#প্রেম_এসেছে_গোপনে
#পর্ব_০৯
#অনন্যা_অসমি
কারেন্ট না থাকার কারণে সবাই বাইরে ঘুরাঘুরি করছে। পিচ্চি বাচ্চাগুলো বল নিয়ে খেলা করছে, বাড়ির মা-চাচীরা একসাথে বসে সংসারের আলাপ করছে। বড় বাচ্চারা সবাই একসাথে বসে যে যার মতো মোবাইল দেখছে।
আরশিয়া ফোনে গল্প পড়ছিল। আচমকা জায়রা বলে বসল,
” কহিনূর আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?”
জায়রার আচমকা প্রশ্ন শুনে সবাই তব্দা খেয়ে গেল। আরশিয়া তো একেবারে থমকে গেল। আড়চোখে সবাইকে পরখ করে দেখল সবাই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যা বুঝতে পেরে সে কিছুটা বিব্রত হলো। নড়ে চড়ে আরশিয়া বলল,
” এ কেমন প্রশ্ন জায়রা?”
” আরে আপু বলোনা। আমরাই তো, সত্যি বলছি কাউকে বলবো না।”
” না আমার এরকম কিছু নেই। এসব রিলেশন আমার ভালো লাগেনা। যেই সম্পর্কের কোন নিশ্চিয়তা নেই সেই সম্পর্কে জড়িয়ে কি লাভ? আমার কাছে মনে হয় শুধু শুধু সময় নষ্ট।”
” আহারে ইনান ভাই এবার তোমার কি হবে? কহিনূর আপু তো শুরুর আগেই তোমাকে ছ্যাঁকা দিয়ে দিলো।” একটু ঢং করে খোঁচা দিয়ে বলল জায়রা। তার কথা শুনে উল্টো ইনানও নাটকীয়ভাবে বলল,
” আপু আপনি এটা ঠিক করেননি। এভাবে কিছু করার আগেই আমার মাসুম দিলটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলে। এবার তো আমাকে প্রেমিক প্রেমিক ভাব থেকে বেরিয়ে দেবদাস চরিত্রে ঢুকতে হবে।”
তাদের নাটকীয়তা দেখে সবাই হেসে উঠল,এমনকি আরশিয়াও। কারণ সে জানে ইনান তার সাথে মজা করছে। এতোটুকু বোঝার ক্ষমতা তার আছে।
” এভাবে আর কতক্ষণ ফোন চালানো যাই? ইনান ভাই একটা গান ধরো তো।” জুবা বলল।
” আমার এখন মুড নেই। তোরা জানিস মুড না থাকলে আমার সুর আসেনা। ওয়াসিম ভাইকে বল তার তো এখন সবসময় ফুরফুরে মেজাজ থাকে।”
” তোকে বলেছে।” ইনানের পিঠে আস্তে করে চাপড় মেরে বলল ওয়াসিম।
ইনান মুখ ভেঙিয়ে বলল, ” বলতে হয়না আমি জানি। কেউ যদি মনে করে অন্যদের মতো আমিও অন্ধ তাহলে সেটা তার সমস্যা।”
ইনানের কথায় ওয়াসিম ভ্রু-কুচকে তাকালো তবে ইনান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উঠে ভেতরে চলে গেল। কিছুসময় পর ভেতর থেকে একটা গিটার নিয়ে এলো। সবাই মনে করেছিল ইনান হয়তো সেটা ওয়াসিমকে দেবে। কিন্তু ইনানের স্বভাবই সবার চিন্তার বাইরে কাজ করা। তাই সবাইকে চমকে দিয়ে সে আরশিয়ার হাতে গিটারটা ধরিয়ে দিলো। পূর্ব সংকেত ছাড়া এভাবে গিটার দেওয়াতে আরশিয়া তাড়াতাড়ি সেটা আঁকড়ে ধরলো।
” সবসময় তো ওয়াসিম ভাই গিটার বাজাই, আজ না হয় আমরা দামী নূর আপুর গিটার বাজানো দেখবো। সবসময় একই জিনিস কি আর জমে? কি বলিস তোরা?”
” তোমার আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ।” খুশি হয়ে বলল জুবা।
” মা-মামী সবাই এদিকে চলে এসো। ওয়াসিম ভাই আর কহিনূর আপু আমাদের ফ্রীতে কনসার্টের ফিল দেবে। এই সুযোগ মিস করতে না চাইলে তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
ইনানের বলতে দেরি কিন্তু সবার আসতে দেরি নেই। মূহুর্তেই সবাই তাদেরকে ঘিরে বসে পড়ল।
তোমার নামের রোদ্দুরে
আমি ডুবেছি সমুদ্দুরে
জানি না যাব কতদুরে এখনও…
আমার পোড়া কপালে
আর আমার সন্ধ্যে সকালে
তুমি কেন এলে জানি না এখনও………
আরশিয়া গানের তালে তালে গিটার বাজাচ্ছে তবে তার মনোযোগ গিটারের থেকেও বেশি ওয়াসিমের উপর। ওয়াসিমের কন্ঠে একপ্রকার মুগ্ধতা আছে, যা সবসময় তাকে মোহিত করে। সে স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও আরশিয়া মনোযোগ দিয়ে তা শোনে। নিজের অজান্তেই তার অবচেতন মন বারবার চাই ওয়াসিমের কন্ঠ শুনতে। এমনিতেই সে ওয়াসিমের কন্ঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল এখন সেই কন্ঠে গান শুনে সে একেবারে গলে গিয়েছে। তার মনে হচ্ছে সে বুঝি আর এই পৃথিবীতে নেই।
গান শেষ হতেই সবাই তালি দিয়ে উঠল। সবাই ওয়াসিমের প্রশংসা করলেও তার থেকে বেশি প্রশংসা করছে আরশিয়া। যা দেখে ইনান মজা করে বলল,
” ব্যপার কি? মনে হচ্ছে ওয়াসিম ভাইয়ের প্রশংসায় বুঝি এবার ভাগ পড়ল। এভাবে দামী নূর আপুকেই প্রশংসা করে গেলে ওয়াসিম ভাই তো কান্না করে দেবে।”
” চুপ কর বদ’মাইশ। আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি যে কান্না শুরু করে দেবো?”
” কান্না করলেও বা কি? আমরা তো কহিনূররেই প্রশংসা বেশি করবো। ওয়াসিমের গান তো আমরা আগেই থেকেই শুনে আসছি, আমরা তো জানি ওর গানের গলা কেমন। কিন্তু আমাদের এই টুকটুকিটা যে এতো ভালো গিটার বাজাতে পারে তা কি আগে জানতাম?” আরশিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ইনানের মা।
” তাহলে আমাকে ধন্যবাদ দাও। দামী নূর আপুর এই গুণটা তোমাদের সামনে তো আমিই এসেছি। সেই হিসেবে আমারও তো কিছু পাওনা আছে।”
” যা বদ’মাইশ ছেলে। সবসময় নিজের লাভ খুঁজে।” ইনানের হাতে হালকা চাপড় দিয়ে বলল তার মা।
কথার মাঝেই কারেন্ট চলে আসাতে সবাই বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো।
” চলো ভাবী খাবার ব্যবস্থা করে ফেলি। রাতও তো হলো, এখনই খাওয়াটা সেরে ফেলি। আবার কারেন্ট চলে গেলে তখন আরেকটা সমস্যা।” জায়রার মায়ের কথায় সায় দিলো সবাই। আস্তে আস্তে সবাই খাওয়ার জন্য বসে পড়ল। সবার আড়ালে ওয়াসিম আরশিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। একটু নিচু হয়ে আরশিয়ার কানের কাছে এসে বলল,
” তোমার গিটার বাজানোর দক্ষতা অনেক ভালো।”
আচমকা তার কন্ঠ শুনে আরশিয়া ভড়কে গেল। সে পেছন ফেরার আগেই ওয়াসিম সোজা হয়ে কয়েক কদম পেছনে চলে গিয়েছে। আরশিয়া নিজেকে সামলে হালকা হেসে বলল,
” তার থেকেও আপনার গানের গলা ভালো।”
” হুম তা তো ঠিক আছে। কিন্তু আজ তোমার গিটারের তালের কারণে শুনতে আরো ভালো লেগেছে।”
প্রতিউত্তরে আরশিয়া তেমন কিছু বলল না, শুধু হাসলো।
” খাবেন না?”
” হুম তুমি যাও, আমি আসছি।”
বিপরীতে কোন কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে খেতে চলে গেল সে।
.
.
নিজের সবকিছু গোছানো শুরু করেছে আরশিয়া। পরশু তারা চলে যাবে। তার মায়ের ছুটি শেষ, আর থাকা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তারা গোছগাছ করতে ব্যস্থ সেইসময় রুমে এলেন আলী সাহেব।
” মা-মেয়ে কি করছো?”
” আরে আলী যে, বস বস।” বলেই বিছানায় বসার জায়গা করে দিলেন সুমনা আহমেদ।
তিনি বসতে বসতে আরশিয়া থেকে জানতে চাইলেন,
” রাতে ঠিকমতো খেয়েছো তো মা?”
” জ্বী মামা।”
” বেশ বেশ। তো আপু কি করছো?”
” জামা-কাপড় গোছগাছ করছিরে ভাই। না হলে কাল তাড়াহুড়ো তে এটা ওটা ফেলে চলে যাবো। তাই আজ থেকেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছি।”
” গোছগাছ করছো মানে! তোমরা কবে যাবে?”
” পরশু দুপুরের টিকিট কেটেছি।”
” কি বলছো! কখন কাটলে টিকিট? আমাদের তো জানালেও না।”
” হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম ভাই। ছুটি প্রায় শেষ, এখন না গেলে যে হয়না। তাই সন্ধ্যাবেলা তৃষাণকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রেখেছি।”
” এটা তুমি ঠিক করোনি আপু। দেখি টিকিটগুলো আমাকে দাও। আমি গিয়ে ডেট চেঞ্জ করে আনবো। ইলমারাও তো কিছুদিন পর চলে যাবে। তোমরা বরং ওদের সাথে যেও। দাও আমাকে দাও।”
” আচ্ছা বাবা লাগবেনা। আমি তৃষাণকে দিয়ে চেঞ্জ করিয়ে আনবো।”
সুমনা আহমেদ কোনভাবে আলী সাহেবকে এটাওটা বলে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই আরশিয়াকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” কি বলিস? যাবি নাকি আরো কয়েকদিন থাকবি?”
” অনেকদিন তো হলো এবার না হয় ফিরে যাই আবার না হয় পরে আসবো। বাবা বাড়িতে একা, কি না কি খেয়ে আছে। আরহামেরও তো স্কুল মিস যাচ্ছে। আর টিকিটও তো কেটে ফেলেছি। এখন চেঞ্জ করতে গেলে আরেকটা বাড়তি কাজ।”
” হুম ঠিক বলেছিস। তাহলে আস্তে ধীরে গোছানো শুরু কর। আপাতত ওদের বলার দরকার নেই। আমি কাল রাতে আস্তে ধীরে বলব।”
চলবে……