#নেশা
#১৬_এবং_অন্তিম_পর্ব
#Tabassum_Kotha
আজ তিন দিন হতে চলল আমি এই উপরের ঘরে বন্দি আছি। ঠিক আগের মতোই ব্যালকনির কাচে লক লাগানো আর চাবি হয়তো নির্ঝরের কাছে আছে। দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ। সময় মত আমাকে শুধু খাবার দিয়ে যায় সার্ভেন্টরা। তিতলির কথা খুব করে মনে পরছে। আমি কষ্টে থাকলেই কেনো যেনো তিতলিকে খুঁজে মন। হয়তো আমার ভালো থাকার একমাত্র অবলম্বন আমার তিতলি! কিন্তু তিতলিকে ফিরে পেতে হলেও আমি তন্ময়ের কাছে যাবো না। তিতলিকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে আছি। এখন নির্ঝরের বিয়ের পর আমার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে।
.
দুই তিন দিন যাবত শরীরটা ভীষণ খারাপ মনে হচ্ছে। সারাক্ষণ মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা। মাথা সোজা করতে পারি না। জানি না কোন রোগ শরীরে বাসা বাধঁলো! হয়তো আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। এই দুনিয়ায় হয়তো আর বেশি দিন থাকা হবে না। অবশ্য এই অপূর্ণতার জীবন রেখে কি লাভ! সবার কাছেই তো আমি বোঝা.. আমিতো আমার নিজের কাছেই বোঝা। যে জীবনে ভালোবাসা নেই, মাতৃত্বের সুখ নেই সে জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। মৃত্যুর মাধ্যমে অন্তত আমি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবো।
বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে ছিলাম। তখন দরজায় টোকা পরলে, উঠে দরজা খুলে দিলাম। সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে এসেছে দুপুরের। কিন্তু খাবারের ট্রেতে রাখা মাছের স্মেলেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠলো। বুঝলাম না কি হলো! দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ইচ্ছেমতো বমি করলাম। এমনিতেই দুর্বল শরীর, তারওপর আবার বমি,, মনে হচ্ছে ওয়াশরুমেই মাথা ঘুরে পরে যাবো।
মিতা (সার্ভেন্ট) আমাকে ধরে ঘরে এনে পুনরায় বিছানায় শুইয়ে দিলো।
— আর ইউ ওকে ম্যাম? আপনার তো শরীর খুব খারাপ মনে হচ্ছে! আমি কি নির্ঝর স্যারকে ইনফর্ম করবো আপনার অসুস্থতার কথা? (মিতা)
— না, আমি ঠিক আছি তুমি যাও। আর খাবারটা নিয়ে যাও। আমার শরীর ভালো লাগছে না আমি খাবো না। (তৃষ্ণা)
মিতা খাবার নিয়ে তৃষ্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে সিড়ি দিয়ে নামার সময় স্নিগ্ধার সাথে ধাক্কা খেলো।
— আর ইউ ব্লাইন্ড? কান্ট ইউ সি,, ইডিয়েট।
— সরি ম্যাম। আসলে আমি খেয়াল করতে পারিনি। সরি।
— হুম ঠিক আছে কোথা থেকে আসছিলে? তৃষ্ণার জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলে বুঝি?
— জি ম্যাম। কিন্তু তৃষ্ণা ম্যাম খাবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার শরীর ভালো নয়।
— কি হয়েছে তৃষ্ণার?
— ম্যামের বমি হচ্ছে আর মাথা ঘুরাচ্ছে। শরীর নাকি খুব দুর্বল, এজন্য কিছুই খেতে পারছেন না। আমার সামনেই একবার বমি করলেন।
— হঠাৎ করে তৃষ্ণা এত অসুস্থ কি করে হলো। বাট হু কেয়ারস! ইনফ্যাক্ট তৃষ্ণা মরে গেলে আমার জন্যই ভালো, নির্ঝর আর আমার জীবন থেকে একেবারে চলে যাবে।
স্নিগ্ধ একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হেলতে-দুলতে নয়না বেগমের ঘরে গেলো। নয়ন বেগম বিয়ের গহনা ঠিকঠাক করছিলেন স্নিগ্ধার জন্য।
— কি হলো এত চিন্তিত লাগছে কেন তোকে? (নয়না বেগম)
— আরে আম্মু আর বলো না এই তৃষ্ণা আমাকে কখনো শান্তিতে থাকতে দেবে না। (স্নিগ্ধা)
— কেন তৃষ্ণা আবার কি করলো?
— দুইদিন পরে আমার বিয়ে আর এই তৃষ্ণা আজকে অসুস্থতার নাটক করছে যাতে নির্ঝরকে আবার ফাসাতে পারে।
— মানে?
— তৃষ্ণা নাটক করছে যে অনেক অসুস্থ.. দুর্বলতা.. মাথা ঘুরে.. বমি বমি ভাব। ওই কী যেন নাম সার্ভেন্ট,, মিতা! ওর সামনেই নাকি বমি করেছে। খাবারও খেতে পারছেনা ব্লা ব্লা। আচ্ছা, আম্মু তুমিই বলো এসব নাটকের এখন কি প্রয়োজন? যেখানে তৃষ্ণা নিজেই নির্ঝরকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছে…. এখন আমাদের লাইফ থেকে চলে গেলেই পারে। শুধু শুধু আমার লাইফটা হেল বানাচ্ছে।
.
নয়না বেগম স্নিগ্ধাকে ভালো মন্দ কিছু না বলে চিন্তিত মুখে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে তৃষ্ণার ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। এসির ঠান্ডা থাকা সত্ত্বেও নয়না বেগমের কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দিচ্ছে। হাত দিয়ে কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে তৃষ্ণার ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন তিনি।
নিস্তেজ শরীরে ক্লান্ত অবস্থায় বিছানার সাথে লেপ্টে আছে তৃষ্ণা। নয়না বেগম হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। তৃষ্ণার কপালে হাত রেখে একপ্রকার ঘাবড়ে যায় সে। আর কিছু চিন্তা না করে সার্ভেন্টদের সাহায্যে তৃষ্ণাকে গাড়িতে নিয়ে উঠালো।
কিছু একটা ভেবে নয়না বেগম আবার বাড়ির ভেতর ফিরে এসে স্নিগ্ধার কাছে গেলেন।
— স্নিগ্ধা!
— আম্মু তুমি এমন হাপাচ্ছো কেনো?
— স্নিগ্ধা তুমি এখনই তৃষ্ণা কে নিয়ে হসপিটালে যাও। আমি বাসায় থাকছি নির্ঝরকে সামলানোর জন্য।
— হোয়াট!! হ্যাভ ইউ লষ্ট ইট আম্মু? আমি যাবো তাও আবার ঐ সতীনটার জন্য? ইমপোসিবল আম্মু। ইফ শি ডাইজ, দ্যান লেট হার!
— ডোন্ট টক রাবিশ স্নিগ্ধা। আমি বলছি মানে তুমি যাচ্ছো। রাইট নাও।
স্নিগ্ধা রাগে ফুসতে ফুসতে ঘর থেকে বেরিয়ে তৃষ্ণার সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তৃষ্ণার শরীর এতোটাই দুর্বল হয়ে পরেছে যে, সে চোখ খুলে দেখতেও পারছে না তার সাথে কে আছে।
.
.
.
.
গাড়ির কাচে হেলান দিয়ে বসে আছে তৃষ্ণা। গাড়ি আপন-মনে ছুটে চলছে গন্তব্যের দিকে। একটু আগেই স্নিগ্ধার সাথে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। ডাক্তারের সাথে তার কথা হয়নি। তাই যা করার স্নিগ্ধাই সব করেছে। অবশ্য তৃষ্ণা জানার কোন ইচ্ছাও নেই যে, তার কি হয়েছে বা ডাক্তারে কি বলেছে? আজকে রাতের পর তার জীবন পাল্টে যাবে। তার মাথায় যদি একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
আজকের পর তার নির্ঝর আর তার থাকবে না। অন্যকারো হয়ে যাবে। দুচোখ বেয়ে অনবরত বেরিয়ে আসা পানির ফোঁটা গুলো মুছে চোখ বন্ধ করে নিলো তৃষ্ণা।
এসি করা গাড়িতেও প্রচন্ডরকম ঘামছে স্নিগ্ধা। কোন একটা দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে তৃষ্ণার সামনে স্বাভাবিক উপস্থাপন করতে কিন্তু সে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে তৃষ্ণা কে সে বলেছে যে, দুর্বলতা থেকে এই অবস্থা হয়েছে তৃষ্ণার কিছুদিন মেডিসিন নিলেই সে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। যদিও সত্যিটা ভিন্ন আর এই সত্যিটা সে কাউকে জানাতে পারবে না।
বাড়িতে পৌঁছাতেই নির্ঝরের মুখোমুখি হয় তৃষ্ণা আর স্নিগ্ধা। নির্ঝর অগ্নিদৃষ্টিতে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অনুমতি ছাড়া তৃষ্ণাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ায় যে সে ক্রুদ্ধ হয়ে আছে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। নির্ঝরের এই দৃষ্টিতে তৃষ্ণা ভয় পেলেও নির্ঝরকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে উপরের ঘর সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে চলে গেল। স্নিগ্ধা উপরের ঘরে যেতে নিলে নির্ঝর তাকে ডেকে ফেরালো।
— আমার পারমিশন ছাড়া তৃষ্ণাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সাহস তোমাকে কি দিয়েছে স্নিগ্ধা?
— নির তৃষ্ণার শরীর ভীষণ খারাপ ছিল। এজন্য আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।
— হোয়াট? কি হয়েছে তৃষ্ণার? আমাকে জানাওনি কেন? তৃষ্ণা অসুস্থ আমাকে একবারও বলোনি কেন? কেমন আছে এখন তৃষ্ণা? ওর কি হয়েছে? ডাক্তার কি বলেছে?
তৃষ্ণার প্রতি নির্ঝরের চিন্তা দেখে হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে স্নিগ্ধা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— রিল্যাক্স নির তৃষ্ণা ঠিক আছে। যা সমস্যা হয়েছিল তা শুধু দুর্বলতা থেকে হয়েছিল। কিছু মেডিসিন দিয়েছে ডাক্তার। সেগুলো নিয়মিত নিলে তৃষ্ণা ঠিক হয়ে যাবে।
— এখন তৃষ্ণা কেমন আছে আমাকে জানতে হবে।
— উফফ নির্ঝর এখন অন্তত তৃষ্ণার চিন্তা বাদ দাও! কাল আমাদের বিয়ে। একবার অন্তত আমার চিন্তা করো। এখন আমাকে নিয়ে ভাবো। তৃষ্ণা তোমার অতীত আর আমি তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। আমাদের বিয়ে কাল সে কথা চিন্তা করো।
— আই এম ভেরি টায়ার্ড। পরে কথা বলছি।
স্নিগ্ধা পিছন থেকে কয়েকবার নির্ঝরকে ডাকলেও নির্ঝর পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
.
ব্যালকনির কাচ খোলা থাকায় ব্যালকনির কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। এই পাঁচ ছয় দিনে প্রথমবার ব্যালকোনির কাঁচ খোলা পেয়েছি। দু চোখের কোন বেয়ে অনবরত অজস্র অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। আজকের এই একটা রাত,, তারপরেই সব বদলে যাবে আমার জীবনে। আমার ভালোবাসা হয়ে যাবে অন্য কারো স্বামী। নির্ঝরের প্রতি আমার আর কোনো অধিকার থাকবে না। ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের চোখের সামনে অন্য কারো হতে দেখবো। এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে। আমিও তো অনেক ভালোবেসেছিলাম নির্ঝরকে। কিন্তু আমার ভালোবাসা যে উনাকে পূর্ণতা দিবে না। আমার থেকে দূরেই উনি সুখে থাকবে। একটা সম্পূর্ণ জীবন উনার অপেক্ষা করছে।
আজকের পর থেকে নির্ঝরকে দূর থেকে হয়তো অনেক বার দেখবো। কিন্তু কাছে গিয়ে তার বুকে মাথা রাখার অধিকার আমার আর থাকবে না। তার জন্য মনে ভালোবাসা তো অনেক থাকবে কিন্তু তার উপর আমার অধিকার থাকবে না। ভালোবাসি বলার অধিকার টুকু থাকবেনা। অধিকারের দুনিয়ায় ভালবাসার কোন মূল্য নেই।
আচমকা পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলে চমকে উঠলাম। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিটি নির্ঝর। এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই তাই স্পর্শ আমি চিনতে পারি। নিজের অজান্তেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নির্ঝর আমার পেটে স্লাইড করতে করতে ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে দিলেন। ধারে একটা গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে আমাকে পাজা কোলে তুলে নিলেন। আমার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। আজকেই হয়তো নির্ঝর আমার একসাথে শেষ দিন শেষ সময়। এরপর আর এত কাছাকাছি কখনো থাকা হবে না।
পরদিন,,
পুরো চৌধুরীবাড়ী ব্যস্ততায় মগ্ন। আজ নির্ঝর আর স্নিগ্ধার বিয়ে। বিউটিশিয়ানরা এসে পড়েছে। স্নিগ্ধাকে সাজাচ্ছে তারা। কিছুক্ষনের মধ্যেই কাজী এসে যাবে আর বিয়েও শুরু হয়ে যাবে। সময় বিয়ের সময় যত ঘনিয়ে আসছে আমার বুকের ধুকপুকানি ততই বেড়ে চলছে। কোন এক অজানা কষ্ট বুকের বাঁ পাশটা ছিড়ে যাচ্ছে। দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভিতরটা। জানিনা কিভাবে বাঁচবো আমি নির্ঝরকে ছাড়া। জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমাকে সারা জীবন।
নির্ঝর সার্ভেন্ট কে দিয়ে আমার জন্য একটা লাল শাড়ি পাঠিয়েছেন আর কিছু গয়না। আমাকে সুন্দর ভাবে সেজেগুজে তার আর স্নিগ্ধার বিয়ে এনজয় করতে বলেছেন। নির্ঝর নিজের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হয়তো উঠে পরে লেগেছেন। কোনো সুযোগ ছাড়ছেন না আমাকে কষ্ট দেওয়ার। সে খুব ভালো মতোই জানে তাকে অন্য কারো সাথে দেখে আমার কি অবস্থা হবে। আমার যত কষ্টই হোক আমি নির্ঝরের সব ইচ্ছা পূরণ করব। কারণ তার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারিনি। উনি আমার ভালোবাসা চেয়ে ছিলেন আর আমি তাকে সেটাই দিতে পারিনি। এজন্য আমার যত কষ্টই হোক তার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সব করব। হয়তো এই প্রতিশোধ নিতে পেরে তার মনের প্রশান্তি পাবেন।
নির্ঝরের পাঠানো শাড়িটা পরে মুখে কৃত্তিম হাসির রেখা ফুঁটিয়ে নিচে নেমে এলাম। সবার থেকে দূরে এক কোনায় দাড়িয়ে আছি। স্নিগ্ধা বধুবেশে বসে আছে। তার ঠিক সামনে নির্ঝর বসে আছে বর বেশে। নির্ঝরকে এতোটা সুদর্শন লাগছে যে আমার চোখ সরাতে পারছি না। আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন বর নিঃস্বন্দেহে নির্ঝর। নয়না ম্যাম আর রাজীব স্যার মেহমানদের দেখা শোনা করছেন। হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়াতে মেহমানের সংখ্যা কম। তবে সবাই উচ্চপদস্থ।
.
কাজী সাহেব এসে পরেছেন,, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বিয়ে শুরু হবে। শেষ বারের মতো দুচোখ ভরে নির্ঝরকে দেখছি। এই সময়টুকুতেই আমি উনাকে আমার চোখে বন্দী করে নেবো। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার স্মৃতি চোখে নিয়েই কাটিয়ে দেবো।
— বিয়ের কাজ শুরু করা যাক? (কাজী সাহেব)
— হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু করুন। (নয়না বেগম)
— ওয়েট আম্মু। কনে কে আসতে দাও। (নির্ঝর)
— কি বলছিস? স্নিগ্ধা তো এখানেই আছে।
— আমি স্নিগ্ধার কথা বলছি না আম্মু। তৃষ্ণা দেখো কতো দূরে দাড়িয়ে আছে। ওকে কাছে আসতে বলো। নাহলে তো কবুল বললে কেউ শুনবে না।
— তুই কি পাগল হলি? তৃষ্ণা কেনো কবুল বলবে?
— কারণ বিয়েটা তো আমি তৃষ্ণাকেই করছি।
নির্ঝরের কথায় যেনো সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।
— কি আবোল তাবোল বলছিস তুই? মজা করিস না। চুপচাপ বিয়েটা হতে দে।
— মজা আমি করি নি আম্মু। মজা তো তুমি করেছো আমার জীবন নিয়ে।
— নির্ঝর! এসব খেলা চলছে না!
— ইয়েস। এসব খেলা চলছে না। খেলা তো সেটা ছিল যেটা তুমি একবছর আগে খেলেছিলে।
— মানে?
— তৃষ্ণার ফেইক রিপোর্টস কেনো বানিয়েছিলে আম্মু?
নির্ঝরের প্রশ্নে নয়না বেগম হঠাত করেই ভীষণ ঘাবড়ে যায়।
— ককি বলছিস?
— কেনো তৃষ্ণাকে মিথ্যে বলেছিলে যে তৃষ্ণা কখনও মা হতে পারবে না? কেনো বলেছিলে তৃষ্ণা সন্তান জন্মদানে অক্ষম?
— নির্ঝর তুই আমাকে সন্দেহ করছিস?
— না আম্মু আমি তোমাকে দোষী প্রমাণ করছি। তুমি আমার ভালোবাসাকে আমার কাছে থেকে দূর করেছো। আমার জীবন নিয়ে খেলেছো কেনো?
— এসব মিথ্যে নির।
— প্রমাণ ছাড়া কথা বলছি না আমি আম্মু। একবছর আগে যেই ডাক্তারকে দিয়ে তুমি তৃষ্ণার ফেইক রিপোর্ট বানিয়েছিলে তার কাছে থেকেই সব জেনেছি। ডাক্তার নিজেই বলেছে তুমি তাকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলে রিপোর্ট বানানোর জন্য।
কেনো করেছিলে এসব আম্মু? কেনো নিজের ছেলের খুশি তুমি সহ্য করতে পারো নি? কেনো?
— তোর খুশি চৌধুরী এম্পায়ারের যোগ্য নয়। একটা রাস্তার মেয়েকে তুই এই বাড়ির বউ করার জন্য খুঁজে এনেছিলি। যেই মেয়ের জন্মের ঠিক নেই সেই মেয়ে হবে আমার ছেলের বউ কখনই না।
— আম্মু! তৃষ্ণার প্রতি তোমার মনে এতো ক্ষোভ জমে আছে!
— আমি তোকে অনেকবার বোঝাতে চেয়েছিলাম যে এই মেয়েকে ছেড়ে দে। কিন্তু তুই ফিরিস নি। তাই বিয়ের দুইদিন আগে তৃষ্ণার পেটে ব্যথার সুযোগ নিয়ে ডাক্তারকে টাকা দিয়ে ফেইক রিপোর্ট বানাই। তৃষ্ণাকে সেই রিপোর্ট দেখিয়ে একটু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলে তৃষ্ণা তোর ভালোর জন্য তোকে ছেড়ে চলে যায়।
এতোক্ষণ নির্ঝর আর নয়না বেগমের কথোপকথন দূরে দাড়িয়ে মূর্তির মতো শুনছিল তৃষ্ণা। নয়না বেগম তার সাথে কি করেছে সেটা তার কাছে তেমন কোনো বিষয়ই না। যা যা বলেছে নয়না বেগম প্রতিটা কথাই তো সত্য। আসলেই তার জন্ম পরিচয় নেই। জন্মের পর তার মা বাবা তাকে এতিমখানার বারান্দায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। এমন একটা মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ কে করতে চাইবে!! তবুও তৃষ্ণার মনের কোনে একটা আশার আলো ফুঁটে উঠেছে সে মা হতে পারবে। সে বন্ধা নয়। কিন্তু জীবনের এমন একটা সময়ে এসে এই কথাটা জানতে পারলো যে, এখন চাইলেও এই খুশিটাকে কাজে লাগাতে পারবে না। নির্ঝরের সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই স্নিগ্ধা আর নির্ঝরের বিয়ে।
.
.
.
.
নয়না বেগম আর নির্ঝরের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে নির্ঝরের হুশ হয় তৃষ্ণা আশে পাশে নেই। নির্ঝর নয়না বেগমের বলা কোনো কথা না শুনে তৃষ্ণাকে খোঁজার কাজে লেগে পরে। অনেক খুঁজেও তৃষ্ণাকে খুজে না পেলে নির্ঝর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে।
সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আলো অন্ধকারের খেলা খেলছে প্রকৃতি। পাগলের মতো কার ড্রাইভ করছে আর বাইরের দিকে তাকাচ্ছে নির্ঝর। আজকে সে কিছুতেই তার ভালোবাসাকে হারাতে দেবে না। অনেক কষ্ট সহ্য করেছে সে তৃষ্ণাকে আপন করে পাওয়ার জন্য।
আজ যে করেই হোক তৃষ্ণাকে সে খুঁজে বের করবেই। কিছুতেই তৃষ্ণাকে নিজে থেকে দূর হতে দেবে না। তার ভালোবাসা ছেড়ে সে বেঁচে থাকতে পারবে না। এই নেশা ভুলে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রায় দু তিন ঘন্টার মতো খুঁজেও তৃষ্ণাকে না পেলে নির্ঝর ক্লান্ত হয়ে পরে। হাইওয়েতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে নির্ঝর রাতের আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। হয়তো সে সারাজীবনের জন্য তার তৃষ্ণাকে হারিয়ে ফেলেছে। আর হয়তো দেখা মিলবে না তার নেশা এর!
.
.
.
.
নয় মাস পর,,
হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময় আর তিতলি। একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে একজন বয়স্ক লোক হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তিতলি হসপিটালে করিডোরের এদিক থেকে ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। তন্ময় একটু এগিয়ে গিয়ে তিতলিকে এনে কোলে বসিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো।
— এমন করে না মা। ভিতরে তৃষ্ণা মামনি অসুস্থ। তুমি যদি এভাবে দুষ্টুমি করো মামনি কষ্ট পাবে না।
— মামনি আমার জন্য ভাই আনবে? নাকি বোন আনবে বাবাই?
— সেটা তো বলতে পারব না। তবে তোমার কি চাই ভাই নাকি বোন। (তন্ময়)
— তিতলির ভাই-বোন দুজনেই এসেছে।
তৃষ্ণার কেবিন থেকে বেরিয়ে তন্ময় আর তিতলির উদ্দেশ্যে কথাটা বলল নির্ঝর।
— মানে? সত্যি বলছো তুমি?
— হ্যাঁ তৃষ্ণা টুইন্স বেবি জন্ম দিয়েছে। আমি দুই বাচ্চার বাবা হয়েছি! এত খুশি কোথায় রাখবো বুঝতে পারছিনা!! আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি। আমার তৃষ্ণাকেও পেয়েছি আর আমাদের বাচ্চাদেরও।
তনময় নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরে বাবা হওয়ার শুভেচ্ছা জানালো। নির্ঝর তিতলিকে কোলে নিয়ে আদর করে দিয়ে, তন্ময় আর তিতলিকে মিষ্টি খাইয়ে তৃষ্ণার কেবিনে নিয়ে গেলো।
নয়নে বেগম তৃষ্ণার মাথার কাছে বসে তৃষ্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এখনো তৃষ্ণায় জ্ঞান ফিরে আসেনি। আজ নয়না বেগমকে দেখলে কেউ বলবে না যে দুই বছর আগে উনি তৃষ্ণাকে এতোটা অপছন্দ করতেন। আজ তৃষ্ণাকে যেভাবে আদর করছেন যে কেউ বলবে তৃষ্ণা তার নিজের মেয়ে।
সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তন হয়ে যায়। এক বছর আগে তৃষ্ণা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে নির্ঝর পাগলের মতো তাকে খুঁজতে বের হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তৃষ্ণাকে খুঁজে না পেলে ক্লান্ত হয়ে নির্ঝর হাইওয়েতে আত্মহত্যা করতে যায়। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় ঠিক সেখানেই তার তৃষ্ণাকে সে ফিরে পায়। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্য নিজের চোখের আড়াল হতে দেয়নি তৃষ্ণাকে সে।আর আজ তৃষ্ণা তার সন্তানদের মা। নির্ঝর আর স্নিগ্ধার বিয়ের আগের দিন তৃষ্ণাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানায় তৃষ্ণা মা হতে চলেছে। কিন্তু সেদিন স্নিগ্ধা নির্ঝরকে বিয়ে করার লোভে সবার কাছে থেকে সত্যিটা লুকিয়ে ফেলে। সেই কাউকে জানতে দেয় না যে তৃষ্ণা মা হতে চলেছে।
তৃষ্ণাকে নির্ঝর ফিরিয়ে আনার কিছুদিন পরেই তৃষ্ণার শরীর আরো খারাপ হয়ে গেলে ডাক্তার দেখালে জানা যায় তৃষ্ণা মা হতে চলেছে। এই নয় মাসে নির্ঝর তৃষ্ণার দেখাশোনায় কোন প্রকার ত্রুটি রাখেনি। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তৃষ্ণার সেবা করেছে। তৃষ্ণাকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। আজ তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে। এক মেয়ে আর এক ছেলের জননী হয়েছে তৃষ্ণা। সেই সাথে তাদের এক বড় মেয়ে হিসেবে আছে তিতলি। তন্ময় এবং নানা বেগমও তাদের ভুল বুঝতে পেরে নিজেদেরকে সুধরে নিয়েছেন
.
.
.
.
.
.
.
.
রাতের অন্ধকারে ব্যালকোনিতে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে নির্ঝর। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হওয়াতে ভেজা মাটির সুঘ্রাণ আসছে। চোখ বন্ধ করে নির্ঝর সেটা উপভোগ করার চেষ্টা করছে। দুই মগ কফি হাতে নির্ঝরের পাশে বসলো তৃষ্ণা।
— কি ভাবছেন? (তৃষ্ণা)
— ভাবছি স্বপ্ন দেখছি না তো?
— এমন কেনো মনে হলো?
— জানো তৃষ্ণা, যখন তুমি ছিলে না,, তখন তোমাকে এভাবে পাশে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম প্রতিদিন। প্রতিটা নির্ঘুম রাত স্বাক্ষী যে কতোটা চেয়েছি তোমাকে! আজ তোমাকে পেয়েও মনে হচ্ছে এসব স্বপ্ন। চোখ খুললেই হারিয়ে যাবে।
— কিছুই হারাবে না। আপনি-আমি, আমাদের ভালোবাসা, তানভীর-নীরা আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন সব এখানেই আছে।
— থ্যাংক ইউ তৃষ্ণা।
— কেনো?
— আমার জীবনে এতো সুখ এনে দেওয়ার জন্য। তানভীর আর নীরা কে আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য।
নির্ঝরের কথার উত্তর না দিয়ে উনার বুকে মুখ গুজে দিলাম। সময় যদি এখানে থেমে যেতো আর আমি যদি উনার মধ্যে মিশে যেতাম.. তাহলেও হয়তো মনে হতো আমার নির্ঝরের কাছে থেকে আমি দূরে। নির্ঝর সবসময় বলেন আমি নাকি উনার নেশা। কিন্তু সত্যি টা তো হলো নির্ঝরের ভালোবাসাই নেশা। আর এই নেশায় আসক্ত থাকতে চাই শেষ নিশ্বাস অব্দি।
~সমাপ্ত~
[কেমন লাগলো জানাবেন। অনেক তাড়াহুড়া করেছি লিখেছি। নতুন কোনো গল্প লিখলে কি আপনারা পড়বেন😐। ধন্যবাদ।]