শেষ বিকেলের রোদ- ২৩ তম পর্ব
©শাহরিয়ার
— ঠিক স্বপ্নের মত একটি বিকেল কাটিয়ে ঘরে ঢুকছি। মনে হচ্ছে যেন যুগ যুগ ধরে এমনি একটি বিকেলের অপেক্ষায় আমি ছিলাম। ভেজা জামা চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে বের হবার পরেই বুঝতে পরলাম যে শরীরের জ্বর জ্বর ভাব চলে আসছে, সেই সাথে ঠাণ্ডাও লেগে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে কিন্তু বৃষ্টি থামার কোন নাম নেই বরং সময় যত বাড়ছে মনে হচ্ছে বৃষ্টিও বেড়ে চলেছে। হঠাৎ করে ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই মোবাইলের হাতে নিতেই বড় চাচার ফোন দেখে কিছুটা চমকে উঠলাম।
ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে
বড় চাচা:- কেমন আছিস মা?
— জ্বি আমি ভালো আছি আপনারা সকলে কেমন আছেন?
বড় চাচা:- আমরাও সকলে ভালো আছি সোহানের ফোন বন্ধ পাচ্ছি তাই তোকে ফোন দিলাম।
— মনে হয় ফোনে চার্জ নেই তুমি লাইনে থাকো আমি যেয়ে ফোন ধরিয়ে দিচ্ছি।
বড় চাচা:- আচ্ছা ঠিক আছে যা।
— দৌঁড়ে সোহানের রুমে যেয়ে ফোনটা দিয়ে বললাম বড় চাচা ফোন দিয়েছে। সোহান ফোনটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। অনেকটা সময় দু’জন কথা বলার পর লাইন কেটে দিলো। আমি জিজ্ঞাসা করলো?
সোহান:- তোকে কেন সব বলতে হবে?
— কি আজব তুমি বললে কি এমন ক্ষতি হবে?
সোহান:- সব বিষয়ে জানার এতো আগ্রহই কেন থাকবে তোর?
— হয়েছে আমার খুব ভুল হয়েছে আর কখনো কিছু জানতে চাইবো না মাফ করে দাও। বলেই ঘুরে চলে আসবো তখনি সোহান পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো। কি হচ্ছে ছাড়ো আমাকে,
সোহান:- না ছাড়লে কি করতে পারবি? সব সময় এতোটা রাগ দেখাছ কেন?
— রাগ দেখাতে আমার বয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ছাড়ো না হলে কামড়ে দিবো, চিৎকার করবো, বাড়ির সব মানুষ জড়ো করবো।
সোহান:- আচ্ছা তাই বলেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, কোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নে চিৎকার কর এই বৃষ্টির ভিতর তোর আওয়াজ যদি কারো কান অব্দি পৌঁছায় তো চিৎকার কর বলেই বিছানার উপর শুয়িয়ে দিলো।
— ওমনি ঘুরে সোহানের হাতে কামড় লাগিয়ে দিতেই সোহান আহ বলে চিৎকার করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এই সুযোগে বিছানা থেকে নামতে যাবো অমনি সোহান আবারও ধাক্কা মেরে বিছানায় শুয়িয়ে দেবার সাথে সাথে আমি ফুপু ফুপু বলে চিৎকার শুরু করলাম।
সোহান:- শক্ত করে দু’হাত চেপে ধরে চুপ করবি নাকি আমি চুপ করাবো?
— আমাকে ছাড়ো বলে দু’হাত ছুটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু কোন ভাবেই পেরে উঠছি না।
করুণ চোখে সোহানের দিকে তাকালাম। সেখানে কোন রকম মায়া দেখতে পেলাম না বরং ভয়ংকর রকম রেগে আছে সে কিন্তু কেন আমি কামড় দিয়েছি তাই বলে কি? এদিকে মাথা প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে, মনে হচ্ছে জ্বর বেড়ে গিয়েছে। সোহানের নিঃশ্বাসের শব্দ আমার কান অব্দি এসে পৌঁছাচ্ছে, অথচ আমি চিৎকার করার মত শক্তি পাচ্ছি না। ওকে বলতেও পারছি না আমার কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে।
— চোখ মেলে যখন তাকালাম রাত আনুমানিক দশটার মত বাজে, পাশেই আপু বসে আছে আমি উঠার চেষ্টা করবো,
আফরিন: শুয়ে থাক উঠতে হবে না। যা ভয় দেখিয়েছিলি।
— ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম আমি আফরিন আপুর রুমে, কিন্তু এ ঘরেতো আমি ছিলাম না, আপু আমি এ ঘরে কি করে আসলাম?
আফরিন:- তুই জ্ঞান হারানোর পর ভাইয়া তোকে কোলে করে নিয়ে এসে এই ঘরে শুয়িয়ে দিছে। এই বৃষ্টির ভিতরে তোর জন্য কত দৌঁড়াদৌঁড়ি করলো সে। ভিজে ভিজে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সঙ্গে করে তাকে নিয়ে এসেছে। তোকে চেক আপ করিয়েছে। দেখেছিস তোকে কত ভালোবাসে। আচ্ছা তোর খারাপ লাগছিলো তুইতো আমাকে বা ভাইয়াকে বলতে পারতি।
— আরে হঠাৎ করেই এমনটা হলো, আমি ফোন নিয়ে গেলাম কথা বলিয়ে দেবার জন্য ফেরার সময় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তারপর আর কিছু মনে নেই।
আফরিন:- তুই রেস্ট কর আমি ভাইয়াকে যেয়ে বলে আসি তোর জ্ঞান ফিরেছে। আর তোর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি।
— লাগবে না আপু, আমার খিদে নেই তোমরা খেয়ে নিও। আপু রুম থেকে বের হয়ে গেলো আমি দু’চোখ বন্ধ করে ভাবতে শুরু করলাম, ইস কত ব্যথায় না পেয়েছে সোহান। ওকে কামড়ে দিয়েছি অথচ ও আমার জন্য এই বর্ষার রাতে ভিজতে ভিজতে ছুটে যেয়ে ডাক্তার নিয়ে এসেছে, হ্যাঁ এটাইতো ভালোবাসা। ভাবনা বেশী দূর এগোনোর আগেই তাতে ছেদ পরে কপালে কারো ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে। চোখ মেলে তাকাতেই সোহানের মুখটা দেখতে পেলাম।
সোহান:- এখন কেমন লাগছে?
— উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে ভালো।
সোহান:- উঠতে হবে না, শুয়ে থাক কিছু খাবি?
— না কিছু খাবো না, তোমাকে ধন্যবাদ।
সোহান:- কেন?
— এই যে আমার জন্য কত কষ্ট করলে তাই।
সোহান:- ওহ তাই ধন্যবাদ দিয়ে কি ঋণ শোধ করতে চাস নাকি?
— এই সব কি বলো তুমি? আমি কি তা বলছি নাকি?
সোহান:- আচ্ছা শুয়ে ঘুমা আমি যাচ্ছি। বলে উঠে দাঁড়ালো।
— এই তোমাকে খুব ভালোবাসি,
সোহান:- জানি জানি,
— কি করে জানো?
সোহান:- যে মেয়ে জ্ঞান হারানোর পরেও শক্ত করে চেপে ধরে ভালোবাসি বলতে পারে সে নিশ্চই অনেক ভালোবাসে তা বুঝতে সমস্যা হবার কথা নয়।
— সত্যি করে বলোতো কিছু মিছু করোনিতো সে সুযোগে?
সোহান:- মানে কি? কিছুমিছু আবার কি? ওহ হ্যাঁ যেটা তখন করতে পারিনি ভাবছি এখন করবো।
— এই খবরদার বলছি আমার কাছে আসবে না নইলে চিৎকার করবো।
আফরিন:- ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কি হলো চিৎকার করবি কেন? চিৎকার না করে খেয়ে ঔষধ খা, তুই খাসনি বলে ভাইয়াও এখনো খায়নি।
— তোমার ভাইকে না খেয়ে থাকতে বলছে কে শুনি? শেষে অসুখ বাধলে সব দোষ আমার উপর চাপবে।
আফরিন:- উফ তোরা পারিস ও বটে, আচ্ছা তোদের দু’জনের কি একজনের ভাইরাস আরেক জনের গায়ে যায় নাকি?
সোহান:- মানে কি? তুই আবার এসব কি বলছিস?
আফরিন:- আরে ভাইয়া বুঝলে না, এই যে কয়দিন আগে তুমি জ্বরে পরলে আর আজ ওর জ্বর। এটাই বুঝালাম যে ছোঁয়াছে নাকি তোমাদের দু’জনের।
সোহান:- আরে না বাসায় ফিরার সময় ফুলটুসি খুব সখ করে বৃষ্টিতে ভিজেছে তাই এমন হুট করে জ্বর আসছে।
আফরিন:- আচ্ছা ভাইয়া তুমি যাও খেয়ে নাও, আমি ওকে খাওয়ি ঔষধ খাওয়াচ্ছি।
— সোহান আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলে আপু আমাকে খাবার বেড়ে দিলো। খেতে ইচ্ছে না করলেও আপুর জোরাজুরিতে আর না খেয়ে পারলাম না। খাবার খেয়ে ঔষধ খাওয়া শেষ হবার পরেই আপু ঘর থেকে বের হলো নিজে খাবার জন্য। বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ব্যাগ থেকে সোহানের দেয়া বই দু’টো বের করে নিয়ে আসলাম পড়ার জন্য। একটা বই খুলতেই ছোট কাগজে লেখা একটা চিরকুট বের হয়ে আসলো। তাতে লেখা।
“এই ফুলটুসি তোর বই খুব পছন্দ নারে? বই এতো পছন্দ করিস কেন? তোকে একদিন অনেক গুলো বই গিফট করবো যা পড়তে পড়তে তুই বুড়ি হয়ে যাবি।”
— হাসতে হাসতে আরেকটা বই খুলতে আরও একটা কাগজ বের হয়ে আসলো। তাতে লেখা
“তুই সারা জীবনই গাধাই থেকে যাবি, এতো কিছু বুঝিস অথচ ভালোবাসাটাই বুঝিস না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তোকে মেরে মেরে বুঝাই আমিও খুব রোমান্টিক। তোর বইয়েরর গল্পের নায়কের চেয়েও বেশী রোমান্টিক। আমিও দেখতে অনেক সুন্দর মেয়েরা আমাকে দেখলেও ক্রাশ খায় বুঝলি, শুধু তুই বুঝস না। আচ্ছা শোন আমার লেখা এতো পড়তে হবে না তার চেয়ে বরং তুই গল্পের বই পড়।”
— হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে করছে এমন লেখা শুধু পাগলরাই লেখতে পারে। যদিও লেখাটা কয়েকদিন আগেই লেখছে, এখন লেখলে নিশ্চই অন্য কিছু লেখতো হ্যাঁ জানিতো তুমি খুব রোমান্টিক পাগল। তাইতো এতো ভালোবাসি। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। বই পড়তে পড়তে এক সময় আপু ঘরে চলে আসলো বই বন্ধ করে রেখে আপুর সাথে টুকটাক গল্প করতে শুরু করলাম। এমন সময় ফোনে মেসেজ আসলো, সোহানের নাম্বার থেকে, ছোট করে লেখা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পর, কাল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এবাড়ি ও বাড়ি দৌঁড়াতে হবে শুভ রাত্রী। আমিও রিপ্লে দিলাম কেন দু’বাড়িতে সুন্দরি অনেক মেয়েই আছে তাদের সাথে প্রেম শুরু করবে নাকি? রোমান্টিক বয় লক্ষ মেয়েদের ক্রাশ। এভাবেই দু’জন দু’জনকে মেসেজ আদান প্রদান করতে করতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলাম।
আফরিন:- সকালে ডাক দিয়ে কিরে জ্বর কমেছে? শরীর কি ভালো লাগছে এখন?
— হুম আমি একদম ঠিক আছি কখন উঠলে তুমি?
আফরিন:- আমিতো ভোরে উঠছি আর এখন নয়টা বাজে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নে নাস্তা খাবি।
— নয়টা বাজে আর তুমি আমাকে ডাকোনি?
আফরিন:- ভাইয়া নিষেধ করছে তাই ডাক দেইনি।
— তাই বলে নয়টা বেজে গেছে ডাকবা না।
আফরিন:- আচ্ছা উঠে পর তাড়াতাড়ি তাহলেই হবে।
— আচ্ছা তুমি বসো আমি এখুনি ফ্রেস হয়ে আসছি, আপুকে বসিয়ে তাড়াতাড়া ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলাম। ফ্রেস হয়ে বের হয়ে আপুকে সাথে নিয়ে ডাইনিং এর দিকে হাঁটতে শুরু করছি অমনি প্রচণ্ড শব্দ করে গান বাজতে শুরু করলো।
সোহান:- সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো শুধু লাইটিং করলেই হবে নাকি বিয়ে বাড়ি? আজ বিয়ে বাড়ি বাড়ি মনে হচ্ছে, বিয়ে বাড়িতে নাচ হবে গান হবে তবেই মনে হবে বিয়ে বাড়ি কি বলিস তোরা?
আফরিন:- ধ্যাত ভাইয়া আমার ভীষণ লজ্জা করে বলেই দৌঁড় দিলো ডাইনিং এর দিকে।
সোহান:- হায় হায় নতুন বউ কেমনে দৌঁড়াচ্ছে দেখ দেখ চেয়ে।
— তুমিই চেয়ে দেখ, আমি যাচ্ছি খুব খুদা লেগেছে।
সোহান:- এই আমিও যাবো তোর জন্যইতো অপেক্ষা করছিলাম।
— আমার জন্য এতো অপেক্ষা করতে হবে কেন?
সোহান:- কারণ আমাদের দু’জনের বিয়ে হলে তখনতো তুই অপেক্ষা করবি খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে আমার জন্য।
— সোহানের কথায় থমকে দাঁড়ালাম, সত্যিই কি আমাদের দু’জনের বিয়েটা হবে? আজও কি হবে নাকি হবে না। যে মানুষটাকে এতো ভালোবাসি সেই মানুষটাকে কি সারা জীবনের জন্য পাবো কিনা তা এখনো নিশ্চিৎ নয়। কারণ এই মানুষটাকে সত্যিই আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। শত প্রার্থনায় থাকা মানুষটাকে যে আমার সব কিছুর পরেও চাই। সব ব্যস্ততার শেষে এই মানুষটার বুকে মাথা রেখে আমি একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাই। ভালোবাসি সোহান বড্ড ভালোবাসি তোমাকে। ভাবতে ভাবতে এক’পা দু’পা করে এগিয়ে চলছি ডাইনিং এর দিকে।
চলবে…