—রূপ দয়া করে এই ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দাও!
—এসব কি বলছো অনিল?তুমি ভুলে গিয়েছো আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।
—যেভাবেই বিয়ে করিনা কেন আমি আমার বংশের অস্তিত্ব রাখতে চাই।যেহেতু তোমার পক্ষে আমার বংশ রক্ষা করা সম্ভব না তাই শুধু শুধু তোমাকে আমি খাওয়াবো না।
—তোমার জন্য আমি আমার পুরো পরিবারকে ছেড়েছি।তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি ভালোবাসো।
—হ্যাঁ ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি আমার সন্তান চাই।তুমি কি তা দিতে পারবে?না পারবে না।তাই আর এখন একসাথে থাকার কোনো মানে হয়না।
—আমি এখন কোথায় যাবো আমার বাবা-মা আমাকে মেনে নিবে না কেন বুঝতে পারছো না?
—ওসব আমি জানি না ডিভোর্স পেপারে সই করে তাড়াতাড়ি চলে যাও।
একলাফে উঠে বসলো রূপ।ঘুমের মধ্যে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে দেখে ঘাবড়ে গেল।চারিদিকে চোখ বোলালো। চারিদিকে আভিজাত্যের ছোঁয়ায় মাখামাখি।ঘরের প্রতিটা কোণা খুব সৌখিনতার সাথে সাজানো হয়েছে।ঘরে লাইটের সংখ্যা কম না হলেও আট কিংবা নয়টার মতো।সারা ঘর সাদা রঙে মুড়িয়ে রেখেছে।রূপের কাছে মনে হচ্ছে ঘরটাকে কেউ কা’ফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রেখেছে।রুমের দুইপাশে দুটো বড় বড় জানালায় ইয়া বড় বড় সাদা পর্দা।ক্ষনে ক্ষনেই সেগুলো বাতাসে বাড়ি খাচ্ছে।বিশাল সাদা বিছানার ঠিক মাঝখানে রূপ পড়ে আছে ছোটো পাখির মতো। সাদা ধবধবে ঘরে দামি আসবাবপত্রে ঠাঁসা। সাদা দেয়ালের অধিকাংশ জায়গায় বিভিন্ন রঙের পেইন্টিং। খুব নিখুঁত এবং দক্ষ হাতে পেইন্টিং গুলো করা হয়েছে।রূপ এবার চোখ ঘুরিয়ে বেডের উপরে রাখা ইয়া বড় পেইন্টিংটা দেখলো।দুইটা মায়াবী চোখ আঁকা।আর যে এঁকেছে সে যেন একটু বাড়তি সৌন্দর্য দিয়ে এঁকেছে চোখটা যাতে চোখ দুটি আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে।মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি কোনো জাদুকরীর চোখ সামনে জ্বল জ্বল করছে।
রূপের কাছে চোখ দুটো চেনা চেনা লাগছে।কিন্তু মস্তিষ্কে এই মুহূর্তে ঠিক আসছে না এটা কে?রূপ যখন মুগ্ধ নয়নে সব বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করলো।কিন্তু রূপের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই সে বিভর হয়ে আছে চোখজোড়ায়।
—এই মেয়ে!
অসম্ভব সুন্দর ভরাট কন্ঠে পিছন ফিরলো রূপ।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঘোলা চোখের এক সুদর্শন যুবক।তার পা থেকে মাথা অব্দি আভিজাত্যের ছাপ।ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চুলগুলো চোখের উপর বিশাল জায়গা করে আছে।ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রূপের দিকে।
রূপের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কুঞ্জ ঝাড়ি দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,
—ঐ?বোবা নাকি?
রূপ নিজেকে সংযত করে বললো,
—আপনি কে?
লোকটা ভ্রু গুলো আরও সংকুচিত করে বললো,
—আমার বাসায় বসে বলছো আমি কে?আচ্ছা সত্যিই তুমি আমাকে চিনো না?
রূপ সত্যিই লোকটাকে চেনে না তাই সে বললো,
—না কেন?
লোকটা এবার সন্দিহান কন্ঠে বললো,
—আচ্ছা তুমি কুঞ্জ দেওয়ানকে চিনো?
রূপ এই নামের কেউকেই চেনেনা তাই সে এবারও বললো,
—না। সে কে?
লোকটা বোধহয় হতাশ হলো তাই একটা শব্দেই কথা শেষ করলো,
—পেইন্টার।
লোকটা রূপের সামনে থেকে কাবার্ডের কাছে গেল।কাবার্ড থেকে কিছু একটা বের করলো।রূপ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছে।কিছুক্ষণ পর রূপের দিকে একটি মলম ছুঁড়ে দিল।রূপ সেটা ধরতে না পারায় পরে গেল।রূপ আস্তে ধীরে তুলেও নিল সেটা।লোকটা রাগী কন্ঠে বললো,
—মলমটা লাগিয়ে নাও কপালের সাইডে কেটে গিয়েছে।
রূপ চট করে কপালে হাত দিল।কপালের কাটা জায়গায় ব্যাথা করে উঠলো সাথে সাথে।লোকটা চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এলো।রূপ খাটের উপর বসে মলমটা লাগানোর জন্য তার মুখ খুলছিল।আচমকা লোকটা এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
—যাচ্ছো কবে?
হঠাৎ কথা বলায় রূপ কেঁপে উঠলো।হাত থেকে মলমটা পরে গেল।তড়িঘড়ি সেটা তুলে জবাব দিল,
—কি?
লোকটা এবার রাগি চোখে তাকালো রূপের দিকে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—সারাজীবন আমার ঘাড়ে বসে খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
রূপ থতমত খেয়ে গেল। তবে কিছু বললো না।কারণ সে কোথায় যাবে?তার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।তাকে চুপ থাকতে দেখে লোকটা ঝাড়ি দিয়ে বললো,
—তাড়াতাড়ি নিজের রাস্তা মাপ।আমার অঢেল সম্পত্তি থাকলেও আমি তোমাকে এখানে রাখতে চাই না।আমার চোখের সামনে তো নাই।
বলে লোকটা ধপাধপ পায়ে চলে গেল রুম থেকে।রূপ বিছানার এক কোণায় বসে ভাবছে সে কোথায়?আর এখানে কিভাবে এলো?আর এই লোকটাই বা কে?এর মধ্যে ঘরে প্রবেশ করলো আরও একটা সুদর্শন যুবক। তবে ইনি একটু হালকা পাতলা ছিপছিপে গড়নের। গায়ে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট।চুলগুলো আগের লোকটার মতোই কপালে পরে আছে।ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—ভাবী আমি তনয়।ভাইয়ের এসিস্ট্যান্ট।
রূপ গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে।তারপর নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—আগের লোকটা কে?আপনার ভাই?
তনয় হাসলো।মাথা নাড়িয়ে বললো,
—হ্যাঁ। চিনেন নিশ্চয়ই বিখ্যাত চিত্র শিল্পী কুঞ্জ দেওয়ান। আর আমি তার বিখ্যাত এসিস্ট্যান্ট তনয় রহমান।
রূপ ঠোঁট উল্টায়। না বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
—না আমি চিনিনা।আসলে আঁকা-আঁকিতে তেমন আগ্রহ নেই তাই এই জগতের তেমন কেউকে চিনি না।
তনয় অবাক কন্ঠে বললো,
—কি বলেন ভাবী সারা দুনিয়া ভাইকে চিনে।
রূপ তনয়কে জিজ্ঞেস করলো,
—আচ্ছা উনি কি অনেক রাগি?
তনয় আবার হাসে।বেশ সুন্দর তার হাসি।হেসে জবাব দেয়,
—একটু! চলেন ভাবি আপনাকে ভাই খেতে ডাকছে।তারপর আবার আপনাকে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে।
বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে রূপ চমকায়।কোথায় যাবে ও?কোন বাড়ি যাবে ও?কোথাও তো ওর একটু জায়গা হবে না।তা ও খুব ভালো করে জানে।ওর ভাবনার মধ্যেই তনয় আবার বললো,
—কি হলো ভাবি কি ভাবেন?চলেন খাবেন।
রূপ চলে গেল তনয়ের পিছন পিছন।সারা বাড়ি সাদা রঙে ভর্তি তার মধ্যে কিছু কিছু আসবাব অ্যাশ রঙের দেখা যাচ্ছে। আর চারিদিকে বিভিন্ন পেইন্টিং-এ ভরা।বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট সব পেইন্টিং।বিশাল বড় বাড়িটার পাশ দিয়ে দুই ধাপের সিঁড়ি। সারা বাড়ি দেখতে দেখতে রূপ তনয়কে জিজ্ঞেস করলো,
—আচ্ছা আপনি কি আমাকে চিনেন?বা আমি আপনাদের কেউকে চিনি?
তনয় পিছন ফিরে রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
—আমরা চিনি আপনাকে আপনি আমাদের চিনননা।
রূপ জিজ্ঞেস করলো,
—কিভাবে চিনেন?
তনয় কিছু একটা ভেবে বললো,
—পরে একসময় সময় পেলে বলবো।এখন চলেন খেতে দেরি হলে ভাই আবার রেগে যাবে।
রূপ চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
—ওনার রাগ কি সব সময় নাকের ডটায় থাকে?
রূপের কথায় তনয় হাসলো।তনয়ের হাসি দেখে রূপের ঠোঁটও চওড়া হলো।কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে খাবার টেবিলের কাছে গেল।এতো বড় খাবার টেবিলে দেখে রূপের মুখ হা হয়ে গেল।এখানে পুরো পাল গোষ্ঠী বসে খেতে পারবে।এতো বড় খাবার টেবিল?টেবিলের একটা চেয়ারে খুব ভাবে সাথে বসে আছে কুঞ্জ। গায়ে তার কালো টিশার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত একটা কালো ট্রাওজার।চুলগুলো ভেজা হয়তো গোসল করেছে।রূপকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুঞ্জ রাগি কন্ঠে বললো,
—বসার জন্য কি এখন ইনভাইটেশন কার্ড পাঠাতে হবে? নাকি কুঞ্জ দেওয়ানের চেয়ার টেনে দিতে হবে।এমন কিছু ভেবে থাকলে সরি এসব কিছুই হবে না।
কুঞ্জের ঝাঁজালো শাসানিতে ভয় পেল রূপ।তড়িঘড়ি চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে ফেলে দিল একটা গ্লাস।তা দেখে কুঞ্জ যেন আরও ক্ষিপ্ত হলো।বাজখাঁই গলায় বললো,
—এই মেয়ে এটা কি করলে?ইডিয়েট একট!
রূপ অনুশোচনা থেকে বললো,
—আমি আসলে.. আমি দুঃখিত!আমি বুঝতে পারিনি।
কুঞ্জ আগের মতো চিৎকার করে বললো,
— হ্যাঁ।তুমি তো কিছুই বুঝতে পারোনা।অবুঝ তুমি এজন্যই তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করো।আবার মাঝ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকো।
রূপ কেঁপে উঠলো সেই বাজখাঁই কন্ঠে। আবার ভাবতে লাগলো।সে যে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে এটা এই লোকটা জানলো কিভাবে?
তনয় কুঞ্জকে ঠান্ডা করার জন্য বললো,
—ভাই কি করছেন?ভাবি ভয় পাচ্ছে।
কুঞ্জ রাগি গলায় বললো,
—শোনো তনয় এই মেয়েটাকে তুমি যতটা ইনোসেন্ট ভাবছো মেয়েটা ততোটাও ইনোসেন্ট না।তাড়াতাড়ি একে এর শ্বশুর বাড়ি ওর স্বামীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
চলবে..?
#হয়তো_তুমি_আসবে_বলে {১}
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি