#এক_কাপ_চায়ে : ১৪
লেখনীতে : নাহিদা সানজিদ
আজকের সকাল বেশ পরিচ্ছন্ন লাগলো পুষ্পর। নবীনকে অনেক অনুরোধ করে গ্রামে ফিরাচ্ছে। গ্রামে আসার পক্ষে ও কোনোদিনই ছিলো না। পুষ্প একপ্রকার জোর করেই এসেছে। আফরোজা পিঠা বানাচ্ছেন।
পুষ্পর ফিতা পেঁচিয়ে বেণী করে বলল,
— “মা, আজকে পুরো গ্রামবাসীকে তুমি জানাতে পারো, আমি তোমার পুত্রবধূ।”
আফরোজার মন ভালো নেই। বিষন্ন স্বরে বললেন,
— “এখানে নবীনের আসা ঠিক হচ্ছে না। ওকে দেখলেই ফিসফাস শুরু হয়ে যাবে সবার। তুই ওদের কথায় কান দিস না। গ্রামে এমন অনেক কথাই হয়।”
— “কেন ফিসফাস হবে? আমি দেখব কে কী বলে।”
— “আরে মাতবর! তুই একটুখানি মেয়ে কী করবি?”
— “অনেককিছু।”
ওদের গ্রামটার নাম মুসাপুর। গ্রামের রাস্তাগুলো পাকা হয়েছে। টিনের চাল বদলে জায়গা করে নিয়েছে কংক্রিটের ছাদ। শান্তির নিঃশ্বাস বলে এখন আর কিছু নেই। নবীনের ব্রংকাইটিসের সমস্যাটা বেড়েছে। সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া বুকে লাগায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। মাঠটার সামনে মোড় নিতেই থুতু ফেললো সে। চোখ উঠাতেই বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। সীমা মামী!
নবীন চোখ নামিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে এলো ঘরে। পুষ্প অনুগত বধূর মতো হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিলো। শরবত এনে দিলো। এর বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মারমুখো হয়ে এলো এক লোক। লম্বা, বয়স্ক, নবীনের তুলনায় স্বাস্থ্যবান। কলার চেপে ধরলো ওর। নবীন আচমকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধুপধাপ ঘুষি বসালো ওর নাকে। গলগল করে গড়িয়ে পড়লো রক্ত। পুষ্প হতবাক হয়ে আফরোজাকে ডাক দিলো।
.
.
সন্ধ্যা নামছে। হারিকেনের পরিবর্তে জ্বলে উঠলো বৈদ্যুতিক বাল্ব। পুষ্প শান্ত গলায় বলল,
— “মা, এখানকার মেম্বার কে? দেখি ডাকুন।”
আফরোজা চুপ করে রইলো। মেম্বার তার আপন ভাই। কথা জানাজানি হলে শুধুশুধুই তার বদনাম হবে, এই ভয়ে তিনি ঘরে ঘরে সামলে নিতে বললেন। পুষ্প হাতের কাছের ফুলদানি ছুঁড়ে মারলো দূরে।
— “কী বদনাম হবে, আমি দেখি। আপনি ডাকবেন, নয়ত..”
— “নয়ত?”
নবীনের প্রশ্ন।
পুষ্প নির্ভয়ে বলে উঠলো, “চট্টগ্রামে ফিরে আমাকে ভুলে যাবেন। আমি নিজেই এই অবস্থায়, এই রাতে তাকে স্বকন্ঠে ডেকে সবকিছুর জবাবদিহিতা চাইবো।”
— “কী বলবে তুমি? কী প্রমাণ আছে আমি সত্যি, সে মিথ্যা?”
— “সে সত্যি, তার প্রমাণ কী?”
পুষ্পকে মানানো গেলো না। সে ঘাড় বেঁকিয়ে বলতে লাগলো, “ওই মহিলাকে আমি দেখছি, সে কত নিচে নামবে? আমি আরও নিচে নামবো।”
নবীন ওর হাত ধরে বলল, “কুকুর কামড় দিলে, কুকুরকে কামড় দিতে হয় না।”
পুষ্প ওর হাত ছাড়িয়ে নিলো।
— “আপনি কী প্রমাণ করতে চান? ক্ষমাশীল, মহা দয়াবান? তাহলে আমিও বলছি, সে কুকুর না। সে একটা মানুষ। আপনিও মানুষ। আপনার কী জীবন নেই? আমার তো মনে হচ্ছে আপনি নিজেকে কুকুর ভাবছেন, যার সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই।”
আফরোজা থামতে বললেন ওকে। পুষ্প দুহাতে মুখ ঢেকে বলল,
— “আপনার ছেলেকে বোঝান, মা। ছেলেদের এভাবে অসহায়ের মতো বিহেভ মানায় না। সে আমাকে কীভাবে সেভ করবে, নিজেকেই সেভ করতে পারছে না!”
.
.
তর্কের এক পর্যায়ে মেনে গেলো। সীমা আলতো পায়ে মাথা নিচু করে একপাশে দাঁড়ালো। উঠোনে জড়ো হয়েছে আশেপাশের অনেক মানুষ। সেদিন নবীনকে মারার কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হলো : নবীন সীমাকে দেখে ঘৃণার সহিত থুতু নিক্ষেপ করেছে।
পুষ্প বিড়বিড় করে বলল, “শয়তান ওকে একাই সার্ভিস দিচ্ছে।” শুভর কথা মনে পড়তে লাগলো ওর। শুভ ঠিক এমন করেই কথা বলে। পুষ্প সামনে না এসে দরজার ওপাশ থেকেই বলল,
— “একচুয়েলি, ও ঠিক কাজটাই করেছে। আপনি যেমন, তাতে ও কেন, কাল থেকে যে দেখবে সেই থুতু ফেলবে।”
সীমার বর আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। পুষ্প নবীনের হাতে রেকর্ডার টা দিলো।
— “একটু চালিয়ে শোনাবেন সবাইকে? আপনার মামীর গলায় গান শুনব।”
নবীন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অন করলো। বেজে উঠলো সেদিন রাত্রির কথাগুলো। সীমা অবাক হয়ে তাকালো। নিরুকেও সাক্ষী হিসেবে ডাকা হলো। সে সংকোচ নিয়ে সম্মত হলো। সীমা অস্বীকার করলো। পুষ্প মৃদু চিৎকার করে বলল,
— “একটু ঘরে আসবেন, ভা..বী?”
শেষের সম্বোধনে একটু তিরস্কারের সুর পাওয়া গেলো। পুষ্প এন্ড্রয়েড ফোনের স্ক্রিনটা ওর চোখের সামনে ধরে বলল,
— “সরি, এখন তো আবার মামী না? বলছি, আপনার শালীন পবিত্র চ্যাটিং অলরেডি সবাই দেখে ফেলেছে। আমার মূল্যবোধ আছে, তাই আপনার ছবিটা কাউকে দেখাইনি, বুঝলেন? নাকি দেখাবো?”
সীমা পুষ্পকে দেখে অবিশ্বাসের সুরে বলল,
— “তুমি!”
— “ইয়েস।”
— “তুমি নিজেও কেমন ভালো, আমি জানি না?”
— “কেন কেন? আমি তো শুধু আমার বরকে বলেছি। আপনার মতো তো স্যার পরিচয়ে পরকীয়া করছি না।”
বেশ খানিকক্ষণ কাটলো তাদের বাকবিতন্ডায়। সীমা নতিস্বীকারে বাধ্য হলো। ভরা মজলিসে তার তালাক হলো। পুষ্প সীমার বরকে বলতে চাইলো, “আমার স্বামীকে যে মারলেন, আমি চাই ও এখন প্রতিশোধ নিক।”
নবীন ওকে আটকে রেখে বোঝালো, পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা ভালো না। পুষ্প চোখ গরম করে বলল,
— “আমাকে পর্দা শিখাচ্ছেন? আরো যান, পেয়ারের মহিলাদের ডাকে সাড়া দিতে। আমাকে ছাড়ুন।”
নবীন ছাড়লো না।
— “তুমি ওরকম বাজে কথা কীভাবে বলছিলে?”
— “বাজে কথা বলাতেই তো আমাকে নিজের ভেবে সব বলে দিয়েছে।”
— “তুমি হাঁটুর বয়সী মেয়ে, আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না তুমি এসব বলতে পারো।”
পুষ্প শাহাদাত আঙ্গুল উঁচু করে বলল, “আমার বয়স এখন আঠারো। নট হাঁটুর বয়সী। নিচুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হলে নিচে তো নামতেই হবে। নাকি আপনার মার খেতেই ভাল্লাগে?”
.
.
— “পুষ্প তুমি প্রথম থেকেই এটা প্ল্যান করেছিলে তাই না?”
— “কী?”
— “এই, এসব করার।”
— “সত্যি বলতে আমি চাইনি কেউ দীর্ঘমেয়াদী এই অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকুক।”
— “এজন্য বিয়ে করে নিলে?”
— “বিয়ে তো করতেই হতো। একে নয়ত ওকে।”
— “আমি তোমার কাছে এ,ও?”
পুষ্প বিরক্ত হয়ে বলল, “ধূর, এসব নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না।”
— “তুমি স্রেফ আমাকে দয়া দেখিয়েছো না? তুমি আমার চেয়ে বুদ্ধিমান, সাহস আছে তোমার, এসব প্রমাণ করতে চেয়েছো?”
নবীনের কন্ঠ অন্যরকম শোনালো। পুষ্প কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকালো।
— “আমার পরিবার আপনার কাছে বিয়ে কেন দিয়েছে? কারণ আমি ছেলেমানুষ সহ্য করতে পারি না। আমি কখনও স্বপ্ন দেখি না বিয়ে নিয়ে। আপনার কমতি ছিলো, আপনার ভালো কোনো চাকরি নেই। আসলে আমরা আমাদের অবস্থানকে বিয়ে করেছি। নিজেদের না। প্রেম-ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার বিরক্ত লাগছে। আপনি যান।”
নবীন শক্ত হয়ে বসে রইলো। বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। মাহবুব ফোন করে ওদের ফিরে আসার তাগাদা দিলো। নবীন ভাঙা গলায় বলে উঠলো, “শুভ ভাইয়া অসুস্থ। আমাদের ফিরতে হবে কাল।”
নম্র চুপিচুপি ঘরে ঢুকছিলো। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অবুঝ গলায় বলল, “ভাইয়া, তোমার চোখটা লাল লাল দেখাচ্ছে কেন?”
চলবে ~