#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব১০
রুমি, রশ্মি আর আদিল তিন ভাইবোনকে সহ সবাইকে বড়ো মামা বসার ঘরে ডেকে বসান, ওনার জরুরি কথা আছে। রুমির বাবা মা বয়সে ছোটো বলে তিনি তাদের দুজনকেই নাম ধরে ডাকেন।
“হামিদা, বয়। চা তো খেলাম। বাকি নাস্তা পানি পরে করা যাবে, আগে জরুরি কথা বলে নেই।”
“বলেন ভাই।”
“শুক্রবার রশ্মিকে দেখতে আসাটা একরকম ফর্মালিটি বুঝেছিস। প্রাথমিক কথাবার্তা সব আগেই হয়েছে আমার সাথে। আর সানোয়ার তো আমার সাথে ছেলের অফিস দেখে এসেছে। হামিদাকে বলো নাই সানোয়ার?”
“জ্বি ভাই বলেছি তো। ছেলে নিয়ে আমাদের অপছন্দের কিছু নাই।”
“আলহামদুলিল্লাহ। ছেলের ছোট একভাই আর বড়ো দুইবোন আছে, বোনদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই দুলাভাই ভালো চাকরি বাকরি করেন। আর ছোটোভাই ইস্ট ওয়েস্ট ভার্সিটিতে পড়ছে। ছেলের বাবাও সানোয়ারের মতো অবসরে গিয়েছেন কয়েক বছর হলো। ”
“এসব তো জানি ভাই।”
“হ্যাঁ, জানোস, তাও বল্লাম এটা বোঝানোর জন্য যে আল্লাহর রহমতে প্রস্তাব ভালো। আর প্রাথমিক কথাবার্তায় ওনারাও তোদের পরিবার পছন্দ করেছেন। ছেলের মা বাবা রশ্মির ছবি দেখেছে, ওনারদেরও মেয়ে নিয়ে আপত্তি নাই। এখন শুধু সামনাসামনি দুই পরিবার বসে কথা বলা বাকি। সাথে ছেলে আর পরিবারের বাকিরা একটু মেয়েকে সামনাসামনি দেখে নিল, এই আর কী। শুক্রবার সবকিছু মনের মতো মিললে ওনারা কাবিন করিয়ে যাবেন। অনুষ্ঠান পরে ধীরে সুস্থে হবে।”
হামিদা বেগমের তারপরও চিন্তা যায় না, এত সহজে রশ্মির বিয়ে হবে তা তিনি ভাবেন না। বড়ো ভাই ভাবির প্রতি কৃতজ্ঞ, ওনারা এগিয়ে এসেছেন, সবকিছু নিশ্চয়ই সামলে নিবেন। কিন্তু যদি ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখেশুনে কাবিন না করেই চলে যায়, তাহলে কেমন অপমানের বিষয় হবে। কিন্তু বড়ো ভাইকে এই কথা তিনি বলতে পারেন না। তবে রুমির আব্বা, সানোয়ার সাহেবই বলেন, ” ভাই এটা তো ভালো কথা যে ওনারা সরাসরি কাবিন করাতে চান। তবে আল্লাহ না করুক, যদি ওনারা কাবিন না করে চলে যান, তখন আমাদের মেয়ের কেমন নিজেকে ছোটো লাগবে। তাছাড়া একদিনেই এত বড়ো সিদ্ধান্ত কিভাবে নেওয়া যাবে? তারচেয়ে ওনারা ঐদিন শুধু আসুক, মেয়েকে দেখে যাক, আমরাও ছেলে আর ছেলের পরিবার দেখি। তারপর না হয় সবাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেই। এতে কারও উপর কোন চাপ থাকলো না। কাবিন না হয় পরে করা যাবে।”
“আরে পছন্দ হবে না কেন। ওনারা যে খালি রশ্মির ছবি দেখে পছন্দ করেছেন তা তো না। রশ্মিকে কলেজে দুইবোন আড়াল থেকে দেখে এসেছে, খোঁজ খবর নিয়েছে। মনের মতো মনে হয়েছে বলেই তো নিজ থেকে কাবিনের কথা বললেন। এখন আমরা কাবিন করতে না করলে বরং ভাববে ভাব নিচ্ছি। রুমির কথা শুনেও ওরা আগাচ্ছে এটাই তো বড়ো কথা।”
“আমার কী কথা মামা? আমি কী করলাম?”
“না মানে, মেয়ের ইমিডিয়েট বড়ো বোন তালাক নিয়ে বাচ্চাসহ বাড়িতে আছে এই কথা শুনলে অনেকেই আর আগাতে চায় না। সেখানে তারা এটা নিয়ে আপত্তি করেনি, শুধু বলছে শুক্রবার তুই মেয়েকে নিয়ে বাসায় থাকতে না।”
“মানে, বাসায় কেন থাকবে না রুমি আর তিতলি? ওদের অপরাধ কী?” এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার আদিল প্রশ্ন করে।
মামার হয়ে মামীই উত্তর দেন, “আদিল, তোমরা সবাই এমন ভাব করতেছ যেন কিছু বোঝ না। ওরা দশ বারোজন আসবে আত্মীয় স্বজন, সবাই তো আর এক মতের না। অযথা রুমির তালাক নিয়ে কথা হবে, প্রশ্ন হবে, এসবের কী দরকার? শুনো তুমি বড়ো ভাই কোন চাকরি করো না এখনো, তোমাদের বাবা অবসরে গিয়েছেন, এই ফ্ল্যাট ছাড়া বলার মতো কোন সম্পদ নাই, রশ্মিও কোন আহামরি রূপসী বা গুণী না। এরপরও ছেলেপক্ষ নিজ থেকে কাবিন করতে চাইছে, সেটাই তো বড়ো। তোমার মামা আগানোয় এইটা সম্ভব হয়েছে, না হলে এত সহজ না সবকিছু। ”
রশ্মি চুপ করে থাকো। ওর বিয়ের কথা হচ্ছে, সেখানে নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু বলাটা অশোভনীয়। আর মামীর কথা শুনে আদিল চুপ হয়ে যায়। বলবে না বলবে না করেও রুমি চুপ থাকতে পারে না, তাছাড়া নিজের বোনের কাবিনে থাকতে পারবে না, এ কেমন শর্ত! “মামা আমার বোনের কাবিনে আমি থাকব না? ডিভোর্সি বলে? এই শর্ত আবার আপনারা স্বাভাবিক বলছেন?”
“রুমি মূল অনুষ্ঠানে থাকবি। তখন তো বিয়ে হয়েই যাবে, কে কী বললো না বললো তা নিয়ে সমস্যা হবে না। এই শুক্রবার তুই আমাদের বাসায় চলে যা তিতলিকে নিয়ে।”
রুমি আব্বা আম্মার দিকে তাকায়, রুমি আর তিতলির জন্য কী ওনারাও কিছু বলবেন না! কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর সানোয়ার সাহেব মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছেন। আর হামিদা বেগম শুধু শান্তিতে রশ্মির বিয়ে দিতে চান। রুমি নিজেই আবার বলে, “মামা, এত তাড়াহুড়োয় বিয়ে কী ঠিক? আর শুধু ওনাদের শর্ত মতো সব পছন্দ হলেই কাবিন হবে। না হলে ওনারা চলেও যেতে পারেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে আগানোর কারণই বা কী? আমাদেরও পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার আছে। আব্বা ঠিকই বলেছেন মামা।”
“আমি তাহলে ভুল বলছি?”
বড়ো মামা রেগে যাচ্ছেন বুঝতে পারছে রুমি, “না মামা। বললাম তাড়াহুড়ো না করাই ভালো।”
“তাড়াহুড়োর কী দেখলি? সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে।”
“মামা ছেলে চাকরি করে, ভাইবোন শিক্ষিত এতটুকুই দেখা হয়েছে।”
“আর কী দেখা লাগে?”
“লাগে মামা, ছেলে মেয়ে উভয়ের ব্যাপারেই আরও অনেক কিছু দেখা লাগে। সংসার শুধু চাকরি দিয়ে হয় না।”
“তোর মতো নারীবাদী হলে সংসার এমনিও হয় না।” পাশ থেকে উত্তর দেন মামী।
“নারীবাদী শব্দটা কী গালি মামী? শুনেন আমার বিয়েটাও এভাবেই হয়েছিল, ডাক্তার ছেলে, শিক্ষিত পরিবার, ব্যস ওনারা মেয়ে পছন্দ করেছে, বলো আলহামদুলিল্লাহ। আর বিয়ে হয়ে গেল। ছেলেটার চরিত্র কেমন, মানুষ কেমন সেসব খোঁজ নেওয়ার কথা কেউ ভাবেনি। অথচ সংসার ভাঙার কথা উঠলেই আমি নারীবাদী, তাই সংসার হয়নি!”
“রুমি, হিমেলের যে চারিত্রিক সমস্যা আছে তা আমরা বিয়ের আগে কিভাবে জানব? এটা তোর কপালে লেখা ছিল।”
“এটা মোটেও কপালে লেখা ছিল না। আপনারা কেউ কী হিমেলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলেন যে ওর আচার আচরণ কেমন? হসপিটালে বা কলেজে ছেলে হিসেবে সবাই ওকে কোন চোখে দেখে?”
বড়ো ভাই ভাবির সাথে মুখেমুখে তর্ক করায় হামিদা বেগম বিরক্ত হন। রুমিকে থামতে ইশারা করেন। সানোয়ার সাহেবও রুমিকে থামতে বলেন। কিন্তু রুমির মামী নিজেই উত্তর দেন, “না তোমার মামা সেসব খোঁজ নেয় নাই। এটা দোষ হয়েছে স্বীকার যাচ্ছি। কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রী হিসেবে বাকি খেয়াল তো তোমার রাখার কথা। অথচ স্বামী একজনের পেট বাঁধিয়ে ফেললো আর তুমি টেরও পাওনি। ঐ মেয়ে মরতে না ধরলে কেউ জানতেও পারত না। তখন সুন্দর সংসার করতে হিমেলের সাথে।”
“ঘুরেফিরে দোষ আপনারা আমার কাঁধেই দিবেন। কারো চরিত্র খারাপ হলে তাকে পাহারা দিয়ে রাখব? আর মামী হিমেলের কথা জানাজানি হওয়ার পর যখন আমি তালাক নিতে চাই, তখন কিন্তু আপনি আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছেন। আমি ভাবছিলাম পরিবারের একজন আমাকে বোঝে। কিন্তু পরে দেখলাম যে না কোন সাপোর্ট না, মজা নেওয়ার জন্যই এমন করেছেন। একদিকে আমাকে বলতেন সংসার করো না এই লম্পটের সাথে, আরেকদিকে আম্মার কান ভারী করতেন আমার নামে। আমি বোকা, বুঝতে অনেক দেরি করেছি। তালাক নেওয়ার পর যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি নেগেটিভ কথা বলেছে সে আপনি মামী।”
“শুনলে হামিদা শুনলে। কত বড়ো বেয়াদব এই মেয়ে। এই তুমি আরও আসবা গায়ে পড়ে ভাগ্নিদের বিয়ে দিতে। এই জন্য না স্বামী আছে না সংসার আছে এই মেয়ের। আমি এখনি চলে যাব, আর কোনদিন যদি এই বাড়িতে এসেছি।”
“আপনি যাবেন কেন। আমি যাব আমার মেয়ে নিয়ে। এই বাসার সবার ঘাড়ে আপদ আমি আর আমার মেয়ে। তাই তো নিজের মাও আমার পাশে দাঁড়ায় না।”
হামিদা বেগম উঠে রুমিকে একটা চড় দিলেন।
বসার ঘর উত্তপ্ত হয়ে যায় অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে। চড় খেলেও চুপ হয় না রুমি, আজ কেন জানি চিল্লাতে চিল্লাতে নিজের অভিযোগগুলো বলে যায় একে একে। মেয়ের মুখে একের পর এক অভিযোগ শুনে হামিদা বেগম আর সানোয়ার সাহেবও অবাক হয়ে যান।
(চলবে)