‘অবেলায় কেন বসন্ত নিয়ে এলে?’
‘পর্ব-০৩’
‘আপনার ব্যস্ত সময় থেকে কফি খাওয়ার জন্য কিছুটা সময় চাইছি।’
‘আজ না। অন্যদিন আমি আপনাকে খাওয়াবো।’
সবুজ আবার অনুনয়ের সুরে বলল,
‘প্লিজ। আজই যদি একটু সময় ……’
‘আচ্ছা চলুন’ বলে মাধবীলতা সামনের দিকে হাঁটছে। পাশাপাশি দু’জন হাঁটছে। মাধবীলতার খুব ক্লান্ত লাগছে। ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমোতে পারলে খুব ভালো হতো। রমিজা খালাকে হসপিটালে রেখে বাসায় ভালো ঘুমও হবে না। খালা ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই। সবাইকে চেনা হয়ে গেছে। বিপদের সময় মানুষ চিনেছি। কে আপন আর কে পর এখন চিনতে আর ভুল হয় না। মাধবীলতা ভেবে ভেবে এগিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা কি কথা বলবো উনাকে? সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। উনি কি বিরক্তবোধ করছেন? অস্বস্তি হচ্ছে আমার সাথে যেতে? মনে হয় তাই হচ্ছে। না হলে উনি কোনো কথা বলছেন না কেন? আমার সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে ইচ্ছে করে না মনে হয়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সবুজের চোখ গেল মাধবীলতার সাইট ব্যাগের দিকে। ব্যাগের ভেতর একটা বই। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। ব্যাগের চেইন খোলা। সবুজ বলল,
‘ম্যাম,ব্যাগের চেইনটা টেনে নিন। ব্যাগ খোলা রাখা ঠিক না।’
‘মনে ছিল না’ বলেই ব্যাগের চেইন টেনে নিল মাধবীলতা।
কাছাকাছি একটা কফি শপে মুখোমুখি দু’জন বসেছে। সবুজ কফি অর্ডারের আগে মাধবীলতাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ম্যাম,কফির সাথে আপনার পছন্দের একটা খাবার অর্ডার করতে পারি? পছন্দের খাবারের নামটা জানালে ভালো হয়।’
মাধবীলতা আলতো করে কপালে ডানহাত বুলাচ্ছে।
মাথাটা খুব ধরেছে। আস্তে করে বলল,
‘নো থ্যাংকস। শুধু কফিই খাবো।’
সবুজ ওয়েটারকে ডেকে দুটো কফির অর্ডার দিল। ওয়েটার চলে গেল।
‘মাথায় পেইন হচ্ছে?’
‘কিছুটা’
‘খালার কি হয়েছে?’
‘ডেঙ্গু জ্বর। রক্তের প্লাটিলেট অনেক নীচে নেমে গেছে। পেঁপে পাতার রস খাওয়ালে নাকি দ্রুত প্লাটিলেট বেড়ে যায়। পেঁপে পাতা কোথায় পাবো? পুদিনা পাতা,থানকুনি পাতা বাজারে খুঁজলেই পাবো। এ দুটো পাতার ভর্তাও নাকি খুব ভালো কাজ করে।’
সবুজ মুগ্ধ হয়ে মাধবীলতাকে দেখছিল আর কথা শুনছিল। হালকা পার্পেল রঙের ড্রেসে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ড্রেসের সাথে ম্যাচিং কানে ছোট্ট দুল। হাতে গোল্ডেন চেইনের স্কয়ার শেপ ঘড়ি। চোখে ডিপ কফি ফ্রেমের রাউন্ড লেন্স। সিম্পল খোঁপায় দেখতে অসাধারণ লাগছে।
‘ম্যাম,আমি যে বাসায় থাকি ছাদে পেঁপে গাছ আছে। আমি এনে দিতে পারবো।’
‘আপনি থাকেন কোথায়?’
‘আদাবর’
আপনি অযথা কষ্ট করবেন?
সবুজ হেসে ফেলল।
‘এটা কোনো কষ্টের কাজ? আমার হাতের কাছে আছে। আমি আপনাকে এনে দেব এটুকুই।’
এর মধ্যে ওয়েটার কফি নিয়ে আসলো। সবুজ কফির মগ মাধবীলতার দিকে এগিয়ে দিল।
উষ্ণ কফির মগে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
‘পেশায় কোথায় আছেন?’
বিজনেস করি। দুটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। দুটো সিএনজি ভাড়া দিয়েছি। টাকা সব ছড়িয়ে আছে। আসলে কোনটাতে ভালো করে মনোযোগ দিতে পারছি না। সবই অগোছালো। আমেরিকার ভিসা হয়ে গেলে সব গুছিয়ে চলে যাবো। তিনবছর দুবাই ছিলাম। মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে দেশে চলে আসলাম। পরে আর যাইনি। তিনভাইয়ের দুই ভাই কাতার আর সৌদিতে অনেক বছর ধরে আছে। এক বোন বিয়ে হয়ে গেছে।
আব্বা বেঁচে আছেন। আলাদা থাকেন। নতুন সংসার নিয়েই ব্যস্ত। আমার সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তবে মাঝেমধ্যে আমাকে খোঁজেন উনার প্রয়োজনে। কেমন আছি? কি করছি এসব কোনোদিন জানতে চান না। দেখা করেই বলবে,’পাঁচ হাজার টাকা দে তো।’ ঐ মূহুর্তে আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে কিনা একবারও জিজ্ঞেস করে না। কারো কাছ থেকে ধার করে হলেও টাকাটা দিয়ে দেই। ছেলে বড় হলে মা,বাবার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। মায়ের দায়িত্ব নিতে পারলাম না। এর আগেই চলে গেলেন। কখনোই আমি দায়িত্ব এড়িয়ে চলি না। তবে একটা কষ্ট,আক্ষেপ আমার সারাজীবন থেকে যাবে। মায়ের অসুস্থতার সময় পাশে থাকতে পারিনি। মায়ের সেবা করতে পারি নি। ফোন করলে শুধু বলতেন,
‘বাবা তুই খেয়ে নিস সময়মতো। বিদেশ থাকিস একটু দেখেশুনে পথ চলিস।’ যদি প্রশ্ন করতাম,’তোমার শরীর কেমন আছে?’ চুপ করে থাকতেন। বুঝতে পারতাম মা কাঁদছেন। আব্বা বাড়ি আছে জানতে চাইলে শুধু বলতেন,’দু’দিন ধরে বাড়ি আসেন না।’ অযত্ন,অবহেলা,
চিকিৎসার অভাবে আমার মা মারা গেছেন। নিজেকে দোষী মনে হয়। আব্বার সাথে ফ্যামিলি বন্ডিং খুব নড়বড়ে ছিল। আব্বা মা’কে মানুষই ভাবতেন না।
সবুজ কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে রাখে।
মাধবীলতা কফি শেষ করেছে অনেক আগেই। ঘড়ির দিকে তাকালো।
সবুজ টিস্যু দিয়ে চোখ,মুখ মুছে বললো,
‘স্যরি, আমি মনে হয় আপনার অনেক সময় নিয়ে নিয়েছি।’
‘একদম না। জীবনের কথা শুনতে ভালো লাগছিল। সবার জীবনে কষ্ট,অভিযোগ,অভিমান,চাওয়া-পাওয়া থাকে। সুখ-দুখ,হাসি-কান্না,আবেগ,ভালোবাসা জীবনের অংশ। কষ্ট না পেলে সুখের মূল্য বুঝা যায় না। এখন যে উঠতে হবে। অন্যদিন অনেক কথা হবে।’
‘সিউর। আর এক মিনিটও সময় নেব না আপনার। আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন।’
মাধবীলতা মৃদু হাসলো।
সবুজ রিকশা ডাকলো। মাধবীলতা রিকশায় উঠে বসলো। কলাবাগান রোড ১২/বি যাও। সবুজ পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালার হাতে দিল।
‘এটা রাখো। ম্যাডামকে ভালোভাবে পৌঁছে দিও।’
মাধবীলতা রাগে বড় বড় চোখে সবুজের দিকে তাকালো। সবুজ নিঃশব্দে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিল। ওড়না রিকশার চাকার উপরে দেখে সবুজ সরিয়ে বললো,’সাবধানে যাবেন।’
মাধবীলতা কোনো কথা বলল না। রিকশাওয়ালাকে যেতে বলল। রিকশাওয়ালা প্যাডেলে পা চালালো। দু’মিনিট অপেক্ষা করে সবুজও দ্রুত বাসার দিকে রওয়ানা হলো। যাওয়ার পথে পুদিনা পাতা,থানকুনি পাতা কিনে নিল। ছাদ থেকে পেঁপে পাতা সংগ্রহ করে মাধবীলতাকে ফোন দিল। মোবাইল বেজে যাচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। মনে হয় কাজে ব্যস্ত। সবুজ ফোন রেখে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেল। মাধবীলতা গোসল করে পাখার নীচে বসে। ফ্রেশ হয়ে সবুজ আবারও কল করে।
মাধবীলতা কল রিসিভ করলো,
‘বলুন’
‘আমি সব পাতার ব্যবস্থা করেছি। আপনার কিছু করতে হবে না। শুধু হসপিটালে আসার আগে একটা ফোন দিলেই হবে। রাখছি।’
‘ঠিক আছে।’
ফোন রাখলো মাধবীলতা।
গোসলে যাওয়ার আগে অল্প ভাত বসিয়ে দিয়েছিল। ভাত হয়ে গেছে। ঝটপট একটা ডিম ভেঁজে নিল। খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বের হলো। সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে সবুজকে ফোন দিল,
‘হসপিটালে যাচ্ছি।’
‘আমিও বের হয়েছি।’
মাধবীলতা রিকশা থেকে নেমেই সবুজকে দেখলো। ব্ল্যাক রঙের টি-শার্ট আর জিন্স পরা।
সবুজ ছোট্ট শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিল।
‘পুদিনা পাতা,থানকুনি পাতা, আর পেঁপে পাতা আছে। সাথে একটা ঔষধ আছে ওটা আপনার জন্য। মাথার পেইনে দ্রুত কাজ করে। মাথা ব্যথা হলে নাকের কাছে দু’মিনিট ধরলেই ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
‘এতকিছু করার কি প্রয়োজন ছিল?’
‘মানুষের বিপদে মানুষই তো এগিয়ে আসবে তাই না?’
মাধবীলতা হাসলো।
‘বুঝেছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ। ‘
‘ভালো থাকুন।’
সবুজ বিদায় নিয়ে চলে গেল। মাধবীলতা কেবিনে রমিজা বানুর কাছে আসলো। হসপিটালে থেকে রমিজা বানু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। দু’দিন পর রমিজা বানুকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো। বাসায় আসার পর রমিজা বানু অনেকটাই সুস্থ। মাধবীলতা নিয়মিত কলেজ করছে।
সবুজ আর ফোন করেনি। মাধবীলতাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে কলেজ,নিজের লেখা নিয়ে। বিকেলে
ঘুম থেকে উঠে আছরের নামাজ পড়ে এফবিতে ঢুকে। একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে থাকে। ম্যাসেনঞ্জার সিন করে সবুজের সেন্ড করা কিছু ছবি ওপেন করলো। সব মাধবীলতার কলেজের ছবি। আশ্চর্য তো আমার কলেজের পিক কোথায় পেল? আমি তো কোনো ছবি সেন্ড করিনি। ছেলেটা কি করতে চাইছে? এই মূহুর্তে একটিভ নেই। তাই সরাসরি ফোন কল দিল।
সবুজ রিসিভ করলো,
হ্যালো,শরীর ভালো আছে?
হুম। আমার কলেজের ছবি কোথায় পেলেন?
আজ সকালে আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
কেন জানি আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই সকালে ছুটে গিয়েছিলাম আপনার কলেজ গেইটে। যদি ক্ষণিক দেখা পাই। দেখতে না পেলে খুব খারাপ লাগতো। আপনার গায়ে পিংক কালারের শাড়ির সাথে ম্যাচিং চাদর ছিল। রিকশা থেকে নেমেই একটা নতুন একশো টাকার নোট দিলেন রিকশাওয়ালাকে। রিকশাওয়ালা পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিল। আপনি ডান বাম না তাকিয়ে হনহন করে গেইটের ভেতরে ঢুকে গেলেন। আপনাকে ভিডিও করলে যদি পাবলিকের কিল,ঘুষি খেতে হয় তাই ভয়ে করিনি। আপনাকে দেখেছি তার প্রমাণ হিসেবে কলেজের কিছু পিক নিয়েছি। আপনার অনুমতি নেইনি তারজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’
মাধবীলতা সরাসরি প্রশ্ন করলো,
‘আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো কেন?’
‘জানি না’
‘দেখতে পেয়ে কি শান্তি পাচ্ছেন?’
সবুজ হেসে জবাব দিল-
‘ভীষণ শান্তি পাচ্ছি।’
‘পাগল একটা।’ বলেই ফোন রাখলো মাধবী।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় গেইটের দারোয়ান একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল,
ম্যাডাম,কুরিয়ার অফিস থেকে আপনার একটা পার্সেল আসছে। আমার কাছে রেখে গেছে।
মাধবীলতা প্যাকেটা নিয়ে ঠিকানা দেখলো।
শুধু লেখা শ্যামলী,ঢাকা। ফোন নাম্বারটা পরিচিত লাগছে। কে পাঠাতে পারে? প্যাকেট হাতে নিয়ে রিকশা ঠিক করলো। বাসায় এসে দ্রুত প্যাকেট খুললো। তাজা গোলাপের তোড়া,ছোট্ট চিরকুট। চিরকুটটা মেলে ধরলো চোখের সামনে,
ভালোলাগা যদি অপরাধ হয়
আমি সে অপরাধে অপরাধী,
সুখের দেখা না পেলে কষ্টকে
সুখ ভেবে বানাবো জীবন সাথী,,,
”আগামীর পথচলা শুভ হোক,,
”শুভ জন্মদিন প্রিয় মাধবীলতা”
শাড়ির প্যাকেট বের করে দেখলো অ্যাশ কালারের জামদানি। পুরো শাড়িতে ভরাট কাজ।
মাধবীলতা বুকভরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ নিল।
গোলাপ হাতে নিয়ে অতীত জীবনে ফিরে গেল কিছু সময়ের জন্য। যে মানুষটাকে নিজের জীবনের চাইতে অনেক বেশি পছন্দ করতাম। সে-তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। রেখে গেছে কিছু সুখস্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়েই জীবনের অনেকটা পথ যেতে হবে।
‘কি-রে মাধবী ভাত খাবি না?’ রমিজা বানু বলল।
হুম। যাও আসছি।
‘শাড়ি কে দিল? ছাত্রী?’
মাধবীলতা শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
রাতে নেটে এসে দেখে সবুজ তাকে টেক্সট করেছে,
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
একটিভ দেখেও মাধবীলতা কোনো রিপ্লাই দিল না। সবুজ আবার টেক্সট করলো,
যেইদিন শাড়িটা পরবেন তার আগের দিন ছোট্ট করে লিখবেন,’কাল শাড়িটা পরবো।’
আমি কাঠগোলাপ কিনে প্যাকেটে চুপ করে গেইটের দারোয়ানের কাছে রেখে আসবো।
বলবো,ম্যাডাম এটা অর্ডার করেছিল। আপনি খোঁপায় কাঠগোলাপ জড়িয়ে,শাড়ির সাথে ম্যাচিং অর্নামেন্টস পরে শুধুমাত্র একটা ছবি দেবেন।
এবারও মাধবীলতা মেসেজ সিন করে কোনো রিপ্লাই দিল না।
——————
পর্ব-০৩
( পর্ব-০৪ এ সমাপ্ত )
#মাকসুদা খাতুন দোলন।