#এক_কাপ_চায়ে : ১২
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। বৃষ্টির জোরাজুরিতে মাস্টার্সের পরীক্ষা দেয়ার জন্য বসেছে শুভ। তার বউয়ের মতে, কিছু অর্ধেক করে ফেলে রাখা ভালো না। সে গর্ব করে বলতে পারবে, আমার বর মাস্টার্স পাশ। সেজন্য নাকি পড়তে হবে।
ডিপার্টমেন্টের স্যার বন্ধুসুলভ, যদিও তিনি সবসময় মুখ গম্ভীর করে রাখেন। শুভকে দেখেই বলে উঠলেন,
— “আজকাল নাকি মুড়ি বেচাকেনা করছো?”
— “জ্বি, স্যার। বউয়ের দোয়ায় মুড়িঘর।”
— “ফাইজলামি করছো?”
— “তওবা স্যার, অত সাহস আছে আমার?”
— “গ্রাজুয়েট মামা — নাম কেন? মামা হয়েছো?”
— “না স্যার, বিয়ে করব জানলে গ্রাজুয়েট স্বামী দিতাম।”
— “বউ-বাচ্চা ফেলে পরীক্ষায় আসার দরকার কী ছিল?”
শুভ খাতায় প্রশ্ন তুলছে। কৃত্রিম ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
— “বাচ্চা তো হয়নি স্যার। চুল পেকে যাচ্ছে। পাকা চুল তোলার জন্য বাচ্চাকাচ্চা দরকার। দোয়া করবেন।”
— “চুপ, বেয়াদব ছেলে।”
শুভ চুপ করলো না। পেছন ফিরে আরিফকে ডেকে বলল,
— “মামা, একটু দেখা।”
— “পরীক্ষায় অন্যের দেখা হারাম!”
— “সংসার বাঁচানো সওয়াবের কাজ দোস্ত। একটু দেখা। বউয়ের কাছে মানসম্মান আছে না?”
কালাম স্যার ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন।
— “সংসারের চাপে কী পড়াশোনা হচ্ছে না?”
শুভ বুকে থুতু দিয়ে মুখ ফিরালো সামনে। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,
— “স্যার, দোকান বড় করে রেস্তোরাঁ বানাচ্ছি। ম্যাডামকে নিয়ে আসবেন, আপনার জন্য ফ্রি।”
— “ফ্রি দিলেই তোমাকে দেখে দেখে লিখতে দেব?”
— “দিতে পারেন। আপনার মর্জি। আমি স্যার বিবাহিত পুরুষ। বিবাহিত পুরুষদের বদদোয়া লেগে যায়। কারণ তারা নিরীহ প্রকৃতির মানুষ।”
কালাম স্যার অবাক হয়ে বললেন,
— “তুমি নিরীহ!”
শুভ হাসলো। সরল গলায় বলল,
— “তা তো বলিনি। ছেলেদের বিবাহিত অবিবাহিত হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। মনে মনে আমি এখনও সিঙ্গেল।”
— “তুমি ক্লাস থেকে বের হও। এখনি।”
শুভ বেরিয়ে গেলো। বৃষ্টি মেসেজ করেছে, “পরীক্ষা কেমন দিয়েছেন?”
শুভ ভয়েস মেসেজে বলল, “অতি চমৎকার!”
যেতে যেতে বলে গেল, “স্যার, অফার কিন্তু ক্যানসেল করিনি। অবশ্যই আসবেন। আমার বউ খুশি হবে।”
.
.
তনু চিন্তিত গলায় বলল, “আপনি শুধু শুধু ঝামেলা বাড়াচ্ছেন কেন? চিকিৎসা নাই করলেন, শুধু শুধু কেস ফেসে ঢুকার কী দরকার!”
মাহবুব চোখ তুলে তাকালো। মইনুল কেস সামলাচ্ছে, ওর হাইস্কুলের বন্ধু। আজ বিকেলে এহসান সাহেবের ঘর তল্লাশি করা হবে৷ মাহবুবও যাবে সাথে।
— “মৃত্তি, একটা মেয়ে কতটা মানসিক চাপ নিয়ে মারা গেছে বুঝতে পারছো? ওর ভাই না জেনেশুনে ওর জীবনটা নরক করে দিয়েছে। বেচারি সুইসাইডের তকমা গায়ে লাগিয়ে মারা গেছেন। এই লোকটা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ডাক্তার ডাকছে। কিছু একটা তো আছে এখানে! আমি জানতে চাই। আমার মনে হচ্ছে না, এটা সুইসাইড। ওদের মেয়েটাও নিশ্চয় সুইসাইড করেনি, ও কীভাবে মারা গেছে? অপরাধী হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবে আর তার পাপের বলি অন্যরা হবে, এতসব জেনে আমার ঘুম হয় না।”
তনুর বুক কেঁপে উঠলো। তবুও কিছু বললো না। মাহবুব চলে গেল। তনু নিজেকে প্রবোধ দিতে লাগলো। ডায়েরীর পাতা খুলে খসখস শব্দ তুলে লিখলো, “কেস নম্বর – ৩১”।
.
.
মইনুল এসেই সরাসরি মুক্তার রিডিং রুমটি খুলতে বলল। ঘরটার দরজায় ‘নো এন্ট্রি’ সিল মারা। দরজা ভেঙে ফেলল। ধুলোয় কাশি উঠে গেলো সবার। মাকড়সার জাল বাসা বেঁধেছে।
এহসান সাহেব বেশিরভাগে ঘুমের ঘোরে থাকেন। তাকে বেঁধে ফেলা হলো চেয়ারে বসিয়ে। ঘরে একটি ভাঙা চেয়ার পাওয়া গেল বটে। মাহবুব বেশ ভালো করে খেয়াল করে বুঝলো, এটা ভেঙে যায়নি। কেটে ফেলা হয়েছে। পুলিশ দুজন বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো।
মাহবুব মইনুলকে ডেকে দেখালো।
— “দেখ মইন, এখানে ধুলোবালি নেই। মনে হচ্ছে বই জাতীয় কিছু উঠানো হয়েছে কয়েকদিন আগেই।”
মইনুল দেখলো। হঠাৎ থাইগ্লাসে চোখ পড়লো ওর। আবছা ধুলোর উপর লেখা, “Qu”। পুরো শব্দ লেখা নেই। টেবিলের এক পায়ায় শুকিয়ে যাওয়া রক্ত পাওয়া গেল। বহুদিন আগে বিধায় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেলে রক্ত পাওয়ার কথা নয়। এহসান সাহেবের মুখ থেকে কথা বের করা গেলো না। তিনি কিছুই স্বীকার করছেন না।
আশ্চর্যজনক ভাবে তার ঘরে থাকা মুক্তার ছবিটাও গায়েব। আত্মীয়দের কাছেও ছবি নেই। মা-মেয়ে মৃত্যুর সাথে সাথে নিজের চিহ্নসহ নিশ্চয় কবরে যায়নি। নূরজাহান কাজ ছেড়ে দিয়েছে। বাগানের মালি বাবুল কথা বলতে পারে না। মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নবীনটা যদি সেদিনই পুলিশকে ডেকে দিতো!
.
.
পুষ্প গ্রামে এসেছে দুদিন হচ্ছে। আফরোজা ছুটি নিয়ে এসেছেন। পুষ্প বায়না করে বলল ওর পরিচয় গোপন রাখতে। আফরোজা অবাক হলো। পুষ্প তাকে নানান কথা বলে মানালো। সুতরাং সে এখন দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া।
নিরু চঞ্চল হরিণীর মতো এসে বলল,
— “আসো, বিকেলে খই ফোটাবো।”
নিরু সবজান্তা মেয়ে। পুরো গ্রামের আনাচকানাচে কি হচ্ছে সব ওর নখদর্পনে। পুষ্প মাথা নাড়ালো সম্মতির। জিজ্ঞেস করলো,
— “মাঠের ওদিকে, তোমাদের কোনো মামী থাকেন?”
নিরু মাথা দুলিয়ে বলল,
— “হুম। মহিলা জঘন্য, বুঝলে? আমার বরের কড়া নিষেধাজ্ঞা, ওর কাছে যাওয়া যাবে না।”
— “কেন কেন?”
— “আছে কিছু কাহিনী, কেন বলোতো?”
— “আমার খুব দরকার, আমি উনার ঘরে একরাত থাকতে চাই। তুমি সাহায্য করবে?”
নিরু চোখ পাকিয়ে তাকালো।
— “উনার বাজে কথা শুনতে চাও?”
— “কী বাজে কথা?”
— “থাকলেই বুঝতে। কী দরকার বলো।”
— “কসম করো, কাউকে বলবে না।”
— “আচ্ছা কসম।”
— “ওয়াদা?”
— “হুঁ, ওয়াদা।”
পুষ্প যথাসম্ভব সংক্ষেপে বর্ণনা করলো। নিরু চালতা চিবুতে চিবুতে বড়দের মতো ভাব নিয়ে বলল,
— “দাঁড়াও, ব্যবস্হা করছি। কিন্তু তুমি কী করবে, পিচ্চি মেয়ে?
— “যা পারি করব, তুমি শুধু বলবে আমি তোমার বান্ধবী।”
নিরু বাঁকা চোখে তাকালো। পরক্ষণেই হেসে বলল,
— “আমিও থাকবো তোর সঙ্গে। দেখব কী করিস।”
— “অমনি তুমি থেকে তুই?”
— “বান্ধবীকে তুই বলব না?”
পুষ্প নিজের হাতের ফোনটা বন্ধ করে ফেলে রাখলো একপাশে। সে এখন লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করা এক উন্মাদ প্রেমিকা। প্রেমিকের সঙ্গে রাতভর কথা বলতেই সে অন্যকারো বাড়িতে রাত্রিযাপন করবে। আচ্ছা, নিজেকে নিচ শ্রেণির মানুষ প্রমাণ করতে আর কি কি করা যায়?
.
.
শুভর রেস্তোরাঁ বানানোর চিন্তা এসেছে বৃষ্টির কথায়। সেদিন কথা হচ্ছিল তার দূর্ভাগ্য নিয়ে। বৃষ্টি অনুপ্রেরণাদাতার মতো করে বলছিলো,
— “দেখো, অন্ধকারে কিন্তু আমরা কেউই দেখতে পাই না। আমরা তখন বুঝতে পারি না, আমি কী অন্ধ নাকি দেখতে পাই? অন্ধকারে দেখতে না পেলে এর মানে এটা নয় যে আমাদের দৃষ্টিশক্তি নেই। ব্যাস, মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের লিমিট। এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমাদের চলতে হবে।
তোমার কষ্ট টা আমি বুঝি, এত বছরের পরিশ্রমে অর্জিত শিক্ষার মূল্য হিসেবে তুমি চাও কোনো সম্মানজনক পেশা। কিন্তু দেখো, তুমি তোমার পেশাটাকে ছোট করে দেখছো। অথচ, আমাদের শিক্ষা এটা হওয়া উচিত ছিলো যে আমরা সব পেশাকে সম্মানের চোখে দেখব। সেখানে খোদ তুমিই দেখতে পারছো না।
তোমার দোকানটা, কিন্তু চলছে তো তাই না? তুমি তোমার শিক্ষা এখানে কাজে লাগাও। নবীন ভাই ম্যানেজমেন্ট এর স্টুডেন্ট, তার থেকে ব্যবসার হালচাল বুঝে নাও। এই ছোট্ট দোকান টা হয়ত একদিন বড় রেস্টুরেন্টে পরিণত হবে, হতে পারে এটার কয়েকটি শাখা বের হবে। স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী? স্বপ্ন দেখার রাস্তা একদিকে বন্ধ তো অন্যগুলো তো ফাঁকা। পরিশ্রম করো, সফল না হলে ভাবো তোমার জন্য আরো কল্যাণজনক কিছু অপেক্ষা করছে। সৃষ্টিকর্তার তো তোমার সঙ্গে শত্রুতা নেই তাই না? নাকি আছে?”
বৃষ্টির শেষের কথাটায় হেসে ফেলেছিলো সে। মাথা চুলকে বলছিলো,
— “ইউ আর জাস্ট লাইক অ্যা…..”
— “অ্যা?”
— “অ্যা না, মাই ওয়াইফ অর সামথিং মোর!”
শুভর কল্পনা বেশিদূর আগালো না। শুভর মা রাবেয়া ওর কাঁধে হাত রাখলেন। ভীষণ অবাক হয়ে বললেন,
— “তুই ঠিক আছিস?”
— “আছি তো।”
— “প্রায় দেখি একা কথা বলিস।”
— “কোথায়?”
— “হ্যাঁ, মাঝেমাঝে বৃষ্টি বলে ডাক দিস। বৃষ্টি কে?”
— “বৃষ্টি কে মানে?”
শুভ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মা কী মজা করছে ওর সঙ্গে? রাবেয়া বিভ্রান্ত গলায় বললেন,
— “আমি তো বৃষ্টি নামের কাউকে চিনি না।”
— “মা, তুমি কীভাবে মজা করছো এমন করে?”
শুভ মায়ের হাত সরিয়ে নিলো কাঁধ থেকে। রাবেয়া ছেলের অদ্ভুত ব্যবহারে অবাক হয়ে রইলেন। বৃষ্টি মেয়েটা কে?
চলবে ~