সার্ভেন্ট বলাতে আর কি আসে যায়। এমনিতেও এই চুক্তির বিনিময়ে আমি মোটা অংঙ্কের টাকা নিচ্ছি আপনার কাছে থেকে। তাই আপনার ইচ্ছা মতোই আমাকে চলতে হবে।

তৃষ্ণার বলা কথাগুলোয় নির্ঝর নির্বাক হয়ে যায়। তৃষ্ণার কথাগুলোর পিছনে লুকিয়ে থাকা তার কষ্টটা নির্ঝর খুব ভালোই বুঝতে পারছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কিছুই করার নেই। তৃষ্ণা আর তার বিয়ে আর একসাথে থাকার কথা সে তার পরিবারকে বলতে পারবে না। উপায়ন্তর না দেখেই নির্ঝর তৃষ্ণাকে সার্ভেন্ট বলে পরিচয় দিয়েছে। এখন সবার সামনে সে আর তৃষ্ণা এক ঘরে থাকতে পারবে না। কিন্তু তার মুখ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বের হচ্ছে না তৃষ্ণাকে বলার জন্য।

কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে এভাবেই নীরবতা বিরাজ করে। একসময় তৃষ্ণা নিজেই সে নীরবতা ভেঙে জামা কাপড় গুছাতে থাকে।

— কি করছো?

— আপনার মা বাবা আর হবু স্ত্রীর সামনে তো আর আপনি পর নারীর সাথে একঘরে থাকতে পারবেন না। তাও আবার সে যদি হয় সার্ভেন্ট! তাই নিজের আসল অবস্থানে চলে যাচ্ছি।

— মানে?

— ঘাবড়াবেন না। কিচেনে নয়তো চিলেকোঠার ঘরে থাকবো। তিন মাসের আগে এই বাড়ি ছাড়বো না।

নির্ঝর আর কিছু বলতে পারলো না। কেনো যেনো তার মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না। তৃষ্ণা একে একে তার সব জিনিস গুছিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নির্ঝর আগের অবস্থানেই ঠায় দাড়িয়ে আছে দরজার পানে তাকিয়ে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here