শেষ বিকেলের রোদ-১০ম পর্ব
©শাহরিয়ার
— জীবনে প্রথম কোন পুরুষের ঠোটের স্পর্শে সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। প্রাণপণ চেষ্টা করলাম নিজেকে সে ঠোটের স্পর্শ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে। একটা সময় বুঝতে পারলাম আমি পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছি। তখন শুধু চোখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় আমি খোলা দেখতে পেলাম না। চোখের কোনে পানি চলে আসলো। গাল বেয়ে টপ করে পানি সোহানের গালে পরতেই সোহান আমাকে ছেড়ে দিলো। আমি ছাড়া পেতেই লাফিয়ে উঠে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে পরলাম। পেছন থেকে সোহান ডেকে চলছে। আমি একবারের জন্য ফিরে তাকালাম না সোজা এসে পুকুর ঘাটে বসলাম। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পানি পরছে। কি হতে কি হয়ে গেলো কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না।
— দীর্ঘ সময় পুকুর ঘাটে বসে থেকে অবশেষে চোখের পানি মুছে ঘরে চলে আসলাম।
আফরিন :- কিরে এমন মন মরা হয়ে আছিস কেন?
— মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে তুলে কই নাতো,
আফরিন:- কি হয়েছে সত্যি করে বলতো।
— আরে কিছু হয়নি, বাবা মায়ের সাথে দু’দিন কথা বলিনি তাই খারাপ লাগছে।
আফরিন:- ওহ এই ব্যাপার ফোন দে কথা বল, আমি রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছি দুপুরের জন্য রান্না করতে হবে।
— আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম আচ্ছা আমি কান্না করছি কেন? এটা সুখের কান্না নাকি দুঃখের আমিতো বরাবরই এমনটা চেয়েছি। সোহানের ভালোবাসা তবে কেন আজ এমন লাগছে। আর যা হয়েছে তার দোষ কি আমার নয়? ভাবতে ভাবতেই ফোনের মেসেজ বেজে উঠলো ফোনটা হাতে নিতেই সোহানের নাম্বার থেকে ছোট একটা মেসেজ যেখানে লেখা সরি। একটু হাসলাম আবার লজ্জাও লাগলো মনে মনে বলতে শুরু করলাম সরির বদলে কেন লেখলে না ভালোবাসি?
— দুপুরে খাবারে টেবিলে বসে আছি সোহান ফুপার সাথে বাহিরে গেছে অনেক মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে। সোহানকে ছাড়া খেতে কেমন কেমন যেন লাগছিলো। হঠাৎ করেই ফুপু বলে উঠলো কিরে খাচ্ছিস না কেন?
— কই খাচ্ছিতো ফুপু।
ফুপু:- খাবার ভালো হয়নি?
— অনেক ভালো হইছে ফুপু।
আফরিন:- কিরে তার কথা মনে পড়ছে নাকি?
— কি সব বলো না তুমি আপু ফুপু শুনলে কি মনে করবে?
আফরিন:- আরে শুনবে না, এক কাজ কর তারে ফোন দিয়ে কথা বল।
— না দরকার নেই, খাওতো আমার খুব খুদা লেগেছে।
আফরিন:- কত যে খুদা লেগেছে তাতো দেখতেই পাচ্ছি।
— আপু
আফরিন:- আচ্ছা খা আর কিছু বলবো না।
— লাঞ্চ শেষ করে রুমে আসতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।
বাবা:- হ্যালো মা কেমন আছিস?
— ভালো বাবা তোমরা সকলে কেমন আছো আর কবে আসবে?
বাবা:- আমরাও সকলে ভালো আছি, বিয়ের আগের দিন চলে আসবো। সোহান কোথায় ওর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।
— ওতো ফুপার সাথে বাহিরে গেছে বিয়ের কার্ড দেওয়ার জন্য হয়তো নেটওয়ার্ক পায় না তাই বন্ধ দেখাচ্ছে।
বাবা:- আচ্ছা নিজের খেয়াল রাখিস আর সোহানকে জ্বালাবি না একদম, সারাদিনতো ছেলেটার সাথে ঝগড়া করিস।
— হ্যাঁ সব দোষতো আমার আর তোমাদের ছেলেতো খুবি ভালো, আমিই শুধু খারাপ।
বাবা:- দেখ মেয়ে কি বলে? এমনটা বলছি আমি।
— হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।
বাবা:- আচ্ছা রাখছি নিজের খেয়াল রাখিস।
— বাবার সাথে কথা বলে বিছানায় শুয়ে পরলাম। পাশে এসে আফরিন আপুও শুয়ে পরলো। দু’জন মিলে গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম।
— সন্ধ্যায় ফুপুর ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।
ফুপু:- ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা করবি। বলে ফুপু চলে গেলো। আমি আর আপু ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে যেতেই দেখতে পেলাম সোহান মাথা নিচু করে বসে আছে। আমার ও ওর দিকে তাকাতে কেমন জানি লজ্জা লাগছিলো। ফুপু সবাইকে নাস্তা খেতে দিলো। নাস্তা খেতে খেতে ফুপা বললো সোহানকে আজ নাস্তা বাড়িয়ে দাও, সারা দিন অনেক পরিশ্রম করছে।
সোহান:- কি যে বলেন না ফুপা আপনি, এটা কোন ব্যাপার হলো? আর দুপুরেতো দু’জন এক সাথেই লাঞ্চ করলাম।
ফুপা:- আরে বোকা ছেলে বুঝে না তোমার নাম আর আমাদের সকলের কাম। কি বলিস ইকরা?
— জ্বি ফুপা ঠিক বলেছেন বলেই সোহানের দিকে তাকালাম। সোহান তখনো মাথা নিচু করে নাস্তা খাচ্ছিলো, এক বারের জন্যও এদিকে তাকাচ্ছিলো না দেখে রাগে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। আচ্ছা ফুপা বাহিরে কি খুব রোদ ছিলো নাকি আজ?
ফুপা:- কই নাতো কেন?
— না এমনি একজন মাথা নিচু করে খাচ্ছে মনে হচ্ছে রোদে চেহারা পুড়ে গেছে তাই মাথা নিচু করে রাখছে।
ফুপা:- ওহ আচ্ছা হয়তো ক্লান্ত লাগছে ওর সারা দিন জার্নি করছে।
— ওহ তাহলে কি আজ স্যারের হাত পা টিপে দিতে হবে মনে হয়।
ফুপু:- এই ইকরা কি সব বলছিস, সব সময় এতো লেগে থাকিস কেন ওর সাথে।
— কোথায় লেগে থাকলাম আমিতো ভালো কথা বললাম, আর আমি মাঝে মাঝেই দেইতো এমন করে তাইনা ভাইয়া।
সোহান:- কাশতে কাশতে হ্যাঁ দেয়তো মাঝে মাঝে।
— হ্যাঁ সমস্যা নেই আজও দিবো, বাবা ফোন দিয়েছিলো বললো তাদের ছেলেকে দেখে রাখার জন্য। আর যেহেতু ফোন দিয়ে বলেই দিয়েছে তখন কি আর সেবা না করে থাকতে পারি বলো তোমরা?
ফুপু:- হয়েছে এখন চুপ করে খাতো তোরা।
— সবার নাস্তা শেষ হতেই বললাম চা করে দিবো সবাইকে? বলতেই সোহান আমার দিকে তাকালো, আমি ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে শুরু করলাম।
সোহান:- আমি চা খাবো না।
— বললেই হলো ফুপু তুমি বসতো আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি, দেখি চা না খেয়ে যেতে পারে কিনা। যদি এখান থেকে উঠছো তাহলে তোমার খবর আছে বলেই হাঁটা শুরু করলাম রান্না ঘরের দিকে। আর মনে মনে বলছি এতো ভিতুর ডিম একটা।
— অল্প সময়ের ভিতর চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম সবার দিকে চা এগিয়ে দিতে শুরু করলাম। সোহানের দিকে চা বাড়িয়ে দিতেই সোহান কাঁপা কাঁপা হাতে কাপটা ধরলো, আমি ওর কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম ভয় নেই মরিচ দেইনি।
— চা খাওয়া শেষ হতেই সবাই যার যার মত উঠে পরলাম। সেখান থেকে বের হয়ে চলে আসলাম পুকুর ঘাটে। আমার পিছু পিছু সোহানও ছুটে আসলো।
সোহান:- এই তোর সমস্যা কিরে? তোকে সরি বলছি না?
— একটা সরিতে কি সব শেষ হয়ে গেলো?
সোহান:- তাহলে কি করতে হবে পায়ে ধরে মাফ চাইতে হবে?
— কি আজব আমি কি বলছি তুমি এমন করো?
সোহান:- তাহলে এমন করে খোঁচা মেরে কথা বলছিস কেন?
— তো কি করবো তুমি কি করছো তা কি ভুলে গেছো?
সোহান:- না ভুলে যাইনি, আর তা ইচ্ছে করে করিনি।
— তাহলে এখন ইচ্ছে করে করো।
সোহান:- মানে?
— মানে কি তুমি বুঝনা?
সোহান:- তোর মাথা কি ঠিক আছে?
— তোমার কি আমাকে পাগল মনে হয় বলেই সোহানের মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
সোহান:- কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে দেখ ভালো হবে না কিন্তু।
— ভালো হবে না তো কি হবে?
সোহান:- আমি যাচ্ছি বলেই ঘুরে দাঁড়ালো।
— হাত ধরে টান দিয়ে এই কই যাচ্ছো তুমি? বলেই হাত ধরে আবার টান দিতেই কাত হয়ে গেলো সোহান।
সোহান:- ফুলটুসি ভালো হচ্ছে না কিন্তু।
— সোহানের কাঁধের উপর হাত রেখে মুখটা সোহানের মুখের সামনে নিয়ে কি ভালো হচ্ছে না?
সোহান কিছু বলতে যাবে ওমনি পুকুর ঘাটের দিকে কারো আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত সোহানকে ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়ালাম।
আফরিন:- তোমরা দু’জন এখানে কি করো?
সোহান:- কিছু না এমনি দাঁড়িয়ে আছি আলো আঁধারিতে পুকুরের পানির ঢেউ দেখতে ছিলাম। তুই কোথায় যাচ্ছিস?
আফরিন:- এই যে এই ইকরা কে খুঁজতে বের হলাম। ঘরে আসেনি তাই ভাবলাম হয়তো তোমার ঘরে গেছে ওখানে গিয়েও পেলাম না তোমাদের কাউকে তাই ভাবলাম হয়তো এদিকে আসছো তাই এখানেই চলে আসলাম।
— ভালো করেছো এখানে এসেছো এখন তিনজন বসে গল্প করতে পারবো।
আফরিন:- এখানে এখন মজা হবে না গল্প করে অন্ধকার হয়ে আসছে, আরও কিছুক্ষণ পর পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে তখন মজা হবে। কখনো পুকুরের পানিতে চাঁদ দেখেছিস?
— নাতো কখনো দেখিনি,
আফরিন:- আজ চাঁদ উঠলে দেখতে আসিস এখন ঘরে চল।
— আপুর সাথে হাঁটছি আর মনে মনে বলছি আজতো চাঁদ দেখবোই তবে একা নয় সোহানের সাথে। ভাবতে ভাবতে তিনজন মিলে রুমে চলে আসলাম। রুমে আসতেই সোহানের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। বড় চাচা ফোন করেছো।
সোহান:- হ্যাঁ বাবা বলো, তারপর অনেকটা সময় দু’জন কথা বলে ফোনটা এগিয়ে দিলো।
— সালাম দিয়ে হ্যাঁ আমি ভালো আছি, কোন সমস্য্ হচ্ছে না, টুকটাক আরও অনেক কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। তারপর তিনজন মিলে গল্প করতে শুরু করলাম। আমিতো অপেক্ষায় আছি পূর্ণিমার চাঁদ উঠার। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে যেতেই চাচ্ছে না। সোহান কিছুটা ভয়ে আছে তা বুঝাই যাচ্ছে তবে আমি খুব মজা পাচ্ছি এ ভেবে জীবনে প্রথম বারের মত ভালোবাসার মানুষটা সাথে পুকুর ঘাটে বসে পূর্ণিমার চাঁদ দেখবো।
চলবে…