শেষ বিকেলের রোদ- ৬ষ্ঠ পর্ব

0
1991

শেষ বিকেলের রোদ- ৬ষ্ঠ পর্ব
©শাহরিয়ার

— সোহান দেখ ভালো হবে না আমি মাকে ডাক দিবো।

— তুমি কি ডাক দিবে আমিই ডাক দিচ্ছি চা..

— ওমনি হাত দিয়ে মুখ চেঁপে ধরলো শুধু গোঙ্গানোর শব্দ বের হলো।

— সোহান তুই কি সবার মাইর খাওয়াবি আমাকে? বলে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।

— উফ তুমি এমন কেন? ব্যথা পাইনি বুঝি আমি?

— সোহান আমি তোকে ইচ্ছে করে ব্যথা দিতে চাইনি, তোর দোষেই তুই ব্যথা পেয়েছিস। একেতো সকাল সকাল ভিজিয়ে দিয়েছিস তার উপড় আবার চিৎকার করতে নিয়েছিলি।

— তো কি হইছে বলেই সোহানের বুকে ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসো সবাই নাস্তা করবে।

— ডাইনিং এ বসে সকলে নাস্তা করছি এমন সময় বাবার ফোনটা বেজে উঠলো।

— বাবা হ্যালো রাশেদা কেমন আছিস, বাড়ির সকলে কেমন আছে? খেতে খেতে অনেকটা সময় বাবা ফুপুর সাথে কথা বললো।

— বড় চাচা কি বললো রাশেদা?

— বাবা খুশির খবর আছে একটা

— বড় চাচা কি?

— বাবা আফরিনের বিয়ে ঠিক হইছে।

— বড় চাচা বলিস কি?

— বাবা জ্বি ভাইজান, রাশেদা বলতাছে আমাদের সকলকে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য।

— বড় চাচা বিয়ে কবে?

— বাবা আগামি সপ্তাহের রবিবারে।

— বড় চাচা কিন্তু এতোদিন আগে তো যাওয়া সম্ভব নয়।

— বাবা রাশেদা বলতাছে আমরা আগে যেতে না পারলেও ইকরা আর সোহানকে পাঠিয়ে দিতে। এতে করে আফরিনের মন ভালো থাকবে।

— বড় চাচা এটা ভালো হবে আমরা না হয় আগামি শুকবার চলে গেলাম। আর অনেক বছর হলো ওরাও যায় না।

— মনে মনে অনেক খুশি হলাম কত বছর গ্রামে যাই না, সেই ছোট বেলায় গিয়েছিলাম। এখনো মনে পড়ে পুকুর ঘাটে সাঁরি সাঁরি হিজল গাছ। সারা রাত পুকুরের হিজলের ফুল পরে থাকে। সকালে দেখতে কি সুন্দর লাগে। সব চেয়ে বড় কথা সোহানকে খুব কাছ থেকে অনন্ত একটা সপ্তাহ পাবো।

— বাবা তাহলে রাতের ট্রেনের টিকিট কেটে নিয়ে আসি সোহান কি বলিস?

— সোহান তোমার যা ভালো মনে হয় করো। আমার কোন সমস্যা নেই। আমি আজ যেয়ে সবাইকে এক সপ্তাহের ছুটি দিয়ে আসবো।

— বাবা তাহলে আর কি তোরা সব গুছিয়ে রাখিস আমি বিকেলের ভিতর টিকেট নিয়ে চলে আসবো।

— নাস্তার পর্ব শেষে সবাই যে যার মত রুমে চলে আসলাম। অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে মনের ভিতর। তরীকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম গ্রামে যাবো বিয়ে খেতে এক সপ্তাহ ভার্সিটিতে আসবো না। এরপর নিজের সব জামা কাপড় গুছাতে শুরু করলাম। সোহানের কিনে দেওয়া কাঁচের শাড়ি আর কাঁচের চুড়িটা হাতে নিতেই ইচ্ছে জাগলো এর সাথে ম্যাচিং করে সোহানের জন্য একটা পাঞ্জাবী কেনা দরকার। তবে তা সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিবো। সোহান বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই আমি মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিলাম। বললাম টুকটাক কেনাকাটা করতে হবে। মা টাকা দিতেই বেরিয়ে পরলাম বাড়ি থেকে।

— শপিং সেন্টারে এসে অনেক খোঁজাখুঁজির পর হালকা আকাশি রঙের একটা পাঞ্জাবী পেলাম। সাথে আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দুপুরের আগেই বাসায় ফিরে আসলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার মনে আছে ছোট বেলায় আমরা গ্রামের পুকুরে কত মজা করে গোসল করছি?

— তুই বড় না আমি বড়? তোর মনে থাকলে আমার কেন থাকবে না? খবরদার আমার সাথে যাবি ভালো হয়ে থাকতে হবে কোন রকম উল্টা পাল্টা কিছু করবি না। পুকুরপাড়, বন জঙ্গল কোথায় যেতে পারবি না।

— আমার কি আর কাজ নেই, যে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো?

— কথা কম বলে খেয়ে নে, নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে আমার গুলো গুছিয়ে দিবি।

— তুমি বড় না আমি বড়? তুমি যেহেতু বড় সেহেতু তোমার গুলো গুছিয়ে এসে আমার গুলো গুছিয়ে দিবে।

— কান টেনে ধরে বেশী পাকনা হয়ে গেছিস তুই ফুলটুসি, আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস।

— ছাড়ো ব্যথা পাচ্ছি, বড় চাচী দেখ তোমার ছেলে আমাকে মারছে।

— সোহান ছাড় ওকে, তোর শরম লাগে না ওর গায়ে হাত তুলতে?

— কেন শরম লাগবে?

— কেন শরম লাগবে না? ও বড় হচ্ছে সেদিকে তোর খেয়াল আছে?

— ফুলটুসি আবার বড় হয় নাকি?

— না তুই শুধু বড় হতে পারিস হাতীর মত, আর সবাই ছোট থাকবে সারা জীবন।

— আমি কি তা বলছি নাকি? ওরে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আমার রুমে এসে সব গুছিয়ে দিতে বলো আমি গেলাম।

— রুমে এসে সব জামা কাপড় গুছিয়ে নিলাম, জামা কাপড়ের মাঝে সোহানের জন্য কিনে নিয়ে আসা পাঞ্জাবীটাও রাখলাম। নিজের কল্পনার জগৎ এ পাঞ্জাবী পড়া অবস্থায় সোহানকে কল্পনা করলাম, একদম রাজ কুমারের মত লাগে সোহানকে। শাড়ি পরে ওর পাশে আমাকে বেশ মানাবে। আচ্ছা আমি যে এতো কিছু কল্পনা করি ওকে নিয়ে এতো ভাবি ওকি আমাকে নিয়ে ভাবে? নাকি ওর কল্পনাতে অন্য কারো ছবি আঁকে? নানান রকম চিন্তা নিয়ে ব্যাগটা এক সাইডে রেখে ওর রুমের দরজার সামনে এসে নক করলাম।

— ভিতরে আয় ফুলটুসি।

— রুমের ভিতর ঢুকে আচ্ছা আমি যে আসছি এটা তুমি কি করে বুঝলে? অন্য কেউও হতে পারতো। বলে তাকাতেই দেখতে পাই সোহান খালি গায়ে টিশার্ট পরতাছে।

— এই তুমি খালি গায়ে কেন? আর আমি এসেছি কি করে বুঝলে?

— কি আজব আমি কি মেয়ে মানুষ নাকি খালি শরীরে থাকতে পারবো না? আর তুই ছাড়া যে অন্য কেউ এই সময় আসবে না এটা আমি ভালো করেই জানি।

— হয়েছে আর ঢং এর কথা বলো না, কি কি নিবে দাও।

— তোর যা যা মন চায় সব ব্যাগে ঢুকিয়ে নে।

— কি আজব তোমার কি কি লাগবে আমি কি করে বলবো?

— আলমারির ভিতর সব আছে প্যান্ট শার্ট টিশার্ট সব যেগুলো ভালো লাগে নিয়ে নে।

— তুমি এক কাজ করো তোমার পছন্দের খেয়াল রাখার জন্য একটা বিয়ে করে নাও।

— আমার মত বেকার কে বিয়ে করার জন্য মেয়েদের লাইন লেগেছে বাহিরে যেয়ে দেখে আয়।

–বাহিরে যেয়ে দেখতে হবে কেন? তোমার গার্লফ্রেন্ডকেই বিয়ে করে ফেলো।

— প্রচণ্ড শব্দ করে হাসতে হাসতে গার্লফ্রেন্ড সেটা আবার কিরে?

— জামা গুছাতে গুছাতে ফাজলামো কইরো না। কত মেয়ের সাথে যে রিলেশন আছে কে জানে।

— যেহেতু কেউ জানে না আর জানার দরকার ও নাই এখন চুপচাপ নিজের কাজ কর আমি একটু ঘুমিয়ে নেই।

— ঘুমাও ঘুমিয়ে স্বপ্নের দুনিয়াতে হারিয়ে যাও।

— কেন তোর হিংসে হয়?

— আমার হিংসে হবে কেন তুমি ঘুমাও সারা রাত আমার বকবক শুনতে হবে।

— সেতো আমার জানা আছে তুই এখন যা ফুলটুসি।

— জামা কাপড় গুছিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। ব্যাগের ভিতর বই গুলো গুছিয়ে নিলাম। বিকেলে বাবা আর বড় চাচা এসে ট্রেনের টিকেট দিয়ে দিলো। সেই সাথে সোহানকে বলে দিলো আমাকে কোন রকম জ্বালাতন না করতে।

— সন্ধ্যার পর পর আমরা রওনা হয়ে গেলাম রেলস্টেশন এর উদ্দেশ্যে রাত আটটার ট্রেন। কতদিন পর লং জার্নিতে যাচ্ছি এই অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। সব চেয়ে বেশী ভালো লাগছে ভালোবাসার মানুষটির সাথে যাচ্ছি। যদিও জানিনা ভালোবাসাটা এক তরফা কিনা। সোহানকে জিজ্ঞাসা করার সাহস ও আমার নেই।
তবে এবার আমাকে বুঝতে হবে জানতে হবে সোহানের মনে কেউ আছে কিনা। কিংবা সোহান কাউকে ভালোবাসে কিনা। সোহান চুপ করে বসে আছে সি.এন.জিতে, বাহিরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে বাহিরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছি, সোহান নিজের মত ফোন টিপে চলছে।

— সি.এন.জি থেকে নেমে যখন রেলস্টেশনে ঢুকতে ঢুকতে অনেকটা ভিজে গেলাম। ট্রেন আসতে প্রায় ত্রিশ মিনিটের মত বাকি। সোহান দোকান থেকে টিসুর প্যাকেট এনে এগিয়ে দিতে দিতে তাড়াতাড়ি মাথা মুছে নে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

— টিসুর প্যাক হাতে নিয়ে লাগবে না ঠাণ্ডা, তুমিও মুছে নাও মাথাটা বলে প্যাক থেকে একটা টিসু বের করে এগিয়ে দিলাম সোহানের দিকে। সোহান মাথা মুছতে শুরু করলো। মাথা মুছা শেষ করে আবার দোকানের দিকে এগিয়ে যেয়ে চিপস, আর জুসের প্যাকেট নিয়ে আসলো।

— আটটা তিন মিনিটে ট্রেন রওনা করলো আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। দু’জন পাশাপাশি সিটে বসে আছি আর সারা রাত এভাবেই থাকবো।
কি এক অসাধারণ রাত।

— চিপসের প্যাক খুলে চিপস খাওয়া শুরু করতেই সোহান কিরে এখনি সব খেয়ে শেষ করবি সারা রাত বাকি রয়েছে।

— কখন ঘুমিয়ে যাই ঠিক আছে? তার চেয়ে বরং খেয়ে নেই, নাহলে আমি ঘুমিয়ে পড়লেতো তুমি সব খেয়ে শেষ করবে।

— খা বেশী করে খা, খেয়ে খেয়ে ফুলটুসি থেকে ফুলবানু হয়ে যা।

— ফুলবানু কে তোমার গার্লফ্রেন্ড নিশ্চই?

— ফুলবানু তোর মাথা ফুলটুসির আপডেট ভার্সন হচ্ছে ফুলবানু।

— আচ্ছা আমার মাথা যেহেতু সেহেতু তোমার কাঁধে রাখি বলেই মাথা সোহানের কাঁধে রাখলাম।

— সোহান মাথাটা ফাটিয়ে দেই?

— উহু, তোমাকে একটা কথা বলি?

— বল

— সবার সামনে আমাকে ফুলটুসি বইলো না প্লিজ।

— হাজার বার বলবো, যখন মন চায় তখন বলবো ফুলটুসি ফুলটুসি ফুলটুসি।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here