#প্রেম_এসেছে_গোপনে
#পর্ব_০৬
#অনন্যা_অসমি
ভোরের আলো ঠিকমতো ফোঁটার আগেই বাড়ির ছেলেরা এবং বাচ্চাকাচ্চারা শীতের কাপড় গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো কিছুটা দূরে থাকা বড় পুকুরটার কাছে। তারা নাকি আজ মাছ ধরবে আর সেই ধরে আনা মাছ দুপুরের জন্য রান্না করা হবে।
আরশিয়ার যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও আরহামের কারণে তাকেও যেতে হল। পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখলো মাহিম আর মাহাও এসেছে। সবাই নিজেদের ছিপি তৈরি করে মাছ ধরার জন্য পানিতে ফেলে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পনেরো পর ইকবাল সাহেবের ছিপেতে টান পড়তেই উনি চেঁচিয়ে উঠলেন। পানি থেকে ছিঁপি বের করতেই দেখা গেলো মাঝারি সাইজের মোটাসোটা একটা মাছ। মাছটা বালতিতে রেখে তিনি গর্বের সাথে বললেন,
” দেখ দেখ মাছ কিভাবে ধরতে হয়। এইখানে আমার থেকে ভালো মাছ কেউ ধরতে পারবে না।”
” মাত্রই তো এলাম এখনই এতো গর্ব করোনা বড় ভাই। আমি তোমার থেকেও ভালো মাছ ধরতে পারি।”
” তাহলে ধরে দেখা মেঝো। আমিও দেখি তুই কত বড় মাছ ধরতে পারিস।”
দু’ই ভাইয়ের এই দ্বন্দ্বে বাকিরা বেশ মজা পেলো। তারা থামানোর বদলে উল্টো আরো চিৎকার করতে লাগলো।
” মেঝো মামা তোমাকেও দেখিয়ে দিতে হবে তুমি দুর্বল নও। বড় মামা থেকেও তুমি ভালো মাছ ধরতে পারো।” চেঁচিয়ে বলল জায়রা।
” না, আমার বাবাই সেরা। চাচা আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন কিন্তু আমার বাবা থেকে বড় মাছ আপনি কখনোই ধরতে পারবেন না।”
” এই না হলে আমার ছেলে।”
ফারুক সাহেব লুঙ্গির গিটঠু শক্ত করে বেঁধে মাছ ধরায় মনোযোগী হলেন। এতোটাই মনোযোগ দিয়ে তিনি মাছ ধরতে লাগলেন যেন আজ বড় মাছ না ধরে তিনি হাল ছাড়বেন না। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন ওনার ছিপেতে কোন মাছ উঠলোনা তখন ইকবাল সাহেব মজা করে বললেন,
” দেখলি তো তোদের বলেছিলাম না। আমার থেকে ভালো মাছ কেউ ধরতে পারবে না।”
” এইতো মাছ আটকেছে, মাছ আটকেছে।”
ইকবাল সাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন ফারুক সাহেব। দ্রুত ছিপে পানির বাইরে নিয়ে আসতেই ওনার আনন্দ একেবারে মাটি হয়ে গেল। ছিপির দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে ইকবাল সাহেব বললেন,
” এই তোর বড় মাছ মেঝো! হা হা হা এটা তো আমার মাছ থেকেও দ্বিগুণ ছোট। তুই ছেড়ে দে ভাই, আমার সাথে প্রতিযোগিতা করে তুই পারবিনা।”
ফারুক সাহেব বিপরীত কিছু বলবেন তার আগেই কেউ আনন্দে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” ওরে জায়রা, জুবা, ইনান দেখ দেখ কত বড় মাছ।”
সবাই চোখ ঘুরিয়ে পুকুরের অন্যদিকে তাকালো। আলী সাহেব খুশিতে গদগদ হয়ে আছে, হাতে তার বিশাল সাইজের মাছ যা ইকবাল সাহেব মাছ থেকেও অনেকটা বড়। ছোট ভাইয়ের হাতে এতো বড় মাছ দেখে ইকবাল সাহেবের মুখ চুপসে গেলেন, বিজয়ের আনন্দ মিলিয়ে গেলো।
” চাচা তুমি এটা কখন ধরলে?” ইনান প্রশ্ন করল।
” যখন তোর বাবা আর বড় চাচা ঝগড়া করছিলো তখন আমি আর ওয়াসিম মিলে এটা ধরেছি। এবার বল কে ভালো মাছ ধরতে পারে? তোর বাবা নাকি আমি? কি হল বড় ভাইয়া বল বল।”
” ওয়াসিম ভাই তুমি এরকম বিশ্বাসঘাতকা করতে পারলে?” অসহায় কন্ঠে বলল ইনান।
” হুম ওয়াসিম ভাই তুমি আমাদের না বলে চুপিচুপি ছোট মামার কাছে কখন গেলেন? বড় মাছ ধরার মজা শুধু তুমি একাই নিলে।” জুবা বলল।
” হুম ঠিক ঠিক। কই ভেবেছিলাম মামাদের মধ্যে আরেকটু ঝগড়া লাগাবো কিন্তু তুমি সব মাটি করে দিলে।” হতাশাকন্ঠে বলল জায়রা।
” ওরে বাচ্চা তাহলে এই তোদের প্ল্যান। দাঁড়া আজ তোদের কানগুলো আমি যদি লাল না করেছি।” ফারুক সাহেব এগোতে নিলেই জায়রা দৌড়ে ওয়াসিমের পেছনে লুকিয়ে পড়ল।
” আমি কিছু করিনি মেঝো মামা। এসব তো ইনান ভাইয়ের বুদ্ধি ছিল।”
” কি! দাঁড়া তবে ইনানের কান আগে লাল করবো তারপর তোদের।”
বাবার কথা শুনে ইনান দৌড়ে আরশিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালো। তার হঠাৎ আগমনে আরশিয়া ভড়কে গেল।
” আমি কিছু করিনি। আমি তো তোমার দলেই ছিলাম। তোমাকে না আমি চিয়ারআপ করেছি। আমাকে কিছু করলে কিন্তু পরের বার থেকে আমি আর তোমার দলে থাকবো না।” আরশিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল ইনান। ছেলের বাচ্চামো দেখে ইকবাল সাহেব হাসতে হাসতে চলে গেলেন। ইনানের ছোটাছুটি দেখে আরহামও খিলখিল করে হাসতে লাগলো। তিন ভাই আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আরো কয়েকটা মাছ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। ততক্ষণে আলো ফুঁটে গিয়েছে। বড়রা চলে গেলেও থেকে গেলো ছোটরা। আরশিয়া আরহামের হাত ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের এই কর্মকাণ্ড তার ভালোই লাগছিলো।
” ইশ…. কত ভালো এরা। সবাই কত মিলেমিশে থাকে। এখানে না এলে হয়তো ভাইদের মধ্যে এতো সুন্দর মূহুর্ত কখনোই দেখতে পেতাম না।”
” ওয়াসিম ভাই তুমি কি এটা ঠিক করোনি। চালাকি করে ছোট মামাকে জিতিয়ে দিলে।” মুখ ভার করে বলল জায়রা।
” আমি কি আর তোদের মতো বুদ্দু নাকি? ব্রেইনটা কি সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছে নাকি? ব্রেইন দিয়েছে ব্যবহার করার জন্য। তোরা তা সাজিয়ে রাখলে এরকমই হবে।” ভাব নিয়ে বলল সে।
” আচ্ছা বাদ দে। এখন মাছ ধরবি নাকি বাড়ি ফিরে যাবি?”
” না না আমি মাছ ধরবো। এই ইনান ভাই চলো ওইদিকটায় যাই।”
জায়রা, জুবা, ইনান তিনজনেই ছিপি,বালতি তুলে অন্যদিকে চলে গেলো। ওয়াসিমও তাদের সাথে যোগ দেবে তখন মাহা তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
” ওয়াসিম ভাই তুমি তো খু্ব ভালো মাছ ধরতে জানো। আমাকে শেখাও না।”
” তোমার ভাই কোথায়? সেও তো জানে, তাকে বলো।”
” না না আমি ভাইয়ার কাছে শিখবোনা। ও আমাকে ভালো মতো শিখাবেনা। তুমিই শিখিয়ে দাও না।”
মাহার জোড়াজুড়িতে অবশেষে বাধ্য হয়ে ওয়াসিম রাজি হয়ে গেলো। সে রাজি হতেই মাহা খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো।
” আপু আমিও যাই ওদের সাথে?”
” না আরহাম মা বকা দেবে। দেখো ওখানে কত পানি। পড়ে গেলে তখন কি হবে? এখানেই চুপটি করে দাঁড়িয়ে দেখো।”
” তুমি কি এখনো ওইদিনের কথা মনে রেখে বসে আছো?”
আচমকা মাহিমের কন্ঠ শুনে আরশিয়া ঘাবড়ে গেলো। পাশে মাহিমকে দেখতে পেয়ে আস্তে করে কয়েকদম পিছিয়ে গেলো সে।
” না আমি ওসব মনে রাখিনি।”
” একা একা দাঁড়িয়ে আছো যে? এসো তুমিও মাছ ধরো।”
” না থাক তার দরকার নেই। আমি আরহামকে একা ছেড়ে যেতে পারবোনা। আপনারাই মাছ ধরুণ, আমরা বরং দাঁড়িয়ে তা দেখি।”
মাহিমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে আরশিয়ার বেশ অস্বস্তি লাগছিলো। তা হয়তো সে বুঝতে পেরেছিলো, তাই আর কোন কথা না বলে চুপচাপ সরে গেলো। কি লাভ শুধু শুধু আরেকজনের বিরক্তির কারণ হওয়ার।
আচমকা কোন পূ্র্বাভাস ছাড়া ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। সবাই দৌড়ে চাউনির নিচে আশ্রয় নিলো। আরশিয়া, আরহাম আগে থেকেই সেখানে ছিলো বিধায় তারা না ভিজলেও বাকিরা প্রায় অনেকখানি ভিজে গিয়েছে।
” এবার আমরা বাড়ি যাবো কি করে? বৃষ্টির বেগ তো অনেক বেশি। তাড়াতাড়ি কমবে বলে তো মনে হচ্ছেনা।” চিন্তিত কন্ঠে বলল জুবা।
” ধুর ভালো লাগেনা। কোথায় ভাবলাম একটু মজা করবো কিন্তু অসময়ে এই সকালবেলা বৃষ্টি এসে সব নষ্ট করে দিলো।” জায়রা কথা শেষ হতেই প্রচ্ছদভাবে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। আরহাম ভয়ে পেয়ে আরশিয়াকে জড়িয়ে ধরল।
” জায়রা এভাবে বকিস না, দেখ তোর কথা বৃষ্টির পছন্দ হচ্ছেনা বলে কিভাবে গর্জে উঠছে।”
” আব…. আমি বলি কি মেয়েরা না হয় এখানে থাকুক। আমাদের মধ্যে কেউ বাড়িতে গিয়ে ছাতা নিয়ে আসি। কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো? এমনিতেই আমরা ভিজে গিয়েছি।” মাহিমের কথাটা সবার পছন্দ হলো।
” ঠিক বলেছো মাহিম। ইনান বরং ওদের সাথে থাকুক আমরা গিয়ে ছাতা নিয়ে আসি।”
ওয়াসিমের কথা শুনে মাহা চটজলদি বলল,
” তুমি থাকোনা ওয়াসিম ভাই। ইনান ভাইকে পাঠাও।”
” কেন আমি থাকলে তোমরা কোন সমস্যা আছে?” বিরক্তি নিয়ে বলল ইনান। তার কথায় মাহা কিছুটা অপমানিত বোধ করল। বিরক্তি নিয়ে ইনানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগলো।
চলবে…..