দাওয়াত (চতুর্থ ও শেষ পর্ব) ইকবাল হোসেন

1
510

গল্প: দাওয়াত (চতুর্থ ও শেষ পর্ব)
ইকবাল হোসেন

ট্রেন চলে যাওয়ার পর আমি রেল ষ্টেশনের এক চা দোকানে বসলাম। বেশ সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে এক কাপ চা পান করলাম। খুব টেনশন হচ্ছে। কিভাবে কি করবো তা মাথায় আসছে না। হটাৎ করে আমার কি যে হলো, মনে বেশ জিদ চেপে গেল। আমার অনুষ্ঠান আর আমি ভয় পাচ্ছি কেন? আমি আমার মত করবো, কে কি মনে করলো তা চিন্তা করার দরকার নেই। চা শেষ করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়ালাম। অবশ্য সম্পর্কগুলোর জন্য চিন্তা করবো না বললেও চিন্তা করতে হয়।

আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকি সে বাড়ির লাগোয়া বেশ বড় একটি খালি যায়গা আছে। সেখানে সামিয়ানা টাংগিয়ে অথিতিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার এক পাশে রান্না-বান্না চলছে। রান্না প্রায় শেষের দিকে। রান্না হচ্ছে আর আমি সেখানে চেয়ার পেতে বসে আছি। সারারাত ঘুমাই নি, তাই শরীরটা ঝিম ঝিম করছে। স্ত্রী ঘুরে ঘুরে বিছানো চেয়ার টেবিলে দেখছে, সবকিছু ঠিকঠাক মত আছে কিনা।

এমন সময় আপা ও ছোট দুলাভাই আসলেন। ছোট দুলাভাই হই হই করে বললেন, কি ব্যাপার নায়ক নায়িকা কি করছে?

আমার স্ত্রী বলল, ভাই গতকাল থেকে খেটে মরছি, এখন আর নায়িকা নই। আপনার শ্যলক কাজের বুয়া বানিয়ে রেখেছে।

তিনি বললেন, নায়িকা তো নায়িকাই। সিনেমায় দেখেননা, নায়িকা যাই করুক সে নায়িকা।

আপা বললেন, পুরুষ মানুষের এই এক সমস্যা। নিজের স্ত্রী ছাড়া সবাইকে নায়িকা মনে হয়।

ছোট দুলাভাই ভ্যানে করে ব্যন্ডের মালামাল নিয়ে এসেছেন। সাথে ওনার একজন সহকারীও এসেছে। তাকে নিয়ে প্যন্ডেলের এক পাশে চলে গেলেন সেগুলো সেট আপ করতে। ওনার দলে আরো তিনজন আছেন, তারা নাকি পরে আসবেন। তিনি বাদ্যযন্ত্রগুলো সাজাচ্ছেন আর এদিকে আমার চোখ মুখ ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। মনের কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, অনুষ্ঠানে এসে এসব দেখে চাচার মুখ কালো হয়ে যাচ্ছে এবং তিনি আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছেন। আমার দিকে তাকানো ওনার চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে ওনি এখন সবার সামনে আমাকে কিছু না বললেও পরে দেখে নিবেন।

কিছুক্ষন পর বড় আপা, মেঝ আপা ও মেঝ দুলাভাই আসলেন। বড় আপাকে দেখে আপার সাথে বড় দুলাভাইও এসেছেন মনে করে আমি চমকে উঠলাম। মন চাচ্ছিল ওনার মুখুমুখি হওয়ার চেয়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কারন, আমি তো উনার পছন্দ মত আইটেম করিনি। কিন্তু দেখলাম তিনি আসেননি। আপাকে বাইকে করে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি ওসি সাহেব ও চেয়ারম্যান সাহেবকে নাকি আনতে গেছেন।

মেঝ দুলাভাই আমাকে দেখিয়ে ছোট দুলাভাইকে বললেন, তুমিতো ওর কাছের লোক, তাই আগে ভাগেই চলে এসেছো।

ছোট দুলাভাই বললেন, আমি ছোট মানুষ তাই আগে চলে এসেছি। আপনারা ভিআইপি লোক, ভিআইপিরা দেরী করে আসে।

বড় আপা গিয়ে আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন।বললেন, তোমার এই অবস্থা কেন? আজকে অনুষ্ঠান, কোথায় একটু সেজেগুজে থাকবা। যাও গোসল করে আসো। তোমার চুলগুলো বেধে দেই।

বড় আপা আমার স্ত্রীকে বিশেষ স্নেহ করেন। মা বেঁচে থাকতে ওকে স্বাশুরীসুলভ কোন শাসন করতে চাইলে, আপা বাধা দিতেন। তাছাড়া দুই বোনও ননদী সুলভ কিছু বলতে চাইলে আপা তার প্রতিবাদ করেন।

জুমার নামাজের পর মেহমানরা আসতে শুরু করলো। বড় দুলাভাই এখনো এসে পৌছাননি। আপা ফোন দিয়েছিল। দুলাভাই বলেছেন চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য নাকি দেরী হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এই এক সমস্যা, কোথাও যাবো বললেই সাথে সাথে যেতে পারে না।

লোকজন আসছে এবং দাওয়াত খেয়ে চলে যাচ্ছে, সবকিছুই ঠিকঠাক মত চলছিল। বর্তমান এক ব্যাচ খাওয়া প্রায় শেষ, তখন হটাৎ করে প্যন্ডেলের এক কোনা থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম কি হয়েছে দেখার জন্য। গিয়ে দেখি এক তরুনী মেয়ে বয়স্ক এক লোককে তার পাশে বসা এক যুবককে দেখিয়ে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলছে, তুমি ওকে মারলেন কেন?

ঠিক ওই সময়েই বড় দুলাভাই ওসি সাহেব এবং চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়ে প্যন্ডেলে প্রবেশ করলেন এবং ঝামেলা দেখে সোজা ঝামেলাস্থলে চলে আসলেন।

ওসি সাহেব মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?

মেয়েটি কিছু বলতে যাবে,তখন বড় দুলাভাই তাকে থামিয়ে দিয়ে ওসি সাহেবকে বললেন, এখানে মেহমানরা আছেন, এখানে কথা বললে ওনারা অস্বস্তি ফিল করতে পারেন। তার চেয়ে চলুন আমরা ভেতরে গিয়ে কথা বলি।

ওসি বলল, ঠিকই বলছেন। তারপর তিনি তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন। আপনারা আমার সাথে আসেন। এই কথা বলে তিনজনকে নিয়ে ওনারা আমার বাসার ভীতরে চলে গেলেন।

আমি তাদের সাথে যেতে চাইলে দুলাভাই বললেন, তুমি থাকো,মেহমানদের দেখাশোনা কর। আমরা ব্যাপারটা দেখছি।

মেহমানদের খাওয়ানো প্রায় শেষ। এরই মধ্যে বাসা থেকে ওনারা বের হয়ে আসলেন। দুলাভাই বললেন, কথা এখনো শেষ হয়নি। তাদেরকে তোমার বাসায় বসিয়ে এসেছি। আমরা খাওয়া দাওয়া করে নেই, তারপর আবার ব্যাপারটা নিয়ে বসবো।

ওনারা টেবিলে বসলেন। দুলাভাই বললেন, তোমার তো মনে হয় এখনো খাওয়া হয়নি, আসো তুমিও বসে পর।

আমি ওনার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস বললাম, ব্যাপারটা কি?

তিনি বললেন, প্রেমের কেইস।

অথিতিদের সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। বাবুর্চির সহকারীরা থালা বাসন পরিস্কার করছে। কাজ শেষ হলে সব কিছু গোছগাছ করে চলে যাবে। দুরের আত্বীয স্বজন সবাই চলে গেছেন। আমরা বাকি সবাই প্যন্ডেলের ভীতর ওই ব্যাপারটা নিয়ে বসলাম।

চাচা বড় দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার? তিনি ঐ ঝামেলার সময় এখানে ছিলেন না, পরে এসেছেন।

দুলাভাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই মেয়েটি ওর বউয়ের পরিচিত। এই এলাকাতেই থাকে, কলেজে পড়ে। ওর মা-বাবা নেই, ছোট বেলায় মারা গেছে। চাচার বাসায় থাকে। সে এক জনকে পছন্দ করে। ছেলেটি বেকার এবং গরীব পরিবারের ছেলে। তার চাচা ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না। তিনি ওই ছেলেটিকে আগে কয়েকবার সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, সে যেন তার ভাতিজির সাথে না মিশে। মেয়েটি আজকে ঐ ছেলেকে নিয়ে এখানে দাওয়াতে এসেছে। তার চাচা এই খবর শুনে এখানে এসে ওই ছেলেটিকে খাওয়ার টেবিলে মেরেছেন।

আমার চাচা বললেন, সব বাবা-মা বা অভিভাবকরাই চায় তাদের মেয়ের খুব ভালো যায়গায় বিয়ে হোক। কিন্তু খাওয়ার টেবিলে এসে কাউকে মারদোর করা মনে হয় খুব লজ্জার বিষয়, এটা শুধু তাদের না, আমাদের সবার।

মেঝ দুলাভাই বললেন, যেহেতু তার সাথে ওই ছেলেটির সম্পর্ক তার চাচা পছন্দ করছে না। তখন তাদের বাসার কাছের কোন অনুষ্ঠানে তাকে ডেকে নিয়ে আসলে ঝামেলা তৈরী হতে পারে। ছেলেটিকে ওর এখানে নিয়ে আসা উচিত হয়নি।

মেয়েটিকে দেখে মনে হলো সে শক্ত প্রকৃতির মেয়ে। তার প্রেমিককে যে মেরেছ তার জন্য সে যতটুকু না দু:খিত তার থেকে বেশী ক্ষুব্দ। সে বলল, ও মেসে থেকে কি না কি খায়। তাই ভাবলাম তাকে এক বেলা একটু ভালো খাবার খাওয়াই। সে জন্য ভাবীকে (আমার স্ত্রী) বলে ওকেও দাওয়াতে নিয়ে এসেছি।

মেয়েটির চাচা মনে হয় একটু ভয় পেয়েছে। তার রাগের মাথায় এই রকম কাজের জন্য তাকে যে পুলিশ এবং চেয়ারম্যান সাহেবের উপস্থিতিতে বিচারের সম্মুক্ষিন হতে হবে তা সে চিন্তাও করতে পারেনি।

বড় দুলাভাই ওই লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা আমাদের পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান। আপনি এই অনুষ্ঠানে এসে তাকে মারলেন কেন? আপনার এই আচরনের জন্য আমরা আমাদের আত্বীয় স্বজনের কাছে খুব লজ্জিত হয়েছি।

ওই লোকটি আত্বপক্ষ সমর্থন করে বলল, আমার ভাতিজিকে নিয়ে আমার খুব আশা যে, তাকে খুব ভালো যায়গায় বিয়ে দিব। এই ছেলেকে আমি বার বার নিষেদ করেছিলাম, ওর সাথে যেন না মিশে। কিন্তু সে আমার ভাতিজির পিছু ছাড়ছেইনা। তাই আমি রাগ ধরে রাখতে পারিনি।

বড় দুলাভাই বললেন, আজ সে তো আপনার ভাতিজির পিছু নেয়নি, তাকেই তো ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে।আপনার ভাতিজি যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কা সেহেতু তার বিয়ের সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে।

ঐ লোকটি বলল, সবাই চায় তাদের মেয়ের যেন ভালো যায়গায় বিয়ে হয়। বিয়ের পর যেন সে কোন কষ্ট না পায়। আপনার ভাতিজি হলে আপনিও মনে হয় তা ই চাইতেন।

বড় দুলাভাই কিছুটা রেগে বললেন, আমি হলেও তাই চাইতাম। কিন্তু আপনার মত কোন অনুষ্ঠানে এসে এভাবে সিন ক্রিয়েট করতাম না।

মেঝ দুলাভাই বললেন, ওনাদের ব্যাক্তিগত বিষয়ে আমাদের এত ঝামেলার কি দরকার? ওনার এই আচরনের জন্য ওনি সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে যাক।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, সব অপরাধের ক্ষমা হয় না। তিনি একজনের অনুষ্ঠানে এসে কোন মেহমানকে মারবেন তা কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। সে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেই তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। পরে মেয়েটি ওর পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইবে, তিনি রাজী হবে না, জোড় করে অন্য যায়গায় বিয়ে দিতে চাইবেন, তাতে নতুন কোন ঝামেলা তৈরী হবে। তার থেকে ছেলে মেয়ে যদি রাজী থাকে তাহলে কাজী ডেকে আমরা এখনি ওদের বিয়ে পরিয়ে দেই।

পাত্র পাত্রি দুজনেই জানালো যে তারা বিয়েতে রাজী।

কিন্তু মেয়েটির চাচা জানাল যে, তিনি এই বিয়েতে রাজী নন। তিনি তার ভাতিজিকে বললেন, ছোট বেলায় ভাই-ভাবি মারা যাওয়ার পর আত্বীয়-স্বজন কেউ তোর দায়িত্ব নিতে চায়নি। শেষে আমি তোকে আমার মেয়ের মত কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। তোমার বিয়ের সিদ্ধান্ত তুমি একা নিতে পারো না।

মেয়েটি তার চাচাকে দৃঢ় কন্ঠে বলল, তুমি আমাকে এমনি এমনি মানুষ করনি। তোমার স্বার্থের জন্য করেছো। তোমারও তো মেয়ে আছে, কিন্তু আমাকে তো মেয়ের মত রাখনি, কাজের মেয়ে বানিয়ে রেখেছো। তোমার বাসার কাজে সমস্যা হবে বলে তুমি আমাকে পড়াশোনাতেও বাধা দিয়েছ। আমি পড়াশোনা করতে পারছি, আমার প্রচন্ড ইচ্ছা এবং জেদের কারনে। পড়াশোনা করার জন্য চাচীর হাতে অনেক মারও খেয়েছি।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আপনি তাকে মানুষ করে খুব ভালো কাজ করেছেন, এজন্য আপনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু, সে এখন বড় হয়েছে, ওকে ওর ভালো মন্দ বুঝতে দিন। পরে কোন বড় সমস্যা তৈরী হতে পারে তাই ওদের বিয়েটা আমরা আজকেই দিয়ে দিব। বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য আপনি বাসায় গিয়ে আপনার পরিবারের লোকদেরকে নিয়ে আসেন।

ওসি বললেন, এই বিয়েতে আপনার রাজী হওয়া বা না হওয়াতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আপনি একজন লোককে শারিরিকভাবে আক্রমন করেছেন। আপনার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিব কিনা তা চিন্তা করছি।

চেয়ারম্যান সাহেব কাজী সাহেবকে ফোন করে আসতে বললেন। কাজী সাহেব জানালেন, তিনি এক যায়গায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছেন। তার আসতে আরো ঘন্টা দেরেক সময় লাগবে।

আজকেই এখানে একটি বিয়ের আয়োজন হতে যাচ্ছে, এটা শোনার পর উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে যেন সাজ সাজ রব পরে গেল। ছোট আপা বললেন, তাহলে আমরা কাজী সাহেব আসতে আসতে এর মধ্যে কনে সাজিয়ে ফেলি?

বড় আপা বললেন, সাজানোর জন্য তো বিয়ের শাড়ি লাগবে?

আমার স্ত্রী বলল, আপা আমার বিয়ের শাড়িটি বের করে দেই?

ছোট আপা বললেন, বিয়ের আনন্দ তো সাধারনত মানুষের জীবনে একবারই আসে। পুরোনো শাড়ি দিয়ে বিয়ে পরালে কেমন হয়?

তিনি মেঝ আপার দিকে তাকিয়ে বললেন,তার থেকে চল আমরা মার্কেটে গিয়ে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে আসি।

ছোট আপা মেঝ আপাকে নিয়ে মার্কেটে যেতে চাইলেন। সাথে করে আমাকেও নিয়ে নিলেন। বড় আপা কেনাকাটা করার জন্য আমাদেরকে টাকা দিলেন।

আমরা রওয়ানা দিতে যাবো, তখন মেঝ দুলাভাই আমাদের আটকালেন। বললেন, সেনাবাহিনি কোথায় যাচ্ছে?

ছোট আপা বললেন, মার্কেটে যাচ্ছি।

মেঝ দুলাভাই বললেন, মেয়েদের কোথায় একা যাওয়া ঠিক না।

ছোট আপা আমাকে দেখিয়ে বললেন, একা কোথায়? ওকে তো নিয়ে যাচ্ছি।

মেঝ দুলাভাই বললেন, ও ছোট মানুষ, ও তোমাদেরকে সামলাতে পারবে না।

ছোট আপা বললেন, কাকে ছোট মানুষ বলছেন? আপনার মত ওর ও তো বউ আছে, ওর বউকে ও সামলায়না বুঝি? আসল কথা হলো, আপনি বউকে আপনার সাথে ছাড়া ছাড়তে চাননা, সেটা বলেন।

শেষে আর আমি গেলাম না। মেঝ দুলাভাই দুই আপাকে নিয়ে মটর সাইকেলে করে চলে গেলেন। ওনারা যাওয়ার আগে আমার স্ত্রী দৌড়ে আসলেন এটা বলার জন্য যে ওনারা যেন আসার সময় কিছু গায়ে হলুদের সরঞ্জাম নিয়ে আসেন। চাচি বলেছেন বিয়ের আগে নাকি কনেকে একটু হলুদ দিতে হয়।

অতি বিপদে এবং অতি আনন্দের সময় দুরের লোকও আপন হয়ে যায়। এখানে আমার আত্বীয় ছাড়া আর বাকী যারা আছেন তারা সবাই একে অপরের সাথে হাসি তামাশা এবং গল্পগুজব করতে লাগলেন, যেন তারা কত দিনের চেনা।

ওসি সাহেব বললেন, মনে করেছিলাম বিয়ে পড়িয়েই চলে যাবো, এখন তো মনে হচ্ছে অনেক দেরী হবে। মহিলাদের নিয়ে এই এক সমস্যা, কোন কিছু সোজাসুজি ভাবে করতে পারে না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করতে ভালো লাগে। গায়ে হলুদ, কনেকে সাজানো এগুলো করতে করতে তো রাত হয়ে যাবে।

বড় দুলাভাই বললেন, এগুলো করতে করতে তো অনেক দেরী হয়ে যাবে। ততক্ষনে সবার আবার ক্ষুধা লেগে যাবে। আমার মনে হচ্ছে রাতেও এখানে আমাদের সবার খেতে হবে।

ওসি সাহেব বড় দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হাসি দিয়ে বললেন, আমরা যাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, এটা তাদের ব্যাপার।

বড় দুলাভাই বললেন, আমার শ্যলক তো একবার অনুষ্ঠান করেছে। এখন মনে হয় আবার আয়োজন করতে বলা ঠিক হবে না, চাপে পরে যাবে।

ওসি সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখিয়ে বললেন, আমরা এখানে একটি সমাজকল্যানমুলক কাজ করছি, এটা মনে হয় এলাকার জনপ্রতিনিধি ও অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব।

চেয়ারম্যান সাহেব বিপদে পড়তে যাচ্ছেন মনে করে, বললেন, আমাকে এর মধ্যে টানিয়েন না।

ওসি সাহেব বললেন, সবাই বলে চেয়ারম্যন সাহেবরা আমাদের যোগসাজেশে গম চুরি করে। আমার মনে হয় আজকে আমরা একটি ভালো কাজ করতে যাচ্ছি, এখন সেই গমের টাকা থেকে কিছু কিছু টাকা ভালো কাজে খরচ করার সময় এসেছে।

চেয়ারম্যান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, খরচ আমি একা করবো কেন? গমের মধ্যে আপনার কিছু ভাগও তো আছে। আপনিও শেয়ার করবেন।

ওসি সাহেব বললেন, আমি পারবো না ভাই, আমি গরীব মানুষ। পুলিশদের হাতে টাকা থাকে না। এক হাতে আসে আর এক হাত দিয়ে চলে যায়।

চেয়ারম্যান সাহেব তার সাথে আসা এক লোককে ডাকলেন। তারপর বড় দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি খাবেন বলুন?

ওসি বললেন, একবার তো পোলাও মাংশ খেলাম, এবার মনে হয় বিরিয়ানি করা যায়। একই আইটেম দুবার খেতে ভালো লাগবে না।

আমি বললাম, বিরিয়ানি না করে কাচ্চি করলে বেশী ভালো হবে।

এত ঝামেলার মধ্যে দুলাভাই মনে হয় তার ডিমান্ড কাচ্চির কথা আপাতত ভুলেই গিয়েছিলেন। আমার মুখে কাচ্চির কথা শুনে তিনি চোখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন।

ওসি সাহেব দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাচ্চি হলে তো আরো ভালো, কি বলেন?

দুলাভাই বললেন, হুম।

কত জনের আয়োজন করতে হবে তা জেনে নিয়ে, তারপর তিনি ওই লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখনি বাজারে চলে যাও, আমার কথা বলে শমসের কসাইয়ের দোকান থেকে গোসত এবং বাকী যা কিছু লাগে কবিরের দোকান থেকে নিয়ে এসো। ওর দোকানে যদি সব কিছু নাও থাকে তাহলে তা তাকে ম্যানেজ করে দিত বলো। বাবুরচির কাছে থেকে কাচ্চির লিস্ট নিয়ে যাও।

আমি ওই লোকটিকে নিয়ে বাবুর্চীর কাছে গেলাম কাচ্চি রান্নার বাজারের লিস্ট নেয়ার জন্য এবং তাকে নতুন রান্নার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।

এরই মধ্যে আপারা ছোটখাট একটি বিয়ের বাজার করে চলে আসলেন। তারপর সবাই মিলে হৈ-হুল্লোর ও হাসি তামাসা করে বর কনেকে সাজালেন।

বাবুর্চী নতুন করে আবার রান্নার হাড়ি চুলায় চড়িয়ে দিয়েছে। কাজি সাহেব এখনো এসে পৌছাননি।

ছোট আপা চাচিকে বললেন, পরিবেশটা কেমন যেন থমথম করছে। একটু গান বাজনা না হলে তো বিয়ে বাড়ি মনে হয় না।

চাচি চাচাকে বললেন, আপনি অনুমতি দেন, ওরা একটু আনন্দ করুক।

চাচা কিছু বললেন না। নিমরাজী ভাবে চুপ করে রইলেন। চাচি মুচকি হেসে ছোট দুলাভাইকে বললেন, এখন আর আমাদের কোন ভয় নাই, তোমার অনুষ্ঠান শুরু করে দাও।

ছোট দুলাভাই গিটার বাজাতে শুরু করলেন। গিটারের টুংটাং আওয়াজ শুনে ওসি সাহেব বললেন, মেয়েরা কোথাও গেলে ষোলকলা পূর্ন না হলে ছাড়ে না, যাক ষোল কলা পূর্ন হলো।

ছোট আপা হাসতে হাসতে বললেন, ভাই, মেয়েদের প্রতি আপনার এত বিরক্ত ভাব কেন? ভাবি মনে হয় আপনাকে খুব প্রেসারে রাখে। আপনার কথা শুনে ভাবিকে দেখতে মন চাচ্ছে।

ওসি বললেন, আপা, ওকে আর আপনাকে দেখতে হবে না। কয়েক বছর সংসার করে আমারই দেখার শখ মিটে গেছে।

আমার ছেলেকে সাজিয়ে গুছিয়ে টোপর মাথায় বর কনের মধ্যমনি করে মাঝখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। দেখতে কি যে সুন্দর লাগছে! মনে হচ্ছে আকাশ থেকে ছোট একটা ফেরেশতা নেমে এসে স্টেজের উপর বসে আছে।

বড় আপা আমার ছেলেকে দেখিয়ে ছোট আপাকে বললেন, দেখ আমাদের বাবাটাকে কি সুন্দর লাগছে।

ছোট আপা বললেন, সবই ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের বাবার পাশে এখন একটি কনে বসিয়ে দিতে পারলে, পরিপূর্ন হতো।

মেঝ আপা বললেন, একটি কাজ করলে কেমন হয়, চাচিকে সাজিয়ে ওর পাশে কনে হিসেবে বসিয়ে দেই।

চাচি হাসতে হাসতে বললেন, আমি রাজি, আমার কোন আপত্তি নেই। ভালোই হবে। এই বয়েসে এসে বুড়োর রাগারাগি আর প্যনপ্যনানি শুনতে ভালো লাগে না।

ছোট আপা বললেন, তা করা যাবে না। চাচা যেই রাগি মানুষ, চাচার সাথে আগে ওকে কুস্তিতে পারতে হবে। চাচা যৌবনে ভালো ফুটবল খেলোয়ার ছিলেন, গায়ে অনেক শক্তি ছিল।

চাচি বললেন, সমস্যা নেই, এখন বুড়ো হয়ে গেছে, এখন আর আমাদের দুজনের সাথে পারবে না।

ওসি চেয়ারম্যান সাহেবকে বললেন, ঝোকের মাথায় তো বিয়ে পড়িয়ে দিলেনন এখন সে বউকে খাওয়াবে কি? নিজেই তো চলতে পারেনা, বিনা দাওয়াতে দাওয়াত খেয়ে বেড়ায়। তার তো এখন ইমিডিয়েটলি চাকুরী দরকার।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আমি এভাবে বিয়ে পড়াতে পারি। কিন্তু, চাকুরী তো দিতে পারি না।

তারপর তিনি কিছুক্ষন কি চিন্তা করে আমার স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বরের তো একটি চাকুরী দরকার। আপনি মনে হয় ওকে মামা খালু হয়ে একটি চাকুরী দিতে পারেন।

স্যার বললেন, আজকে আপনাদের কাজ দেখে আমি অভিভুত। আপনাদের কাজ নাটক সিনেমাকেও হার মানায়। বিষয়টি আমিও চিন্তা করেছি। ওর এখন একটি চাকুরী জরুরী দরকার। আচ্ছা ঠিক আছে, আমাদের কোম্পানীর দিনাজপুরে নতুন প্রজেক্ট চালু হয়েছে। দেখি ওখানে দেয়া যায় কিনা।

এই বলে তিনি বরের দিকে ওনার একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, তুমি আগামীকাল তোমার বাইওডাটা আমার অফিসে গিয়ে দিয়ে এসো।

ওসি মজা করে বললেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে মামা খালু ছাড়া চাকুরী হয় না, তা আপনাকে ও কি ডাকবে, মামা না খালু?

স্যার এ কথা শুনে কিছু বললেন না, মজা পেয়ে হাসলেন।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আপনার দেখে মামার মত মনে হয়। ও ইচ্ছা করলে আপনাকে মামা ডাকতে পারে।

বিয়ে পড়ানোর পর বড় কনে একে একে উপস্থিত সবাইকে সালাম করতে লাগলো। চাচিকেকে যখন কনে সালাম করতে গেল, তখন আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম চাচি গলা থেকে তার স্বর্নের চেন খুলে কনের গলায় পরিয়ে দিলেন।

তিনি বললেন, স্বর্ন ছাড়া কি বিয়ে হয় নাকি? এই মেয়েটির এভাবে বিয়ে হলো দেখে সে কিছু পেলো না। তা না হলে একটি মেয়ের বিয়ের সময় কত কিছু পাওয়ার থাকে।

কনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যেও গো মেয়ে। যে বাবা-মায়ের কোন মেয়ে নেই, তার মত অভাগা আর কেউ নেই। শেষ বয়সে মায়া করে তাদের মাথায় হাত বুলানোর মত কেউ থাকে না। ছেলেরা তো টাকা দিয়েই খালাস।

এসব বলতে চাচির চোখ পানিতে টলমল করে উঠল। আমার চাচা চাচির দুই ছেলে, কোন মেয়ে নেই।

মেঝ দুলাভাই ছোট আপাকে বললেন, এরকম বিয়ে দেখে তো আবার বিয়ে করতে মন চাচ্ছে।

ছোট আপা বললেন, বিয়ে করা এত সোজা নয়, দেখলেন না বিয়ে করতে চাইলে আগে মার খেতে হয়।

দুলাভাই বললেন, আবার যদি বিয়ে করতে পারি তাহলে কিছু মার খেতেও রাজি আছি।

ছোট আপা বললেন, কিছু নয়, আপার হাতে মার খেতে হবে শত শত, সহ্য করতে পারবেন না। সুতরাং ওই চিন্তা ভুলেও মাথায় আনিয়েন না।

একে একে মেহমানরা সবাই চলে যাওয়ার পর সমস্ত কাজ কর্ম শেষ করে ঘুমুতে যেতে যেতে বেশ রাত হয়ে গেল। কিন্তু ঘুমুতে গিয়ে সমস্যা দাড়ালো ছেলে, আমি এবং আমার স্ত্রীর মাঝখানে শুতে চাইলো।

আমি ছেলেকে বললাম, তুমি হয় আমার পাশে শোও অথবা তোমার আম্মুর পাশে শোও।

কিন্তু ছেলের এক কথা সে বাবা মা দুজনের পাশেই, মানে মাঝখানে শোবে।

স্ত্রী বলল, ও মাঝখানেই থাকুক না অসুবিধা কি?

ছেলে মাঝখানে থাকলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ওর ঘুম খুব পাতলা। ঘুমের মধ্যে সামান্য নাড়াচাড়া করলেই ঘুম ভেংগে যায়। রাত বিরাতে স্ত্রীকে কাছে পাওয়ার জন্য পরে আবার ওকে আমাদের মাঝখান থেকে সরাতে গেলে ওর ঘুম ভেংগে যেতে পারে।

আমি বললাম, আমাদের যে কোন একজনের পাশে থাকলে কি সমস্যা?

স্ত্রী বলল, আমার সমস্যা। আমি খুব ট্রায়াড।

আমি বললাম, আমি কি করেছি?

স্ত্রী বলল, গতকাল রেলষ্টেশন থেকে আসার পর থেকেই দেখছি, তুমি আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছ। তোমার ভাবগতি সুবিধার মনে হচ্ছে না।

আমি বললাম, কেমন করে তাকাচ্ছি মানে? আমি সব সময় তোমার দিকে যেভাবে তাকাই, সেভাবেই তাকাচ্ছি। কারো দিকে তাকালেও দোষ?

স্ত্রী বলল, মশাই, আপনার সাথে গত সাত বছর ধরে সংসার করছি। আপনার চোখের ভাষা মুখস্ত হয়ে গেছে। আপনি কখন কি জন্য আমার দিকে তাকান তা এখন ভালোই বুঝতে পারি

কি আর করা, মেজরিটির সিদ্ধান্ত মানতে হলো। গতকাল না ঘুমানোর কারনে আমিও খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাই শোয়ার কিছুক্ষন পর ঘুমের রাজ্যে চলে গেলাম।

তৃতীয় পর্বের লিংক:

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1709225052925848/?mibextid=Nif5oz

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here