শেষ বিকেলের রোদ- ২১ তম পর্ব
©শাহরিয়ার
— আপুর বান্ধবির বাসার সামনে আসতেই আপু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো তুমি কি যাবে আমাদের সাথে?
সোহান:- না তোরা যা, আমি এদিক দিয়েই ঘুরিফিরি তোরা বের হলে এক সাথে বাসায় যাবো।
আফরিন:- কোথায় ঘুরবে তুমি? শেষে গ্রামের লোকজন নানান রকম কথা বলবে।
সোহান:- নানান কথা বলবে কেন? আমি কি চোর নাকি যে মানুষ উল্টা পাল্টা কথা বলবে?
আফরিন:- মানুষতো আর তোমাকে চিনে জানে না। তাই ভাবতেও পারে এসব।
— দু’জনের কথা শুনে হো হো করে হেসে দিলাম। সোহান রাগী রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো একটা চড় মেরে তোর সবকটা দাত ফেলে দিবো। এমন কথা শুনে আমার হাসির শব্দ আরও বেড়ে গেলো।
আফরিন:- থামতো তুই, ভাইয়া তুমি আমাদের সাথে চলো।
— আর কোন কথা না বলে তিনজন বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম। বাড়িতে ঢুকতেই আপুর বান্ধবী ছুটে এলো, সকলকে বসার জন্য চেয়ার এনে দিলো বসার জন্য। সকল মিলে গল্প করছি এমন সময় আন্টি চা নাস্তা নিয়ে এলেন। নাস্তা শেষ করে বের হয়ে আসার সময় আপু বার বার করে বলে আসলেন আগামিকাল সকালেই ঐ বাড়িতে যেয়ে নাস্তা করতে এবং সারা দিন ঐ বাড়িতেই থাকতে হবে। এসব বলে আমরা সে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।
সোহান:- এখন কি বাড়িতে যাবি তোরা?
আফরিন:- নয়তো কোথায় যাবো?
সোহান:- না মানে বাড়ি ভর্তি মেহমান আমার কেমন জানি লাগে?
— কেমন লাগে তোমার আমিতো দেখি বেশ ভালোই আপুর ঐ মোটা ফ্রেমের চশমা পরা কাজিনের সাথে চোখাচোখি করো।
সোহান:- রেগে তোর মাথা করি, পৃথিবীর সব মেয়েই আমার প্রমিকা আর আমি একাই তাদের প্রমিক হয়েছে এখন তো খুশি তুই?
— আমার খুশিতে বা কষ্টে তোমার কিছু আসে যায় কি?
সোহান:- না আমার কিছু আসে যায় না তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তোর মোটা মাথাটা ফাঁটিয়ে দেই।
— ঢং দেখলে আর বাঁচি না।
আফরিন:- উফ তোমরা আবার শুরু করলে? আল্লাহ জানে তোমাদের বিয়ে হলে তারপর কি করবে।
সোহান:- এই ফুলটুসি মাথা মোটা মেয়েকে আমি বিয়ে করবো তুই ভাবলি কি করে?
— আমিই তোমাকে বিয়ে করবো না। দেশে কি ছেলের অভাব পরছে যে তোমাকেই আমার বিয়ে করতে হবে।
সোহান:- সে দেখা যাবে আমার চেয়ে ভালো কাউকে পাস কিনা। আর তোকেই বা কে বিয়ে করতে আসে তাও আমি দেখে নিবো।
— হ্যাঁ দেখে নিও তোমার চেয়ে ভালো ছেলেই আসবে। ঝগড়া করতে করতে তিনজন বাড়ির ভিতরে ঢুকে পরলাম। সোহান ওর রুমের দিকে আমি আর আপু আমাদের রুমের দিকে এগিয়ে আসলাম।
আফরিন:- পারিস ও তোরা দু’জন।
— আরে আপু এটাই আমাদের ভালোবাসা।
আফরিন:- আচ্ছা তুই রেস্ট নে আমি গোসলটা সেরে ফেলি। তারপর তুই গোসল করিস বলতে বলতে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো।
— বাবা মায়ের সাথে কথা হয়না ভাবতে ভাবতে ফোনটা হাতে নিতেই আবারো দেখতে পেলাম আরমানের মিসকল। এতো ভালো সময় পার করছিলাম যে ফোনের দিকে নজর দেবার মত সময় পাইনি। আরমানকে ফোন ব্যাক করলাম।
আরমান:- ফোন রিসিভ করে কি ব্যাপার খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে?
— জ্বি কিছুটা ব্যস্ত, আসলে বিয়ে বাড়ি অনেক মেহমান কত রকম কাজকর্ম তাই ফোনটা কাছে রাখা হয়না। তারপর বলুন এতো বার ফোন দিয়েছেন আপনি ঠিক আছেনতো?
আরমান:- জ্বি আমি ঠিক আছি, আসলে আপনাদের ওখান থেকে বাসায় ফিরে কল দিলাম বলার জন্য যে বাড়িতে ফিরে এসেছি। ধরলেন না তাই আবারও সকালে ফোন দিয়েছিলাম।
— সরি আসলে ফোনের কাছে ছিলাম না, রাতে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম মাত্রই হাতে নিলাম বাবা মাকে কল দেবার জন্য। আপনার কল দেখে আগে আপনাকেই ফোন করলাম।
আরমান:- ধন্যবাদ ম্যাডাম আমাকে এতোটা প্রায়োরিটি দেবার জন্য।
— আরে কি যে বলেন না। তো কি করছেন?
আরমান:- তেমন কিছু না, আসলে বাংলাদেশে আপাতত খাওয়া আর ঘুরা ছাড়া আমার তেমন কাজ নেই। আপনি কি করছেন আর বাড়ির সবার কি অবস্থা?
— এইতো আপুর এক বান্ধবির বাড়ি থেকে মাত্রই বাসায় ফিরলাম, এখন ফ্রেস হবো। বাড়ির সকলেই ভালো আছে।
আরমান:- তাহলে কাল গায়ে হলুদে দেখা হচ্ছে কি বলেন?
— হ্যাঁ নিশ্চই, এভাবে আরও কিছু সময় কথা বলে ফোনটা কেটে দিয়ে বাবাকে কল দিলাম। বাবা জানালো আগামি কাল সকালে সকলে রওনা দিবে সন্ধ্যার ভিতরেই চলে আসবে। বাবার সাথে কথা বলে ফোন রাখতে রাখতেই আপু গোসল শেষ করে বের হয়ে এলো।
আফরিন:- যা গোসল করে নে, লাঞ্চ করে আবার শপিং এর জন্য বের হতে হবে। আমি ডাইনিং এর দিকে যাচ্ছি।
— আপু চলে যেতেই আমি ওয়াশ রুমে চলে আসলাম। গোসল শেষে নতুন একটা জামা পরে ডাইনিং এ যেতেই আপু বললো সোহান ভাইয়াকে ডাক দেবার জন্য। আমি রুমের দরজায় নক করে কোন রকম সারা শব্দ না পেয়ে রুমে ডুকে দেখি সোহান ঘুমিয়ে আছে, মাথায় একটু শয়তানি বুদ্ধি আসলো যদিও সব সময়ই এমন হয়। আবার গতবারের কথা চিন্তা করে কিছুটা ভয়ও লাগলো। ভাবতে ভাবতে ভেজা চুল গুলো সোহানের মুখের উপর নিয়ে ধরলাম। কয়েক সেকেন্ডের ভিতর সোহান লাফিয়ে উঠে বসলো। ওর অবস্থা দেখে আমি হো হো করে হাসতে শুরু করলাম।
সোহান:- এসব কি ধরণের ফাজলামো ফুলটুসি? আমি কতটা ভয় পেয়েছি তুই জানিস?
— হাসতে হাসতে এতো বড় ছেলে আবার ভয়ও পাও নাকি? তোমার আমার বিয়ে হলে প্রতিদিন তোমাকে এভাবে জাগাবো তখন ও কি এভাবে লাফিয়ে উঠবে নাকি?
সোহান:- তোকে বিয়ে করবো কখনোই না, তুই কখনোই বদলাবি না।
— কি আমাকে বিয়ে করবে না? থাকো তুমি তোমার মত আমি যাচ্ছি বলে ঘুরার সাথে সাথেই সোহান হাত ধরে টান দিয়ে খাটের উপর ফেলে দিলো।
সোহান:- এতো রাগ কোথায় থাকেরে তোর?
— যেখানে খুশি সেখানে থাকে তাতে তোমার কি ছাড়ো আমাকে। যাকে বিয়ে করবে তার সাথে এমনটা কইরো। আমাকে ছেড়ে ডাইনিং এ আসো লাঞ্চ করবে।
সোহান:- তোকে খুব সুন্দর লাগছে আজ অপূর্ব মায়াবতী লাগছে। খাবারতো খুব ঝাল হবে তার আগে একটু মিষ্টি মুখ করে নিলে মন্দ হয়না কি বলিস। বলেই একটা হাত দিয়ে চিবুক ধরে উপরের দিকে তুললো।
— দু’চোখ বন্ধ অবস্থায় বুঝতে পারছি সোহানের ঠোঁট আমার ঠোঁটের খুব কাছে চলে এসেছে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম ছেড়ে দাও আমাকে। অনেকটা সময় পার হলেও যখন সোহানের ঠোঁট আমার ঠোঁটকে স্পর্শ করলো না। তখন চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলাম সোহান এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। সে চাহনিতে খারাপ কিছু নেই তবে গভীর মায়া আর ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রচণ্ড রকম লজ্জা লাগছিলো। একটা মানুষের চোখে এতোটা মায়া এতোটা নেশা থাকে আজ সোহানের এমন চাহনি না দেখলে আমি কখনো জানতেই পারতাম না। কোন সে মোহে চেয়ে ওর দিকে জানি না। যতই দেখছি মন ভরে যাচ্ছে, মনে মনে বলছি যখন তুমি সামনে থাকো মন ভরে দেখি, যখন তুমি দূরে থাকো দেখতে তোমায় পায় না চোখ বুকের মাঝে কিসের ব্যথা টনটন করে রোজ। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়, নিঃশ্বাসটা যে বন্ধ হয়ে যায়। এই অনুভুতিটাই কি সত্যি কারের ভালোবাসা নয়? সোহানের ফোনটা বেজে উঠতেই কল্পনার সকল জগৎ ছেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম।
সোহান:- সালাম দিয়ে হ্যালো কে?
— কথপোকথনে বুঝতে পারলাম আরমানের বোন নীলা ফোন দিয়েছে, সব ভালোবাসা মুহুর্তেই উবে গেল, রাগে সমস্ত শরীর লাল হয়ে গেলো যখন সোহানকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখলাম। জিদ্দে একটা ধাক্কা মেরে খাটের উপর থেকে উঠে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। ডাইনিং এ আসতেই আপু সোহানের কথা জানতে চাইলো আমি বললাম ফোনে কথা বলতাছে একটু পরে আসবে। কথা শেষ হতে না হতেই সোহান চলে আসলো। সকলে মিলে খাওয়া শেষ করলাম। রুমে এসে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে রেডি হতে শুরু করলাম।
আফরিন:- কিরে গাল এমন ফুলিয়ে রাখছিস কেন?
— তো কি করবো তোমার ভাই কি সুন্দর হেসে হেসে ঐ নীলার সাথে কথা বলছিলো ফোনে, দেখেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো।
আফরিন:- তো একটা মানুষ ফোন দিলে কি কথাও বলবে না?
— কথা বলতে তো নিষেধ করিনি, তার জন্য আমার সামনে হেসে হেসে কথা বলতে হবে?
আফরিন:- হাসতে হাসতে নে রেগে থাকিস না, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। রাগ করে থাকলে সাজলে পেত্নীর মত লাগবে।
— আপুর কথা শুনে হেসে দিয়ে বললাম কি সব বলো না তুমি।
আফরিন:- প্রেম রোগ কঠিন রোগ এ জন্যই কখনো কাউকে আর ভালোবাসা হয়ে উঠেনি, ভেবেই রেখে ছিলাম যখন বিয়ে করবো তখন বর কেই ভালোবাসবো।
— তুমি খুব ভাগ্যবতী আপু দেখবে আকাশ ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসবে।
আফরিন:- আর ভাইয়া বুঝি তোকে ভালোবাসে না?
— কি জানি বলতে পারি না। কথা বলতে বলতে সেজে নিলাম।
আফরিন:- আজ তোকে একদম পরীর মত লাগছে দেখতে, ভাইয়া তোর দিক থেকে চোখ সরাতেই পারবে না দেখিস।
— হয়েছে তোমার ভাইয়ের দেখার জন্য কত মেয়ে আছে। অল্প সময়ের ভিতর ফুপা এসে ডাক দিতেই আমরা দু’জন রুম থেকে বের হয়ে এলাম। ফুপা বললো গেটের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাড়াতাড়ি যেয়ে গাড়িতে বসতে সকলে গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আপু আর আমি বাড়ির বাহিরে বের হতেই দেখতে পেলাম গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সকলে গাড়ির ভিতর বসে আছে সোহান সামনের সিটে বসে আছে ড্রাইবারের সাথে। পেছনের সিটে যেয়ে আপুর কাজিনদের সাথে বসলাম। সোহানের সেদিকে কোন খেয়াল নেই গভীর মনোযোগ দিয়ে সে মোবাইল টিপে চলেছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। একবারের জন্যও সে পেছনে তাকাচ্ছে না। ফুপা এসে সোহান ভাইয়ার সাথে সামনে বসতেই গাড়ি এগিয়ে চললো শপিং মলের দিকে। গাড়ির ভিতর সকলে মিলে গল্প করছে আমার কেন জানি কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বুকের ভিতর শূন্যতার হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। সব কিছু থেকেও মনে হচ্ছে কি যেন নেই। ভাবতে ভাবতে গাড়ি শহরের ভিতর ঢুকে পরলো। একটা শপিং মলের সামনে যেয়ে গাড়ি দাঁড়ালো। একে একে সকলে নেমে পরলাম গাড়ি থেকে। ফুপা এগিয়ে চললো শপিং মলের দিকে সাথে সকলে আমিও মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করলাম। হঠাৎ করেই কেউ পেছন থেকে হাত টেনে ধরতেই চমকে ঘুরে তাকালাম।
সোহান:- কিরে ফুলটুসি তুই এমন মুড অফ করে হেঁটে চলেছিস কেন?
— কই নাতো।
সোহান:- তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
— আমাকে সুন্দর লাগলেই কি কেউ দেখার মত আছে?
সোহান:- এই দেখিস কান্না করিস না। তাহলে এতো সুন্দর কাজল চোখের পানিতে লেপ্টে যাবে। তখন কিন্তু ভুত ভুত লাগবে।
— তাতে কারো কিছু আসে যায় না, আমাকে কেমন লাগলো তা নিয়ে কি কারো কোন মাথা ব্যথা আছে?
সোহান:- মাথা যদি থাকে তবে ব্যথাও করবে। কারো না থাকলেও আমার আছে।
— সেতো দেখতেই পাচ্ছি সেই যে গাড়িতে বসে ফোন টিপছিলে একটা বারও আমার দিকে তাকালে না।
সোহান:- তখনতো বলতি যে অন্য মেয়েদের দিকে তাকিয়েছি।
— হয়েছে আমার সামনে আর সাধু সাজতে হবে না। ফোনেতো কি রোমান্টিক ভাব নিয়ে কথা বলো, সে আমার দেখা হয়ে গেছে।
সোহান:- বেশী বুঝিস না আয়তো সেল্ফি তুলি।
— না তুলবো না।
সোহান:- জোড় করে হাত ধরে টান দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলো।
ফুপা:- একটা শাড়ির দোকানে ঢুকে কইরে ইকরা তাড়াতাড়ি আয় ফিতরে।
— সোহানের বুক থেকে ছুটে হ্যাঁ ফুপা আসছি।
চলবে…