#মাশুল (অষ্টম পর্ব)।
শিলার অকাল বৈধব্য, সত্যই ভীষণ কষ্টের একটা ঘটনা। আমার নিজের মনটাও অজান্তেই খারাপ হয়ে গেল। শিহাবের মৃত্যুটা কিভাবে হয়েছে, সেটা জানার প্রচন্ড আগ্রহও হলেও জিজ্ঞেস করতে পারিনি। অপেক্ষা করতে থাকলাম! আমি নিশ্চিত কাহিনীর এক পর্যায়ে শিলা আজ নিজে থেকে গল্পটা বলবে। অনেকদিন পর আজ যে ও একজন মনোযোগী শ্রোতাকে পেয়ে গেছে। খুবই চেনা, এক সময়ের কাছের এক মানুষ! জমানো সব কথা সে আজ শোনাবেই শোনাবে।
“আরিয়ানার জন্মের পর থেকে শিহাবের মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত, আমাদের সংসারের গল্পটা শুধুই সুখের। শিহাব আপাদমস্তক ফ্যামিলি অন্তপ্রান একজন মানুষ। অফিস বাদে বাকি সময়টায় আমার আর আরিয়ানার সাথেই কাটায়। বন্ধু বান্ধবের পার্টটা অনেকটা নিয়ম রক্ষার জন্যই ও চালিয়ে যেত।
আমিও মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরের একটা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে দিলাম। আমরা দুজনেই ব্যস্ত, তারপরও কিন্তু সংসারে সুখের কোন কমতি ছিল না।” শিলা এবার কিছুটা ইতস্ততায়, হয়তো পরের কথা গুলো বলবে কিনা ভেবেই।
আমিও ভদ্রতা করেই বললাম ইচ্ছা করলে গল্পটা ও এখানেই শেষ করে দিতে পারে। আমার যতোটুকু মেসেজ পাওয়ার দরকার ছিল, ততোক্ষণে আমি সেটা পেয়ে গেছি। শিলাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখাটা শুধু দুঃসাহসই ছিল না, রীতিমতো অপরাধ করে ফেলেছি। উপলব্ধিটা নিশ্চিত।
শিলা আবারো শুরু করলো, সম্ভবত করুন অংশটা বলার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে।
“জানো নেহাল, আমিই শিহাবের হত্যাকারী। মৃত্যুর মুখে আমি ই ওকে ঠেলে দিয়েছিলাম, জেনেশুনেই।” এ কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। অবাক হয়ে খানিকটা বোকার মতোই বললাম, আমিতো জানতাম শিহাব ভাই সুদানে মারা গেছেন!
“হ্যাঁ ঠিকই জানো। দারফুরে, শান্তি মিশনে কাজ করতে গিয়েই ও মারা যায়! বিয়ের পর থেকেই ওর মিশনে কাজ করার সুযোগ এসেছিলো অনেকবার। আমার আর আরিয়ানার সাথে সময় কাটানোর জন্যই অফারগুলো এভয়েড করতো, অফিসকে অন্যসব অজুহাত দেখিয়ে। আমাদের ছাড়া এক সপ্তাহ দূরে থাকাই নাকি ওর জন্য অনেক কষ্টের! সেখানে মাসের পর মাস দূরে থাকবে, এটা ও কল্পনাই করতে পারে না! আমিও অবশ্য চাইতাম না শিহাব দূরে যাক, সবকিছু মিলিয়ে আমরাতো বেশ আছি!
দারফুরে যাওয়ার মাস ছয়েক আগে, পূর্বাচলের পাশে জলসিড়ির নতুন প্রজেক্টটায় আমরা পাঁচ কাঠার একটা প্লট পেলাম। খুব খুশি হয়েছি, লটারিতে কর্নার প্লটটা পাওয়াতে।
প্লট বাবদ প্রায় তিরিশ লাখ টাকা দিতে হবে, আমাদের জন্য সাধ্যাতীতই। তাইতো দারফুরের মিশনের অফারটা আসতেই, আমিই ওকে ইনসিস্ট করলাম। যাও এবার ঘুরে আসো। হিসাব কষে দেখলাম, এক বছরের মিশন বাবদ পাওয়া টাকাটা দিয়ে জমির দামটা সহজেই পরিশোধ হয়ে যাবে।
আর্মির সবাই কিন্তু জানে দারফুর আফ্রিকার একটা কঠিন মিশন। ইতোমধ্যে কয়েকজন অফিসারসহ অনেক বাংলাদেশী সৈনিক মারা গেছে, ওখানকার সরকার বিরোধী বিদ্রোহীদের অতর্কিত আক্রমনে। তাইতো পারতপক্ষে অফিসাররা দারফুর মিশন এভয়েডই করতে চায়।
শিহাবও প্রথম প্রথম রাজি হয়নি। আমিই ওকে বুঝিয়ে পাঠালাম, অনেকটা স্বার্থপরের মতো!” শিলার অনুশোচনা চোখেমুখে স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠলো।
“মিশনে যাওয়ার পর সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে চলেছে। মাস ছয়েক পর শিহাব দেশে একবার ঘুরেও গেল, দুসপ্তাহের ছুটিতে। আরিয়ানা সেবার পুরো সময়টা বাবার সাথেই ছিল, একদিনের জন্যও স্কুলে যায়নি। আমিও কলেজ থেকে ছুটি নিলাম। খুবই সুন্দর সময় কাটলো, একান্ত পারিবারিক কোয়ালিটি টাইম।
দারফুর মিশন শেষে ফিরলেই শিহাবের পদোন্নতি হচ্ছে, হেডকোয়ার্টার থেকে এ সুখবরটা নিয়েই শেষবারের মতো ও সুদান যাচ্ছে। এয়ারপোর্টে বাবা ও মেয়ের সেদিনের কান্নাটা এখনো আমাকে তাড়ায়।
ঐদিন এয়ারপোর্টে বেশ বড় ধরনের একটা সিনক্রিয়েটও হল। আরিয়ানা ওর বাবাকে কিছুতেই যেতে দিবে না! শিহাবেরও প্রচন্ড মন খারাপ। আমিও কান্না থামিয়ে রাখতে পারিনি। সব মিলিয়েই বিমানবন্দরে একটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরী হল।” শিলার বাষ্পরূদ্ধ কন্ঠটা এবার আমাকেও ছুঁয়ে গেল।
“মিশন শেষে শিহাবের দেশে আসার প্রস্তুতি চলছে। আমাদের জন্য কিছু কেনাকাটাও করে রেখেছে। আরিয়ানা ওর বাবা আসার উত্তেজনায় বিভোর, আমি নিজেও দিন গুনছি। শিহাবের দারফুর পাকাপাকিভাবে ছাড়ার ঠিক চারদিন আগেই ঐ ভয়াবহ দুর্ঘটনাটা ঘটল!
একটা রিফুজি ক্যাম্প থেকে কাজ শেষে ফৌজিরা নিজ ইউনিটে ফিরছে। মাত্র চার কিলোমিটার দুরত্বে সেনানিবাস। জিপটাতে শিহাবসহ মোট চারজন সৈনিক। বিদ্রোহীদের অতর্কিত গেরিলা আক্রমণে জিপের আরোহী সবাই মারা গেল।
খবরটা প্রথম আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকেই ফোন করে আমাকে জানায়, আমি তখন কলেজে ক্লাস নিচ্ছি। দারফুরে একটা দূর্ঘটনা হয়েছে এতটুকুই ওরা বলেছিল, মৃত্যু সংবাদটা তখনোও হয়তো ইচ্ছা করেই দেয়নি। মৃত্যু আশংকা নিয়ে তড়িঘড়ি বাসার দিকে আসতেই দেখি, পুরো আর্মি কমিউনিটি যেন আজ আমার বাসার সামনে! স্বান্তনা দেওয়ার ভাষাটুকুও কারো মুখে নেই, সবাই গভীরভাবে শোকাচ্ছন্ন!
অবুঝ আরিয়ানা হঠাৎ করে এতো আংকেলকে একসাথে পেয়ে খুব খুশি হয়ে গেল। ওর বাবা শীঘ্রই দেশে আসবে এই একটা গল্পই বলে যাচ্ছে জনে জনে। শিহাবের ব্রিগেড প্রধান হাসান স্যার, জাঁদরেল এই সেনা কর্মকর্তা পযর্ন্ত সেদিন কেঁদেছিলেন বাচ্চাদের মতো করে।” শিলার কথাগুলো এতোই আবেগ দিয়ে বলা, আমার চোখ দিয়েও দরদর করে পানি ঝরছে।
কল্পনায় মুহূর্তটার কথা চিন্তা করলাম। শিলার জন্য সময়টা যে কতোটা কষ্টের, চিন্তা করেই খুব খারাপ লাগল। কেন জানি এরপর গল্পটা শুনতে আর ভালো লাগছিল না। অপেক্ষা করতে লাগলাম শিলার নেওয়া পরবর্তী বিরতিটার জন্য। গল্পটা এখানেই ইতি টানার অনুরোধ করবো বলে।
“শিহাবের লাশটা অনিচ্ছা সত্বেও দেখেছি। দেখার আগ পযর্ন্ত আমার ধারণা ছিল শিহাব মারা যায়নি। দুঃস্বপ্নে আছি! শিহাব মোটেও আমাকে আর আরিয়ানাকে একা ফেলে রেখে মারা যাওয়ার মতো লোক নয়!
আমাকে অনেকটা জোর করে ধরাধরি করে লাশটা দেখানো হল। কি শান্ত সৌম্য ঘুমিয়ে থাকা শিহাব! মনে হল একটু পরই ঘুম থেকে জেগে উঠবে!” শিলা কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে বল যাচ্ছে আর আমি কাঁদছি। শিলা অবশ্য আমার এ কান্নাটায় বেশ অবাক একটা চাহনী দেয়।
“লাশ দাফনের কয়েকদিন পর থেকেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগলো। শুধু আমি আর আরিয়ানা ছাড়া। কি যে কষ্টের শিহাবের মৃত্যু পরবর্তী সেই সময়গুলো, তা বলে বোঝাতে পারবোনা! বাবা মা দুজনই তখন থেকে আমার সাথে। মিশন থেকে মৃত্যু ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া টাকায় ঢাকার কাফরুলে একটা ফ্ল্যাট নিলাম। বাড়তি কিছু টাকা ছিল, ওগুলো দিয়ে সঞ্চয় পত্র নিলাম।
চাকুরী আর সঞ্চয় পত্র থেকে আসা টাকায় আমাদের মা মেয়ের সংসার বেশ ভালো ভাবেই চলে যাচ্ছে। তবে একটাই সমস্যা আমাকে এখনো তাড়ায়, আজ পযর্ন্ত শিহাবকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি। আমার মেয়েটা দেখতে অবিকল যেন ওর বাবা। যতবারই আরিয়ানাকে দেখি, ওর বাবার কথা মনে পড়ে যায়, অজান্তেই।” শিলার দীর্ঘশ্বাস।
আরিয়ানার প্রতি দৃঢ় কমিটমেন্ট আর শিহাবের কাছ থেকে পাওয়া অসীম ভালোবাসার স্মৃতিগুলো রোমান্হন করেই যে শিলা বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। যদিও ভীষণ কষ্ট পেলাম, আমার সম্পর্কে শিলার বর্তমান ধারনাটাকে জেনে। ওর জীবনে আমি সত্যিই যে অস্তিত্বহীন একজন!
গত দশ বছর ধরে শিলার প্রতি গভীর মমতা নিয়ে লালন করা আমার ভালোবাসাটাকে রীতিমতো এখন অপরাধ বলেই মনে হল। বারবারই শ্যানন নদীর ঐ বড় পাথরটার কথা মনে পড়লো, অনেক মায়া, ভালোবাসা আর আবেগ নিয়ে লেখা “শিলা”। ভুল, সবই আসলে ভুল!
(দশ পর্বে সমাপ্ত। নবম পর্ব আগামীকাল। ধন্যবাদ।)