দাওয়াত ইকবাল হোসেন পর্ব- ১

0
588

গল্প: দাওয়াত
ইকবাল হোসেন

সেদিন আমার ছেলের সুন্নতে খাতনা করালাম। স্ত্রীকে বললাম এই উপলক্ষে একটা ছোটখাট অনুষ্ঠান করে কাছের আত্বীয় স্বজনকে দাওয়াত করি।

স্ত্রী বলল, অনুষ্ঠান করার টাকা পাবে কোথায়?

আমি বললাম, অফিসে প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু টাকা জমা হয়েছে। সেখান থেকে টাকা উঠিয়ে অনুষ্ঠান করবো।

স্ত্রী বলল, সুন্নতে খাতনার অনুষ্ঠান তো জরুরী কিছু নয়, করার দরকার কি? তার থেকে টাকাগুলো ছেলের ভবিষ্যৎ এর জন্য রেখে দাও।

আমি বললাম, বেঁচে থাকলে তো টাকা জমাতে পারবো, কিন্তু শখটা তো আর ফেরত পাবো না।

অনুষ্ঠান এর ব্যাপারে স্ত্রীও মনে হয় নিমরাজি ছিল, তাই সে আর এ ব্যাপারে আর বাধা দিল না।

তারপর আমরা অনুষ্ঠানের বিষয়ে পরিকল্পনা করলাম, কি কি আইটেম থাকবে এবং কাকে কাকে দাওয়াত করবো।

অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে ছুটির দিন সকালে নাস্তা করার পর আত্বীয় স্বজনকে দাওয়াত করার জন্য বের হলাম। প্রথমেই পরলো আমার মেজো দুলাভাইয়ের বাসা। এই ভদ্রলোক স্কুল টিচার।

মেঝ দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখি তিনি কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছেন আর আপা টেবিলে বসে নাস্তা করছেন। আপা আমাকে নাস্তা করার জন্য ডাকলেন। নাস্তা আমি করে এসেছি, তাই শুধু চা খেতে টেবিলে বসলাম। তাদেরকে দাওয়াতের কথা বললাম। আপা বললেন, তোর টানাটানির সংসার, অনুষ্ঠান করার কি দরকার?

দুলাভাই বললেন, তোমার ভাই মনে হয় চাকুরী করে অনেক টাকা জমিয়েছে। আমাদের পেছনে কিছু খরচ করতে চাচ্ছে, করুক না। তুমি বাধা দিচ্ছ কেন! তা কি কি আইটেম থাকবে?

আমি বললাম, সাদা পোলাও, মুরগীর রোষ্ট, গরুর রেজালা আর বোরহানি। আইটেম কি ঠিক আছে?

তিনি বললেন, হুম, এই আইটেমই ভালো। সবাই পছন্দ করে। অবশ্য এই আইটেম তোমার বড় দুলাভাইয়ের পছন্দ নাও হতে পারে। ভালো খাবার তো তার মুখ দিয়ে রোচে না। যে সব খাবার বেশিরভাগ লোক পছব্দ করে না, যে গুলো খেলে মানুষের বদ হজম হয়, সে গুলোই তার পছন্দ।

আমার মেঝ দুলাভাই এবং বড় দুলাভাই, দুজনই নিজেদেরকে অত্যান্ত জ্ঞানী লোক বলে মনে করেন। তাতে সমস্যা দাড়ায় দুজন অত্যান্ত জ্ঞানী লোক যখন একসাথে হয় তখন তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঝগড়া লেগে যায়। কারন, তখন একজনের যুক্তি অন্যজন মানতে চান না, ফু দিয়ে উরিয়ে দেন।

যেমন, গত ঈদ উপলক্ষে আমি ওনাদেরকে দাওয়াত করেছিলাম। তখন তারা দাওয়াতে এসে বিভিন্ন ধরনের আলাপ আলোচনার শুরু করলেন। আলোচনার এক পর্যায়ে ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়ে খাবার টেবিলে দুজনের তুমুল ঝগড়া লেগে গেল এবং তারপর তাদের মধ্যে একজন অন্য জনের কথা মানতে না পেরে রাগ করে না খেয়েই চলে গেলেন।

মেঝ দুলভাই বড় দুলাভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন, ওনাকে দাওয়াত করেছ?

আমি বললাম, এখনো করিনি। আপনাদের বাসা থেকে বের হয়ে ওখানে যাবো।

তিনি বললাম, তোমারা তো আবার আমার কথার দাম দাওনা। তার কথায় ওঠ বস কর। তাকে দাওয়াত দিতে গেলে তিনি তোমাকে আইটেম পরিবর্তন করার কথা বলতে পারেন।

আমি বললাম, আমার বাজেট কম, আমি ওনার পছন্দ মত বেশি রিচ ফুড করতে পারবো না।

তিনি গম্ভির মুখে বললেন, না পারলে তো ভালো। কিন্তু ওনার কথা মত যদি আইটেম পরিবর্তন কর তাহলে কিন্তু আমি দাওয়াত রাখলাম না।

মেঝ দুলাভাইয়ের এই কথা শুনে আপা খুব রাগ করলেন এবং আমি হতাশ হয়ে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।

বড় দুলাভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখি তিনি বসে বসে পেপার পড়ছেন। আপা বাসায় নেই, হাসপাতালে মনে হয়। প্রায় ছুটির দিনেও আপার ডিউটি থাকে।

আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট হলো আমার বড় আপা। তিনি ডাক্তার হয়েছেন। কিন্তু ওনার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মনে হয় বেকার ছেলেকে প্রেম করে বিয়ে করা। দুলাভাই বিয়ের সময় বেকার ছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারাজীবন বেকারই থাকবেন। ওনার যে যোগ্যতা তাতে তিনি ভালো কোন চাকুরী যোগার করতে পারেননি আর ওনার কথা হলো উচ্চ পদস্থ কোন চাকুরী ছাড়া সাধারন কোন চাকুরী তিনি করবেন না।

ওনার একটাই কাজ হলো সমাজের উঁচু পর্যায়ের লোকজনের সাথে চলাফেরা করা। ওই শ্রেনীর প্রচুর লোকজনের সাথে তার যোগাযোগ আছে। তার মত একজন হা-ভাতের সাথে সমাজের হোমরা চোমরা লেভেলের লোকজনের কি প্রয়োজন থাকতে পারে তা আমার মাথায় আসেনা।

আমার এই দুলাভাইটি হলো আমাদের বিপদের বন্ধু। আমারা সরকারী অফিসে কোন কাজে আটকে গেলে বা হাসপাতালে সিট না পেলে, ওনাকে বললেই হয়। উনি ব্যবস্থা করে দেন। গুরুত্বপূর্ন সব যায়গাই যেন ওনার পরিচিত লোক আছে।

বাবা বেঁচে থাকতে এই লোককে দুচোখে দেখতে পারতেন না। তার মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট হয়েও এরকম একজন টেনে টুনে পাশ করা বেকার ছেলেকে বিয়ে করেছে, যার কোন ভবিষ্যৎ নেই। আব্বা এই কারনে আপাকে অনেক বকাঝকা করতেন।

আপার মত একজন এই রকম বেকার ছেলেকে বিয়ে করার জন্য আমরা সবাই অবাক হয়ে ছিলাম। আমার স্ত্রী একদিন আপাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপা কিছু মনে না করলে একটি কথা বলি, সবাই বলে আপনি দুলাভাই থেকে আরো ভালো বর পেতেন। দুলাভাইকে বিয়ে করলেন কেন?

আপা কিছুটা লাজুক হেসে বলেছিলেন, আমি ওকে বিয়ে করেছি আমার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে। সে যে আমাকে কি পরিমান ভালোবাসে আর কি মনে করে আল্লাহই জানে! তার মত পৃথিবীর কেউই আমাকে ভালোবাসতে পারতো না।

আমি দুলাভাইকে দাওয়াতের কথা বললাম।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি কি আইটেম থাকবে? আমার এই দুলাভাইটি খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে খুব সৌখিন। তিনি খেতে খুব পছন্দ করেন।

আমি আইটেমগুলো বললাম।

তিনি বললেন, আইটেম গুলো মনে হয় তোমার মেঝ দুলাভাইয়ের পরামর্শ মত করেছো?

আমি বললাম, আমিই ঠিক করেছি।

তিনি বললান, তোমরা তো আবার তার কথা ছাড়া চলো না। বিপদে পরলে আমার কথা মনে হয়। অন্য সময় সে।

আমি বললাম, আপনার কথা আমাদের সবসয়ই মনে হয়। আমরা হাসলেও আপনাকে নিয়ে হাসি, কাঁদলেও আপনাকে নিয়ে কাদি।

তিনি কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন, পোলাও রোষ্ট তো কমন খাবার এগুলো করে লাভ নেই। তার থেকে তুমি কাচ্চি, কাবাব করতে পারো।

আমি বললাম, আমার বাজেট কম। এত খরচ করতে পারবো না।

তিনি বললেন, খরচ তেমন বেশি হবে না, প্রায় একই। উনিশ বিশ হতে পারে। তুমি উনিশ খরচ করতে পারলে বিশও করতে পারবে। তাতে করে তোমার খাবার টা স্টান্ডার্ড হবে। ভাবছি থানার নতুন ওসি সাহেব এবং এলাকার কমিশনার সাহেবকেও দাওয়াত করবো।

আমি ওনার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বললেন, তবে এই আইটেম তোমার মেঝ দুলাভাইয়ের পছন্দ হবে না। তিনি তো আবার ডাল ভাত খেয়ে অব্যস্থ, ভালো খাবার খেতে পারে না। অবশ্য তোমরা যদি তার কথা মত ফকিরা আইটেম আয়োজন কর তাহলে আমাকে দাওয়াত করার প্র‍্যয়োজন নেই।

ওনার কথা শুনে আমি প্রচন্ড বিপদে পরা ব্যাক্তির মত প্রচন্ড মন খারাপ করে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here