#মাশুল (তৃতীয় পর্ব)
সাতই জুন এখনো আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। শিলার জন্মদিন! ক্যাম্পাসে প্রতিবার ওর জন্মদিনটা পালন করতাম একটু ভিন্নভাবে। শেষবার আমি আর ও কেক কেটে খাইয়েছিলাম শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের পথশিশুদেরকে! শিলা ভীষণ আনন্দ নিয়ে জানালো এটাই ওর জীবনের সেরা জন্মদিন পালন।
সেই সাতই জুনে বন্ধুদের ফেসবুক গ্রুপে সবাই শিলাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় ভাসালো। দুরু দুরু বুকে আমিও! পোস্টটা মুহূর্তেই সবার এটেনশনে। আমার মতো অনেক বন্ধুরাও টান টান উত্তেজনায়, শিলার কি রিএক্ট করে সেটা দেখার জন্য।
পরদিন শিলা আমার শুভেচ্ছার উত্তরে ধন্যবাদ দিয়ে ভদ্রগোছের একটা ফিরতি কমেন্ট করে। ব্যস ওতোটুকুনই! ঐ ছোট্ট কমেন্টটা যে কত শতবার পড়লাম, আর পড়ে পড়ে কতোবার যে কেঁদেছি তার কোন হিসাব নেই। শিলা কিন্তু ঐ মন্তব্যটা ছাড়া আমাকে আর কিছুই লিখেনি। তবুও সবকিছু মিলে এতেই আমার মধ্যে তীব্র কষ্টের একটা অনুভূতি তৈরী হল।
মাস দুয়েক আগে ভার্সিটির ক্লাসমেটরা আমাদের ব্যাচের পনের বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটা অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিল, গ্রুপ ডিসকাশনেই। ডিসেম্বরে রিইউনিয়ন হবে, ভেন্যু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
খুব জোরালো একটা গ্রুপ ডিসকাশন হল, যদিও আমি এসব আলোচনার এক নীরব শ্রোতা। ছেলেদের কয়েকজন আমাকে রিইউনিয়নে পার্টিসিপেট করার অনুরোধ জানায়। দেশে আসার ইচ্ছা নাই, তাই আগ্রহ দেখালাম না।
“ডিসেম্বরের রিইউনিয়নে কি আসছো নিলু?” আচমকাই শিলার পাঠানো একটা পার্সোনাল মেসেজে রীতিমতো উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করলাম। কথাটা আমার ভিতরে যে কি পরিমাণ তোলপাড় তুলে গেল তা বলে বোঝানো যাবে না। মনে হল তখুনিই দেশে রওনা দেই। শিলাকে দেখার হঠাৎ তীব্র ইচ্ছায়।
ভার্সিটি লাইফে শিলাকে আদর করে মাঝে মধ্যে আমি “শীলু” বলে ডাকতাম। শিলাও আমাকে ডাকে “নিলু” বলে। ওর ডাকটা আদর না মজা করে, তা অবশ্য কখনোই জানা হয়নি। দশ বছর পর শিলার এই “নীলু” ডাকটাই আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায়, প্রিয় মানুষ যে সবসময়ই প্রিয় থেকে যায়।
ওর ম্যাসেজটার উত্তরে কিছু না ভেবেই জানালাম রিইউনিয়নে আসছি। দ্বিতীয় ম্যাসেজটা ছিল “শুধুমাত্র তোমাকে দেখতে!” ওটা লিখেও মুছে ফেললাম। মনে পড়ে গেল ওকে এসব লেখার অধিকার হারিয়েছি, এসব ম্যাসেজ মোটেও শোভন নয়।
তারপরও ঐদিন এতো বেশি খুশি হয়েছি যে দৌড়ে গিয়ে শিলাকে দেখে আসলাম! ভাবছেন এই শিলা আবার কে? লিমেরিকে শিলাই বা আসলো কিভাবে?
বিষয়টা একটু খুলে বলছি, যদিও বিষয়টিতে একটু লজ্জার বা টিনেজ প্রেমের ব্যাপার স্যাপার আছে। তারপরও আপনাদের জানিয়ে রাখলাম, গল্পের প্রাসঙ্গিকতায়।
লিমেরিকে আসার পর থেকেই আমি নিয়ম করে প্রতিদিন বিকালে শ্যানন নদীর পাড় ধরে অনেকক্ষণ হাটাহাটি বা জগিং করি। বড় বড় পাথর আর লম্বা লম্বা গাছের মধ্য দিয়ে নদীটা মিষ্টি একটা শব্দ করে বয়ে গেছে অনেকদূর। যদিও শ্যানন প্রস্হে আমাদের দেশের মাঝারি সাইজের একটা খালের মতোই হবে। তবুও আইরিশরা সৌন্দর্যের রানী এই শ্যাননকে সম্ভবত ভালোবাসা নিয়েই রিভার বলে থাকে।
ইউনিভার্সিটি অব লিমেরিক ক্যাম্পাসের শেষ প্রান্তে নদীর উপরে যে ব্রীজটা আছে, তার ঠিক নীচের একটা বড় পাথরে খুব যত্ন নিয়ে খোদাই করে বাংলায় লিখে রেখেছি “শিলা”। বেশ বড় করেই লেখা যাতে ব্রীজের উপর থেকে ওটা দেখা যায়। লিমেরিকে আসার প্রথমদিকে কোনো এক ছুটির দিনে অনেক সময় নিয়ে পাথরে আমার প্রিয়তমার নাম লেখা, অনেক যত্ন ও ভালোবাসা নিয়ে। হয়তো অনেকের কাছে হাসির বিষয়, কিন্তু আমার কাছে অমূল্য, আবেগ গাথার।
রুটিন মাফিক প্রতিদিন হাটা শেষে খুব মায়া করে পাথরে খোদাই করা “শিলা”কে দেখে যাই, একমনে। আর এভাবে ভালোবাসার মানুষটির অস্তিত্ব আমার জীবনে অনুভব করি, প্রতিনিয়ত।
(দশ পর্বে সমাপ্ত। চতুর্থ পর্ব আগামীকাল। ধন্যবাদ।)