মাশুল (ষষ্ঠ পর্ব)।

0
191

#মাশুল (ষষ্ঠ পর্ব)।

হঠাৎ করেই আমার আবেগী কান্না, শিলা সম্ভবত একটু বিব্রতই হল! কিছুটা অবাক আর খানিকটা অবিশ্বাস মিলিয়ে দেওয়া ওর চাহনীতেও অস্বস্তি। তারপরও সম্ভবত আমাকে কাঁদার সুযোগ করে দিতেই নীরব রইল। এই মেয়েটার সবকিছু আমার খুব ভালো করে জানা। আমার কান্নাটা যে ওকে মোটেও স্পর্শ করেনি, ওর অভিব‍্যক্তিতে বুঝে নেই। সত‍্যি বলতে কি, আমি নিজেও কিন্তু এভাবে কাঁদতে চাইনি, জমে থাকা কষ্ট যেন অনেকদিন পর বাষ্পীভূত!

“জানার আগ্রহটা অবশ‍্য অনেক আগেই মরে গেছে, তারপরও আজ সুযোগটা যখন পেলাম, বলবে কি? সেদিন কেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলে?” শিলার উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে করা এ প্রশ্নটায় তাচ্ছিল্য স্পষ্ট।

প্রশ্নের উত্তরটা যে আমার নিজেরই জানা নেই, ওকে কি বলবো?

একবার ভাবলাম বলি “পায়ের নীচে মাটি না থাকা কপর্দকশূন‍্য মেরুদণ্ডহীন নেহালের পক্ষে বিয়ের মতো বড় একটা ডিসিশন নেওয়ার সাহস ছিল না বলে! হঠাৎ করে তৈরী হওয়া বৈরী পরিস্থিতিতে নেহাল বরঞ্চ ভয়ই পেয়েছে। পালিয়ে থাকতে চেয়েছে, পুরো পরিস্হিতি থেকে। উল্টো নেহাল নিজেই ভুল ধারনা নিয়ে অপেক্ষায়, শিলা হয়তো পুরো পরিস্থিতি নিজেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, ওর পরিবারকে বুঝিয়ে বিয়েটাকে ভন্ডুল করে ফেলবে!”

নতুবা সত‍্য কথাটা শিলাকে বললে, বলতে পারতাম। পুরো বিষয়টা ডিল করার মত ম‍্যাচুইরিটি তখনকার নেহালের ছিল না। কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি, অপরাধীর মতো করে চুপ করে রইলাম!

“তোমার রহস্যময় ও সন্দেহজনক আচরণ, হঠাৎ করেই আমার মধ‍্যে নীচ ধারনা তৈরী করে। অনেকদিনের ভালোবাসাও কেন জানি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল, মারাত্মকভাবে!

আমি কিন্তু তোমার কাছে সেদিন কিছুই চাইনি নেহাল? ঘোরতর বিপদে পাশে এসে দাড়াবে, আপনজন হিসেবে। এতটুকু চাওয়া কি আমার অপরাধ ছিল, তুমিই বলো নীলু?” কান্নাটা বোধ হয় সংক্রমণজনিত, আমি আবারো অঝোরে কাঁদছি শিলার সাথে।

“বিশ্বাস করো নেহাল, বিয়ের অল্পদিনের মধ‍্যেই আমার উপলব্ধি। শিহাবের সাথে বিয়ে, বিপদ নয়। আমার জীবনে আশির্বাদ হয়েই এসেছে।” শিলা বেশ স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়েই কথাটা বললো। সত‍্যি বলতে কি ততোক্ষণে একটা বিষয় আমি নিশ্চিত। বিয়ের কিছুদিনের মধ‍্যেই শিলা আমাকে মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিয়েছে, পুরোপুরিভাবেই।

“আমার কাছে কিন্তু তুমি সবসময় অপরাধী, নীলু। ক্ষমার অযোগ্য করা তোমার ঐ কাজগুলোর জন‍্যই। শুধু তোমার কারণে একটা মেয়ের সারাজীবনের তপস‍্যা বাসর রাত, খুব বাজে ভাবে ভেস্তে যায়। সবচাইতে বড় কথা আমার ইনোসেন্ট বর শিহাবের বাসর অভিজ্ঞতা হল ভয়াবহ রকমের খারাপ, অনেকটা দুঃস্বপ্নের মত।

ঐ রাতে শিহাবকে আমি এক মুহুর্তের জন‍্যও ধারে কাছে ঘেষতে দেইনি! বোকার মতো কেঁদেছি, তোমার কথা ভেবে। আর বেচারা শিহাব সারারাত জেগে জেগে দেখলো তোমার ঐ নাম জপার দৃশ্য!

বিশ্বাস করো নেহাল, ঐদিন শিহাবের সাথে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। তুমি নিজেও অবাক হতে ছেলেটার ধৈর্য দেখে। আমার পাগলামিগুলোর প্রত‍্যুত্তরে ও যেন একদমই শান্ত নদী! অন‍্য যে কোন ছেলে হলে, সম্পর্কটা সম্ভবত শেষ করে দিত ঐ রাতেই।” শিলার বলা শেষ কথাটায় উত্তেজনা স্পষ্ট।

আমি এখন শিলার কথা আনমনে শুনে যাচ্ছি, চিন্তাগুলোও বিক্ষিপ্ত। আমার প্রতি শিলার তৈরি হওয়া বৈরী ধারনা, বিন্দুমাত্র ভালোবাসাও যে অবশিষ্ট নেই, এটা ভেবে খুব কষ্ট পেলাম। লজ্জায় কুকড়ে গেলাম, শিলাকে নিয়ে কিছুদিন ধরে পুনরায় ঘর বাধার স্বপ্ন বোনায়। ওটা যে মিথ‍্যে স্বপ্ন এতোক্ষণে আমি নিশ্চিত।

ততোক্ষণে এটাও বুঝলাম যে আমার জন‍্য সামনে আরো অনেক কঠিন কঠিন কথা অপেক্ষা করছে। তারপরও মন চাইছে শিলার কাছ থেকে আরো কিছু শুনি। অন্ততপক্ষে শিলার ভাষ‍্যটাতো জানা থাকবে, বাকী জীবনটায়। যদিও ওর বলা এ গল্পে আমার ভূমিকা এখন নিতান্তই খলনায়কের! তারপরও শিলাকে কাহিনী বলা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলাম।

“তোমার হাম দিলকে চুকে সানাম সিনেমাটার কথা মনে আছে নেহাল? ঐ যে সালমান খান আর ঐশ্বরিয়ার বিখ‍্যাত সেই সিনেমাটা?” শিলার চোখ চকচক করছে, সম্ভবত হঠাৎ ওর জীবনের সাথে সিনেমাটার মিল পাওয়ার আনন্দে।

আমি কখনোই সিনেমার ভক্ত নয়, হিন্দি ছবিতো নয়ই। তারপরও বন্ধুদের সাথে মাঝে মধ্যে দু একটা সিনেমা দেখতাম। শিলার নাম উল্লেখ করা সিনেমাটা আমার ঐ দেখাগুলোর মধ‍্যে একটা। তাইতো মুহূর্তেই আচঁ করতে পারলাম, শিলা সিনেমার কোন সিকোয়েন্সের কথাটা বলতে যাচ্ছে।

“তোমার হয়তো জানা নেই, ঐ সিনেমার একটা জনপ্রিয় সিন, হুবহু আমার জীবনেও ঘটেছিল, বিয়ের পরদিন সকালে।” কথাটা বলেই শিলা জোরে হাসতে লাগলো, ফানি কিছু একটা মনে পড়েছে এই অনুভূতিটা নিয়েই। ওর ঐ হাসিটাতে আমি জয়েন করতে পারলাম না বরঞ্চ দম বন্ধকর একটা পরিস্হিতিতে।

“বাসর রাতে আমি আর শিহাব দুজনেই একফোঁটাও ঘুমাইনি। শ্বশুর বাড়ীতে আনা আমার লাগেজটাও তখনো খুলা হয়নি। ভোর বেলায় লাগেজ সহ শিহাবের সামনে এসে দাড়াই। ওকে করা আমার সিরিয়াস রিকোয়েস্ট, আমাকে যেন তোমার কাছে দিয়ে আসে।” শেষ কথাটা বলে শিলা ওর হাসির মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিল।

আমি নিজেও অবাক হলাম, ওর জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এসব ঘটনাগুলো এই প্রথমবারের মতো শুনে, কথাগুলো এতোদিন জানা হয়নি বলে মনের মধ‍্যে একটা চাঁপা আক্ষেপও হল।

“বেচারা শিহাবের চেহারাটা তখন দেখার মতোই হয়েছিল। আমার অবস্হা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। হয়তো আমি মানসিকভাবে সুস্থ ছিলাম না, এটাও বুঝে নেয়। আমার জামাই আর্মির লোক, সম্ভবত এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন‍্য ট্রেনিং করা আছে। ও কিন্তু শান্ত মাথায় খুবই ডিপ্লোমেটিকালি পুরো বিষয়টাকে হ‍্যান্ডেল করে।” শিলার হাসিমাখা মুখটা দেখে আমার নিজেরও এখন ভালো লাগছে।

আমার প্রতি শিলার ভালোবাসা বরাবরই নিখাদ, এতে আমার কখনোই সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও মেয়েটা এরকম আত্মঘাতী কাজ করবে, এটা কিন্তু কখনোই ভাবিনি।

“শিহাবের সাথে করা ঐদিনের ঐ সিনটা নিয়ে পরে আমরা জামাই বউ অনেকবার হাসাহাসিও করেছিলাম। ওটা আমাদের একটা কমন জোকস হয়ে গেলো।” শিলা ওর হাসিটা চালিয়েই যাচ্ছে।

আমিও ততোক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে আসলাম, পরাজিত মনোভাব নিয়ে। অপেক্ষায় আছি ওর বিয়ে পরবর্তী উদ্দাম ভালোবাসার গল্প শুনবো বলে।

“শিহাব কোন উচ্চবাচ্য না করে আশ্বস্ত করলো, আমাকে ক‍্যাম্পাসে নিয়ে আসবে। তবে সেদিনই নয়, সপ্তাহ খানেক পর। কারণ হিসেবে দেখানো ওর যুক্তিগুলোতেও হার মানলাম, আই মিন মানতে বাধ‍্য হলাম আর কি। কৌশলী এক সৈনিকের ধী শক্তির কাছে।

আমাদের দু বাসাতেই তখনো বিয়ে উপলক্ষ্যে জমায়েত করা অসংখ্য আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বাসা খালি হয়ে যাবে। আমার প্ল‍্যানটা এক্সিকিউটের জন‍্য ওটাই ভালো সময় হবে, এটাই শিহাব আমাকে বুঝালো।

জানো নেহাল, পাগলামিটা মাত্রার বাইরেই করেছিলাম। এক সপ্তাহও অপেক্ষা করতে চাইলাম না। অতঃপর ঝানু ক‍্যাপ্টেন সাহেব সন্ধির প্রস্তাব দিতেই গররাজি। অন্ততপক্ষে আমার মধ‍্যে থাকা অস্হিরতাটা কমে আসে।” শিলা এবার আমার দিকে তাকিয়ে গল্পে আগ্রহ বোঝার চেষ্টায়। আমার চোখে মুখে অবশ‍্য শুধুই গল্প শোনার তেষ্টা।

“শিহাব সেই এক সপ্তাহ আমার সাথে ঘুমোবে না। এমনকি অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগও নিবে না! ওর দেওয়া আশ্বাস এতোটাই জোরালো ছিল যে বিশ্বাস করলাম। ছেলেটা যে অনেক নির্ভরযোগ‍্য, এরই মধ‍্যে এটা বুঝে গিয়েছি।

শিহাব সেই সময় হিতাহিতজ্ঞানশূন‍্য আমার পক্ষ হয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিল। হ‍্যাঁ, ওর ঐ কথাটাই কিন্তু আমার জন‍্য লাইফ সেভিং ছিল। শুনবে ওটা?” প্রশ্নটা করেই শিলা আমার সম্মতির অপেক্ষায়। আমার জন‍্য আরেকটা কথার তীর আসছে বুঝতে পেরেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি।

“তুমি কাপুরুষ, এটা আমার সৈনিক জামাই হয়তো ততদিনে বেশ ভালো করেই বুঝে ফেলেছে। নিজের বিয়ে করা স্ত্রীকে কোনোরকম ঝুঁকি পূর্ন পরিস্হিতিতে ফেলানোর মতো ছেলে শিহাব নয়। আপনজনের মতোই আমাকে পরামর্শ দেয়, তোমার সাথে যেন যোগাযোগ করি। জাহাঙ্গীরনগরে তোমার কাছে যাওয়ার আগে যেন আমি সবকিছু নিশ্চিত হয়েই যাই।” আমার দিকে দেওয়া শিলার এবারের চাহনীটা আর নিতে পারলাম না, ইচ্ছা করেই অন‍্যদিকে তাকিয়ে বাকি কথাগুলো শোনার প্রতিক্ষায়!

“তোমাকে কাপুরুষ বললেও অনেক সন্মান করা হয়ে যায়, নেহাল। আমি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে টানা তিনদিন তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, নানা ভাবে। এমনকি প্রীতিলতা হলের পাচক মোমেনা খালাকেও ফোন দিলাম, তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিতে। আমার তখনো বিশ্বাস, তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।

ভীষণ আশ্চর্য ও অবাক হলাম, তুমি কোন রকম আগ্রহ দেখাওনি বলে। বিভিন্ন জনের মাধ্যমে দেওয়া আমার মেসেজগুলো পাওয়ার পরও। কোন যোগাযোগই করলে না নীলু? রুমমেট সামিনা যখন আমাকে ফোনে জানায়, নেহালের এ বিষয়ে কথা বলার আর কোন আগ্রহ নেই। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তারপরও তোমার সাথে একটিবার কথা বলতে চাইছিলাম। তোমার জন‍্যও কষ্টও হচ্ছিলো অনেক। কিন্তু তুমিতো কোন কথা বলোনি, বলার আগ্রহটাও দেখাওনি! ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ, একটা মেয়ের জন‍্য যে কতটা কষ্টের তা তোমার মতো কাপুরুষরা কখনোই বুঝবে না!

(দশ পর্বে সমাপ্ত। সপ্তম পর্ব আগামীকাল। ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here