#এক_কাপ_চায়ে : ০৮
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
নবীন ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মাহবুবের কাছে একবার যাওয়া দরকার। মানুষের হরেক রঙের চেহারা দেখে ও নিজের উপর আর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। ভাবছে ওর কল্পনার বোকা রাজপুত্র হওয়াটা খুব একটা মিথ্যে নয়। সিলিং ফ্যানের নিচে শার্ট ঢিলে করে বসল।
আফরোজা রান্নাঘরে কাজ করছেন। নম্র নাকি তনুভাবীর কাছে। কীভাবে এই পুংটা ছেলেটাকে বশ করেছে আফরোজা তার অর্থোদ্ধার করতে ব্যস্ত। আফরোজা চায়ের সঙ্গে চাল ভেজে দিলেন।
নবীন মুখে পুরতে পুরতে মাকে শুধালো,
— “মা, তুমি মাহবুব ভাইয়ের বোনটাকে চেনো? দেখেছো?”
আফরোজা মনে করার ভান করে বললেন,
— “ও! পুষ্প? মেয়েটা বুঝলি হাসি ছাড়া কথাই বলতে পারে না। একটা সাধারণ কথা বলতে গেলেও হাসতে থাকে। একদিন আমাকে বলছিল, ‘আন্টি আপনি ছেলে একটু ভালো চাকরি পেলেই চাকরিটা ছেড়ে দিবেন। ঘরেও কাজ, বাইরেও কাজ। এত পরিশ্রম করে লাভটা কী হয়?’ আমি অবাক হয়েছি। এমন ভাবে কথা বলছিল যেন আমাদের জনম জনম ধরে চেনে।”
নবীন মাথা নাড়িয়ে বলল,
— “না আম্মু, আরেকটা মেয়ে আছে। একটু ছোটমতন। স্কুলে পড়ে মনে হয়। ও হাসে টাসে না। এমন করে তাকায় যেন আমি কোনো অপরাধী।”
— “ওদের একটাই বোন। স্কুলেই পড়ে। পুষ্পই।”
নবীন অবাক গলায় বলল, “আম্মু, তুমি ওকে জিজ্ঞেস করবা তো, ও কেন আমার সঙ্গে এমন করে!”
আফরোজা হেসে ফেললেন।
— “তুই এরকম বাচ্চাদের মতো নালিশ কেন করছিস? ও শুধু নিজের ভাইদের চেনে। অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না।”
— “কেন আম্মু?”
আফরোজার হাসি মুছে গেল। তিনি অন্যমনষ্ক হয়ে গেলেন। ছোট্ট করে উত্তর করলেন,
— “চাইল্ডহুড ট্রমা। তুই বুঝবি না।”
আফরোজা উঠে চলে গেলেন। নবীনের প্রশ্নের জবাব আর দিলেন না। ও বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ভাবনা কাটাতে চাইলো। মোবাইল ফোনটা স্ক্রল করতে করতে এক জায়গায় এসে আটকে গেল। কেউ একজন পরিচয় গোপন প্রশ্ন করেছেন,
— “ছোট্টবেলার বাজে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো কীভাবে ভুলে থাকা যায়?”
সেখানে প্রায় হাজার খানেক মেয়েদের মন্তব্য। নবীন ঢোক গিললো কয়েকবার। কয়েকজনের গল্প পড়েই সে ফোন বন্ধ করে চোখ বুজে রইলো। পুষ্প শব্দের অর্থ তো ফুল। ফুলের মতো খুব মিষ্টিও।
নম্র এসে গুটিগুটি পায়ে ওর বাহুতে ঢুকে সুড়সুড়ি দিলো। নবীনের ধ্যান ভাঙলো। নবীন হঠাৎ নম্রকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
— “আচ্ছা নম্র, শোন। তোর তো তনুভাবীকে খুব পছন্দ। না?”
নম্র মুখে আঙ্গুল পুরে বলল,
— “হুঁ।”
— “যদি কখনো তনুভাবীকে কেউ কষ্ট দেয়, আর সেজন্য তনুভাবী আর কাউকে পছন্দ না করে, তখন তুই কী করবি? তোকেও তখন সে পছন্দ করবে না।”
নম্র ভাবলো। বলল, “আমি ভাবীকে বোঝাবো আমি কী ওদের মতন? আমি না ভালো? আমি বলব, আমি তোমাকে কষ্ট দিবো না। যে দেয় তাকেও দিতে দিবো না। মেরে দেব একদম।”
ছোট মানুষের ছোট্ট একটা উত্তর। তবুও এই কথাটাই নবীন খুব গভীরভাবে অনুভব করল। জগৎ কত বিচিত্র! মানুষের কত রকমের দুঃখ। নম্র ওর কচি আঙ্গুল গুলো দিয়ে নবীনের চোখের কোণায় থাকা পানিগুলো স্পর্শ করল। ওর ভাইটা কী বোকা! সামান্য কথায় কেঁদে ফেলে।
নম্র কী আর বুঝবে বড় হলে এই যন্ত্রণা দেখার জন্য শুধু রাতের অন্ধকারেরাই অপেক্ষা করে।
.
.
— “মাহবুব ভাই কী আছেন ঘরে?”
সিরাজ সাহেব মাহবুবকে ডেকে দিলেন। সচরাচর তিনি নির্ঝঞ্ঝাট থাকতেই পছন্দ করেন। নিজের ছোট্ট শোবার ঘরটাই তার প্রিয়। বই হাতে বসে থাকেন আর তনুকে ডেকে চায়ের আবদার করে বসেন। তনু অবশ্য তার বাধ্য মেয়ে। কখনো কখনো নিজেই এসে জিজ্ঞেস করে, “চা দেই বাবা?”
সিরাজ সাহেব চোখের চশমা উঁচু করে বললেন,
— “তোমাকে তো চিনলাম না বাবা।”
— “আমি আপনাদের নিচের ফ্ল্যাটে থাকি, আঙ্কেল। মাহবুব ভাই একটা কাজ দিয়েছিলো, সেটার আপডেট নিয়ে এলাম।”
সিরাজ সাহেব ভেতরে ডেকে পুষ্পকে চা বসাতে বললেন। তার এই এক স্বভাব, যেই আসুক, এক গ্লাস পানি হলেও দিতে হবে। ঘরে কি আছে কি নেই, বিষয় না। রান্নাঘর থেকে ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কান্না চেপে রেখেও পারছে না। নবীন প্রশ্ন করলো না। অনধিকারচর্চা খুব একটা ভালো বিষয় না।
সিরাজ সাহেব রয়ে সয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী রকম হালচাল তোমার? বিয়ে শাদী করেছো?”
নবীন অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
— “না আঙ্কেল। এই বয়সে এখনকার দিনে বিয়ের চিন্তা কী করব, চাকরি পেতেই হাভাতে অবস্থা।”
— “সেটা ঠিক বলেছো। এখনকার বাবামাদের বুঝি না। আমার বয়স যখন বিশ হলো, আমার বাপ নামাজ থেকে আসার পর বললো, চল একটা কাজ আছে। কাজের কথা বলে যে বিয়ে করিয়ে দিবেন স্বপ্নেও ভাবিনি।”
সিরাজ সাহেব হাসতে লাগলেন। নবীনও হাসলো তাল মিলিয়ে।
— “এরপর দেখি বউ একদম ছোট্ট একটা মেয়ে। এইট নাইনে পড়ে নাকি। আমার পাশে বসতে বসতে বলছিল, সাজুগুজু বেশি করি তো তাই আম্মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আমি আপনার প্লেট থেকে মাংসটা নেই? সকাল থেকে কেউ খাওয়ার খোঁজ নিচ্ছে না, জানেন? মুরগির রান ছাড়া আমি একদম খেতে পারি না।”
নবীন শব্দ করে হেসে ফেলল। সিরাজ সাহেব শেষ করলেন না।
— “আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়ে যেদিন মুরগির রান আমার জন্য ত্যাগ করতে পারবে, তখনই বুঝতে হবে সে আসলেই আমাকে ভালোবাসে। এখন তো সেই রান আমার প্লেট থেকে ছেলেদের, ছেলেদের থেকে মেয়েদের, বউদের প্লেটে পর্যন্ত যায়। এই ছিলো আমাদের জীবন।”
— “সুন্দর জীবন ছিল আপনাদের!”
সিরাজ সাহেব কিছু না বলে হাসলেন। অন্যমনষ্ক হয়ে বললেন,
— “আমি আমার ছেলেমেয়েদেরও তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছি, বুঝলে? মেয়েটা রাজি হচ্ছে না। শুভও একটু বেয়াড়া ধরনের ছেলে। আমাদের মতো নিঃশব্দে ঘর সংসার করতে পারলেই হয়।”
নবীন কিছু বলল না। মাহবুব এসে গেল ততক্ষণে। নবীন সব বিস্তারিত বলল। চা এসে গেছে। সম্ভবত পুষ্পর বানানো। নবীনের খেতে অস্বস্তি হচ্ছে। চা তো চা-ই। কার হাতে বানানো সেটা ভাবার কী দরকার!
চা বানানেওয়ালার কথা ভেবে চুমুক দিতেই মনে হলো,
— “মেয়েটার চা-টাও ভালো। মাকে কী একবার বলে দেখব?”
.
.
রাবেয়া বিয়ের ব্যাপারে তেমন দ্বিমত দেখালেন না। পুষ্পর অস্বাভাবিক দৃষ্টি তাকে দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে। আজকাল মেয়েরা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। কারো কথা শোনার মতো দু রত্তি ধৈর্য্য নেই এদের। রাবেয়া মুখে রেখে রেখে অনেক কথাই শোনালেন মেয়েকে। পুষ্প বইগুলো ফেলে দিয়ে রাগ করে বলল,
— “বিয়ে দিবা তোমরা। দুই একদিনের মধ্যে যদি না দিচ্ছো, আমি নিজে গিয়ে বসবো বিয়ে।”
রাবেয়া অবাক হয়ে অকথ্য ভাষায় বকা দিতে লাগলেন। তনু এসে দুপক্ষের অবস্থা দেখে রাবেয়াকে ঘরে রেখে এলো। পুষ্প কথা বলার আগেই কেঁদে ফেলল। ওর কান্না দেখে তনুরও চোখ ছলছল করে উঠলো।
ওকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
— “তোর ভাইয়ার সঙ্গে আমি কথা বলছি তো। তোর ভাই কী তোকে খারাপ মানুষের হাতে তুলে দেবে বল? এত ভয় পাস কেন? আমরা সবাই আছি না?”
পুষ্প হিচকি দিয়ে কাঁদছে। শুভ নিজের ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছে। ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে ওর এ নিয়ে। ইচ্ছে করছে পৃথিবী বিগড়ে দিয়ে হলেও পুষ্পর কান্না থামাতে।
রাতে মাহবুবের সঙ্গে একদফা ঝগড়া হলো তনুর। তনু বালিশ নিয়ে পুষ্পর ঘরে শুয়ে পড়ল। কড়া গলায় বলল,
— “পেয়েছেন টা কী বলুন তো? এতটুকু মেয়েকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিতে চান কেন?”
— “তনু, তুমি বুঝতে পারছো না কেন? ওর অবস্থা দেখেছো? মনে হচ্ছে ওকে ছেলেদের জান কবজের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওর অস্বাভাবিক মনোভাব পরিবর্তন করা দরকার।”
মাহবুব তনুকে কখনো তনু বলে ডাকে না। ওর পুরো নামের ‘মৃত্তিকা তন্ময়ী’ প্রথমটুকু বলে, মৃত্তি। মাহবুব সত্যিই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তনু নরম কন্ঠে বলল, “আমি পুষ্পর সাথে থাকি আজ?”
.
.
নবীন ঘরে পায়চারি করতে লাগলো। সম্পর্ক কী বললেই হয়ে যায়? নবীনের কোনো নিশ্চিত চাকরি নেই। এহসান সাহেবের দেয়া কাজটার আশাও শেষ। মা দিনরাত পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছেন। নবীনের রাতে ডিউটি করতে হয় দোকানে। এতকিছুর পরে যদিও মেনে যায়, এরপরের জীবনটা যদি আরো দূর্বিষহ হয়? সিরাজ সাহেব সামান্য ভাড়াটিয়ার ছেলেকে মূল্য দিবেন? অসম্ভব ব্যাপার। নবীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো, “বলি একবার। ক্ষতি তো নেই।”
রাতে খাবারের সময় তিনজনে একসাথে বসল। নবীন খুকখুক করে কেশে অস্বস্তি নিয়ে বলল,
— “আম্মা?”
— “হুঁ।”
— “শুনো না।”
— “তোর কী মনে হয়? আমি বয়রা?”
— “না আম্মা। মনে হচ্ছে আমি এক কানে কম শুনতেছি।”
— “তো ডাক্তার দেখা।”
— “মেয়ে ডাক্তার লাগতো আম্মা।”
— “কী বলবি সরাসরি বল।”
নবীন একটু নড়েচড়ে বসলো।
— “আসলে আম্মা বলতে চাইতেছি, তুমি তো এখন ক্লান্ত না? এতদিন আমাদের টেনে টেনে এতদূর নিয়ে আসলা। একটু বিশ্রাম তো দরকার।”
— “তো?”
— “একটা মেয়ে আসলে ভালো হয় না? যেমন ধরো তোমার ডটার (daughter), আমার ইন ল (in law)?”
আফরোজা হেসে বললেন,
— “আমি এত ইংরেজি বুঝি না।”
নবীন ভ্রু কুঁচকে নম্রকে বলল,
— “এই নম্র, তোর ভাবী লাগবে না?”
নম্র মাথা নাড়িয়ে বলল, “লাগবে।”
— “পুষ্প ভাবী হইলে কেমন হবে বলতো?”
— “বহত আচ্ছা।”
নবীন ওর মাথায় চাটি মেরে বলল, “বাংলা বল।”
নম্র বললো না।
আফরোজা কিছু বললেন না। স্রেফ হাসি মুছে গেল। খাওয়া শেষ করতে বলে উঠে গেলেন। নবীন অন্যমনষ্ক হয়ে গেল। স্বাভাবিক বাঙালি ঘরের চিত্র। জানা কথা তবুও মন কেমন কেমন করে!
চলবে ~