ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ২৪
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
সারাদিন মোটামুটি বেশ ভালো ইগনোর করেছি ওনাকে। চরম ইগনোর যাকে বলে। উনি যতোই ভালোভাবে কথা বলতে চেয়েছেন ততোই পরিস্থিতি ঘেটে দিয়েছি আমি। আর আমার প্রতিবারের করা ইগনোরে ওনার কালো হয়ে যাওয়া মুখটা খুব ইনজয় করেছি। যদিও আমারও তখন খারাপ লেগেছে কিন্তু উনিও তো আমায় কত কষ্ট দিয়েছেন তার বেলা?
রাতে জাবিন আর আপির সাথে গল্প করে বিরক্তি নিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছি। এখন আমায় আবার ওই খাটাশের কাছে যেতে হবে। না জানি আবার কোন নতুন উপায় খুজে বসে আছে আমায় জ্বালানোর। এখন মামাবাড়িতে আছি তাই অন্যরুমেও থাকতে পারবোনা তাহলে সবাই খারাপ ভাববে, আর তাছাড়াও আলাদা থাকার মতো তেমন স্পেসও নেই। তাই নিরুপায় হয়ে ওই রুমেই যেতে হচ্ছে। আমি দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজাটা ভিড়িয়ে দেওয়া। আমি দরজাটা আস্তে করে অর্ধেক মেলতেই কেউ আমার হাত ধরে হ্যাচ আমায় ভেতরে নিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ান। এস এসপেক্টেড। এরকম কাজ উনি ছাড়া আর কে করতে পারে? উনি আমার হাত ধরে রেখেই দরজা আটকে দিলেন আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। উনি আমায় দরজার সাথে লাগিয়ে ধরে বললেন,
— “এতো লেট করছিলে কেন হ্যাঁ? জানো কখন থেকে ওয়েট করছি?”
আমি ওনার দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— ” কেনো? আমাকে দিয়ে কী করবেন আপনি?”
— ” মানুষ বউ দিয়ে কী করে?”
আমি ওনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
— ” সারাদিন বউ বউ করবেন না তো। এখন বউ বলতে এসছে।”
উনি মুচকি হেসে আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,
— ” আমার বউ আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন ডাকবো তাতে কার কী?”
— ” আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। বলবোই না কথা।”
বলে বেডের কাছে চলে এলাম। আমি মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও ওনার মুখে বারবার বউ ডাকটা শুনে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে। কিন্তু ভালোলাগাটাকে বাইরে দিয়ে প্রকাশ না করে চেহারায় বিরক্তিভাব রেখেই গিয়ে বিছানা ঠিক করতে লাগলাম। বিছানা ঠিক করে আমি ওনার দিকে তাকালাম। উনি দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে মনোযোগ দিয়ে আমায় দেখছেন। ওনার চোখে এক অদ্ভুত মাদকতা দেখতে পাচ্ছি। এমন মনে হচ্ছে জেনো আমি ওনার থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ওয়াসরুমে গিয়ে দরজা লক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই ছেলের উদ্দেশ্যেটা ঠিক কী? কই এই তিনমাসতো আমার দিকে ঘুরেও দেখেনি পাত্তাই দেয়নি আমাকে। মাস্টারদের মতো পরিয়ে গেছে, আর গার্ডিয়ানদের মতো খাওয়া, গোসল, ঘুম নিয়ে তদারকি করে গেছেন। এখন কী হল? বিয়ের তিন মাস পর এখন ওনার মনে পরলো যে আমি ওনার বউ? সিরিয়াসলি? কিন্তু আমি কেনো? মানবো? উনি নিজে যা খুশি করে যাবেন আমায় মানতে হবে নাকি? এরকম নানা কথা ভেবে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখি উনি বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখছেন। আমি কিছু না বলে চুপচাপ লাইট অফ করে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পরলাম। কিছুক্ষণ পরে উনিও শুয়ে পরলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম উনি আমার পেটের ওপর হাত রাখলেন। আহা! এখন এসছে দরদ দেখাতে। অথচ এতোগুলো দিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পরতো। আমি বেশ রেগেই হাতটা সরিয়ে দিলাম। এবার দেখো কেউ ইগনোর করলে কেমন লাগে। একটুপর উনি আবারও আমার ওপর হাত রাখলেন। আমি আবারও সরিয়ে দিলাম। কিন্তু উনি আবারও হাত রাখলেন কিন্তু এবার আর সরাতে পারলাম না কারণ উনি এবার শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমি ওনার সাথে কথা বলবোনা তাই চোখ বন্ধ করে রইলাম। এমনিতেও বেশ অনেকটাই রাত হয়েছে তাই প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় এভাবেই কেটে গেলো। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,
— ” অনি?”
ওনার ডাক শুনে চমকে উঠলাম আমি। তবুও কিছু বললাম না। ওনার সাথেতো কথাই বলবোনা। এমনিতেও চোখ খুলতে পারছিনা এতোটাই ঘুম পাচ্ছে। উনি বললেন,
— ” আমি জানি তুমি এখনও জেগে আছো। আচ্ছা তোমায় কথা বলতে হবেনা আমি বলছি তুমি শোনো?”
আমি এবারও কিছুই বললাম না। চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারছিনা। উনি আবারও বলে উঠলেন,
— ” জানো জীবন খুব অদ্ভুত হয়। আমরা ভাবি এক কিন্তু হয় আরেক। হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যায় যার ফলে আমাদের আগের করা সব পরিকল্পনাও নিমেষেই বদলে যায়। নতুন করে ভাবতে হয়। এমনটাই হয়েছিল ইশরাকের মৃত্যুর পর। তুমি জানো ভাইয়া আর বউমনির এনগেইমেন্টের দিন যখন তোমা..”
আর কিছু শুনতে পেলাম না আমি। উনি কিছু বলছে বুঝতে পারছি কিন্তু সেটা আর বুঝতে পারছিনা এতোটাই ঘুম আচ্ছন্ন করছে আমাকে। চেষ্টা করছি শোনার কিন্তু শুনতে পারছিনা। আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
___________________
সকালে ঘুম থেকে উঠে আর ওনাকে পাশে দেখতে পেলাম না। হয়তো বেড়িয়েছেন। আমি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। বেড়িয়ে এসে দেখি উনি রুমে চলে এসছেন। বিছানায় বসে ফোন দেখছেন। হুহ সারাদিন শুধু ফোন? অথচ আমার ফোনটা ভেঙ্গে ফেলল। হঠাৎই উনি আমার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঝূকে কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
— ” এতো সকাল সকাল শাওয়ার নিলে যে? আমার জানা মতে আমি তো কাল রাতে কিছুই করিনি।”
আমি এবার চোখ বড় বড় করে তাকালাম ওনার দিকে। কিছুক্ষণ আহম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে তারপর রেগে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” অসভ্য লোক একটা। সমসময় মাথায় এসব ঘোরে তাইনা?”
উনি হেসে দিয়ে বললেন,
— ” বাহবা। আমার পিচ্চি বউটাতো খুব চালাক হয়ে গেছে। আমার কথা আমাকেই শোনাচ্ছে।”
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। দূর ওনার সাথে কথা বলবোনা বলেছিলাম তো তবুও কেনো বলছি? এসব ভেবে মুখ ফুলিয়ে ওনার কাছ থেকে সরে এলাম। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে লোশন লাগাবো। উনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আয়নার আমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়েই একটা চকলেটের বক্স এনে সামনে ধরলেন। চকলেট আমার খুব বেশিই পছন্দের, চকলেট দেখে আমি খুব খুশি হয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ওটা সরিয়ে দিয়ে ওখান থেকে যেতে নিলে উনি আমার কোমর জরিয়ে ধরে বললেন,
— ” বাপরে। আমার বউয়ের এতো রাগ? এই পিচ্চিটাও এতো রাগ করতে পারে? জানতাম না তো?
আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
— ” তা আমি কী করলে ম্যাডামের রাগ ভাঙ্গবে।”
— ” কিচ্ছু করতে হবেনা ছাড়ুন আমাকে।”
বলে ওনার বুক ঠেলে সরাতে গেলেই উনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— “রাগিণী তুমি জানো? তোমার রাগ হচ্ছে বনফুল।
যা কাঁটায় ভরপুর কিন্তু সুগন্ধে সমাকুল।
আচ্ছা তুমি কী সন্ধ্যা? নাকি এক মুঠো রোদ?
যাতে হারিয়েছি আমর চেতনাবোধ?”
আমি পুরো জমে গেলাম। ওনার এই চার লাইনের কবিতাটা আমায় জমিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এই চারটা লাইন উনি আমার জন্যেই বললেন? উনি আমাকে ছেড়ে মুচকি হেসে আমার হাতে চকলেটের বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আর আমি ওখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর চকলেট বক্সটার দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল।
___________________
আমরা সবাই এখানে আছি শুনে মিলি আর মলি আপু মানে আমার বড় মামার দুই মেয়েও জামাইসহ চলে এলো আজ। সবাই মিলে অনেক মজা করে সারাটা দিন কাটালাম। কিন্তু এরমধ্যে আর আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলিনি উনিও আসেন নি কথা বলতে। হুহ একটু ইগনোর করেছি ওমনি ইন্টারেস্ট শেষ? ভালো করেছি, আর বলবোই না কথা। সকালে রাগটা যা একটু কমেছিল ওনার সারাদিনের ব্যবহারে তা আবারও বেড়ে গেলো। সন্ধ্যায় মুখ ফুলিয়ে রুমে বসে আছি হঠাৎ আপি এসে ছাদে যেতে বলে গেলো। দূর! এখন আবার ছাদে কেনো? সবাই আড্ডা দেবে? নিশ্চয়ই উনিও থাকবেন? একগাদা বিরক্তি নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখি সবটাই অন্ধকার। আমি অবাক হয়ে গেলাম বাকি সবাই কই। আপির নাম নিয়ে দুবার ডাকার পরেই লাইট জলে উঠলো। লাইট জলতেই আমি আরও অবাক হলাম কারণ পুরো ছাদটাই সাজানো। অনেক সুন্দর করেই সাজানো। তখনই ভুতের মতো টুপ করে আমার সামনে কাব্য এসে হাজির হলো। পেছন থেকে হলুদ রং এর ইংরেজি S বের করে সামনে ধরল। আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। পাশ কাটিয়ে যেতেই ইফাজ ভাইয়া O বেড় করলো। আমি আবারও অবাক হলাম সজীব ভাইয়া সরে যেতেই অর্ণব আর সজীব ভাইয়া একসাথে দুটো R নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ওদের সরিয়ে আরকটু এগোতেই আদিভ ভাইয়া Y নিয়ে এসে দাঁড়ালো। আমি অবাকের ওপর অবাক হচ্ছি। সব মিলিয়ে তো সরি হয়। কিন্তু সরি কে বলছে? আপি, জাবিন, মিলি, মলি আপু আর জিজুরাও বেড়িয়ে এলো। সবার হাতেই সরি কার্ড। আমি কিছু বলবো তার আগেই ‘বান যা রাণী’ গানটার প্রথম দিকের মতো উইস্টলিং করতে করতে আদ্রিয়ান বেড়িয়ে এলেন পেছনে হাত দিয়ে। আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। ইফাজ ভাইয়া গিটারও বাজাচ্ছেন। উনি উইস্টলিং করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে একটা টেডিবিয়ার বের করে আমার সামনে ধরলেন যার ওপর লেখা সরি। আমি কিছু বলার আগেই আমার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন,
— “বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা
বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা
বান মেরে মেহবুবা, ম্যা তেনু তাজ পাভা দুঙ্গা
এটুকু বলে আমায় ঘোরাতে ঘোরাতে গাইলেন,
— “সুন মেরি রাণী রাণী, বান মেরি রাণী রাণী
শাহজাহান মে তেরা, তেনু মামতাজ বানা দুঙ্গা”
আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে একটা ছোট্ট তাজমহল এগিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে ওটা হাতে নিতেই উঠে দাঁড়িয়ে আবার গাইলেন,
— “বান যা তু মেরে রাণী, তেনু মেহাল দাবা দুঙ্গা
বাদান তেরি দে খুশবু, মেইনু শুন না দেভি নি
রাতান নু উঠ উঠ কে, সোচা বারে তেরি নি
সুন মেরি রাণী রাণী, বান মেরি রাণী রাণী
হান কার দে তু মেনু, ম্যা দুনিয়া নু হিলা দুঙ্গা
বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা”
উনি টেডিবিয়ারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে। কোমর চেপে ধরে আবার নিজের কাছে নিয়ে আরেক হাতে হাত ধরে ডান্স করতে করতে গাইলেন,
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আজা নি আজা সনি, আযা মেরে দিলকে কোল
আজা নি আজা সনি, আযা মেরে দিলকে কোল
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আমাকে ঘুরিয়ে ওনার বুকের সাথে পিঠ লাগিয়ে দোলাতে দোলাতে গাইলেন,
— “সুন মেরি রাণী রাণী, বান মেরি রাণী রাণী
শাহজাহান মে তেরা, তেনু মামতাজ বানা দুঙ্গা
বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা”
আমায় ছেড়ে আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে পরলেন। আর ভাইয়ারাও ওনার পেছনে সেই সরি ওয়ার্ডগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। উনি এক হাতে এক কান ধরে ঘাড় বাঁকিয়ে কিউট স্টাইলে বললেন,
— ” সরি।”
আমি অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।
#চলবে…
( রি-চেইক করতে পারিনি। তাই মিস্টেকগুলো একটু বুঝে নেবেন।)