#এক_কাপ_চায়ে : ০৪
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
পুষ্প বিরক্ত মুখ করে বসে আছে। তার সামনে বরাবর বসা জোয়ান সুদর্শন ছেলেটির প্রতি তার একরত্তি আগ্রহ নেই। পুষ্পর বসে থাকার কারণটিও বিরক্তিকর। ভাবীর বাবার গুরুতর অবস্থা। ভদ্রলোক হাঁটতে গিয়ে এ দেয়াল ও দেয়ালে ঢলে পড়ছেন। কাজেই পিতৃভক্তির শীর্ষে অবস্থান করা তনুর ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। চাবি আছে মাহবুবের কাছে। তার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তবে নবীনের বসে থাকার ব্যাপারটা হজম করা যাচ্ছে না।
নবীন ভাবছে অন্য কথা। পুষ্প যে প্রথম একবার বলেছে, “ভাইয়ার আসতে দেরী হবে” তারপর আর একটা কথাও বলেনি। ঠায় মুখ বন্ধ করে বসে আছে। নবীনকে যেন মানুষ বলেই গন্য করছে না। ইনিয়ে বিনিয়ে চুলে হাত দেয়া, ওড়না বারবার ঠিক করা কোনো মেয়েলি বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে নেই। কথা বলার ধরণও ভারী শক্ত। তবুও অদৃশ্য এক টানে সে বসে আছে। মনে মনে একটা দ্বায়িত্ববোধ কাজ করছে। এই অবেলায় মেয়েটা একা একা বসে থাকবে!
নবীন হঠাৎ খেয়াল করলো পুষ্প তার দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। চারিদিক তার এত রহস্যময় মনে হচ্ছে কেন কে জানে। চাকরি-বাকরির যন্ত্রণা, এখন আবার এই মেয়েটা। তামাম বিশ্বভ্রম্মান্ড লাগছে রহস্যপুরী, যাকে ভেদ করা যায় না। আর সে হচ্ছে রূপকথার বোকা রাজপুত্র। তার জন্য নিশ্চয়ই কোনো বুদ্ধিমতী রাজকন্যা অপেক্ষা করছে।
নবীনের খুব মন খারাপ হতে লাগল। রাজকন্যার দেখা পেতে কত অপেক্ষার প্রহর ভেবে অস্হির বোধ করল। হয়তবা রাজ্যবিহীন বোকা রাজপুত্রের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না।
.
.
সূর্যের আলো চোখে লাগছে না। আবছা অন্ধকার ঘরটায় ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। এহসান সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কানের কাছে অনবরত বেজে চলেছে নূপুরের ঝুনঝুন ধ্বনি। তার কপাল ঘামছে। নবীন এসে বলল,
— “স্যার। মাহবুব স্যার এসেছেন। ভেতরে ডাকব?”
এহসান চোখ মেলে তাকালেন না। গম্ভীর গলায় বললেন,
— “ডাকো।”
মাহবুব ভেতরে এলো। ঘরটা জহুরি চোখে দেখে নিলো একবার। সামনের দেয়ালের মাঝ বরাবর একটা ছবি। ছবিটা ন্যাকড়া দিয়ে ঢেকে রাখা। কার ছবি অনুমান করার চেষ্টা করলো মাহবুব। সম্ভবত ভদ্রলোকের প্রয়াত স্ত্রী।বড়লোকদের ঘরে এমন ছবি টাঙিয়ে রাখার রেওয়াজ আছে। মাহবুব শুকনো কেঁশে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। হুজাইফা ওর পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে।
এহসান উঠে বসলেন। বললেন,
— “আমার মরণব্যাধি দেখা দিয়েছে বোধ হয়। মরণ ব্যতীত নিস্তার নেই।”
— “আপনার সমস্যাটা একটু খুলে বলুন।”
এহসান সংশয় নিয়ে ঠোঁট ভেজালেন।
— “গত সোমবার আমার ঘরের খাটের নিচে আমার মেয়ের লাশ পেয়েছি। আমি অবাক হয়েছিলাম কারণ আমার মেয়ে আমার থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল। সম্ভবত ফরেইন কোনো কান্ট্রিতে….”
— “আপনি জানতেন না কোথায় থাকত? নিজের মেয়ে আপনার?”
এহসান মাথা নিচু করে ফেলল। অপরাধীর লক্ষণ।
— “আসলে ও আমাকে বাবা হিসেবে পছন্দ করতো না। আমাদের মধ্যে বাবা মেয়ের মতো কোনো স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না।”
— “কারণ?”
এহসান সাহেব হঠাৎ অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালেন। মনে হলো এক্ষুনি সামনে থাকা ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বসবেন। মাহবুব দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল।
— “আচ্ছা তারপর বলুন কী হলো?”
— “তারপর থেকে আপনার কানের কাছে একটা নূপুরের আওয়াজ পাচ্ছি। মাঝেমাঝে আমার মৃত এক মহিলাকে দেখতে পাচ্ছি। বারবার বলছে, তোর দিন শেষ। ওদের আমি চিনি না। ওদের কোনো ক্ষতি করিনি আমি।”
শেষের কথাগুলো জোর দিয়ে বললেন খানিকটা। এহসানের শরীর ঘামে জবজব করছে। গায়ের সেন্টু গেঞ্জিতে তা স্পষ্ট ধরা যাচ্ছে। মাহবুব আর কিছু জানতে চাইলো না। কিছু ঔষধ লিখে দিলো। যাওয়ার আগে একবার ছবিটার দিকে তাকাল। ন্যাকড়াটা একটুখানি সরে গেছে বাঁয়ে। শাড়ি পরিহিতা কোনো এক নারীর প্রতিচ্ছবি। কে হতে পারে?
হুজাইফাকে যেতে যেতে বললো,
— “এ বাড়িতে কে কে থাকে আর থাকতো খবর নাও তো দ্রুত। কালকের মধ্যেই ডিটেইলস চাই।”
.
.
শুভ ঘেচ ঘেচ করে দক্ষ রন্ধনশিল্পীর মতো পেঁয়াজ কাটছে। পুষ্পর হাতে ফোনটা দিয়ে বললো,
— “পুষি, আমার পেঁয়াজ কাটার একটা ভিডিও করতো। কুকিং চ্যানেলে আপলোড দেব।”
পুষ্প ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “পাগল হয়ে গেছিস ভাইয়া? পেঁয়াজ কাটার ভিডিও কে দেখবে?”
শুভর চোখ জ্বালা করছে। কটমট করে বললো,
— “তোর মতো কিছু লুতুপুতু মাইয়া আছে। এই মাইয়াগুলো বাপের ঘরে থাকতে মুরগী দেকলে উঁ কইরা চিক্কুর পাড়ে। ওগুলারে যখন হাঙ্গা (বিয়ে) দেয়, তখন ইউটিউবে কানতে কানতে সার্চ দেয়, ‘হাউ টু কাট অনিয়ন, গিংগার অ্যান্ড আমার জামাইয়ের কল্লা’।”
পুষ্প হতভম্ব গলায় বললো,
— “তুই এত বিশ্রী ভাষায় কথা বলছিস কেন? রাস্তায় থেকে থেকে রাস্তার মানুষদের মতো বিহেভ করছিস!”
শুভ নাটুকে গলায় বলল,
— “হ, আমি রাস্তার পোলা। তুই ভিক্টোরিয়ার কইন্যা। দয়া করে ভিডিও কর এখন। আমার হাতগুলো ফিল্টার মেরে সাদা ফকফকা করে দিবি। মেয়েরা যেন মিষ্টি মিষ্টি গলায় বলে, ভাঁইয়াঁ, ইঁউ আঁর সোঁ সুঁইট, আপনার হাতের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি ভাঁইয়াঁ। এমন বরই তো চেয়েছিলাম।”
— “মেয়েদের রুচি এত নিম্নমানের না।”
— “তোগো রুচি কত নিম্নমানে আমি জানি। সরকারি বুইজ্জা পেটমোটা টাকলা হইলো তোগো রুচি।”
— “খবরদার আজেবাজে কথা বলবি না। আর তোদের রুচি তো সাদা চামড়া, সাদা চামড়া দেখলে হুশ থাকে না।”
— “অত্যন্ত বাজে কথা। এতগুলো মাইয়ার সবগুলা কী সাদা? ওদের কি বিয়াশাদী হয় না?”
— “বাঃরে, সব পোলাই কী সরকারি চাকরী করে? অন্যদের কী বিয়ে হয় না?”
— “তর্কফর্ক বাদ দে। তুই আমার রূপচর্চায় মনোযোগী হ। অতিদ্রুত বিবাহ করব। ক্যামেরাতে সুন্দর ছবি আসা জরুরী। মাইয়া দেখলেই ফিট খাইতে হবে।”
পুষ্প শব্দ করে ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল৷ শুভ দোকানের জন্য সরঞ্জাম প্রস্তুত করছে। ভ্রাম্যমাণ দোকানটির নাম হবে, “গ্র্যাজুয়েট মামা”। ও গলায় মামাদের মতো গামছাও বেঁধে ফেলেছে।
মাহবুব ওর জন্য একটা চেক স্বাক্ষর করে দিয়ে বলল,
— “এগুলো হচ্ছে ধার। সৎ রুজির কষ্ট অকাজে নষ্ট করিস না।”
শুভ এবার টাকার হিসেব কষতে বসল। মাঝে একবার পুষ্পকে ডাক দিয়ে বলল,
— “পুষ্প তোকে আগেভাগে বিয়েশাদি দিয়ে বিদেয় করতে হবে রে। নইলে আবার কনের ভাই রাস্তায় রাস্তায় মুড়ি বেচে বলে বিয়ে ভাঙারি হবে।”
পুষ্পকে ওকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছে। মেয়েটার মধ্যে ভদ্রতা বলতে কিছু নেই। ওর বিয়ে এমনিতেও হবে না।
.
.
এহসান সাহেব এক দৃষ্টিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছেন। গায়ে কুঁচকে যাওয়া পাঞ্জাবি। বুকের বোতামগুলো খোলা। তাকে বিধ্বস্ত কাঙালের মতো দেখাচ্ছে। সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণনের সাথে সাথে দুলছে অর্ধনগ্ন নারীর মরদেহ। গা থেকে খসে পড়েছে শাড়ির আঁচল। টুকটুকে লাল বধূর চেহারায় শত বছরের ক্লান্তি যেন।
এহসান চোখ বুজে রইলেন ভয়ে। ভয়ংকর চিত্রগুলো মনে করতে চাইছেন না। চুপিচুপি চোখ খুলে দেখলেন সব শান্ত স্বাভাবিক। ভ্রম কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নূপুরের শব্দ। ষোড়শী কন্যার খিলখিল হাসি। ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাক। উত্তরের শীতল হাওয়া শরীরে হিম বইয়ে দিলো তার। পিতৃত্বের পরম স্বাদ তিনি পেলেন না এই ‘বাবা’ ডাকে।
শুকনো গলায় ডাকলেন,
— “নবীন!নবীন!”
নবীন এলো। উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
— “স্যার আপনার কি খারাপ লাগছে?”
— “ওই ডাক্তারকে ডাকো। আমার চিকিৎসা করছে না কেন?”
নবীন কিছু বললো না। পানি খাইয়ে গায়ে কাঁথা টেনে বেরিয়ে পড়ল। মাহবুবকে পাওয়া দায়। শিক্ষকতা তার প্রথম এবং প্রধান পেশা। অন্যান্য ব্যাপারগুলো নেহাৎ শখের বশে করে। কিন্তু এহসানের বিষয়টা অন্যরকম। নবীনের বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না। কি যে হয় সামনে!
.
.
মাহবুব ক্লাস শেষ করে একবার নিজের অফিসের দিকে গেল। ছোটখাটো খুপড়ির মতো ঘর। হুজাইফা টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঝিমুচ্ছে। দিনদিন ওর ভুড়ি বেড়ে শার্টের ফাঁক দিয়ে লজ্জাবনত চেহারা দেখাচ্ছে।
মাহবুব পানির ঝাপটা দিতেই হুড়মুড় করে উঠে বসল। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
— “স্যার, আসলে একটু ক্লান্ত ছিলাম।”
মাহবুব বললো,
— “তুমি এহসান সাহেবের বাড়ির খোঁজখবর নিয়েছো?”
— “জ্বি স্যার। উনাদের বাড়িতে দুজন কাজের লোক। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। তারা নাকি অনেক বছর যাবত কাজ করছেন। ভদ্রলোকের বউ ছিল। মারা গেছে অনেক বছর হয়েছে। কেউ জানে না কীভাবে মারা গেছেন। ভদ্রলোক তখন নাকি কিছুটা অস্বাভাবিক ছিলেন, বউয়ের লাশের আশেপাশে কাউকে ঘেঁষতে দেননি। কীভাবে দাফন হয় নিশ্চিত কেউ বলতে পারছে না।”
— “আর নবীন?”
— “ছেলেটা দেড় বছর ধরে কাজ করছে,স্যার। ভদ্র ছেলে, কিছুটা সহজ সরল আর সৎ। এহসানের ব্যাপারে বৃত্তান্ত তেমন কিছু বলতে পারেনি। মায়ের খরচ কমাতে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে এখানে কাজ নিয়েছিল। অবশ্য ও বলেনি। আমি আন্দাজ করেছি।”
মাহবুব একটা খুদে ডায়েরিতে সব তথ্য একে একে লিখে রাখল। হুজাইফাকে বললো,
— “কাজের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিকেলের দিকে প্রস্তুত থেকো।”
হুজাইফা মাথা নাড়িয়ে প্রসঙ্গ বদলালো,
— “স্যার, একটা দারুণ অফার আছে।”
মাহবুব কাজ করতে করতে বেখেয়ালে বললো,
— “কী অফার?”
হুজাইফার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস।
— “স্যার, একটা মেয়ে পেয়েছি। অপূর্ব সুন্দরী। বড়লোক বাবার কন্যা। অক্সিজেনে চারতলা বাড়ি। সেকেন্ড ওয়াইফ হতে রাজি। জাস্ট দুএকটা স্কাউন্ড্রেল আছে, স্যার। যদিও এগুলো কোনো ব্যাপার না।”
মাহবুব চোখ তুলে তাকালো। শান্ত গলায় বললো,
— “দুটো চাকরি সামলে এখন কী ঘটকালিও ধরলে?”
হুজাইফা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। নিজের বিয়ের কোনো গতি হচ্ছে না, অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামাতেই আজকাল স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছে সে। ব্যাক্কলের হেসে বললো,
— “না স্যার। মা বলছিলো তো তাই।”
— “তোমার বিয়ের কথা বলেন না?”
— “তওবা স্যার। আমি এখনও ছোট।”
— “প্লেতে পড়ছ নাকি নার্সারিতে?”
— “কী বলেন স্যার! বয়স তো ছাব্বিশে পড়লো এবার।”
— “বিয়ে কী ছেচল্লিশে করার ইচ্ছে?”
— “না না স্যার। মা বললেই করে ফেলব।”
— “তুমি গিয়ে মাকে বলো, নাকি সাহস নেই?”
— “লজ্জা লাগে স্যার।”
— “লজ্জাটুকু বিয়ের দিন রুমাল দিয়ে নিবারণ কোরো। এখন গিয়ে কী বলবে?”
হুজাইফা মাথা চুলকে বললো,
— “স্যার বলেছেন অবিবাহিতদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। সুতরাং চাকরি বাঁচানো দরকার।”
মাহবুব হেসে ফেললো। হুজাইফার খুশি খুশি অনুভব হলো। মাহবুবকে হাসানো বড় কঠিন কাজ!
.
.
নবীনের দুশ্চিন্তার বোঝাটা দিনে দিনে ভারী হচ্ছে। নম্রর স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে ও দশটাকার ঝালমুড়ি কিনল। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোট্ট একটা দোকান। হঠাৎ দোকানির দিকে তাকাতেই ও অবাক হয়ে গেল,
— “আরে শুভ ভাইয়া!”
শুভ হাসতে হাসতে ঝালমুড়ি ঘুটনি নাড়ছে।
— “চিনেছো বলে কম টাকায় পাবে না। ব্যবসায় কোনো খাতির হয় না। তুমি কী নিয়ে পড়তে নবীন?”
নবীনের হতভম্ব ভাব কাটেনি। ঢোক গিলে বললো,
— “ম্যানেজমেন্ট।”
শুভ উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
— “গ্রেট! শোনো কখনও বেকারত্বজনিত সমস্যায় পড়লে আমার কাছে চলে আসবে। ভয় পেও না। তোমাকে দিয়ে এসব করাবো না, তুমি সব ম্যানেজ করবে খালি। পুঁথির বিদ্যে বাস্তবে ফলাতে হবে, বুঝলে?”
শুভর কথার মাঝেই পুষ্প ছুটে এলো। চঞ্চল কন্ঠে বললো,
— “ভাইয়া! আমার বান্ধবীরা তোর থেকে ফ্রি খাওয়া দাবি করছে।”
শুভ ভ্রু কুঁচকে ফেললো।
— “লংকর খানা খুলে বইসি আমি? আমার দোকান কি আল্লা রস্তিয়া খানা দিতাছে?”
— “প্রথম প্রথম সবাই একটু ছাড় দেয় না? তুই এত কিপ্টামি করছিস কেন?”
— “তোর বাপের দিইন্যা দোকান পাইসোস? আমার মন ঝালমুড়ির পোটলার মতো ছোট। তোর মন প্রশান্ত মহাসাগরের চেয়ে বিশাল,নিজের সাগর পরিমাণ সম্পদ থেকে বালতি বালতি দয়া দক্ষিণা দে।”
শুভর সহজ গলা।
পুষ্প রেগেমেগে কিছু বলবে তখনই খেয়াল করলো নবীন হাভাতের মতো চেয়ে ওদের কান্ড দেখছে। পুষ্প গম্ভীর হয়ে দোকানের ভেতরে চলে গেল। শক্ত চাহনি, রুক্ষতায় কেমন বদলে গেল ওর আচরণ। নবীন নিরবে শুধু লক্ষ্যই করে গেল। শুভর আচমকা হাসিখুশি মুখ চুপসে গেল। কোনো কথা ছাড়াই পেঁয়াজ কাটতে লাগল।
রৌদ্রজ্জ্বল ব্যস্ত দুপুরের কোনো এক কোণে মন খারাপের সুর বেজে উঠলো হয়ত। নবীন মনে মনে ভাবছে, “ওর চেহারা কী খারাপ? নাকি তার কোনো বিষয় পুষ্প পছন্দ করছে না? পুষ্পর সঙ্গে তো তার রাগারাগির মতো কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই।”
নবীনের বেশ খারাপ লাগল। বলা নেই, কওয়া নেই, এতটুকুন একটা মেয়ে তাকে প্রতিনিয়ত অপমান করে চলেছে এক বিশেষ নিয়মে। অথচ অভিযোগ তোলার উপায় নেই। সে কী সত্যিই কোনো দোষ করেছে?
.
.
নূরজাহানের ভাবভঙ্গি সুবিধার দেখাচ্ছে না। কাচুমাচু করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মাহবুব সহজ গলায় প্রশ্ন করলো,
— “চাচী, আপনি এ বাড়ির বিষয়ে যা কিছু জানেন, এহসান সাহেবের খুঁটিনাটি সব নির্ভয়ে বলবেন। আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। সবটা না জানলে তার কোনো চিকিৎসাও করা যাবে না। বুঝেছেন?”
নূরজাহান মাথা নাড়লো। মাহবুব যথাসম্ভব শান্ত থেকে জিজ্ঞেস করলো,
— “এহসান সাহেবকে আগে কখনো অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখেছেন? বা বিশেষ কোনো ঘটনা তার ব্যাপারে, যার পর থেকে তার পরিবর্তন এসেছে।”
নূরজাহান শাড়ির আঁচল মুখে চেপে আছে। মুখ লুকিয়েই বললো,
— “স্যারের বউ মইরা গেছিলো গা অনেক বৎসর আগে। তাগো মইধ্যে বনিবনা তেমন হইতো না। তয় ম্যাডাম অনেক ভালা মানুষ আছিলেন, স্যার। আমগো হাতে তেমন কাজ করাইতো না, নিজে নিজে সব করত। স্যারের এক বান্ধবীর লাইগা ম্যাডাম অনেক নাকোশ আছিল। পরে একদিন আইসা হুনি ম্যাডাম মইরা গ্যাছে গা। আমরা লাশ দেহি নাই, কেউই নাকি দেহে নাই। স্যারের এরপর কয়দিন মাথা খারাপ আছিল। পরে ওষুধ খাইয়া ঠিক হয়। কিন্তু ম্যাডামের বান্ধবীরে আর কখনো দেহি নাই।”
নূরজাহানের কথায় জড়তা। হুজাইফা পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,
— “স্যার, প্রেম-পিরিতির মামলা। বেশিরভাগ ছেলেপেলে এমন করেই পাগল ছাগল হয়। বাদ দেন, ডিশমিশ।”
মাহবুব ভ্রু কুঁচকে তাকাল। হুজাইফা বোকার মতো হাসি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাহবুব নূরজাহানের দিকে মনোযোগী হলো।
— “এবারের অসুখ কীভাবে শুরু হলো? কিছু হয়েছিল?”
— “স্যার আমগোরে তিনদিনের ছুটি দিসিলো, গ্রামের বাইত্তে গেসিলাম গা। আইয়া দেহি দুপুরে ফ্যানের দিকে আক কইরা (হা করে) তাকায় আছে। আমি স্যার কইয়া ডাকলাম, ভয় পাইয়া কইলো, তোমার ম্যাডামরে দেহি। আমি কী পাপ করছিলাম নূরজাহান?”
— “এহসান সাহেবের ঘরে ছবিটা কার? ঢাকা কেন?”
— “ওইডা ম্যাডামের ছবি। ম্যাডাম মরণের পরপর স্যার ছবি দেইখা ভয় পাইয়া যাইত। কিন্তু নামায় নাই। পরে কাপড় দিয়া ঢাইক্যা দিসি।”
মাহবুব শেষ প্রশ্ন করলো,
— “আপনার কী মনে হয়, আপনার স্যার আর বান্ধবীর অন্য কোনো সম্পর্ক ছিল?”
নূরজাহান মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— “থাকতেও পারে। বেডা মাইনষের মন! তয় অনেকে কয়, হের বান্ধবীর লগে এককালে তার পিরিত আছিলো। মাইয়ার বাপে মাইয়া দেয় নাই।”
নূরজাহান এর বেশি তথ্য দিতে পারলো না। বাড়ির মালী বাবুল মিজির দেখা পাওয়া গেল না। সে নাকি বাকপ্রতিবন্ধী। মাহবুব যাবার আগে একবার এহসানের সঙ্গে দেখা করল। এহসান সাহেব ভীতু নয়নে অপরিচিতার মৃত মুখ বর্ণনা করছেন। অথচ নূরজাহান বলেছে, অপরিচিতা এহসানের স্বীয় স্ত্রী।
এহসান সাহেবের টলমলে কন্ঠ তার মিথ্যাকে বাজেভাবে প্রকাশ করে দিচ্ছে। তার অসুখটা সম্ভবত অপরাধবোধ থেকে। স্মৃতির পাপগুলো অসুখ হয়ে ভর করেছে গায়ে। মাহবুবের না চেয়েও অপরাধের খোলস ছাড়াবার আগ্রহ হলো খুব। চিকিৎসা ফেলে তদন্তে নামতে হবে এবার। মৃতা স্ত্রী-কন্যাকে কেউ ভয় পাবে কেন?
চলবে ~