#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব১৫
দেখতে দেখতে শুক্রবার চলে আসে, পাত্রপক্ষ রশ্মির সাথে দেখা করতে আসবে। রুমির বড় মামা ছেলের বাড়িতে জানিয়েছেন যে রুমি মেয়ে নিয়ে এ বাসাতেই থাকে, হুট করে ওকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়াটা সম্ভব না। যারা আসবেন তারা যেন জেনেশুনেই আসেন।
রুমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিল, ওনারা না করে দিলে বাসার পরিবেশ আরও খারাপ হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওনারা আসতে সম্মতি জানালে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রুমি ফোনে মাফ চাইলেও মামীর রাগ এখনো যায়নি, আজকের আয়োজনে তিনি অনুপস্থিত। অথচ এমন কখনো হয় না, যে এই বাসার কোন আয়োজন হয়েছে আর মামী নেই। মামাত ভাইবোনেরাও আসেনি। তবে মামা আর খালা খালু এসেছেন। খালাও ছেলেমেয়ে কাউকে সাথে নিয়ে আসেননি। সানোয়ার সাহেব দুই ভাই ভাইয়ের বৌকেও দাওয়াত দিয়েছেন।
সাহেদা বেগুম শুরুতে গাঁইগুঁই করছিলেন, কিছু ঠিক না হতেই এত বাইরের মানুষকে বলার কী দরকার বলে, কিন্তু সানোয়ার সাহেব ঠান্ডা মাথাতেই জবাব দেন, “সাহেদা রশ্মির মামা খালা সবাই আসবেন, আর চাচারা বাদ থাকবে কেন? ওনারাও নিজেদেরই মানুষ। ভাবিরা অবশ্য কথাবার্তা পাকা হলে মূল অনুষ্ঠানে আসবেন, এখন আর আসবেন না। এখন শুধু বড় ভাই আর মেজো ভাই আসবেন।”
রশ্মির হবু বরের নাম সাদিক, একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার পোস্টে আছে। রুমির সমবয়সীই হবে, ত্রিশ চলছে। রুমির ছোটভাই আদিল আর রুমি পিঠাপিঠি বয়সী, আদিলের উনত্রিশ চলছে। আর রশ্মি সাহেদা বেগমের বেশি বয়সের পেটপোঁছা সন্তান, সবে তেইশ শেষ হয়ে চব্বিশে পড়লো। সাদিকের মা বাবার সাথে বিবাহিত দুইবোন, দুলাভাই আর ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছোটভাই এসেছে, অন্য কোন আত্মীয় স্বজন আর সাথে আনেননি তারা। রুমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিল পুরোটা সময়, তবে শেষ পর্যন্ত সব ভালো ভাবেই সম্পন্ন হয়। ওনাদের কথাবার্তায় সবকিছু ইতিবাচক মনে হয়েছে। আগেই কথা হয়েছিল যে হুট করে কাবিন হবে না, দুই পরিবার আগে একে অপরের সাথে পরিচিত হবে, ছেলে মেয়েও একে অপরকে দেখবে। সাদিকের সাথে কথা বলে রুমিরও ভালো লাগে। যথেষ্ট নম্র ভদ্রই মনে হয়েছে, যদিও এইটুকু সময়ের ভেতর কাউকে বোঝা কঠিন।
*****
কলেজে এখন রুমির ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। স্টুডেন্টদের প্রাকটিকাল ক্লাস নিতে হয়, আউটডোরে রোগী দেখতে হয়। আগে অবসরের পুরোটা সময় মরিয়ম আপার সাথে কাটাত, এখন কেন জানি আপার সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না। মরিয়মের প্রেগন্যান্সির কথা রুমি শুনেছে, একটু অপরাধবোধও হচ্ছে কেন আপার সাথে রাগ দেখালো,মরিয়ম আপার সমস্যা কোথায় ছিল সেটা না বোঝার কারণ নেই। অন্তত মানসিক সাপোর্ট দিতে আপা কখনো কার্পণ্য করেননি। নিজের রাগ দেখানোর কথা মনে হলে আরও বেশি বিব্রত লাগে এখন, তাই চাইলেও সহজ হতে পারে না আগের মতো। ক্লাস আর আউটডোরের বাইরে বাকি সময়টা তাই ডিপার্টমেন্টের ভেতরই কাটায়। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টের লেকচারার হাসান জামিলকে জড়িয়ে নানা মুখরোচক গসিপ যে হয় তা রুমি ভালোই বোঝে। রৌশন আপা তো এমনিতেই ওকে পছন্দ করেন না, আর এখন তো হুটহাট সবার সামনে হেসেহেসে ইঙ্গিত করে কথা বলে ফেলেন, এই তো সেদিনও মিটিং শেষে সবাই যখন একসাথে চা খাচ্ছিল তখন বলে বসেন, “জামিল, নতুন সহকর্মীর সাথে কেমন সময় কাটছে? ভালোই সঙ্গ দিচ্ছ মনে হচ্ছে। রুমি তো তোমাদের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আমাদের ভুলেই গেল, রুম থেকেই আর বের হয় না।”
আপার রসিকতায় সবাই হাসে, এইসময় উত্তর দিলে প্রত্যেকে রুমি বেয়াদবি করেছে বলবে। কেননা আপা সবার সামনে এমন ভাবে বলেন যেন মজা করছেন। হাসান জামিলও হেসে মাথা নাড়ে, “আপা তারমানে আপনারা রুমি আপার মূল্যায়ন করতে পারেননি, তাই আপার জন্য ভুলে যাওয়া সহজ হয়েছে।”
হাসান জামিলও হালকা কথায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখে। তবে রৌশন আপা এত সহজে দমার পাত্রী নন, রুমির সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা তিনি এত তাড়াতাড়ি ভুলবেন না, রুমির উত্তরগুলো ওনার মনে ভালোই জ্বালা ধরিয়েছিল। আর তাই সুযোগ পেলেই রুমিকেও কথার আঘাত ফিরিয়ে দেন। রুমি জানে না ঠিক কতদিন ভদ্রতা করে চুপ থাকতে পারবে। ওর সমস্যা হচ্ছে সময় থাকতে কথা গুছিয়ে বলতে পারে না, ফলে মনের ভেতর কথার পাহাড় জমতে জমতে হঠাৎ তা বিস্ফোরণ করে।
****
“রুমি আপা, টার্মের আগেই সবগুলো কার্ড শেষ করতে বললেন স্যার।ক্লাস টেস্ট তো বোধহয় আর বাকি নেই।”
“না জামিল ভাই, আমার ক্লাস টেস্ট নেওয়া বাকি নেই। তবে কার্ড আছে দুটো। ডেট দিয়ে দেব স্টুডেন্টদের, টার্মের আগেই শেষ হবে।”
“আপা, আপনার সাথে রৌশন আপার কোন সমস্যা আছে? না মানে রৌশন আপাকে সবসময় আপনার সাথে কেমন করে যেন কথা বলতে দেখি।”
“জামিল ভাই, আপা কি আপনাকে কিছু বলেছে? সত্যি করে বলেন তো। আমি দেখলাম ঐদিন লিফটের বাইরে কথা বলছিলেন।”
জামিল ইতস্তত করে। বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না। রৌশন আপা জামিলকে রুমির চরিত্র নিয়ে সাবধান করে দিয়েছেন। আপার মতে রুমি জামিলকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করার তালে আছে। কিন্তু এই কথা তো রুমিকে বলা যাবে না। শুনলে রুমি যেমন ক্ষেপে যাবে, তেমনি রৌশন আপাও সব অস্বীকার যেতে পারেন। ভীষণ অপ্রস্তুত হতে হবে তখন।
“না আপা, তেমন কিছু না। আমার এমনি মনে হলো। আর সেদিন আমরা অন্য কথা বলছিলাম, আপনাকে নিয়ে কিছু না।”
“জামিল ভাই, আমি সত্যি জানি না আমাকে নিয়ে আপার কী সমস্যা। কোন কারণ ছাড়াই আমার পেছনে লেগে থাকেন। সত্যি বলতে আমার এসব একদম ভালো লাগে না। আমি আমার ব্যক্তিগত নানা সমস্যায় এত জর্জরিত আছি যে আপার সাথে যেতে ঝামেলা করার কোন ইচ্ছেই নেই।”
“আপা, আপনি অনেক স্ট্রং মানুষ। এসব ছোটখাটো জিনিসকে মন খারাপ করবেন না। ওনার স্বভাত তো জানেনই। তারপরও মাঝেমাঝে উত্তর দিবেন, আপা যেমন হেসেহেসে বলেন,আপনিও তেমনি হেসেহেসেই উত্তর দিবেন। হাসিতে তো ক্ষতি নেই।”
কথা শেষে মুচকি হাসি দেয় জামিল, এতদিন রুমি খেয়াল করে জামিলের হাসিটা বেশ সুন্দর। চেহারায় পুরুষ সুলভ কাঠিন্যের চেয়ে মায়াটাই বেশি। এমনিতে স্টুডেন্টগুলো স্যারের ভক্ত না। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় রুমি। কলিগের চেয়ে বেশি কিছুর দিকে চিন্তা করাও উচিত না। জামিল বা অন্য কেউ আভাস পেলে হয়তো রুমিকেই হাসির পাত্রী বানাবে। জামিলের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে খাতা দেখায় মন দেয় রুমি।