#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব_১
(রিপোস্ট)
“আপা, আপনার মনটা কি খারাপ? খুব চুপচাপ মনে হচ্ছে।”
“রুমি, আজ আমার ক্লাসটা একদম লাস্ট পিরিয়ডে। আমি কি আমার ক্লাস আওয়ারটা তোমার ক্লাসের সাথে বদলাতে পারি? নয়টা বাজে আমার ফিজিওলোজি ক্লাসটা নিলাম, আর তুমি একটার দিকে তোমার ক্লাসটা নিলে? যদি তোমার কোন সমস্যা না থাকে।”
“শুধু আজকের জন্য আপা?”
“হ্যাঁ, শুধু আজকের জন্য। রোজ রোজ তো আর আগে বের হতে পারব না, তাই ক্লাস আগে পরে যখনই হোক কী আসে যায়। কিন্তু আজ আমার শিডিউল ক্লাসটা তোমার সাথে বদলাতে পারলে একটু আগে বের হতাম। ছেলেটা কাল রাতে শোকেসের সাথে মাথায় বাড়ি দিয়েছে, বেশ খানিকটা কেটেছে জানো, সেলাই লেগেছে তিনটা।
“কী বলেন আপা! এতক্ষণ বলেননি কেন? আর আজ আসলেন কেন? ছুটি নিয়ে নিতেন। এখন কী অবস্থা রুমনের?”
“বললেই কী আর ছুটি নেওয়া যায়, আমার ক্যাজুয়াল লিভ প্রায় শেষ। এরচেয়েও যদি বড়ো কোন ইমার্জেন্সি আসে, সেটা ভেবে ছুটি হাতে রাখলাম। রুমন এখন একটু ভালো, ডাক্তার ঔষধ দিয়েছে, ঘুমাচ্ছে। তোমার ভাইয়া আছে বাসায়।”
“কিভাবে কী হলো আপা?”
“কাল রাত নয়টার দিকে ঘটনাটা ঘটে। রুমন শোকেসের ভেতর থেকে কিছু একটা নিতে চাইছিল, আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম, আর তোমার ভাইয়াও ফোনে ব্যবসায়িক আলাপে ব্যস্ত ছিল। আমার শাশুড়িও বাসায় নেই। ও কয়েকবার এসেছে আমার কাছে আর তোমার ভাইয়ার কাছে, আমি হাতের কাজ ফেলে সাথে সাথে যেতে পারিনি। কিন্তু এই কয়েক মুহূর্তের ভেতর ওর রাগ উঠে যায়। রেগে গিয়ে মাথা বাড়ি মারতে যায় শোকেসে। মাথায় বাড়ি দেওয়ার সময় পিছলে শোকেসের কোনায় বাড়ি লেগে কেটে গেল, না আঘাতটাই বেশি জোরে দিল জানি না, কিন্তু কপাল কেটে রক্তারক্তি অবস্থা।”
“আল্লাহ রহম করুন। আপা কাঁচ ঢুকেনি তো?”
“নাহ্, ও হঠাৎ হঠাৎ এমন রেগে নিজের ক্ষতি করে ফেলে দেখে আমরা বাসায় এমন জিনিস রাখি না এখন। ড্রেসিং টেবিল নেই বাসায়, কাঁচের জিনিস কিছু হাতের কাছে রাখি না। শোকেসের গ্লাসও নেই, পুরো কাঠের পাল্লা।”
“আপা আপনি নয়টার ক্লাস নিয়ে চলে যান। কোন সমস্যা নেই।”
“অনেক অনেক ধন্যবাদ রুমি। জানতাম তুমি না করবে না, তাই অনুরোধ করলাম। আমি যাই তাহলে ক্লাসে, সময় হয়ে এসেছে।”
আপা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কী চিন্তা করে আবার বসলেন।
“কী হয়েছে আপা?”
“রুমি, আর কাউকে বলো না রুমনের কথা। আমি শুধু প্রিন্সিপাল ম্যামকে জানাব। টিচার্স রুমের আর কাউকে বলার ইচ্ছে নেই।। জানোই তো সবার কৌতুহলের শেষ নেই।”
রুমি ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মরিয়ম আপা আর অপেক্ষা করেন না, ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে, তার আগেই ডিপার্টমেন্টের হেড আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে কথা বলে নিতে হবে। যদিও মরিয়ম আপা যথেষ্ট দায়িত্ববান, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কলেজ থেকে আগে আগে চলে যান না, তারপরও রুমনের কারণে হঠাৎ হঠাৎ তার ইমার্জেন্সি চলে আসে। এমনও হয় কলেজে ক্লাস নিতে আসার আগ মুহূর্তে ছুটি নিতে হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে এমন ছুটি নিলেও রুমির মতো কলিগরা সামলে নেন বলে চাকরিটা চালিয়ে যেতে পারছেন। এই চাকরিটা ওনার প্রয়োজন, ছেলেকে অনেক বেশি সময় দিতে হয় বলে ক্লিনিক্যাল সাইড ছেড়ে এসেছেন। এখন শুধু ‘লাইফ কেয়ার ডেন্টাল কলেজ এন্ড হসপিটালে’ ফাস্ট ইয়ারের ফিজিওলজির ক্লাস নেন, দরকার না হলে এই চাকরিটাও করতেন না, কিন্তু এই বেতনটা আপার ছেলের জন্য দরকার। ভালো মানের স্পেশাল চাইল্ড স্কুলগুলো ভীষণ ব্যয়বহুল। মরিয়ম আপার একটাই ছেলে, অটিজম আছে বলে ওর পেছনে অনেক বেশি সময় আর কেয়ার দিতে হয়। এগারো বছর বয়সী রুমন এমনিতে ভীষণ মেধাবী, খুব সুন্দর ছঁবি আঁকে, ক্রাফটিং করে, কিন্তু রেগে গেলে নিজেকে আঘাত করে। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের ভেতর গেলে যদি বিরক্ত হয়, তাহলে খুব অস্থির হয়ে যায়। বিশেষ করে সেই পরিবেশ আর মানুষদের মাঝে, যারা ওর প্রতি অযাচিত কৌতূহল দেখিয়ে ওকে বিরক্ত করে। না হলে রুমন ঘুরতে পছন্দ করে। কলেজ থেকে আয়োজিত পিকনিকে মরিয়ম আপা সবসময় ছেলে আর হ্যাসবেন্ডকে নিয়ে আসেন, রুমনকে কেউ যেন বিরক্ত না করে প্রিন্সিপাল ম্যাম এটা সবাইকে দেখতে বলেন। তারপরও যে মাঝেমাঝে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না তা নয়। তবে মরিয়ম আপা সামলে নেন, ভীষণ ধৈর্য আপার, সাথে আপার হ্যাসবেন্ডও সাহায্য করেন যথাসম্ভব। আপার চাকরির সময়টা ওনার হ্যাসবেন্ড শিহাব সাহেব বাসায় রুমনের সাথে থাকেন। রুমন বাবা মা ছাড়া অন্য কারো সাথে খুব একটা স্বস্তি বোধ করে না। দাদি রুমনের মর্জির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না, তার উপর যখন থেকে তিনি বুঝতে পেরেছেন রুমন সব সময় এমনি থাকবেন, তখন থেকে তিনি মরিয়ম আপাকে আরেকটা সন্তান নেওয়ার চাপ দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু রুমনের পেছনে ওনার এত সময় চলে যায় যে অন্য আরেকটা বাচ্চা নেওয়ার কথা এখন আর ভাবতে চান না। এই নিয়ে বৌ শাশুড়ির মাঝে অনেকদিন ধরেই ঠান্ডা লড়াই চলছে।
রুমি ক্লাস নিয়ে যখন বের হয় তখন ঘড়িতে প্রায় দুইটা বাজে, কলেজ তখন প্রায় ফাঁকা, আউটডোরে রোগীদের লাইন আর নেই। অল্প কিছু ইন্টার্ন এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কী আলো ঝলমলে তাদের মুখ, ওদের দিকে তাকিয়ে রুমির নিজের দিনগুলো মনে পড়ে যায়, সেই সুন্দর সময়গুলো আর কোনদিন ফিরে আসবে না। শুধু স্মৃতি হয়ে হানা দিবে। রুমি আজ উবারে যাবে, বাসে যাওয়ার এনার্জি নেই। উবার কল করে বসে মোবাইলের রেডিওটা অন করে দেয় রুমি।
(চলবে)