শুধু তুমি 💞
পর্বঃ- ৬
Samira Afrin Samia
#নিপা
নীল আর তনার দিন গুলো এভাবেই ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে কাটতে লাগলো। যতই দিন যাচ্ছে নীল আর তনার ভালোবাসা ততই গভীর হচ্ছে। নীল তো তনাকে না দেখে এক মূহুর্ত ও থাকতে পারে না। তনার একটু কিছু হলে নীল পুরো পাগল হয়ে যায়। এই তো সেদিন নীল অফিসে ছিল। কেন ই জানি ঐদিন নীলের কোন কিছু ভালো লাগছিল না। কোন কাজেই মন বসছিল না। বুকের মাঝে কেমন অজানা একটা ব্যথা অনুভব করছিল। বার বার মনে হচ্ছিল তনা ঠিক আছে তো। তনার কিছু হলো না তো। নীল আর অফিসে বসে থাকতে পারলো না। সব কাজ ফেলে রেখে বাসায় চলে আসলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলছে না। নীলের ভয় টা আরও বাড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ কলিং বেল বাজানো পরও যখন ভেতর থেকে তনার কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছে না। তখন নীল বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকলো। নীল ভেতরে এসে দেখে তনা ফ্লোরে পড়ে আছে। নীল তনা বলে দৌড়ে এসে তনাকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে রুমে চলে গেল।নীল কিছু ভেবে না পেয়ে ডক্টর কে ফোন দিয়ে আসতে বললো।
—————————
কিছুক্ষন পর,,,,,
ডক্টর তনার পাশে বসে তনাকে চেকআপ করছে। নীল তো পুরো পাগল হয়ে গেছে। যে ডক্টর তনাকে দেখছে ইনি নীল দের ফেমিলি ডক্টর। কারো কিছু হলে সব সময় ইনি ই চিকিৎসা করেন।নীল পুরো রুমে পায়চারি করছে আর ডক্টরের কাছে বার বার তনার কথা জিঙ্গেস করছে।
— ডক্টর প্লিজ বলুন না তনার কি হয়েছে?
— কাম ডাউন নীল। তোমার ওয়াইফের তেমন কিছু হয়নি। প্রেসার টা কমে গিয়েছিল তাই হয়ত মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
— শুধু কি প্রেসার কমে যাওয়ার কারনে এমন হয়েছে নাকি সিরিয়াস কিছু। প্লিজ ডক্টর প্লিজ বলুন।
— তেমন সিরিয়াস কিছু না। শুধু প্রেসার ই কম। আর তনার শরীর অনেক র্দুবল।মনে হয় খাওয়া দাওয়ার প্রতি একদম মনযোগ নেই। তুমি সারা দিন অফিসে থাকো।ওর বাসায় একা থাকে ঠিকমত খায় ও না মনে হয়। ওর সাথে কেউ একজন থাকা দরকার তাহলে ওর একাকিত্বটা কম হবে।
— হুম ডক্টর। এখন থেকে তনার খাওয়ার প্রতি খুব নজর দিব।আর ওকে একা ও ছাড়বো না।
— আচ্ছা নীল তনা কি কোন কিছু নিয়ে খুব বেশি টেনশন করে?
— ডক্টর আপনি তো সব ই জানেন। তনার তো ঐ একটা বিষয় নিয়েই সকল টেনশন। কিন্তু কিছু দিন ধরে মনে হয় অন্য কিছু নিয়েও টেনশন করে।
— আসলে তনা সারাক্ষণ বাসায় একা থাকে তো। তাই সারাক্ষণ শুধু এগুলো নিয়েই ভাবতে থাকে। তনার সাথে যদি কেউ থাকত তাহলে তার সাথে কথা বলতে পারত।বা ওর বেশি কিছু কাজ থাকলে। কাজ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তনার জন্য এটা সবচেয়ে ভালো হবে ও যদি কারো সাথে সব সময় থাকে কথা বলতে পারে।
আর নীল তুমিও তনাকে একটু সময় দিও।অনেক তো কাজ করেছ এখন একটু ওয়াইফের খেয়াল রাখ।
— হুম ডক্টর আমি তনার খুব খেয়াল রাখবো।
— আচ্ছা আজ তাহলে আমি আসি।
— হুম চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
— না তার দরকার হবে না। তুমি তনার পাশে থাকো।আমি আসি।
— ধন্যবাদ ডক্টর।
ডক্টর চলে গেলে নীল তনার পাশে বসে। তনার হাত নীলের হাতে মুঠোয় নিয়ে অপলক দৃষ্টি নিয়ে তনার দিকে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তের মধ্যে নীলের চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল জমা হয়ে গেল। কিন্তু জলের কণা গুলো নীলের অনুমতি ছাড়া চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে না। তনা একটু একটু করে চোখ মেলছে। তনার জ্ঞান ফিরতে দেখে নীল বাম হাত দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা জল গুলো মুছে নিল।তনা নীল কে দেখে উঠতে চেষ্টা করলে নীল তনাকে বাঁধা দিতে শুয়ে থাকতে বললো। তনা শুয়ে শুয়েই নীলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো।
— নীল তুমি এখানে। অফিস থেকে কখন আসছো?
আর কি হয়েছিল আমার। আমাকে এভাবে শুইয়ে রাখছো কেন?
— চুপ একটা কথা ও বলবা না। কি হয়েছিল তোমার??
তুমি জানো না কি হয়েছিল তোমার?
না খেয়ে টেনশন করে নিজের কি অবস্থা করেছ একবার দেখ তো। প্রেসার লও মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলে। আমি বাসায় এসে দেখি তুমি নিচে পড়ে ছিলে।
তনা কিছু বলছে না কারণ তনা জানে এখন কিছু বলতে গেলেই নীলের বকা খেতে হবে। তাই তনা চুপ করে নীলের কথা গুলো হজম করছে।
— কি হলো কিছু বলছ না কেন?
কত দিন ধরে এভাবে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করো না?
এতো কিসের টেনশন তোমার। তুমি কি এটা বুঝ না তুমি ভালো না থাকলে যে আমি ও ভালো থাকি না। তুমি যে আমার ভালো থাকার মেডিসিন এটা তুমি কবে বুঝবে?
তনা এবার ও কিছু বললো না। শুধু নীলের দিকে তাকিয়ে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে একটা হাসি দিয়ে নীলের বুকে মাথা রেখে আলতো করে নীলকে জড়িয়ে ধরলো। তনা মাঝে মাঝে এমন করে যার কারনে নীল তনাকে কিছুই বলতে পারে না। তনার মায়া মাখা মুখটা দেখে নীল সব কিছু ভুলে যায়।
— তনা….?
— হুম।
— সারদিন বাসায় একা থাকতে তোমার ভালো লাগে?
— ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই। তুমি তো আর অফিস ফেলে রেখে আমার কাছে বসে থাকবে না।
— তাই ভাবছিলাম তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য একজন লোক রেখে দিই?
— একা একাই তো আমার ভালো লাগে। নিজের কাজ গুলো সেরে ছাঁদে ফুল গাছ গুলোর যত্ন নেই। মাঝে মাঝে টিভি দেখি। এভাবেই তো আমার সময় কেটে যায়।
— পরেও এমন একজন যদি সব সময় তোমার সাথে থাকে যার সাথে তুমি কথা বলতে পারবে আড্ডা দিতে পারবে। তাহলে খারাপ হয় না তাই না?
— হুম। তুমি যা ঠিক মনে করো।
————————————-
নীল ওর স্টাডি রুমে বসে আছে। ফোন টা হাতে নিয়ে জাহিদ কে কল করলো। কিছুক্ষন রিং হওয়ার ওর ওপাশ থেকে জাহিদ ফোন রিসিভ করলে।নীল এপাশ থেকে বলতে শুরু করলো
— জাহিদ আর্জেন্টলি নিউজ পেপারে কাজের লোকের জন্য বিজ্ঞাপন দেও। আমার বারো ঘন্টার মধ্যে একটা কাজের লোক চাই।
— ওকে স্যার এখুনি দিচ্ছি।
নীল ফোন রেখে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তনা দাড়িয়ে আছে। নীল তনাকে ডেকে
— তনা কি হলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।
— না ভাবছিলাম তুমি কাজ করছো তাই তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না।
— ধুর কিসের কাজ। আমি তো শুধু কাজের লোকের জন্য জাহিদের সাথে কথা বলছিলাম।
— তুমি বাসায় কাজের লোক রাখার জন্য এতো ব্যস্ত হলে কেন? আমার রান্না কি তোমার কাছে ভালো লাগে না?
— আরে পাগলী তার জন্য না। তুমি বাসায় একা থাকো তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন হয়।দেখলে না আজ কেমন একা বাসায় মাথা ঘুরে নিচে পড়ে ছিলে।
আমি যদি বাসায় না আসতাম তাহলে কেমন হতো?
— নীল তুমি আমাকে এত ভালোবাসো কেন?
নীল তনাকে ওর কোলে বসিয়ে। আলতো করে তনার গালে হাত রেখে
— তুমি যে আমার পাগলী বউ তাই তোমাকে এতো ভালোবাসি।
তনা মিষ্টি করে হেসে দিয়ে। নীলের নাক টেনে নিয়ে
— তাই বুঝি মি.হাজবেন্ড?
— হুম গো পাগলী বউ।
——————————
নীলের কথা মত বারো ঘন্টা হবার আগেই কাজের লোকের লাইন লেগে গেল।লাইন লাগার ই কথা দ্বিগুণ বেতন দিলে সবাই কাজ করতে চাইবে। সাথে থাকা খাওয়া ফ্রি। অনেক জনের ভিতর থেকে জাহিদ কয়েক জন কে সিলেক্ট করে নীলের কাছে নিয়ে আসলো।নীল তাদের মধ্যে থেকে যে কোন একজন কে বেছে নিবে।
নীল দুই তিন জনের মধ্যে থেকে তনার বয়সী এক মেয়েকে কাজে রাখলো। মেয়েটা গ্রাম থেকে আসছে। খুব দরিদ্র পরিবারের। এবার এসএসসি এক্সাম দিতে পারেনি। বাবা মারা যাওয়ার কারনে মা তাকে নিয়ে লোকের বাসায় কাজে গেছে।
নীল আর তনা সোফায় বসে আছে আর মেয়েটা সামনে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা কে দেখে তনার খুব মায়া হচ্ছে। তনা মেয়েটা কে উদেশ্য করে জিঙ্গেস করলো
— তোমার নাম কি?
— আমার নাম লিনা।
— ওহ। তুমি এত ছোট বয়সে লোকের বাসায় কাজ করতে আসছো।তুমি সব কাজ পারো?
— হুম ম্যাডাম। আমি সব কাজ পারি। ছোট থেকেই মায়ের সাথে এটা সেটা করতে করতে সব শিখে গেছি।
— তোমার পরিবারে কে কে আছে?
— ম্যাডাম আমার পরিবারে শুধু আমি আর আমার মা। বাবা মারা গেছে আমি ক্লাস সেভেন এ থাকতে। বাবা মারা যাওয়ার পরও মা লোকের বাড়ি কাজ করে খুব কষ্ট করে আমাকে লেখা পড়া করিয়েছে। কিন্তু আমার এসএসসি পরীক্ষার কিছু দিন আগে মা অসুস্থ হয়ে পড়ে যার কারনে আমার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। মার চিকিৎসার টাকার জন্য ই আমি শহরে কাজ করতে আসছি।
লিনার কথা শুনে তনা প্রায় কান্না করে দিল। ছোট একটা মেয়ে তার এখন হেসে খেলার বয়স। কিন্তু এই বয়সে সে মায়ের চিকিৎসা করার জন্য লোকের বাসায় কাজ করতে আসছে।
নীল তনার দিক লক্ষ্য করে দেখে তনা কান্না করে দিচ্ছে। তাই নীল আর কথা বাড়ালো না।
— আচ্ছা আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। তোমার থাকা খাওয়া ফ্রি। আমি তোমার দু’মাসের কাজের বেতন এডভান্সড দিয়ে দিচ্ছি।
— আচ্ছা স্যার।
নীল তনাকে নিয়ে উপরে রুমে চলে গেল।
কিছু দিনের মধ্যেই লিনার সাথে তনার খুব ভাব হয়ে যায়। লিনা মেয়েটি খুব মিশুক। আর অনেক চঞ্চল। ঘরের সব কাজ খুব গুছিয়ে করতে পারে। তনার কথায় নীল লিনাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। নীল এখন তনাকে রেখে অফিসে যেতে ভয় পায় না। তনা লিনার সাথে সময় কাটায়। হাসি ঠাট্টায় সারাটা দিন কেটে যায়।
এভাবে দেখতে দেখতে এক মাস পার হয়ে যায়।
চলবে….